সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) অবশ্য নিজে মনে করেন যে ফিল্মের গঠন সাহিত্যের চেয়ে সংগীতের সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে পাশ্চাত্য মার্গসংগীত সিম্ফনির সঙ্গে। সত্যজিতের ছবিগুলোতে আমরা তাই পাই একটা নির্মেদ সাংগীতিক গঠন — ‘পথের পাঁচালী’, ‘শতরঞ্জ ক্যে খিলৌড়ি’। বাড়তি নেই কিছু। পাশ্চাত্য সোনাটা ফর্ম বা সিম্ফনি সংগীতের মতোই। তাঁর ছবিগুলোতে নাটকীয় মুহূর্তের পরপরই আসে একটা কোমল গতি। ইউরোপীয় সংগীতের ভাষায় অ্যালেগ্রোর (allegro) পরে অঁদঁ (andante)। অবশ্য ইউরোপীয়রা সত্যজিতের ধীরলয়টাকে তেমন পছন্দ করেননি। যেমন ত্রুফো বা নিউওয়েভ ডিরেক্টররা। তবে সময়ের গতি সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতিতে ভিন্ন হয়। প্যারিস বা নিউইয়র্কের সময়ের যা গতি, গ্রামবাংলায় তা এক নয়। ‘ক্র্যামার ভার্সাস ক্র্যামার’-এর টাইম-পেসের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’-র টাইম-পেস মিলবে না সঙ্গত কারণেই এবং তা রায়ের বাস্তববোধেরই পরিচায়ক।
মোজার্টের সংগীতের মতোই এক-ধরনের প্যাস্টোরাল (pastoral) নিষ্পাপ সরলতা আছে ‘অশনি সংকেত’ বা ‘অপুর সংসার’-এ। রায় নিজে অবশ্য বলেন যে ‘চারুলতা’-র গঠনটাই বেশি মোজার্টীয়। সত্যজিতের ছবির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাবের এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ রায় নিজেই বলেছেন, “পাশ্চাত্য মার্গসংগীতের রহস্য সন্ধান করতেই চলচ্চিত্রের সত্য আমার কাছে ধরা পড়ে”, এবং বলেন যে প্রাক-‘পথের পাঁচালী’ বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্বলতার মূল হেতুই ছিল ফিল্মে এই সাংগীতিক কাঠামোবোধের অভাব।
আর সাধারণভাবে রায়ের ছবির গীতিময়তা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। ‘জলসাঘর’, ‘গুপী গাইন’ বা ‘হীরক রাজার দেশে’-র যে-কোনো সিকোয়েন্সই তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর দেবে। দুর্গার মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার সময় বেজে-ওঠা তারসানাই — সত্যজিতের সিনেমার সংগীত-আলোচনায় বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ। তবে এমনকি যখন রবিশঙ্কর নেই, নেই ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ-ও (‘তিন কন্যা’ ১৯৫১-পরবর্তী ছবিগুলির মিউজিক রায় নিজেই করেছেন), তখনও বহুল পরিচিত সেতার, সরোদ, পাখোয়াজ, মায় ঘটি-বাটি-পেয়ালা-পিরিচ দিয়ে আবহসংগীতের যে বিশাল ভাণ্ডার সত্যজিৎ তাঁর ছবিগুলিতে ছড়িয়ে রেখেছেন, তা বাঙালির এক ঐশ্বর্যময় উত্তরাধিকার।
গানপারটীকা
রচনাটা তানভীর মোকাম্মেল প্রণীত ‘চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্ব ও বারোজন ডিরেক্টর’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। এইটা বইভুক্ত ‘সত্যজিৎ, নিওরিয়ালিজম ও জীবনের পাঁচালী’ শীর্ষক পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ থেকে উৎকলিত ছোট্ট একাংশ মাত্র। উপশিরোনামে এই শীর্ষকটা ছাড়াও আরও পনেরোটা মাঝারি-দীর্ঘ উপাধ্যায় নিয়া তানভীর মোকাম্মেলের এই রায়বোধিনী সিনেমাসাক্ষর বাংলাদেশের পাঠকের কাছে বহুল পরিচিত ও পঠিত। গোটা বইটাই সিনেমাপাঠকের কাছে আদৃত। বইটার প্রথম প্রকাশ ১৯৮৫ ফেব্রুয়ারিতে। এরপরেও সম্ভবত একটা মুদ্রণ/সংস্করণ বেরিয়েছে, এইখানে প্রথম প্রকাশ থেকেই গৃহীত হয়েছে রচনাংশটুকু। প্রথম প্রকাশক সুবর্ণ প্রকাশনী, পরিবেশক জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, প্রচ্ছদ মানজারে শামীম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বইটির লেখক তখনও ম্যুভিডিরেক্টর হিশেবে আবির্ভূত হন নাই সম্ভবত, নয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদের তরুণ সংগঠক ও কর্মী তখনও, অচিরেই যিনি বিকল্প ধারায় ফিল্ম বানিয়ে এ-দেশের চলচ্চিত্রতৃষ্ণ সমুজদার দর্শকসাধারণের মনোযোগ অধিকার করে নেবেন। পরে লেখালেখিও সমানতালে চালিয়েছেন মোকাম্মেল, ম্যুভিনির্মাণের ফুরসতে, অব্যাহতভাবে লেখা ও ম্যুভিসৃজনে এখনও সক্রিয়।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS