জামাল উদ্দিন হাসান বান্না : অতীতগর্ভে বিলীন এক শহরের শিল্পী || আহমদ মিনহাজ

জামাল উদ্দিন হাসান বান্না : অতীতগর্ভে বিলীন এক শহরের শিল্পী || আহমদ মিনহাজ

ভাটিবাংলায় যুগ-পরম্পরায় গীত মহাজনদের গান করে দেশ-বিদেশে পরিচিত পাওয়া জামাল উদ্দিন হাসান বান্নাকে হঠাৎ শুনতে ইচ্ছে করছিল। অনেকদিন হয় তাঁর গান শুনিনি। আঙুলে গুনলে কুড়ি বছরের বেশি হবে, এর মধ্যে তাঁকে শুনেছি বলে মনে হয় না। কালেভদ্রে যদি শুনেও থাকি, দেখতেই পাচ্ছি, সে-ইতিহাস স্মৃতিতে এখন আর বেঁচে নেই! যা-ই হোক, অডিও ক্যাসেট ও সিডি প্লেয়ারের জামানায় তাঁর কণ্ঠে জনপ্রিয় কিছু গানের কথা ওই মুহূর্তে মনে পড়ছিল। ভাটিবাংলার গানে স্বচ্ছন্দ বান্না ঢাকাই সিনেমার গানেও একসময় কণ্ঠ দিয়েছিলেন। বিনি সুতোর মালা ছবিতে সাধক কবি দুর্বিন শাহ-র আমার অন্তরায় আমার কলিজায়  গানটি তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। ওয়াসিম ও অলিভিয়া অভিনীত ডার্লিং  ছবির আঁকাবাঁকা পথে যেতে কে আমায় পিছু ডাকে  এবং চলছে জীবন যখন যেমন  গান দুটি ছেলেবেলায় বাজতে শুনেছি। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথা ও আনোয়ার পারভেজের সুরে শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো অলিভিয়ার প্রতি বাল্যমোহ উসকে দিয়েছিল তখন। অলিভিয়ার আরেকটি ছবি বে-দ্বীনএ শাহ আবদুল করিমের এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা  বান্নার কণ্ঠে লোকপ্রিয় হয়েছিল। করিমের কোনো গানের ওটাই প্রথম প্লেব্যাক কি না সে-ব্যাপারে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই, হলেও হতে পারে।

নেট ঘাঁটতে যেয়ে দেখছি বান্না যে-ছবিগুলোয় কণ্ঠ দিয়েছেন সেগুলো বিগত আটের দশকের গোঁড়ায় মুক্তি পেয়েছিল। ভাটিবাংলার গায়ক হিসেবে ওটা ছিল তাঁর উত্থানের সময়। সিনেমার গানে বান্না পরে আর প্লেব্যাক করেছেন বলে আমার জানা নেই। তাঁর এই হঠাৎ নিষ্ক্রিয়তার কারণ আন্দাজ করা মুশকিল। ঘনিষ্টজনরা এ-ব্যাপারে তাঁকে কখনো পুছতাছ করেছেন বলে জানা নেই। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়াটা অগত্যা একমাত্র সম্বল। ঢাকাই সিনেমার প্লেব্যাকে এন্ড্রু কিশোরের উত্থান, ধারণা করি, বান্নার মতো শিল্পীদের নিয়মিত হওয়ার সুযোগ সীমিত করে দিয়েছিল। আব্দুল জব্বার, বশির আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, রফিকুল আলমদের মতো মানিগুণী শিল্পীদের একচ্ছত্র রাজপাটে এন্ড্রু নিজের আসন তখন পাকা করে নিচ্ছিলেন। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস  গানটির পর যাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এই ঠেলাঠেলির ভিড়ে বান্নাকে দিয়ে গান করানোর ভাবনা ঢাকাই সিনেমাকারদের মধ্যে হয়তো স্তিমিত হয়ে এসেছিল। ডার্লিং  ছবির গায়কি অবশ্য সিনেমার প্লেব্যাকে বান্নার সক্ষমতার আভাস দিয়ে যায়। এমন হতে পারে, ভাটিবাংলার গানের প্রতি আবাল্য টানের কারণে সিনেমায় বাজিমাত করার ভাবনা থেকে শিল্পী স্বয়ং নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। প্লেব্যাকে ইস্তফা দিলেও রেডিও, টেলিভিশন আর গানের জলসায় তাঁর হাজিরা কিন্তু লম্বা সময় ধরে নিয়মিত ছিল। সময়ের পটপরিবর্তনে এখন যেটি ম্রিয়মান মনে হচ্ছে।

ভাটি অঞ্চলের গান অদ্য যারা গাইছেন সেখানে বান্নার নাম কানে ক্ষীণ শোনায়। লোকজনের তাঁকে নিয়ে আলাপ করতেও দেখি না আজকাল। শিল্পীর জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে আলাপ-সালাপ বড়ো একটা হয় না। মূল্যায়ন, আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কে বিস্তারিত হওয়া তো দূরের ব্যাপার! কারো কৃতি স্মরণে দু-চার কথা বলার একটি ধারাই এখানে যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে আর সেটি হলো বেচারাকে ফট করে মরে যেতে হবে! তার মরহুম আত্মার সদগতি ও কৃতি স্মরণে দু-এক ছটাক বাণী বর্ষিত হবে তখন। অতঃপর যে কে সেই! ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর;—এই বচনকে সার্থক করে তুলতে শিল্পী বেচারা চিরবিস্মরণের দেশে নিরুদ্দেশ হতে থাকবেন! বান্নার ব্যাপারে শ্রোতাসমাজের আকাট নীরবতার কারণ অনুমানে কাজেই মাথার চুল ছিঁড়তে হয় না।

সে যা-ই হোক, পড়ন্ত বয়সী বান্না তাঁর গায়কজীবনের ভাটি নেমে আসার কালে দু-চারটে জলসা বা ঘরোয়া আসরে এখনো গানটান করেন শুনেছি। মূলত সেই কৌতূহল থেকে ইউটিউবে তাঁর খোঁজ করছিলাম। নাহ! আট ও নয়ের দশকে শ্রোতাপ্রিয় শিল্পী একেবারে হারিয়ে যাননি! তাঁর কণ্ঠে জনপ্রিয় ভাটিবাংলার কিছু গান ইউটিউবে শ্রোতারা শুনছেন মনে হলো। প্লেব্যাকও পাওয়া গেল দু-একটা। সিলেটি বারোমাসী গানে তাঁর সহজ দখল ছিল। ইউটিউবে যদিও তার কোনো হদিশ করা গেল না। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেটুকু রয়েছে তাতে মনে হলো পুরোনো দিনের বন্ধ দরোজা চিচিং-ফাঁক-র মতো খুলে যাচ্ছে একে-একে।

সময়ের পটচিত্র অতীতে দাঁড়িয়ে নেই। ক্যাসেট ও সিডিতে মোড়ানো এ্যালবামের দিন ইতোমধ্যে মরহুম। ইন্টারনেটের বাড়বাড়ন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে তারা অস্ত গেছে পটে। বান্নাও অগত্যা ইউটিউবে নিজের নীড় খুঁজে ফিরছেন। গেল পাঁচ-সাত বছরে স্থানীয় গীতকবির লেখা দু-একটি নতুন গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী। রক্ত খাউরি, ভেজালে যায় দিন  ইত্যাদি গান তাঁর কণ্ঠে আগে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। ইউটিউবে সংরক্ষিত পুরোনো ও নতুন গানগুলো শুনতে বসে, স্বীকার করতেই হচ্ছে, কানে অপ্রীতিকর ঠেকেনি। বয়স হলেও তাঁর কণ্ঠ এখনো সতেজ। মঞ্চে ও ঘরোয়া আসরে শাহ আবদুল করিমের বাউলা কে বানাইল রে, বাউল ছিদ্দিকীর দয়ার সাগর বাবা শাহজালাল আউলিয়া, দুর্বিন শাহ-র টেকনিক্যালের হেড মেস্তরি-র মতো বহুশ্রুত গানগুলো বেশ দাপটের সঙ্গে গাইছেন দেখে ভালো লাগছিল। গলার টেকশ্চার এই বয়সে ধরে রাখা কঠিন। বান্নার ক্ষেত্রে যদিও একে নিছক সংখ্যা বলে মেনে নিতে হচ্ছে।

আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার কণ্ঠে ভাটিবাংলার গান শুনে যে-অনুভূতি হতো সেটি এখনো অটুট দেখতে পাওয়াটা তাৎপর্য বহন করে। এর অর্থ হচ্ছে, আড়ালে-আবডালে তাঁকে যারা বাজারি ও অতি-মূল্যায়িত ভাবতেন তারা সিলেট অঞ্চলের জলবায়ুতে পরিপুষ্ট শিল্পীর স্বকীয়তার জায়গাটি তখন ধরতে পারেননি। পানরসিক মানুষটির কথা বলা ও গান গাইবার ভঙ্গিতে সিলেটি ডায়ালেক্ট  যে-রস বিস্তার করত সেটি আসলে মেকি ছিল না। তাঁর ম্যাজিক ওতেই নিহিত ছিল। শাহ আবদুল করিমের জনপ্রিয় গান হুরু থাকতে প্রচুর শিল্পী গাইলেও বান্নার কণ্ঠে এর আবেদনকে যে-কারণে অমলিন ভাবতে মন অগ্রে সায় দেয়। সিলটি ভাইসাব  গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এ কে আনামের কথা ও সুরে গানটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গস্পর্শী ছিল। স্থানীয় গানের জলসায় বান্নাকে গানটি গাইতে দেখেছি। সিলটি ভাইসাব  ইদানীং ফকির লাল মিয়া বিরচিত আমরা হক্কল সিলটি-র লোকপ্রিয়তার কাছে ম্রিয়মান হয়ে পড়লেও দুটি গানেই আঞ্চলিকতা যাপনের স্মৃতিকাতর রোমন্থন তীব্র বটে!

এ কে আনামের নাম বিস্মৃতির খাতায় উঠলেও সিলেটের জলবায়ুকে স্মরণীয় করতে একাধিক জনপ্রিয় গান সেই সময় লিখেছিলেন। ভাটিবাংলা ও লোকজ গানের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী বিদিত লাল দাসের সুরে সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানা রে  গানটি যার মধ্যে অন্যতম। হিমাংশু বিশ্বাসের কণ্ঠে গীত লোকপ্রিয় গানটির আবেদন আজো অমলিন। সিলেটের নাট্য আন্দোলনে যাঁরা পথিকৃৎ তাঁদের সঙ্গে আনামের নাড়ির যোগ ছিল। নাটকের জন্য গান লিখতেন। কচুবনের মশা রে তার লম্বা লম্বা ঠ্যাং  গানের পরিহাসমাখা আবেদন সাড়া জাগিয়েছিল তখন। মনে রাখতেই হচ্ছে, ভাটিবাংলা তথা সিলেট অঞ্চলের গানে রাসবিহারী চক্রবর্তী, পণ্ডিত রামকানাই দাশ, হিমাংশু গোস্বামী তো বটেই, এছাড়াও বিদিত লাল দাস, হিমাংশু বিশ্বাস, ডা. ফজল মাহমুদ, এ কে আনাম প্রমুখ মিলে একটি যুগাবর্ত জন্ম নিয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার বিকাশ-প্রকাশ। সিলেট অঞ্চলের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে থাকা লোকগানের পরিবেশনায় বিদিত লাল দাস ওরফে পটলবাবু ও তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা বিলক্ষণ কামিয়াবি ছিলেন। বিগত আটের দশকের গোড়ায় সবেধন নীলমণি বিটিভিতে তাঁদের এ-রকম একটি পরিবেশনা কাউয়ায় ধান খাইলো রে খেদাইবার মানুষ নাই  পাঠক ইচ্ছে করলে ইউটিউবে শুনতে পারেন। সিলেটের গ্রামেগঞ্জে একসময় গীত গানটির সঙ্গে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান বোধ করি সংযুক্ত। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী  আন্দোলন গানটিকে আপন করে নিয়েছিল। আট দশকের গোড়ায় উনাদের এই দলীয় পরিবেশনা পুরোনো গানকে নতুন করে লোকের মুখে ফেরত এনেছিল।

পণ্ডিত রামকানাই দাশ রচিত সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী  আর ওদিকে ভাটিবাংলার ভাবসাধক রাধারমণ, গিয়াস উদ্দিন রচিত একাধিক গানে নতুন সুর বসানোর যজ্ঞে বিদিত লাল দাসের ভূমিকা পৃথক গুরুত্ব রাখে। বান্নার সৌভাগ্য মানতে হয়, গুণী এই সুরকার ও সংগঠকের সান্নিধ্য তাঁকে সিলেটের জলবায়ু ও ডায়ালেক্ট  রপ্ত করতে সাহায্য করেছিল। হুরু থাকতে  ও সিলটি ভাইসাব  ফিরে শুনতে বসে সেটি টের পাওয়া যাচ্ছে। বান্নার গায়কি বা এর প্রীতিকর দিকের নেপথ্যে ওই সময়কার সাংগীতিক আবহ গভীর ছাপ রেখেছিল। সিলেটি ডায়ালেক্ট-এ নিহিত রস ও মাত্রাজ্ঞান বজায় রেখে কীভাবে একটি গান কণ্ঠে তুলতে হয় তার শিক্ষা একঝাঁক গুণী শিল্পীর সঙ্গে ওঠবস করার সুবাদে বান্নার মধ্যে আপনা থেকে পরিপুষ্ট হতে পেরেছিল। সিলেটের জলবায়ুকে কোথাও বিঘ্নিত না করে গাইতে পারা সহজ কথা নয়। বান্না এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য বিদিত লাল দাসদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন। বর্ষীয়ান শিল্পী এখনো সেই ধার নিজের কণ্ঠে ধরে রেখেছেন দেখে তাঁর গান শুনতে বসাটাকে সময়ের অপচয় মনে হয়নি।


বাবা শাহজালালের মোকাম দেখভালের দায়িত্ব ঐতিহাসিক সূত্রে যে-দুটি পরিবার ভাগ করে নিয়েছিলেন তাদের একটিতে বান্নার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দরগাহর এক কোণে অপরিসর যে-চত্বর ঘিরে আউলা-ঝাউলা গায়ক ও গাঁজাখোরদের গানের মজমা বসত তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে তিনি পরিচিত। অন্যদিকে ভাটিবাংলার মহাজন বিরচিত গানগুলো গ্রামেগঞ্জে যুগ-যুগ ধরে যেভাবে গীত হয়ে আসছে তার সঙ্গেও সখ্য দূরের ছিল না। মাজারচত্বর ও গ্রামীণ আবহে গীত গায়কির মধ্যে যে-সরু পথটি রয়েছে সেই পথ ধরে গানগুলো নিজের কণ্ঠে তিনি তুলে নিচ্ছিলেন। হাসন রাজা, রাধারমণ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম ও জালাল উদ্দিন খাঁর গান বান্না যেভাবে গেয়েছেন সেখানে মাটির রস খানিক ফিকে হলেও অতটা ফিকে নয় যে শ্রোতার তাকে অচেনা মনে হবে। তাঁর গানকে প্রীতিকর ও সতেজ ভাবার এটি বড়ো কারণ।

রাধারমণের শ্যামকালিয়া সোনা বন্ধু রে; দুর্বিন শাহ-র আমার অন্তরায়; করিমের মন মজালে ওরে বাউলা গান, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম  ইত্যাদি বান্নার আগে-পরে অনেক শিল্পীই গেয়েছেন। তাদের মেরিট নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। প্রত্যেকে নিজের গায়কিয়ানায় শতভাগ বিশ্বস্ত থেকে গানগুলো গেয়েছেন বা গাইছেন এখন। করিমের নিজের রচিত গানগুলো তাঁর কণ্ঠে শোনার অভিজ্ঞতা অত্র স্মরণে রাখা সমীচীন। তথাপি কথা মিথ্যে নয়, সিলেট শহরে আমাদের বেড়ে ওঠার দিনকালে শহুরে কোনো শিল্পীর কণ্ঠে লোকসংগীত ও মহাজনদের গান শোনার সহজ অভ্যাসের অনেকটা জামাল উদ্দিন হাসান বান্না একলাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। শহুরে আবহে গাউগেরামের সুর বইয়ে দিতে পণ্ডিত রামকানাই, বিদিত লাল দাস, হিমাংশু বিশ্বাস, ডা. ফজল মাহমুদের মতো শিল্পীর ভিড়ে বান্নার অনুপ্রেবেশে নতুনত্ব ছিল। বান্নাকে সেক্ষেত্রে এইসব গুণী শিল্পীর পূর্বসূরী ও তাঁদের উত্তরসূরী হিসেবে অনেক পরে আবির্ভূত সেলিম চৌধুরীর মধ্যবর্তী যোগসূত্র বলা যেতে পারে।

দেশভাগের বহু আগে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, রণেন রায়চৌধুরীর মতো বরেণ্য শিল্পী সিলেট জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো গান সঙ্গী করে কলকাতায় স্থায়ী ডেরা পেতেছিলেন। কলকাতায় পাড়ি জমানোর কারণে শহুরে গানের আসরে হাওরের লিলুয়া বাতাস বহানোয় খামতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। খামতি পুষিয়ে দিতে, আগেই বলেছি, বিদিত লাল দাস ও সমসাময়িক শিল্পীরা গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের পরে কে এই প্রশ্নটি যখন উঠব-উঠব করছে সেই ক্ষণে বান্নার অনুপ্রবেশ। তাঁর পরে কে? এই প্রশ্নটি উঠি-উঠির ক্ষণে যেমন সেলিম চৌধুরীকে শ্রোতারা প্রবেশ নিতে দেখেছিলেন। হাসন রাজার গান বাংলাদেশের শিল্পীরা অকাতরে গাইলেও শ্রুতিসুখ বিবেচনায় নির্মলেন্দু চৌধুরী, তাঁর পুত্র উৎপেলন্দু চৌধুরী ও ওপার বাংলার শিল্পীরা খানিক এগিয়ে ছিলেন। সেলিম চৌধুরীর হাসন রাজার গান  অ্যালবামটি ধারায় ছেদ টেনেছিল। অ্যালবামের গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই সময়। সিলেটের এক শিল্পীর কণ্ঠে উচ্ছলিত হাসন রাজা যেন-বা এতদিন পরে নিজের রাজপাট ফিরে পেলেন। তাঁর গানে প্রবাহিত ভাবার্থ ও উচ্চারণ নতুন প্রাণ খুঁজে পেলো সেলিমের কণ্ঠে। খেশকে কেশ ভেবে গাইতে শোনার অত্যাচার থেকেও নিষ্কৃতি মিলেছিল শ্রোতার।

সিলেট অঞ্চল বিশেষ করে ভাটিবাংলার গানের কথা ও উচ্চারণের একটি পৃথক তাৎপর্য রয়েছে। সিলেটি ভাষা স্বতন্ত্র নাকি বাংলা ভাষার শাখা-প্রশাখার সূত্রে একটি উপভাষা এই তর্কে যেতে চাইছি না। সিলেটি ও চাঁটগাইয়া ভাষার সঙ্গে বাংলার বিরোধ ইত্যাদি নিয়ে দূর কিংবা সাম্প্রতিক ক্যাঁচালের ব্যাপারে আমি বলার কেউ নই। বিষয়টি ভাষা বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। তবে কথা সত্য বটে, আসাম অঞ্চলে বহমান সংস্কৃতির প্রভাব আর অন্যদিকে নাগরী লিপির সুবাদে সিলেট অঞ্চলে বিকশিত ভাষার গঠনপ্রকৃতি ও উচ্চারণে ভিন্নতা রয়েছে। গানের কথায় যেটি সহজাত বেশ ধরে প্রবেশ করে। সুতরাং সিলেট তথা ভাটিবাংলার গান কণ্ঠে তুলে নেওয়ার ক্ষণে উচ্চারণের জায়গাটি শিল্পীর বিবেচনায় রাখা অনেকসময় গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। কে উহ্য করে প্রবল ‘খ’ কিংবা ‘হ’ ইত্যাদির ধ্বনিগত বয়ান সিলেট অঞ্চলের গানে গুরুত্ব রাখে। এখানে খামখেয়াল খেশ  শব্দটির প্রকৃত অর্থকে কেশ-এ গুবলেট পাকানোর মতো পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। রণেন রায়চৌধুরীকে স্মরণ করতে বসে খালেদ চৌধুরী ঠিক এই দিকটার ওপর আলো ফেলেছিলেন। তাঁর বক্তব্যের কিয়দংশ উদ্ধৃতি যাই বরং, খালেদ লিখছেন :

রণেনের গানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ধ্বনিগত-‘হ’-এর নিখুঁত ব্যবহার। ব্যাপারটা আরেকটু গুছিয়ে বলি। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে সব দেশের—অর্থাৎ পৃথিবীর সব দেশের—লোকসংগীতের মধ্যে শব্দের সঙ্গে একটা বাড়তি ‘হ’-এর যোগ দেখা যায়। যেমন, ‘ও কোকিলা—’ কথাটা যখন লোকসংগীতে গাওয়া হয় তখন ‘ও কোকিলাহ—’ হয়ে যায়। এমনকি পল রোবসনের গানেও এটা আছে। যেমন, ‘I’m tired of living’ গানটা গাওয়া হয় ‘আহাম্ টায়ার্ড অভ্ লিভিং’। এর একটা কারণও আছে—সব দেশেই লোকসংগীত গড়ে ওঠে শ্রমজীবী মানুষদের মুখে মুখে। শ্রমজীবী মানুষেরা তাদের কাজ করতে করতে এইসব গান গায়। গানের তালে তালে কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাসের যে-ধাক্কাটা বেরিয়ে আসে তাতেই একটা বাড়তি-‘হ’ শব্দের সঙ্গে এসে যায়।

আগেই বলেছি, রণেনদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশের শিলেটে (*সিলেট)—শিলেট জেলার সুনামগঞ্জ থানার সুরমা নদীর ধারে ছাতক গ্রামে। যাঁরা সুনামগঞ্জে গেছেন তাঁরা জানেন যে এখানকার বৈশিষ্ট্য হলো যে গ্রামগুলো হয় উঁচু জায়গায় এবং পাঁচ-সাত মাইল দূরে দূরে। মাঝে ঢালু এবং নিচু জমি মাইলের পর মাইল জুড়ে থাকত। এগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ‘হাওড়’ বলে। গ্রীষ্মকালে ‘হাওড়’ ধু-ধু করত, আর বর্ষাকালে জলে ডুবে যেত। একটা গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে নৌকায় করে যেতে হত। নৌকার মাঝিদের দেখবেন তারা তালে তালে বৈঠা ফেলে আর তারা এই তালটা রাখে দেহের একটা ঝাঁকির মধ্যে। রণেন যখন গান গাইত তখন সামনে পেছনে দুলে দুলে —মাঝিদের মতো একটা ঝাঁকি দিয়ে —তালে তালে গাইত। এর ফলে তালের যে-ঝোঁকটা হারিয়ে যেত তাকে শরীরের ঝাঁকির সঙ্গে একটা বাড়তি ‘হ’ দিয়ে ধরত, অর্থাৎ প্রয়োজনের তাগিদেই বাড়তি ‘হ’ শব্দের সঙ্গে এসে যেত, কৃত্রিমভাবে তাকে গানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিত না। [দ্রষ্টব্য : নিঃশব্দে চলে গেলেন রণেন রায়চৌধুরী : খালেদ চৌধুরী; রণেন রায়চৌধুরীর গানের ভুবন]

খালেদ চৌধুরীর কথার সারবত্তা যারা শাহ আবদুল করিমকে মঞ্চে গাইতে দেখেছেন তাদের টের পাওয়ার কথা। নিজের গান পরিবেশনের ক্ষণে করিমের দেহভঙ্গি ও উচ্চারণে খালেদ কথিত ভারসাম্যে ফেরত আসার ঘটনা স্পষ্ট দেখেছি মনে পড়ে। গানের মোক্ষম জায়গায় করিম তাঁর কণ্ঠে যে-গমক নিয়ে আসতেন তার সঙ্গে দেহের ঝাঁকি একটি নিখুঁত ভারসাম্য তৈরি করত। বয়সের ভার সেখানে কোনো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। সহজাত অকৃত্রিম এই গুণ করিমকে রপ্ত করতে হয়নি। হাওরের জলবায়ু থেকে ওটা আপনাআপনি তাঁর দেহে জায়গা করে নিয়েছিল। ওই পরিবেশে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা না থাকলে গানে এর প্রয়োগ বিড়ম্বনা ঘটায়। বান্নার গানে সংগতকারণে করিমের এমতো জেশ্চার আশা করা বাতুলতার নামান্তর। যেটি লক্ষণীয় সেটি হলো উচ্চারণ, আর সেখানে মুফতি বাড়ির রক্ষণশীল গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসা বান্না ভাটিবাংলার সাধক কবিদের গানের প্রতি পারতপক্ষে অবিচার করেছেন বলে আমার অন্তত মনে হয়নি।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বিদিত লাল দাস থেকে বান্না অবধি শিল্পীরা এমন এক যুগসন্ধির মানুষ যখন ভাটি অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো গানের বৈচিত্র্যে নতুন পালক জুড়তে স্বয়ং ভাবসাধক জালাল উদ্দিন খাঁ, উকিল মুন্সী, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম ধরায় জীবিত ও সক্রিয় ছিলেন। গাঁওগেরামে গানের আসরে সমবেত শ্রোতারা এইসব মহাজনকে মঞ্চে গান গাইতে দেখছেন। নিজের রচিত পদ যেমন তাঁরা গাইছেন, সৈয়দ শাহনূর, হাসন রাজা, রাধারমণ, আরকুম বা শীতালং শাহ-র পদও সমানে গাইতেন। বান্নার সৌভাগ্য যে তিনি মহাজনদের নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। অনেককে স্বচক্ষে গাইতেও দেখেছেন। তাঁদের গান কণ্ঠে ধারণ ও উচ্চারণবিধি রপ্ত করার ক্ষেত্রে এই চর্মচক্ষ দর্শন কাজে দিয়েছিল বৈকি।

ভাটিবাংলার ভাবসাধকরা নিজের গানে যে-ভাবের বার্তা প্রচার করতেন সেটি গ্রামীণ সমাজে ফল্গুধারার মতো বইলেও শহুরে পরিমণ্ডল ও শিক্ষিত নাগরিকজনের কাছে এর আবেদন কতটা কী ছিল সেটি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। বান্নাকে যেমন বিভিন্ন সময় বলতে শুনেছি, ভাটি অঞ্চলের গান শহরের আনাচ-কানাচে চুঁইয়ে পড়লেও তার কদর সেভাবে ছিল না। কলকাতা থেকে আসা আধুনিক বাংলা গানের প্রভাব ব্যাপক ছিল তখন। শহরের সুধীজন মান্না-হেমন্ত-মানবেন্দ্র-কিশোর কুমারের গান যে-পরিমাণে শুনতেন তার সমতুল আদর ও বাহবা লোকধারার গান গেয়ে আদায় করা কঠিন ছিল। তাঁর কথার যথার্থ নিয়ে তর্কে যাওয়া যেতে পারে তবে শহুরে জীবনচর্চায় অভ্যস্ত লোকের কানের সঙ্গে গ্রামের জল-মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কানের বিচ্ছেদ তাতে টের পেতে অসুবিধে হয় না। এই চক্করে পড়ে হয়তো কলকাতা মহানগরে পাড়ি জমানো নির্মলেন্দু চৌধুরী ভাটি অঞ্চলের গান পরিবেশনের চিরাচরিত ধারায় খানিক রদবদল ও নতুনত্ব এনেছিলেন। নির্মলেন্দুর এই কাণ্ড হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও আহত করেছিল। কাণ্ডটি নির্মলেন্দু কেন করছেন তার যুতসই ব্যাখ্যা বোধ করি কমরেড হেমাঙ্গের এক পত্রাঘাতের জবাব দিতে বসে দেবব্রত বিশ্বাস খুব ভালোভাবে দিয়েছিলেন। এখন আর সে-কাহিনিতে না যাই। লেখার সংযুক্তি অংশে কথাগুলো জোড়া থাকল।


ওপরে বলা কথার সুবাদে মনে পড়ে যাচ্ছে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় শাহ আবদুল করিম বলেছিলেন, গানের কথা ও সুর সামান্য এদিক-সেদিক করে কে কীভাবে গাইছে সেটি তাঁকে খুব বেশি পীড়িত করে না। গানের আসরে একজন শ্রোতা যদি থাকে তাকে নিজের গান শোনাতে তাঁর আপত্তি নেই। শ্রোতাকে গান শুনিয়ে আনন্দ দান তাঁর একমাত্র লক্ষ্য নয়। বড়ো ব্যাপার হচ্ছে যে-বার্তা তিনি তার কাছে পৌঁছাতে আকুল শ্রোতা সেটি ধরতে পারছে কি-না। বার্তাটি কী জানতে চাইলে করিম সংক্ষেপে উত্তর দিয়েছিলেন : পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে! শ্রোতামনে এই স্বপ্ন বুনে দিতে তিনি গান বাঁধেন। ভাটিবাংলার সাধক কবিদের গান যারা গাইছেন তাদের গায়কি করিমের এই সারকথার কতখানি অন্তরে পুষে গান গাইতে মঞ্চে উঠেন, সেটি বান্নাকে ফিরে শুনতে বসে মনে উদয় হচ্ছে বৈকি!

করিম যে-বার্তা শ্রোতার কানে বপনের ইচ্ছা বুকে পুষে মঞ্চে গান করতেন তার মাজেজা নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে সীমিত। প্রসঙ্গটি গুরুতর বিস্তারণ দাবি করে। তবে হ্যাঁ, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, হুরু থাকতে, চাল ছানিত কামলা চাচা দিলায় না, কোন মেস্তরি নাও বানাইছে-র মতো বহুপ্রজ গানগুলো পরিবেশনের সময় সাধক কবির কণ্ঠে হাওরের অগাধ জলরাশির মাঝে নাওয়রে বৈঠা ওঠা-নামার যে-ধ্বনিসংগত গমক দিয়ে উঠত, এমতো আবেশ কেবল সেই মানুষটির পক্ষে সৃজন করা সম্ভব যিনি গানের কথাকে আত্মআবিষ্কারের মন্ত্র হিসেবে জীবনভোর জপ করে গেছেন। তাঁর কোনো সাগরেদ বা তাঁকে মোটের ওপর কাছে থেকে দেখেছেন, তাদের পক্ষে ওই ভাবাবেশে সমাধিস্থ হয়ে গান করা দুরূহ। চমৎকার গাইলেও বান্নার পক্ষে সেই জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। যেমন সম্ভব নয় এখন যারা গাইছেন তাদের পক্ষেও। শিল্পীর জন্য এক্ষেত্রে দুটি পথ খোলা থাকে;—ভাটিবাংলার গানগুলো কণ্ঠে তোলার সময় হয় তিনি লোকগানের চিরাচরিত পরিবেশনরীতির ওপর স্থির থাকবেন নতুবা শহুরে আঙ্গিকে এর নবীকরণ ঘটাবেন। বান্না থেকে সেলিম চৌধুরী অথবা সম্প্রতি জনপ্রিয় আশিককে যদি প্রথমটির অনুসারী ধরি তাহলে হাবিব ওয়াহিদ ও তাঁর মর্দেমুমিনগণ দ্বিতীয় পথ ধরে এগিয়েছেন ধরা যায়।

ভাটি অঞ্চলের সাধক কবিদের গান কণ্ঠে তুলে নেওয়ার ঘটনায় বান্নার গায়কিকে নতুন বা আহামরি বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আব্বাসউদ্দিন, নির্মলেন্দু চৌধুরী, ওমর পাল, আব্দুল আলীম, রথীন্দ্রনাথ রায় থেকে বারী সিদ্দিকী অবধি বহমান পরম্পরাকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। পরম্পরাটি সাক্ষাৎ গ্রামীণ বা লোকজ না হলেও গ্রামের জল-মাটি-হাওয়ার সঙ্গে তার কুটুম্বিতা রয়েছে। জালাল উদ্দিন খাঁ, দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম ও উনাদের সাক্ষাৎ সাগরেদরা যেখান থেকে গানগুলো ধরেন তার সঙ্গে এর পার্থক্য অবিসংবাদিত হলেও বিধুরতা উভয় ধারার গায়কিতে কমবেশি সুলভ বটে। হাবিব ওয়াহিদের পরিবেশনা ওদিকে নতুনত্বে রঙিন হলেও তার আবেদন একান্ত নাগরিক। গ্রামীণ আবহকে ধারণের ক্ষেত্রে হাবিবের গন্তব্য পৃথক। ভাটিবাংলার গানে প্রবাহিত আবেদন বা তার লোকালাইজড ফর্মকে ভেঙে তিনি সরাসরি নগরে ঢুকছেন এবং আরবানাইজড  এক পরিসরে নিজের নিষ্কৃতি খুঁজে নিয়েছেন। প্রভেদটি এইবেলা খেয়ালে রাখা প্রয়োজন।

বান্না ও ওয়াহিদ যে-দুটি পৃথক ধারার প্রতিনিধি তার একটিকে ভালো ও অপরটিকে মন্দ বলে দাগানো মনে হচ্ছে অবান্তর। হাবিব ওয়াহিদের কম্পোজিশনে ভাটিবাংলার গান নাগরিক সুরতে প্রকাশ্য হওয়ার কারণে তার দেহে মর্মরিত মরমি ও আধ্যাত্মিক রস নিস্তেজ হবে এটা স্বাভাবিক। গানের পরিবেশনাকে জাগতিক প্রেমরস ও যৌনতায় উচ্ছল মনে হয় শ্রোতার। শহরে বাড়ন্ত নাগরিক শ্রোতার কানে এই উচ্ছলতা হচ্ছে পথ যেটি তাকে আরকুম শাহ বা করিমের কাছে নিয়ে যায়। এখন এর ভালোমন্দ নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু পৃথক যে-পরিসর এটি গড়ে নিয়েছে তাকে পাশ কাটিয়ে অবিকল করিম বা আরকুম কিংবা মধ্যবর্তী বান্নায় শ্রোতার পক্ষে ফেরত যাওয়া কঠিন।

শহুরে জলবায়ুতে শ্বাস নিতে অভ্যস্ত শ্রোতা এইসব গানের ভাবরস কতখানি নিজ অনুভবে জারিত করে সেটি আন্দাজ করা যারপরনাই কঠিন ঠেকে। গানগুলোকে দেহে জায়গা দানের ঘটনায় তারা কতটা করিম কথিত ভাবরসে আবিষ্ট হয় আর কতটা সুর, যন্ত্রানুষঙ্গ ও গায়কির পাবন্দ ইত্যাদি নিয়ে হাবিবুর রহমান এনার সম্পাদিত খোয়াব  পত্রিকায় একসময় লিখেছিলাম। প্রায় ত্রিশ বছর আগে প্রকাশিত গদ্যে উক্ত বিষয়ে যে-কথাগুলো বলার চেষ্টা ছিল তার থেকে সরে আসার মতো কিছু ঘটেছে বলে একিন হয় না। তথাপি, কথা মিছে নয়,—মরমি ও আধ্যাত্মিক জীবনবেদে আচ্ছাদিত গানগুলোকে জলমাটিহাওয়া সংলগ্ন ঠাউরাতে শহুরে শ্রোতাও আজকাল আর বিশেষ গাড্ডায় পড়ে না।

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে দৃকপাত করলে বান্নার গান সেইসব শ্রোতার জন্য মানানসই মনে হবে যারা ভাটিবাংলার সাধক ও তাদের সাগরেদদের গান অল্পবিস্তর শুনে বড়ো হয়েছেন, অন্যদিকে হাবিব ওয়াহিদদের সে-গানের জগতে প্রবেশ নিতেও দেখেছেন;—পৃথক দুটি গন্তব্যে মোড় নিতে উদ্যত ধারার মধ্যে আবার বান্নার মতো শিল্পীর গায়কি তারা নিরিখ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে এরকম কালপর্বে যেসব শ্রোতার বেড়ে ওঠা, তাদের কাছে বান্না কিংবা কালিকাপ্রসাদের আবেদন তাই ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। বান্নাকে ফিরে শুনতে বসে ভাবনাটি মনে জাগছে এখন।


সিলেটের সংস্কৃতি মহলে পরিচিতমুখ জামাল উদ্দিন হাসান বান্না পেশাদার গায়কদলেই পড়েন। তাঁকে সেরকম ভাবা যায় বৈকি। আগেই বলেছি, দুর্বিন শাহ-র সাক্ষাৎ শিষ্য ক্বারী আমির উদ্দিনের মতো প্রবল দাপুটে শিল্পী কিংবা করিমের গান গেয়ে জনপ্রিয় রুহি ও রনেশ ঠাকুরের ধারায় গান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ভাটিবাংলার গান কণ্ঠে তুলে আনতে এঁনারা যে-তরিকায় গলা সাধেন তার সঙ্গে শহুরে গায়ক বান্নার প্রভেদ যতখানি অকাট্য হওয়া উচিত ততটাই ছিল তখন। মালজোড়া গানের আসরে প্রতিপক্ষকে মোক্ষম কথার প্যাঁচে ঘায়েল করতে ওস্তাদ আমির উদ্দিনের গান বাঁধা ও পরিবেশনরীতি গ্রামীণ শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ রাখলেও সেকালের আধা গ্রাম্য আধা মফস্বল সিলেট শহরে এর আবেদন মিশ্র ছিল। কথাটি এইবেলা টুকে রাখতে চাই এখানে।

দুর্বিন শাহ-র ছায়ায় বেড়ে ওঠা ও মারেফতিবিদ্যায় কামেল আমির উদ্দিন নিজে চমৎকার সব পদ রচনা করেছেন জীবনভোর। তথাপি, যারা, ধরা যাক, হাওর-বাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ থেকে সরাসরি সিলেট শহরে আস্তানা পেতেছিলেন অথবা সিলেটবাসীর লন্ডন শহরে গমনের ধারায় সরাসরি বিদেশ পাড়ি দিচ্ছিলেন, তাদের কাছে আমির উদ্দিন, রুহি বা রনেশের আবেদন সদা অটুট থেকেছে। পক্ষান্তরে অনেক দিন ধরে শহরবাসে অভ্যস্ত শ্রোতাদের কানে তাঁরা দূরত্বসূচক ছিলেন। অপরিচিত নয় তবে সেই পরিচয়ের মধ্যে আবিষ্টতার লেশ মাত্র ছিল না। শহুরে সুধীজনের কাছে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য তাঁদের নিয়তি হয়ে উঠেছিল। ভাটিবাংলার সাধক রচয়িতাদের গানকে গ্রামের অনাচ-কানাচে যারা অবিরল গাইছেন এবং শহরে যারা ওই গানগুলোকে নতুন আঙ্গিকে গাইতে উঠেপড়ে লেগেছেন, উভয় পক্ষের মাঝখানে বোধহয় কাউকে দরকার ছিল যিনি মূল আবেশকে ক্ষুন্ন না করে গানগুলো গাইবেন। বান্নার গায়কিকে মনে হচ্ছে এই জায়গা থেকেও প্রাসঙ্গিক ভাবা যায়।

মোদ্দা কথা, দুই পক্ষের মাঝখানে রফায় যাওয়া সম্ভব এরকম গায়কির ধাঁচ তিনি রপ্ত করে নিয়েছিলেন। গ্রামের শ্রোতাদের কাছে তাঁর আবেদন প্রবল ছিল বলে মনে হয় না, তবে সিলেট শহর ও সুদূর লন্ডন নগরীর মিশ্র শ্রোতামণ্ডলী তাঁকে আপনার করে নিয়েছিল। তাঁর মতো শিল্পীদের সুবিধা হলো নিত্যনতুন বাদ্যযন্ত্র ও পরিবশেনরীতির সঙ্গে তাল রেখে গাইতে বড়ো একটা সমস্যায় ভোগেন না। সীমিত ও প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র সমাহারে যে-গানগুলো বান্নার কণ্ঠে একসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার কয়েকটি অধুনা প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র ও পরিবেশনরীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সম্প্রতি গেয়েছেন। ইউটিউবে সুলভ পরিবেশনাটি কানে পীড়াদায়ক ঠেকেনি। গলার টেকশ্চার, উচ্চারণ ও সাবলীল গায়নভঙ্গি যন্ত্রের চড়ানাদে কোথাও ডুবে যাচ্ছে বলে আফসোস জাগেনি মনে। গলার মধ্যে আদি গায়কির টান ও ভঙ্গি ধরে রেখে গাইতে পারা সহজ নয়। বর্ষীয়ান বান্নাকে এখানে সফল বলা যায়। তাঁর গায়নভঙ্গি কতটা জবরদস্ত সেটি টের পেতে গানে ফানে আড্ডা  নামক ইউটিউব চ্যানেলে করিমের মন মজালে ওরে বাউলা গান, দুর্বিন শাহ-র আমার অন্তরায় ও জালাল উদ্দিনের দিন গেলে দিন  গানগুলো শোনার অনুরোধ থাকবে।

নতুন যুগের পরিবেশনরীতির সঙ্গে মানিয়ে গান করা বারী সিদ্দিকীর ন্যায় অতুল মনে না হতে পারে কিন্তু বান্নার স্বকীয়তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। বিষাদ ও নির্বেদঘন গানে শিল্পীকে মাঝেমধ্যে ম্রিয়মান লাগে বৈকি! দুর্বিন শাহ-র বেলা গেল সন্ধ্যা হলোকে অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম গণ্য করা উচিত। ভাটিয়ালির রূপরসমাধুর্যের সবটুকু ঢেলে গানটি তিনি আগে বা এখনো গাইছেন দেখতে পাই। দুর্বিন টিলায় বসে সাধক কবি জীবনের অস্ত দেখছিলেন অগাধ নিস্ফলতায়। হাহাকারে ভরা ছিল অন্তর। তিনি স্বয়ং গানটি কীভাবে গাইতেন তার হদিশ এখন আর পাওয়ার উপায় নেই। দরগাহ চত্বরে বাউল করিম ও দুর্বিন শাহ-র গান স্বচক্ষে দেখা ও শোনার অভিজ্ঞতা বোধ করি বান্নার জীবনের পাথেয় ছিল, যেখান থেকে বেলা গেল সন্ধ্যা হলোর সারকথা তিনি কণ্ঠে তুলে নিতে পেরেছিলেন। কথাটি যে-কারণে বলাই যায়, গানটির মর্ম ও ভাবরস এখন অবধি তাঁর কণ্ঠে সবচেয়ে প্রীতিকর সুখ বহায় কানে।

ভাটিবাংলার গানের বিস্তৃতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ওপার বাংলা এমনকি বিদেশেও স্থান করে নিয়েছে। গান পরিবেশনার ধারায় বৈচিত্র্যও ব্যাপক। নতুন যুগের শিল্পীরা সময়ের পটপরিবর্তনে তাল দিয়ে গানগুলো গাইছেন। শ্রোতারাও অতীতে দাঁড়িয়ে নেই। গানগুলোর পরিবেশনা ও শ্রোতাসংযোগের ধরন-ধারণ নিয়ে ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিতের বাহাস আগেও ছিল, এখন সেটি পরিমাণে বেড়েছে বৈ কমেনি। এইসব ভজকটের মধ্যে নিজস্বতা বজায় রেখে বান্না গেয়ে যাচ্ছেন, ঘটনাটি সুখকর মানতে হয়।

একদিন তিনি থাকবেন না কিন্তু গানগুলো থেকে যাবে। ক্রমশ নাগরিক সভ্যতায় শাহ আবদুল করিমের বাসনা পুরা করতে মেটাভার্সের দিকে ধাবমান পৃথিবীটা কখনো বাউলের হবে না! তবে হ্যাঁ, নির্জন যমুনার কূলে / বসিয়া কদম্বতলে-র স্মৃতিকাতর সুর মুখোশে ঢাকা মানুষের ভিড়ে আলগোছে চুঁইয়ে পড়বে তখনো। ইথার বয়ে আনবে বিলুপ্ত জগতের সংবাদ। ভিড়ে পড়িমড়ি ছুটতে থাকা মানুষ সেটি কি শুনতে পাবে? নাকি পাবে না? সম্ভাবনা এখানে সমান-সমান ধরা যেতে পারে। যারা শুনবে তারা একে কীভাবে নেবে অথবা গাইবে তার আন্দাজ পাওয়া কঠিন। ওদিকে যারা সেটি শুনতে পাবে না তারা হয়তো জানতেও পারবে না, জামাল উদ্দিন হাসান বান্না নামের এক শিল্পী অতীতগর্ভে বিলীন শহরে গানটি গাইবেন বলে মঞ্চে উঠেছিলেন। বড়ো দরদ দিয়ে গেয়েছিলেন সেদিন!সংযুক্তি :
১. সুগায়ক ও প্রখর শেণিসচেতন হেমাঙ্গ বিশ্বাস দেবব্রত বিশ্বাসকে আপসপন্থী, উন্নাসিক ও রবিগানের ব্যাপারে সবজান্তা ইত্যাদি বলে একসময় কামান দেগেছিলেন। অভিযোগের উত্তর করতে বসে দেবব্রত তাঁর স্বভাবসুলভ বাঙাল ভাষায় পাল্টা পত্রাঘাত হেনেছিলেন। দীর্ঘ সেই পত্রের নির্মলেন্দু চৌধুরী সংক্রান্ত অংশটি উদ্ধৃত করছি এখানে :

আৎকা তুমারে এই চিঠিডা ল্যেখলাম—কারণডা পরে জানাইতাছি। বুধয় মাসখানেক আগে তুমি আমার ঘরে আইয়া দর্শন দিছ্লায়, কামপুচিয়ার ব্যাপারে কী উগলা কাগজে আমার সই লওনের লাইগ্যা। সইডা দেই নাই। তুমারে কইছ্লাম যে নিজের দ্যাশের লাইগ্যাই কুছতা করতাম পার্লাম না, কামপুচিয়া দিয়া কিতা কর্বাম্? বুঝছিলাম তুমি আমার উপ্রে ব্যেশ্ গুশা কইরা গেলায় গিয়া। তবে হেইদিন বুঝতাম পারি নাই যে তুমি কইলকাত্তার রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক ময়দানে শহীদ মিনারের উপ্রে উইঠ্যা পরছ। অখনে আমার খুব ডর্ লাগতাছে, সইডা দিয়া দিলেই অইত ভালা—কারণ যদি ভবিষ্যতে সরকারী ক্ষেমতা কিছু তুমার কান্ধে আইয়া পড়ে তইলে আমার অবস্থা ভুট্টো সাহেব। তবে আমার একটু আশা আছে তুমি ক্ষেমতা পাওনের আগেই আমি ভবনদী পার হইয়া যাইবাম্।…

কয়েক বছর আগে তুমি আমার ঘরে আইয়া কইছ্লা যে নির্মলেন্দু চৌধ্রী তুম্রার লুকসংগীতের বারডা বাজাইয়া দিতাছে। তুমার নিশ্চয়ই মন আছে যে তুমারে কইছলাম্ যে নির্মলেন্দু ঠিক কর্তাছে। তার ত গান হুনাইয়া প্যেট্ চালানি লাগব—সিলেটের লুকসংগীত হুনাইয়া সুবিধা অইত না—হেই লাইগ্যা তারে ফোকো-জাজ্, ফোকো-ফক্সট্রট, ফোকো-পপ বানাইয়া শ্রুতাধারে খুশী কইরা প্যেট চালানি লাগব। তুমি যে লুকসংগীত গাও হেইডা যে অরিজিন্যাল্ এবং বিশুদ্ধ লুকসংগীত তার কুনু গ্যারান্টি তুমি দিতা পারবা? দুইশ বছর আগে তুম্রার দ্যাশের লুকসংগীত কি ভায়্ গাওয়া অইত তার কুনু রেকর্ড বা স্বরলিপি তুমার কী আছে?…
[উৎস : বাম পতনের শব্দ হয়, ইন্টারেনট]


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: