উয়াফুটা || কল্লোল তালুকদার

উয়াফুটা || কল্লোল তালুকদার

উয়াফুটা!

ঠিক তাই; জলজোছনার জলোপাখ্যান ‘মউজ, মজে মউজ’ পড়তে পড়তে অনেক জায়গায় সত্যি যেন আমার হয়েছিল উয়াফুটা দশা (অর্থাৎ, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা)! একটানে খতম না-করে সারারাত আর উঠতে পারিনি। যেন নিশিতে পাওয়া, ঘোরলাগা, ঐন্দ্রজালিক এক কুহক সময়! মজে ছিলাম আশ্চর্য জাদুকরী এক শব্দখেলায়। বাক্য-নির্মাণশৈলীর কী আশ্চর্য দক্ষতা! সেই সঙ্গে কাহিনির ঘনঘটা! নিজ শহরের অলিগলি-পাকস্থলী, অপরূপ জল-প্রকৃতি সব আমারও আশৈশব চেনা, তবু এই চিরচেনা শহর যেন হয়ে ওঠে অপার্থিব এক মায়াপুরী।

কালের ঘূর্ণাবর্তে স্মৃতির পাতায় পুঞ্জিভূত ধূলির স্তর মেহেদীর তুলির একেকটি টানে যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে; নূতন আলোয় উদ্ভাসিত হতে থাকে সোনালি অতীত। বহু হারানো মুখ নিমিষেই যেন পায় পুনর্জীবন। তাদের হাঁটাচলা, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি, ঘটনাবহুল যাপিত জীবন — সব যেন বিস্মৃতির গহীন থেকে ফিরে আসতে থাকে স্মৃতির পাতায়।

জলজোছনার জলোপাখ্যান সিরিজের ‘মউজ, মজে মউজ’ উজ্জ্বল মেহেদীর একটি সাহসী ও শৈল্পিক সাহিত্যকর্ম। গদ্য নয়, যেন কবিতা। অসাধারণ সব চিত্রকল্প সৃজিত হয়েছে পাতায় পাতায়। মরমি সাধক হাসন রাজার প্রপৌত্র, চন্দ্রালোকপিয়াসি কবি ও জননেতা মমিনুল মউজদীনের ঘটনাবহুল জীবনের বর্ণিল বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে সমসাময়িক বিচিত্র ঘটনা ও স্থানীয়-জাতীয় অনেক ব্যক্তিবর্গের উপর। তবে কিছু কিছু জায়গায় কিঞ্চিৎ হলেও তাল কেটেছে। ঘটেছে ছন্দপতন। লেখকের সঙ্গে স্পষ্টতই রয়েছে আমার দ্বিমত।

সুনামগঞ্জ কবিতার শহর হয়ে উঠার যে কালপর্ব বর্ণিত হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত নই। গত শতকের সত্তর কিংবা আশির দশকে জনপদটি রাতারাতি কবিতার শহরে পরিণত হয়নি, বরং তার শিকড় আরও অ-নে-ক গভীরে প্রোথিত। যদিও এখানকার আধুনিক সাহিত্যচর্চা সহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস এখনও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত, তবু যেটুকু আলোকছটার সন্ধান আমরা পাই, তাতেই বিস্ময় জাগে!

কালিদহের বেনো জলে জেগে-ওঠা এক চরে কালক্রমে গড়ে-ওঠা গঞ্জের নাম সুনামগঞ্জ। ক্রমে নদীবন্দর থেকে নগর। গ্রামীণ শহর। অদ্ভুত আশ্চর্য এক জনপদ। অতীতে সুপ্রসিদ্ধ বহু কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিকের পদচারণায় মুখরিত হতো ছোট্ট এই নগর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই পরম্পরার রেশ এখনও বহমান, আবার অনেক কিছুই তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে।

‘এরশাদ পাগলা হয়ে আসছেন’ (মূলত পাগলা বাজার হয়ে )-এর মতো সংবাদশিরোনাম তৎকালিক স্বৈরশাসনামলে মফস্বল সাংবাদিকদের সাহসিকতা, দ্রোহ আর সেইসঙ্গে ‘সেন্স অব হিউমার’-এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এরকম অনেক চাপা-পড়া খুঁটিনাটি অথচ ঐতিহাসিক ঘটনা উৎকলিত হয়েছে এই বইয়ে। প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মেহেদীর কলমের জাদুর স্পর্শে। সম্ভব হয়েছে, কারণ মেহেদী নিজেও সেই সাহসী ঘরানার এক উজ্জ্বল উৎপাদ।

তবে কয়েকটি জায়গায় মনে হলো মেহেদীর কল্পনাশক্তি সীমা ছাড়িয়ে অসীমের পানে ডানা মেলতে উদ্যত। তার গল্পের নায়কের প্রতিও যেন কোথাও কোথাও অপ্রতিরোধ্য পক্ষপাত। কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জন। কে.জি. স্কুলটিকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়ে তুলার প্রচেষ্টার কথা বোধকরি কবি মউজদীনের প্রতি লেখকের মুগ্ধতা থেকেই উৎসারিত।

“স্যার, আমাকে দিন সুস্বাদু রুটির মতো ছুটি” — কবি ইকবাল কাগজীর এই লাইন কবি মউজদীনকে উদ্দেশ্য করে নয় এবং কথিত সময়েও সেটি লিখিত হয়নি। কাগজী যখন কবিতাটি লিখেন, তখন সময়টি ছিল অস্বাভাবিকরকম অস্থির। কবি কাগজী তখন ঝলমলে এক কিশোর। তখন তিনি ‘চোখ থেকে ফুল ছুঁড়ে’ দিতেও বদ্ধপরিকর। তাঁর তখন বুকভরা স্বপ্ন, ভালোবাসা, আবেগ আর ছিল হতাশা! মুক্তিকামী এই তরুণ কবির ‘স্বাধীন স্বদেশে’ শিরোনামে এই কবিতাটি ১৯৭৪ সালের ১লা মে সাপ্তাহিক ‘সূর্যের দেশ’-এ ছাপা হয়। প্রথম স্তবকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো —

আমি হাসতে পারি না মোটেও
আপনার অসহায় অঙ্গভঙ্গি সুকুমার হাসি হাইজ্যাকার।
স্যার, আমাকে দিন সুস্বাদু রুটির মতো ছুটি।
আমার হৃদয় হোক বৈশাখের সনাতনী রূপ।

‘মউজ, মজে মউজ’-এর প্রচ্ছদ, বাঁধাই, গেটআপ ইত্যাদি এককথায় দুর্দান্ত; দৃষ্টিনন্দন। চৈতন্যপ্রকাশক রাজীব চৌধুরীর আরেকটি নান্দনিক সৃষ্টি। তবে মাঝেমধ্যে মুদ্রণত্রুটির দেখাও মেলে। প্রত্যাশা রইল, পরবর্তী পরিমার্জিত সংস্করণে টুকটাক অসঙ্গতিসমূহ অপসারিত হবে।

পরিশেষে একবাক্যে বলা যায়, জলজোছনার জলোপাখ্যান ‘মউজ, মজে মউজ’ উজ্জ্বল মেহেদীর এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। স্থানীয় ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ দলিল। অনবদ্য এক সাহিত্যকর্ম, যা কালোত্তীর্ণ হবে বলে আমার বিশ্বাস।


কল্লোল তালুকদার রচনারাশি
গানপার বইরিভিয়্যু

COMMENTS

error: