রবীন্দ্রনাথ ও হার্মোনিয়াম || রুবি মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ ও হার্মোনিয়াম || রুবি মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথের গানের (প্রকৃতপক্ষে সমগ্র রবীন্দ্র-নন্দনতত্ত্বের) নিজস্ব সংসারটি ছিল শান্তিনিকেতনে এবং সেখানে এই (হার্মোনিয়াম) যন্ত্রটি নিষিদ্ধ ছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই নির্দেশে। শৈলজারঞ্জন জানিয়েছেন, ‘শান্তিনিকেতনে এসে দেখলাম হারমোনিয়ামের প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই যন্ত্র আর ছুঁয়েও দেখিনি।’ (রবীন্দ্রসংগীতচিন্তা)। শান্তিদেব ঘোষও তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন, ‘১৯২২ সাল থেকে অর্থাৎ বিশ্বভারতীর যুগ থেকে হারমোনিয়াম যন্ত্রটির ব্যবহার গুরুদেব শান্তিনিকেতনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।’ (জীবনের ধ্রুবতারা, দেশ, ১৮ নভেম্বর ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১১৮)। কলকাতা রেডিওর তৎকালীন স্টেশন-ডিরেক্টরকে রবীন্দ্রনাথ ১৯ জানুয়ারি ১৯৪০ তারিখে লিখছেন, ‘I have always been very much against the prevalent use of harmonium for the purpose of accompaniment in our music and it is banished completely from our Ashrama. You will be doing a great service to the cause of Indian music if you can get it abandoned from the studios of All India Radio.’ (রবীন্দ্রভাবনা, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মুখপত্র, জানুয়ারি-জুন ২০০০, পৃষ্ঠা-১০৯)। এ-ও ভেবে দেখার মতো যে, যেসব সংগীতশিল্পী আজীবন শান্তিনিকেতনেই অতিবাহিত করেছেন (বিখ্যাতদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন এবং স্বয়ং শান্তিদেব ঘোষ), তাঁরা কেউই যন্ত্রটি বাজাতে পারতেন না। কারণ, বাজানোর সুযোগ পাননি। রবীন্দ্রনাথের সংগীতজীবন সম্পর্কে কৌতূহলের সীমা কেবলমাত্র তাঁর জোড়াসাঁকো অধ্যায় পর্যন্তই সীমিত থাকলে রবীন্দ্রসংগীতে যন্ত্রানুষঙ্গ প্রসঙ্গে যে-কোনও সিদ্ধান্তই অপরিণত থেকে যাবে। যন্ত্রটি রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না, এটাই শেষ কথা। কেন করতেন না — সেটাও তো ‘সংগীতচিন্তা’-র পাঠক মাত্রেই জানেন।

গানপারটীকা : গানপারে এই ক্ষীণকায় নিবন্ধটা আমরা ছাপছি বিশেষ একটা আগ্রহের জায়গা থেকে; সেইটে এ-ই যে, বাংলা গানে ব্যবহৃত/ব্যবহার্য যন্ত্রবাদ্য নিয়া, খাস করে যুগধর্মের হাওয়ায় আগত নয়া বাদ্যযন্ত্রাদি মিউজিকে আপ্লাই নিয়া আহাজারি-ছিছিক্কার করেন যারা, আজও শ্রোতা-ভোক্তা-সমুজদার যারা খানিকটা ক্ল্যাসিক মিজাজমর্জি নিয়া হাঁটেন-ফেরেন তাদের মধ্যে ওয়েস্টার্ন মিউজিক-ইন্সট্রুমেন্টস্ নিয়া খামাখাই ভীতি ও বিরক্তি প্রকাশিতে দেখি। বিশেষত সমুজদার সংগীতবিজ্ঞ বলিয়া খ্যাত এই শ্রোতৃবর্গ কথায় কথায় যাদেরে সাক্ষী মানেন, রবীন্দ্রনাথ তন্মধ্যে একজন। অথচ রবীন্দ্রনাথ সময়ের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন সংগীতে যন্ত্রের ব্যবহার বিষয়ে। এই ইশ্যুটা আমরা কাভার করতে চাই সিরিজ আকারে একটা ধারাবাহিকী নিবন্ধগুচ্ছে; এবং বর্তমান রচনাটা আমাদের অভিপ্রেত রচনাবাহিকীর প্রাকজমি প্রিপেয়ার করতে হেল্পফ্যুল বিবেচনায় আগেভাগে ছাপিয়ে রাখছি।

বিশেষ উল্লেখের দরকার বোধ করছি এই কথাটা যে এখনও অধিকাংশ সংগীতশ্রোতা ভাবেন, মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করেন অন্ধ একগুঁয়ে, বলিয়াও থাকেন হামেশা যে রবীন্দ্রনাথের গান আর হার্মোনিয়ামের যন্ত্রণা আবহমান সত্যের মতো হরিহর আত্মা। আশ্চর্য যে, ফ্যাক্ট একদমই উল্টা। আমরা আগামী দিনগুলোতে স্রেফ রবীন্দ্রনাথের ‘সংগীতচিন্তা’ আকর হিশেবে ব্যবহার করে বেশকিছু প্রসঙ্গ পুনরবলোকনের জন্যে পেশ করব। বলবার কথা বর্তমানে এইটুকুনই।

নিবন্ধটা আমরা ভারতের ‘দেশ’ পাক্ষিকের চিঠিপত্র বিভাগ থেকে আহরণ করেছি। চিঠিটি লিখেছিলেন কলকাতা থেকে ‘দেশ’ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক রুবি মুখোপাধ্যায়। এবং চিঠিটার পূর্বানুবৃত্তি হিশেবে এইটুকু বলা যায় যে ২ সেপ্টেম্বর ২০১২ সংখ্যা পাক্ষিক দেশের ‘শিল্পসংস্কৃতি’ বিভাগে ‘কথা ও সুর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানরিভিয়্যু ধরনের একটা আলোচনা পাঠোত্তর ১৭ ডিসেম্বর ২০১২ সংখ্যায় চিঠিলেখক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। পূর্ণ পত্রটা আমরা প্রাসঙ্গিকতা রাখতে যেয়ে নিই নাই, আদ্ধেক নিয়েছি। চিঠির পরবর্তী অংশে গানের পরিবেশনাগত ত্রুটি নিয়া পত্রকারের প্রতিক্রিয়া আছে, যেইটা আমাদের আপাতত দরকার নাই। কিন্তু বোঝা যায় যে পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানরিভিয়্যুয়ারের আলোচনায় ঠাকুরের জোড়াসাঁকো অধ্যায়ের গানজীবনটাকেই নিশানা মানা হয়েছিল, পত্রকারের বিবেচনায় যা আদৌ সমীচীন নয়।

এছাড়া আমরা এই পত্রকারের বিত্তান্ত কিছুই জানি না। খালি চিঠির নিচে নামপ্রকাশের ডানে ঠিকানা আছে কলকাতা-৭০০০৪০। — গানপার

… …

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: