শান্তিগঞ্জের মানুষ উৎসব || ইভা রায়

শান্তিগঞ্জের মানুষ উৎসব || ইভা রায়

মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের অন্বেষণ যারা করেন, তারাই বাউল। মানুষ হওয়ার সাধনায় ব্রতী তারা।অল্পে সন্তুষ্ট থাকার দীক্ষা দেন। সুর আর সংগীতকে আশ্রয় করে অনায়াসে অতিক্রম করে যান বৈষয়িক জগতের লাভ আর লোভের সাগর যেখানে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা অধিকাংশ মানুষ। কোথায় আমাদের শান্তি? কে দিতে পারে আমাদের শান্তি? কী দিতে পারে আমাদের শান্তি? আমরা জানি না; তাই ছুটছি আর ছুটছি। ‘বাহির-পানে’। পাড়ি দিচ্ছি সাগর, মহাসাগর।অথচ শান্তি তো দূরের কেউ নয়। ‘সে’ যে অতি কাছে। তাই বাউল বলেন, “মনের মানুষ অতি ধারে”। বাউলদের এই গানে গানে জীবন অন্বেষণ, শান্তি অন্বেষণের এক চমৎকার উদযাপনের আয়োজন করে শান্তিগঞ্জের ‘মানুষ উৎসব’।

‘মানুষ উৎসব’ নামে যে একটি চমৎকার উৎসব সুনামগঞ্জ শহরের অদূরে শান্তিগঞ্জ উপজেলার উজানীগাঁও গ্রামের বাউল লাল শাহের উদ্যোগে তারই আঙিনায় গত এক যুগের বেশি সময় ধরে হয়ে আসছে, তা আমার জানা ছিল না। হয়তো আমার মতো আরও অনেকেরই জানা নেই। গতকাল সেখানে যাওয়াটা আমার পক্ষে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাই লিখে রাখতে চাই। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই তাদের প্রতি, যাদের আমন্ত্রণ ও সহযোগিতায় আমি খানিকটা হলেও এ-অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি।

এ ছিল বাউলদের মেলা, গানের মেলা আর সংগীতপ্রেমী মানুষের সম্মিলন। উৎসবের রঙে রঙিন মানুষের উৎসব। শহুরে কৃত্রিম জীবনের ছোঁয়া থেকে এখনও মুক্ত, সহজ, সরল, গ্রামীণ জীবনের পরিবেশেই এ-রকম ‘মানুষ উৎসব’ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। শহরের কৃত্রিম পরিবেশ আর অধিকাংশ মেকি মানুষের মাঝে হয়তো সেই স্বাদ অনেকটাই হারিয়ে যেত। অবাক করা বিষয় হলো, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারত থেকেও এসেছেন দুইজন গুণী বাউল শিল্পী। বাউল গানের অপূর্ব সারল্য ও সুরের মাধুর্যে অনুষ্ঠানকে ভরিয়ে দিয়েছিলেন তারা। কী সহজেই অনুষ্ঠানটি হয়ে গেল অনাড়ম্বর, সাধারণ পরিবেশে একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশনা! যোগ দিয়েছেন এলাকার পরিচিত এবং প্রিয় অন্যান্য বাউল শিল্পীরা, তাঁদের স্বজন, সজ্জন আর শিশু সহ নানা বয়সের গ্রামবাসীরা। ছিলেন এলাকা ও এলাকার বাইরের কয়েকজন গণ্যমান্যরাও। আর এমন বাউলমেলায় যাওয়া, সাধারণ হয়ে যারা আজকের যুগের অসাধারণ মানুষ, তাদের কাছে যাওয়াকে প্রকৃতপক্ষেই বলা চলে ‘সাধুসঙ্গ’।

অতি সাধারণ পরিবেশ আর উদ্যোক্তার আর্থিক অসচ্ছলতার মাঝেও গ্রামবাসীদের সহযোগিতায়, আন্তরিকতার প্রাচুর্যে কোনোকিছুর কমতি মনে হয়নি। বরং আড়ম্বরপূর্ণ অনেক অনুষ্ঠানই ম্লান হয়ে যাবে এই উৎসবের কাছে। বাউল লাল শাহের আন্তরিকতা পরতে পরতে তার মানুষ রূপের পরিচয় দেয়। আচার, আচরণে বিনয় ও সৌন্দর্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক লোকের মাঝে দেখতে না পেলেও তাদের মাঝে দেখেছি। একটা অতি সাধারণ ঘর। তার উঠানেই এই আয়োজন। সারা গ্রামবাসীকে নিয়ে তাদের সহযোগিতায় বছরে একবার এ-রকম প্রাণের উৎসবের আয়োজন করা আসলেই এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ উদ্যোগ। একেই বলে ‘মনে ধনী’ হওয়া। শুধু গান নয়, সাথে ছিল আন্তরিক পরিবেশে সবার জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ও আলাপন। চমৎকার একটি উৎসবস্মারক প্রকাশনা হাতে পেয়ে বুঝতে পারি, এই উৎসবের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে সাহিত্য ও সুর সংবেদনশীল নানা সাধুজনের।

হাছন রাজা, বাউল শাহ আবদুল করিমের খ্যাতি আজ দেশকে ছাড়িয়ে অনেক দূর পৌঁছে গেছে। কিন্তু এই সুনামগঞ্জে আরও এমন অসংখ্য বাউল আছেন যাদের হয়তো সেই খ্যাতি নাই, কিন্তু অন্তরের ঐশ্বর্যের আলোকে তারা আলোকিত। তাদের সংগীতের স্রোতে ভেসে যেতে পারে বিভক্ত সমাজের নানামুখী বিরোধ আর বিভেদের প্রাচীর। নীরবে, নিভৃতে এসব সুরসাধকেরাই সমাজের আত্মিক অসুস্থতা নিরাময়ে অবদান রাখতে সক্ষম। সংগীতের শুদ্ধ প্রভাবে বিশ্বাসী এই সাধকেরা আমাদের অন্তরে পরিশুদ্ধির বারি ঢেলে দেন। আমাদের তপ্ত হৃদয় সিক্ত হয়। প্রাণে প্রাণ সঞ্চার হয়। আমরা ঋদ্ধ হয়ে ঋণী হই তাদের কাছে।

সবশেষে বলব, ধন্য সুনামগঞ্জের মাটি যেখানে এমন লাল শাহদের জন্ম হয়, যারা ‘মানুষ উৎসব’ করেন। এমন উৎসব বারবার হোক, আরও বেশি মানুষ যুক্ত হোক মনের কালি থেকে মুক্ত হওয়ার পথে। ছড়িয়ে যাক্ ‘মানুষ উৎসব’-এর আলো ও এর শুদ্ধ প্রভাব।


COMMENTS

error: