ভ্রমণতৃষ্ণদের জন্য প্রযোজ্য, ঘরকুনোদের জন্যও || মনোজবিকাশ দেবরায়

ভ্রমণতৃষ্ণদের জন্য প্রযোজ্য, ঘরকুনোদের জন্যও || মনোজবিকাশ দেবরায়

ঘাস প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক নাজু। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয়। নব্বইয়ের দশকে মাহমুদ কম্পিউটার-এ তাঁর সাথে প্রথম দেখা। শৈল্পিক স্বভাবের মানুষ তিনি। প্রকাশনাশিল্পে তাঁর হাতের ছোঁয়া নান্দনিক রুচির পরিচায়ক। তিনি একজন কবি ও লেখক। খোশমেজাজের মানুষ। ঘাস প্রকাশনা থেকে আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অবসর সময়ে প্রায়ই যাওয়া হয় ঘাস প্রকাশনে। অনেক লেখক ও সজ্জনের সঙ্গে দেখা হয়। সেদিন ঘাস প্রকাশনে নাজুভাই আমার হাতে ৫৬ পৃষ্ঠার একটি বই ধরিয়ে দেন। বইয়ের নাম ‘শিলঙের রৌদ্র-মেঘে’।

মেঘালয়ের একটি সুন্দর শহর শিলং। দু-বার আমার সুযোগ হয়েছে শিলং দেখার। যত দেখেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি। পাহাড়ি টিলার ওপর শহর। টিলার মাঝে ঘরবাড়ির অবস্থান দেখতে ভালো লাগে। প্রকৃতিকে নষ্ট না করে পাহাড়ে লোকালয়ের অপূর্ব নিদর্শন শিলং। এই শহরে অনেক স্কুল-কলেজ আছে। বাংলাদেশের অনেক লোক ছেলেমেয়েকে শিলং শহরে পড়িয়ে বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। আর তুলবেন না-ই বা কেন? সেখানে পড়াশোনা আন্তর্জাতিক মানের।

এবার ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। বইটি হাতে পেয়ে চোখ বোলালাম। সাদা জমিনের ওপর প্রচ্ছদ বেশ ভালো লাগে। তবে আমি শিল্পমনা নই বলে প্রচ্ছদের ভাষা উদ্ধার করতে পারিনি সঠিকভাবে। মলাটের ভেতরদিকে সুন্দর বর্ণন আছে ছোটোকাগজ ঋতি সম্পাদক কবি ফজলুররহমান বাবুল-এর রুচিস্নিগ্ধ বয়ানে। এটি পাঠ করলে যে-কেউ মূল বই পাঠ না করে শান্তি পাবেন না। বাবুলভাইয়ের উপস্থাপনার ক্যারিশমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাই।

ভেতরে প্রবেশ করলেই নজর কেড়ে নেয় শিলং শহরের এক সুন্দর ছবি। পাহাড়ের টিলা গা ঘেঁষে ঘরবাড়ির অবস্থান বেশ সুন্দর লাগে দেখতে। পাহাড়ের ঢাল ও টিলা সংরক্ষণের এই ‘কালচার’ যদি আমাদের দেশে মেনে চলা হতো তবে বাংলাদেশের জল-হাওয়া আরও ভালো থাকতো। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ। প্রকাশক রুহিনা হক, ঘাস প্রকাশন, মাছুদিঘির পাড়, সিলেট থেকে বইটি বের করেছেন। মুদ্রক, ছাপাকানন, সিলেট। উল্লেখ্য ছাপাকানন, ঘাস প্রকাশনার সিস্টার অরগেনাইজেশন। বইয়ের মূল্য রাখা হয়েছে টাকা ২০০/-। বিনা খরচে শিলং ভ্রামণিকদের জন্য এটি সস্তা বলা যায়।

লেখক জুলফা হক নাম্নী তাঁর কন্যার নামে বইটি উৎসর্গ করেছেন লেখক। জুলফা বর্তমানে ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষারত। স্নেহপ্রবণ পিতার মনে কন্যার আসন যে অম্লান, তা এখানে দেখা যায়।

‘প্রবেশিকা’-তে লেখক তাঁর ভ্রমণপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের চিত্র মিতকথনে বর্ণন করেছেন।

এক কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে লেখক শিলং দেখতে গেছেন এবং সংগত কারণেই সাধ্যমতো তিনি বিভিন্ন স্থানের সচিত্র বর্ণন করেছেন যা পাঠককে মুগ্ধ করবে। লেখক ১২-১০-২০২৩ থেকে ১৫-১০-২০২৩ পর্যন্ত শিলং ভ্রমণ করেছেন; ভ্রমণকালীন প্রতিদিনের কড়চা স্থান পেয়েছে এই বইতে। যাঁরা এই সফরের সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরা হচ্ছেন সহধর্মিণী রুহিনা হক সীমা, পুত্র জুলফিকার হক রাফিন, অনুজ আমিনুল হক বেলাল, তাঁর সহধর্মিণী রাহমিনা ইয়াসমিন, ভ্রাতুষ্পুত্র মাহির দাইয়ান, আজমাইন আদিল এবং বেলালতনয় সামায়রা আফরিন। লেখক ও তাঁর ভাইয়ের পরিবারের সদস্যদেরে নিয়েই এ ভ্রমণ।

লেখক ভারতীয় ইমিগ্রেশনের কাজকর্মের বাস্তব বর্ণনা দিয়েছেন। লেখকের দৃষ্টি থেকে ওয়েটিংরুমে পাখা ও বাতি না-থাকার বিষয়টিও এড়ায়নি। দুটি গাড়িতে করে ওনারা রওনা হয়েছেন ওই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলা রাস্তায়। বিশাল পাহাড় কেটে রাস্তা করা হচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে পাহাড়ের অস্তিত্ব হারানোর বেদনায় মর্মাহত লেখক। ডাউকির ঝুলন্ত সেতু দেখে মুগ্ধ লেখক। ১৯৩২ সালে নির্মিত এই সেতুর ডিজাইনার ছিলেন প্রকৌশলী জনাব আবিদুর রেজা। এ সংবাদ জেনে তিনি আনন্দিত হয়েছেন।

বরহিল জলপ্রপাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য লেখকের প্রাণে শিহরণ দিয়ে গেছে। পথিমধ্যে তিনি দেখেছেন কিনরেম জলপ্রপাত ও ক্লিনভিলেজ। পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন ক্লিনভিলেজ দেখে লেখক হারিয়ে গেছেন ভাবনার জগতে। পথিমধ্যে শিবলিঙ্গ দর্শন করেছেন এবং ছবি তুলেছেন। বর্ণনাতে আছে লিভিং রুট ব্রিজ। আজ প্রাকৃতিক সেতুও বলা যেতে পারে। প্রকৃতি নিজের খেয়ালখুশিমতো বয়ে যাওয়া ঝরনার উপর সেতু তৈরি করেছে গাছের ডালপালা ও শিকড় দিয়ে। লেখক লিভিং রুট ব্রিজের বর্ণনা দিয়েই ক্লান্ত হননি, ছবি সংযোজন করে আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করেছেন। তাঁর ভ্রমণে নজরে পড়েছে ‘ফার্স্ট ইন ঢাকা’। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টই বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী হিসাবে প্রথম ঢাকার পাকিস্তানি সৈন্যকে আক্রমণ চালায়। এই স্থাপনা লেখককে নিয়ে যায় বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনে।

লেখক শিলং ঘুরতে গিয়ে সিনরাং সিয়াম গুহায় প্রবেশ করেছেন। এসব গুহা প্রাচীনকালে রাজারা বিশ্রামস্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। আস-সিয়াম ফলসের জলের শব্দ তাঁর ভ্রমণক্লান্তি দূর করেছে। এছাড়া আরও অনেক ফলস এবং গুহায় দুঃসাহসিক প্রবেশ পাঠককে নিয়ে যাবে প্রাকৃতিক দৃশ্য দর্শনের এক মনোরম জগতে। লোকলিকাই জলপ্রপাতের ইতিহাস জানলে পাঠকের গা শিউরে উঠবে। ইকোপার্ক দেখে রেস্টুরেন্টে চা খাওয়ার সময় খাটো প্রকৃতির খাসিয়া মেয়েটি লেখকের পুত্রের দিকে যেভাবে তাকিয়ে দেখছিল এতে লেখক ভাবছিলেন, ছেলেটির উপরে ওই মেয়ের কুনজর পড়ে কি না। ভাগ্যিস তিনি রক্ষা পেয়েছেন। এমনি দৃষ্টিনন্দন লেক, ক্যাথেড্রালচার্চ ইত্যাদির বর্ণনা বইটিকে প্রাণবন্ত করেছে। বইয়ের শেষে সহৃদয় শিলং-ভ্রমণেচ্ছু মানুষের জন্য রচয়িতা সাতটি তথ্য দান করেছেন যা ভ্রামণিকদের গাইডলাইন বলা যায়। পাঠকগণ বইটি পড়লে বিনা খরচায় শিলং ভ্রমণ করে আসতে পারবেন। কাজেই এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।


লেখক : প্রাবন্ধিক

COMMENTS

error: