আদালত ও একটি মেয়ে

আদালত ও একটি মেয়ে

সিনেমার প্রথম দৃশ্যটাই দর্শকের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরি করবে। কী হয়েছে মেয়েটার? মেয়েটি পানির মধ্যে কী করছে? মেয়েটি কি ডুবে যাচ্ছে? মেয়েটি কি দুর্ঘটনাবশত পানিতে পড়েছে? নাকি মেয়েটি আত্নহত্যা করেছে? হাল-আমলের সিনেমাদেখা চোখ বিভ্রান্ত হতে পারে যে, ব্যাকগ্রাউন্ড সুরের তালে এটি হয়তো পানির মধ্যে কোনো মেয়ের নৃত্যরত দৃশ্য। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ সিনামার সূচনাদৃশ্য দর্শকের মনে এমনই অনেক প্রশ্ন তৈরি করতে বাধ্য।

সিনেমাশুরুর প্রথম দৃশ্যে দেখা গেল একটি সিলিংফ্যান ধীরে ধীরে ঘুরছে। দীর্ঘসূত্রিতা ও অস্বস্তি। প্রতীকী এই দৃশ্যের মধ্যেই অবতারণা কালো কোটপরা একজন উকিলের। উকিলের কথায় বোঝা গেল যে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। উকিল বিচারককে জানালেন, ধর্ষণের কেসটি কীভাবে কী কারণে ঘটনাস্থল থেকে সরে এই আদালতে এসেছে এবং আসামীদের একবার জামিনের পরও কীভাবে আবার বিচার শুরু হয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাপসা হয়ে উঠল উকিলের মুখ। পটভূমির পরিবর্তন। ঝাপসা দৃশ্যটি স্পষ্ট হয়ে পরিণত হলো একটি জালে। একটু স্পষ্ট হলে বোঝা গেল যে এটা নোটিস বোর্ডের সামনের জাল। নোটিসবোর্ডে ঝুলছে স্কুলের পুজোর ছুটির নোটিস। একঝাঁক কোলাহলরত বাচ্চার পাশে দুজন শিক্ষিকাকে নিয়ে ক্যামেরা প্রবেশ করল শিক্ষিকাদের কমনরুমে। হাসিঠাট্টা-গল্পে মাতানো তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। সবাই পুজোর ছুটি কাটানোর বিভিন্ন পরিকল্পনা করছে। কিছু কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বোঝা গেল কমবয়স্ক তিনজন শিক্ষিকা মিলে ঘুরতে যাবেন গোয়ালপুর সমুদ্রসৈকতে। প্রধান শিক্ষিকা উর্মিলা। তাদের তিনজনের মধ্যে চলছে টিকিট পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে উত্তেজনা। শেষ মুহূর্তে উর্মিলার বন্ধু সুজিত ম্যানেজ করে দিলো তিনটি ট্রেনটিকিট।

কাহিনি এগোতে থাকে ধীর গতিতে। উর্মিলাদের সাথে কামরায় উঠেছে একজন লোক। ঘুমিয়ে-থাকা মানুষটির মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না, তবে বোঝা যায় যে তিনি বয়স্ক। প্রাথমিকভাবে সেটা কোনো বড় ঘটনা না, বড় ঘটনা হলো পাশের কেবিনে উঠেছে ধনী পরিবারের উচ্ছৃঙ্খল চার যুবক। চারজনই মাতাল। তাদের উদ্দাম নাচের সাথে বাজছে রেকর্ডারের মিউজিক। শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের এক-পর্যায়ে চারজন ভদ্রসন্তানের একজন মেয়েদের কেবিনের দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার উপক্রম করে। নিরুপায় হয়ে তিনজন নারী বয়স্ক মানুষটিকে টেনে তোলে। নিরীহ মানুষটি বুঝিয়েসুঝিয়ে মাতালকে প্রায় কাঁধে করে ছেলেদের কেবিনে ফিরিয়ে দিতে যায়। বাকি তিনজনকে তাদের বন্ধুকে সামলাতে বলে। কিন্তু এই উপদেশের উল্টো প্রতিক্রিয়া হয়। এই বয়স্ক মানুষটির মাধ্যমে ওরা নারীকে কুপ্রস্তাব পাঠায়। নিরীহ মানুষটি তাদের প্রস্তাব পৌঁছে দিতে ফেরত আসে মেয়েদের কেবিনের দিকে। একটু পরে ছেলেদের কেবিনের দরজায় টোকা পড়ে। ছেলেরা উৎসাহের সাথে দরজা খুলে দেয় মেয়েদের প্রত্যাশায়। কিন্তু চমকে দেখে যে আগের মধ্যবয়স্ক লোকটি পুলিশের পোশাক পড়ে ফেরত এসেছে। পুলিশ তার পরিচয় দেয়। তার নাম ‘গোবিন্দ মিশ্র’। ডাকনাম ‘ঠ্যাঙারে গোবিন্দ’। পুলিশের কড়া আচরণে ছেলেগুলো নিরস্ত্র হতে বাধ্য হয়। গোবিন্দ তাঁর সাধারণ পোশাকে আবার মেয়েদের কেবিনে ফেরত আসেন। মেয়েদের আশ্বস্ত করেন। দর্শকদের অনুভূতি হবে যে মূল কাহিনিতে কেবল ঢোকা হলো।

এরপর যা হয় তা এখন আমাদের সমাজে অতি সাধারণ ঘটনা। দর্শকেরা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে এ-রকম দু-চারটে ঘটনা নিশ্চিতভাবেই পড়েন। গণধর্ষণের খবর পড়ায় অভ্যস্ত মনও উর্মিলার ছটফটানি দেখে কেঁপে উঠবে। উর্মিকে একা পেয়ে চারজন মিলে সমুদ্রের পানির মধ্যে গণধর্ষণ করে। দূরের মাঝি সন্দেহ প্রকাশ করলে তাদের একজন উত্তর করে, ‘সাঁতার শিখাচ্ছি’। রেকর্ডারে বাজতে-থাকা উদ্দাম বাজনায় চাপা পড়ে যায় উর্মির চিৎকার। চারজনের স্ফূর্তি শেষে বেলাভূমিতে পড়ে থাকে ধর্ষিতার দেহ।

এরপরের দৃশ্য হাসপাতালের। ছুটে-আসা দুই বান্ধবীর সাথে সাথে দর্শকের মনেও চলতে থাকে উৎকণ্ঠা। ইতোমধ্যেই তদন্তের জন্য ডাক পড়ে গোবিন্দবাবুর। তলব করা হয় উর্মির বাবাকেও। উর্মির বাবা প্রথমে সামাজের ভয়ে মামলা করতে চাননি। কিন্তু পুলিশ আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জোর করে মামলা করান। অপরাধীদের খুঁজে বের করতে গোবিন্দ শুরু করেন তাঁর তৎপরতা। বাবাকে বোঝান, বান্ধবীদের সাথে কথা বলেন, সমুদ্রসৈকতে ঘুরে ঘুরে প্রমাণ জোগাড় করেন, সাক্ষী জোগাড় করেন। এদিকে ২৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে জ্ঞান ফেরে উর্মির।

আদালত ও একটি মেয়েএরপর পাল্টে গেল উর্মির জীবন। সমাজের ভদ্রতার মুখোশ একে একে খুলে পড়তে থাকল তার সামনে। উর্মি তখন পত্রিকার খবর। আত্মীয়স্বজনেরা তাদের বিব্রত হবার জন্য উর্মিকে দায়ী করে। ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করে যে নিশ্চয় মা-মরা উর্মিকে তার বাবা ঠিকভাবে মানুষ করতে পারেনি। বাবার অফিসে সহকর্মীরা প্রতিদিন খোঁজ নেবার অজুহাতে শুরু করে নানা প্রশ্ন। অফিসের বস বাবাকে উপদেশ দেন; বলেন, “মেয়েটি আছে কেমন? সে মানসিক ভারসাম্য হারায়নি তো? এসব ঘটনার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা তো psychological হয়ে যায়। Believe me, একটা মেয়ে raped হবার পরে দেখা যায়, she started to be enjoying the rape. I mean, she used to love it.” উর্মির স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তাঁকে জানায় যে তাকে ক্লাস শুরু করার আগে গভর্নিং বডির মিটিং-এ আসতে হবে। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। এদিকে উর্মির প্রেমিক, যে সাহিত্য-রাজনীতি সহ সকল বড় বড় বিষয়ে সমজদার, উর্মির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আদালতে রুমভর্তি দর্শক আসে উর্মির কাহিনি শুনতে। কোনো কোনো পুরুষ তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়, কেউ নিচুস্বরে মন্তব্য করে। মেয়েরা পর্যন্ত তাকে দেখিয়ে কানাঘুষা করে, “medical evidence of sexual intercourse is not always evidence of rape.” প্রশ্নবানে জর্জরিত অবস্থায় উর্মিলা যখন অপমানে কাঁদছিল, তখন সেই সভ্য উকিল আবার দাবি করে, “পুলিশের সাথে ষড়যন্ত্র করে, কারও কাছে টাকার বিনিময়ে দেহদান করে, আপনি অজ্ঞান হবার অভিনয় করে পড়ে ছিলেন।” এত অপমান সত্ত্বেও উর্মি দাঁড়িয়ে থাকে তার ধর্ষণের ডাক্তারি প্রমাণ নিয়ে বাবা আর পুলিশ গোবিন্দের সহযোগিতায়।

প্রথম দিকে দুর্বল থাকলেও, পরে উর্মির বাবা হয়ে ওঠেন অত্যন্ত সাহসী। উর্মি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলে তিনি বলেন,  “বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে খেতেও হবে।” মাঝরাতে উর্মির কান্না শুনে যুক্তি করেন, “সারা পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে একটি করে রেপ হয়। তার মানে ঘণ্টায় বারোটি। আমরা একা নই উর্মি। আমাদের মতো অনেক পরিবার আছে পৃথিবীতে।” অফিসে সহকর্মীদের প্রশ্ন এড়াতে টেবিলের সামনে কাগজে বড় বড় করে টানিয়ে রাখেন, “আমার ধর্ষিতা কন্যা ভালো আছে।” অমানবিক  পৃথিবীকে এভাবেই তিনি মোকাবিলা করার পথ বের করেন।

শেষ পর্যন্ত উর্মি বিচার পায়। ধর্ষকদের শাস্তি হয়। উর্মি তার সহকর্মী আর ছাত্রদের সহযোগিতায় স্কুলের চাকুরি ফেরত পায়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের ফলে চাকুরি হারান গোবিন্দবাবু। এই আশঙ্কা শেষ অবধি থেকেই যায় যে, উচ্চতর আদালতে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপরও ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ সিনেমার রেশ মাথায় থেকে যায় উর্মিলার লড়াইয়ের কাহিনি হিশেবে। সব শেষে দর্শকের কাছে এ উত্তরই থাকবে যে সূচনাদৃশ্যের পানিতে ডুবতে-থাকা মেয়েটি আসলে বাঁচার জন্য লড়াই করছে।

‘আদালত ও একটি মেয়ে’ সিনেমাটি তৈরি করেছিলেন তপন সিনহা ১৯৮২ সালে। এতদিনে প্রতি মিনিটে ধর্ষণের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে অনেকগুণ। কিন্তু ধর্ষণ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি খুব বেশি পাল্টেছে কি? অথচ, এদেশে নির্যাতনের ঘটনা যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইও। একদিকে দিনাজপুরের ইয়াসমিনকে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি ইয়াসমিনের ধর্ষকদের বিচারের আন্দোলনে সাত ভাইয়ের শহিদি আত্মত্যাগের ঘটনাও বাস্তব সত্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসী মানিকের শত ধর্ষণের দৃষ্টান্ত যেমন আছে; তেমনি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উপাচার্য যখন অভিযোগ করল যে, “কোনো মেয়ে তো আর ধর্ষণের কথা স্বীকার করেনি।” আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে “আমাকে মানিক ধর্ষণ করেছে। আমি বিচার চাই।” – এই বলিষ্ঠ উচ্চারণও ছিল। কিন্তু এই লড়াইগুলোর কাহিনি সিনেমা বা সাহিত্যে খুব বেশি আসেনি। আসলে অবশ্যই সমাজের সবাই একটি প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারত। প্রশ্নটি হলো – ধর্ষক আর ধর্ষিতার মধ্যে শাস্তি কার প্রাপ্য?

গানপার থেকে একনোক্তা :
ম্যুভিরিভিয়্যুটি ‘অনুশীলন’ শীর্ষক সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র থেকে নেয়া হয়েছে। এর  প্রকাশকাল অগাস্ট ২০১৭, ‘অনুশীলন’ চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় লেখাটা ছাপানো রয়েছে। এই মুখপত্রটির মধ্যে একমাত্র এইটাই সিনেমারচনা, বাকিগুলো বক্তব্য-কলাম-নিবন্ধ ইত্যাদি। পত্রিকাটার সম্পাদক হিশেবে কেউ ব্যক্তিনামে হাজির নাই বিধায় কেন্দ্রীয় কমিটি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর সম্পাদক বলা বাহুল্য হয় না আন্দাজ করি। রিভিয়্যুটির রিভিয়্যুয়ার কে, সেই তথ্যও অজানা আমাদের। যিনিই লিখিয়া থাকুন না কেন, রচনাটা আমাদের কাছে গানপার-উপযোগী মনে হয়েছে। এবং মনে করি যে এই মুহূর্তে এই রচনা এবং এই সিনেমা ভাবাতে সহায়ক হবে অনেকেরেই। কিন্তু অনুশীলন পত্রিকার কারো সঙ্গে আমাদের চিনপরিচয় নাই এবং কালবিলম্ব না করে এইটা কম্পোজ করে ছেপে দেয়ার তাড়াহুড়ায় এবং সম্পাদক/রচক কারোর কোনো ব্যক্তিনাম লিপিবদ্ধ না থাকায় আমরা সামাজিক সংযোগমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়ে একটু খোঁজখবর নেবার বা প্রকাশ-অনুমোদনের মওকা পাই নাই। বিষয়টা আশা করি বিবেচনা করবেন অনুশীলনসংশ্লিষ্ট সবাই এবং গানপারের এই পুনর্মুদ্রণ সহজভাবে নেবেন।

 … …

গানপার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you