দশকতামামি ১ / দশকভিত্তিক অর্জন ও স্বকীয়তা : বাংলাদেশের কবিতার অনুসন্ধান ও বিচারপ্রবণতা

দশকতামামি ১ / দশকভিত্তিক অর্জন ও স্বকীয়তা : বাংলাদেশের কবিতার অনুসন্ধান ও বিচারপ্রবণতা

‘লোক’-র আমন্ত্রণে নব্বই দশকের কবিতা নিয়ে লিখতে বসে পুরোনো দিনের অনেক স্মৃতি মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা মিলে আড্ডা ও ছোটকাগজ প্রকাশের শিহরণমথিত সেইসব মুহূর্ত সহজে ভোলার নয়! কবিতাখচিত দিনগুলোর পুনর্পাঠে সম্পাদক গৃহীত সাম্প্রতিক উদ্যোগকে তাই স্বাগত জানাই। দশকি কবিতা নিয়ে ‘লোক’-র আয়োজন এই প্রথম নয়। নব্বই ও শূন্য দশক ছাড়াও দুই বাংলার কবিদের নিয়ে সম্পাদক অনিকেত শামীম একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা অতীতে প্রকাশ করেছেন। নব্বইয়ের নির্বাচিত কবিতার সংকলন প্রকাশেও ‘লোক’ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল বলেই জানি। সংকলনটিকে ঘিরে পাঠকপ্রতিক্রিয়া তখন বেশ সরব ও জোরদার ছিল মনে পড়ে। তথাপি ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার ক্ষণে নব্বইয়ের কবিতা নিয়ে ‘কিছুটা সরবতা’ কেন প্রয়োজনীয় সেকথা সম্পাদক ই-মেইল মারফত প্রেরিত বক্তব্যে তুলে ধরেছেন। মনখোলা বক্তব্যকে নব্বইয়ে কবিতার অর্জন ও স্বকীয়তা সম্পর্কে ‘লোক’-র দৃষ্টিভঙ্গি রূপে যদি বিবেচনা করি তো সেখানে তিনি লিখেছেন…

এটি আজ স্বীকৃত যে ইউরোপবাহিত নন্দন-দর্শনতাড়িত ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার দীর্ঘ ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক কাব্যধারা সৃষ্টি করে নব্বইয়ের দশকের কবিকুল। নিজস্ব শিকড় ও ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং নিজস্ব দর্শন ও ভাবধারায় নিবেদিত হয়ে এ দশকের কবিরা স্বভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অস্তিত্বের জানান দেন কবিতার নতুন বাঁকবদলের মাধ্যমে, যাতে পাল্টে যায় বাংলা কবিতার গতানুগতিক প্রবহমানতা। ভাষা, ছন্দ, প্রকরণ ও কাঠামোয় আঘাতের পর আঘাতে উদ্ভাসিত হয় নতুন এক কবিতাধারা।

দশ-বারো বছর আগে হলে সম্পাদকের বক্তব্যে সায় জানাতে দ্বিধা করতাম না, যেহেতু আমার পাঠপদ্ধতি তখনো দশকি-ছকে কবিতার নতুনত্ব উপলব্ধিতে সুস্থির ছিল। কবিতার পাঠ বা আলোচনায় গমনের অর্থ ছিল এর অতীত অর্জনকে তুলনার নিক্তিতে যাচাই করে সাম্প্রতিক কবিকুলের তরক্কি বুঝে নেওয়া। অভ্যাসটিকে দোষণীয় বলা আমার উদ্দেশ্য নয় তবে এখন এভাবে ভাবতে মন ওঠে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে ভাবনায় নানা রদবদল টের পাই, যারপরনাই পাঠতরিকা অতীত বৃত্তে দাঁড়িয়ে নেই। পুরোনো প্রথা অনুসারে কবির স্বকীয়তা অনুসন্ধানের গুরুতর সমস্যাটি হলো তুলনার ভূত মাথা থেকে নামানো মুশকিল হয়ে পড়ে। ভূতনাচের প্রভাবে অগত্যা গুরুতর ভুলচুক ঘটে বা সম্ভাবনা প্রবল হয়। এইসব কারণে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে দশকি কবিতার হালচাল সম্পর্কে পক্ষে-বিপক্ষে দুকথা বলা এখন অনেক বেশি কঠিন ঠেকে।

আজকের ‘পাঠক আমি’ অর্জন ও স্বকীয়তা বলতে বুঝি নব্বইয়ের অগ্রজ ও অনুজ সকল দশকে বিদ্যমান কবিতার সঙ্গে নিজের মিল-অমিল ধরিয়ে দিতে পারে এমন আলোচনায় গমন। সময়প্রবাহের চাপে কবিতায় নতুনত্ব ও স্বকীয়তার ধারায় যেসব পরিবর্তন ঘটে সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে দশকের মাপে নব্বইয়ের কবিদের পৃথক ভাবার যৌক্তিকতা বজায় থাকে না। পাঠক হয়তো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়,—প্রতিটি দশক একান্ত সময়প্রবাহ জুড়ে সংঘটিত প্রবণতা অনুসারে বিশিষ্ট এবং সেখানে একের ওপর অন্যের আধিপত্য বিস্তার বা অতিক্রম করে যাওয়ার কিছু নেই। পূর্ববর্তী দশকের সঙ্গে পরবর্তী দশকের কবিতায় ঐক্য ও ধারাবাহিকতা বজায় থাকা অবান্তর ও দোষণীয় বলে এখন মনে হয় না। অন্যদিকে দশকগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতার লক্ষণ বিরাজ করলেও নানা কার্যকারণে বিচ্ছেদ ঠিকই অনিবার্যতা লাভ করে ও স্বকীয়তা জন্ম নেয়, আর ব্যাপারটিকে অস্বীকার করা কাজের কথা নয়। সুতরাং পাঠকের পাঠ-অনুসন্ধানে দুটি দিক সমান গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রধানত সেরকম তাগিদ থেকে দীর্ঘ গদ্যের অবতারণা। গদ্যটি দীর্ঘ হলেও পাঠক শেষ পর্যন্ত সঙ্গে থাকবেন এবং বুঝের গলতি হলে শুধরে দেবেন আশা করি।

এই ফাঁকে বলে রাখি ছোটকাগজ প্রকাশনায় ‘লোক’ গত তিন দশক ধরে নিজের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জরুরি সংখ্যার পাশাপাশি লম্বা সময় ধরে প্রকাশনায় ধারাবাহিক থাকায় একটি সিগনেচার মার্ক সে তৈরি করে নিয়েছে। এই সিগনেচারকে যদি কাগজটির স্বাতন্ত্র্য গণ্য করি তাহলে নব্বই দশকের কবিতার স্বকীয়তা বিষয়ক বক্তব্য কেমন যেন বেমানান মনে হয়েছে! কারণগুলো দুই পর্বে বিন্যস্ত রচনায় বলার চেষ্টা থাকবে। প্রত্যুত্তরে পাঠকের পক্ষ থেকে কেউ যদি দু-কলম লিখেন তবে মনের অস্বস্তি ও ভ্রান্তি (*হতে পারে ব্যক্তিগত পাঠ-সীমাবদ্ধতার কারণে বোঝার ভুল।) দূর হবে আশা রাখি। পাঠকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ‘লোক’ লালন করেন সেই ভরসায় কথা আর না বাড়িয়ে মূল প্রসঙ্গে মনোনিবেশ করা যাক।

আহমদ মিনহাজ


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you