সমগীতের আড্ডায় কফিল আহমেদ

সমগীতের আড্ডায় কফিল আহমেদ

[পরিচয়পর্ব — ফর্ম্যাল ইন্ট্রো — দরকার আছে? অ্যাট-লিস্ট কফিল আহমেদ কে, কেন ও কোথাকার ইত্যাদি জিজ্ঞাসা আদৌ উঠবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশজাত গত দুই/তিন-দশকের বাংলা গানে কফিল আহমেদের কন্ট্রিবিউশন চোরাগোপ্তা হামলার মতো ঝড়ো, মূলবিস্তৃত ও অনস্বীকার্য। মূলধারা মাধ্যমিক গণপ্রচারযন্ত্রে এই শিল্পীর প্রেজেন্স নাই বিধায় ম্যাসিভ হিটের হুল্লোড়ে মারকাটারি বিবেচনায় মধ্যবিত্তবলয়িত সংগীতশ্রোতাগোষ্ঠীর নিত্যদৈনিক শ্রবণসীমায় কফিল হয়তো গরহাজির; অনুমান করা বাহুল্য হবে না যে এই মার্কেটপ্লেসে অ্যাবসেন্স কফিলের ন্যায় শিল্পীদের সচেতন ও স্বেচ্ছাচয়িত সিদ্ধান্ত। তবে এই কথাটা আবহমান বাংলা সাংগীতিক গতিপথ নিয়া যারা ভাবেন তারা মানবেন যে কফিল আহমেদ শোনার অভিজ্ঞতা আশ্চর্য উদ্দীপক, উদ্বেলক ও উদ্বোধিত হবার মতো।

কফিল আহমেদ রোজকার স্টুডিয়োঅ্যালবাম-পয়দানো প্রোডাকশনবাড়ির মুখরোচক শিকার কোনো বণিকগোত্রীয় সংগীতকার নন; মোটে একটা অ্যালবাম ‘পাখির ডানায় দারুণ শক্তি গরুর চোখে মায়া’ দিয়াই তিনি ব্রেক-থ্রু/দিশারী মিউজিশিয়্যানের আসনে অধিষ্ঠিত এরই মধ্যে; এবং বাংলা গানের দিগন্ত ও গন্তব্য যারা গায়েগতরে খেটে মেধাশাঁসটুকু লগ্নি করে একটু হলেও অপূর্বভাবিত উন্নয়নে সচেষ্ট, দূরপ্রসারিত করে যেতে প্রয়াসী যারা গানের দিকচক্রবাল ও গোলার্ধ, কফিলের এই একটা অ্যালবাম তাদের কাছে বিশেষভাবেই দ্রষ্টব্য। অনানুষ্ঠানিক উপায়ে ধারণকৃত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বিপণনতরিকায় বাজার এড়িয়ে শ্রোতাহাতে প্রেরিত সংগীতসংকলনটির অভিঘাত গত দুই-দশকের বাংলা গানে-বাজনায় কেমন, তা আন্দাজ করি লিস্নার মাত্রই জানেন। পরে কখনো এই অ্যালবাম ও এই মিউজিশিয়্যানের সংগীতযজ্ঞ নিয়া আমরা ‘গানপার’ থেকে একটা আলাপ জোড়ার চেষ্টা চালাব।

তবে এখানে এটুকু শুধু বলে যাওয়া যাক যে একলষেঁড়ের মতো কফিল আহমেদ দুনিয়ার উদাত্ত সংগীতপ্রান্তরে অ্যালবামপ্রতিযোগ ও বাজার-মাতানো হুজ্জোতি বিকিকিনি প্রক্রিয়ার চটকভরা হাতছানি থেকে নিজেকে তফাতে রেখে বাংলাদেশের গানে এবং সুরবিশ্বের তৃণমূলনিংড়ানো সংস্কৃতিকৃত্যাদিতে একটানা কাজ করে চলেছেন, সুরের সৌহার্দ্যে অসুরের প্রতিবাদে তৎপর রয়েছেন, অনুপ্রেরণাব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন গত দুই-দশকের কালপরিসরে আবির্ভূত অসংখ্য সংগীতশিল্পী — ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক কলানুশীলক গোষ্ঠী — এবং সর্বোপরি ভিন্নস্বরসন্ধিৎসু সংগীতসমুজদারদের কাছে।

এই দীর্ঘ ও ধারাবাহিক ‘আড্ডা’ নামধেয় রচনার প্রথম কিস্তিটিতে আমরা কফিল আহমেদের কিছু বক্তব্য শোনার সুযোগ পাবো — ‘গণসংগীত’/‘শ্রমসংগীত’ ঘিরিয়া আলাপটা আবর্তিত হয়েছে মুখ্যত — শুনব কথাগুলো অন্তরঙ্গ ও বিস্তারিত ধরনে। এই রচনাটা ৪/৫টা কিস্তিতে প্রকাশের পরিকল্পনা ‘গানপার’ ঘোষণা দিয়া রাখছে গোড়াতেই। কিস্তিগুলো প্রকাশ/উত্তোলনকালে একেকটা গানপারভাষ্য জুড়ে দেয়ার প্ল্যানও রয়েছে; দেখা যাক-না, বাকিটুকু কতটা পারা যায়। এবং, বলা বাহুল্য, ভূমিকাপ্রতিম গানপারভাষ্যগুলোতে কিস্তিপ্রাসঙ্গিক তথ্য, সংযোজনী মন্তব্য প্রভৃতি পাঠকপাতে কিছুটা আগায়ে দেবার চেষ্টাটা থাকবে প্রেজেন্টেশনের সৌকর্য ও সৌন্দর্য রক্ষার খাতিরে।

19894450_10211100365277608_264424461_n19894417_10211100365597616_1989182735_nএইটা ‘ধাবমান’ (‘সাহিত্য আন্দোলনের ছোটকাগজ’) পত্রিকায় পাব্লিশ হয়েছিল ২০০১ ফেব্রুয়ারিতে। এই পত্রিকার সম্পাদক আবীর পরশ। সম্পাদকই গোটা আড্ডার সূত্রধর ও মুখ্য সঞ্চালক; যদিও সম্পাদক ও আলাপচক্রের মুখ্য ব্যক্তিত্ব কফিল আহমেদ ছাড়া আড্ডায় আরও অংশ নিয়েছেন সংগীতশিল্পী ও নাট্যকর্মক অমল আকাশ এবং কবি ও ছোটকাগজসম্পাদক কাজল কানন। গোটা আড্ডাটা ঠাসবুনুনি প্রিন্টেড ফর্ম্যাটে প্রায় পঁয়তিরিশ পৃষ্ঠায় ব্যাপ্ত, অর্থাৎ ফর্মার মাপে মেরেকেটে আড়াই-ফর্মা মিনিমাম; প্রত্যেকেরই বক্তব্য অত্যন্ত দীর্ঘ ও অযথা জাড্যকবলিত এবং বিস্তারিত। ফলে, বেশ-অনেকটা ক্লান্তিকর মনে হতে পারে এইটা পাঠকালে। এবং প্রকাশকালে এর শিরোনামে ‘আড্ডা’ শব্দটা থাকলেও বোধহয় এইটা আড্ডার চেয়ে একবক্তা ভাষণেই রূপ নিয়েছে, একটানা বলে গেছেন প্রত্যেকেই বিরামহারা প্যারাগ্র্যাফে, অ্যাট-লিস্ট গ্রন্থনার আদলটা আড্ডার আটপৌরে আরাম দেয় না, যে-কারণে ব্যাপারটা পাঠকবান্ধব হয়ে ওঠে নাই। কিন্তু সমস্যা তাতে তেমনকিছু হয়েছে মনেহয় না; যারা গানের সুলুক সন্ধান করে বেড়ান, তারা আয়েশী না-হয়ে একটু শ্রমনিষ্ঠ হয়ে থাকবেন অনুমান করা যায়। এই আড্ডা/আলাপটা কাজেই উপভোগ্য/প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে পাঠকের কাছে ক্রমশ।

‘ধাবমান’ পত্রিকার ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় এই রিডিং-ম্যাটেরিয়্যালটা ছাপানো হয়েছিল; সম্পাদনায় আবীর পরশ, প্রচ্ছদচিত্রী অমল আকাশ এবং পত্রিকার পাঁচ-সদস্যবিশিষ্ট পরামর্শক পর্ষদের মধ্যে কফিল আহমেদও রয়েছেন দেখা যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি ২০০১ সনে প্রকাশিত পত্রিকাটা ‘ধাবমান সাহিত্য আন্দোলন’ কর্তৃক নারায়ণগঞ্জ থেকে বেরিয়েছে। এখন বোধহয় প্রিন্ট খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না হাটেবাজারে একটাও। পরিবর্তিত প্রযুক্তিস্ফীতির জমানায় এই রিডিং-ম্যাটেরিয়্যালটা আর-কোথাও সংরক্ষিত/পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে বলে গোচরে আসে নাই। ইন-দ্যাট-সেন্স এইটা তো নতুন লেখাই! কিংবা প্রাচীন হলেও কি-বা আসে যায়, যেহেতু পুরানা চাউলের প্রবাদটা বাংলাবিদিত।

প্রথম কিস্তি পড়ে সেরে নেক্সট কিস্তির জন্য শুরু করি অপেক্ষা। — গানপার]

Kafil.png

__________

“আমার কাছে সংগীত অবশ্যই সকল প্রাণ ও প্রাণপ্রবাহের একটা একীভূত ঐকতান”

সমগীতআড্ডায় কফিল আহমেদ

আড্ডায় অংশগ্রাহীবৃন্দ :: অমল আকাশ ।। কাজল কানন ।। আবীর পরশ

আড্ডাস্থান :: ধাবমান ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা
পাব্লিশড ইন ফেব্রুয়ারি ২০০১
__________

সম্পাদক :: সংগীত বিষয়ে আমাদের অনেকেরই প্রাথমিক ধারণা আছে এবং আমরা অনেকেই পারফর্মারের চেয়ে শ্রোতাও বটে। সেজন্যে সংগীতের প্রতি আলাদা একটু দরদ থাকা স্বাভাবিক। আমরা চাচ্ছি, সংগীত বিষয়ে কিছু সিরিয়াস কাজ। সেজন্যই আমরা সংগীতবিষয়ক এই আড্ডায় মিলিত হয়েছি। এখানে এসে আমি একটি বই পেয়ে গেলাম, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের — ‘গানের বাহিরানা’ — মৈনাক বিশ্বাস বইটির সম্পাদনা করেছেন। এই বইয়ের ভূমিকার শেষ অংশটুকু পাঠ করছি, “গণসংস্কৃতি আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে, গণনাট্যের কর্মী হিসেবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তৈরি করেছেন তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থান। এই পরিপ্রেক্ষিতকে কোনো অবস্থাতেই ভুলে গিয়ে এই বইয়ে লেখাগুলোকে পড়া যায় বলে মনে হয় না এবং আরো লক্ষ করবার যে, মার্কসবাদের কোনো সরল প্রয়োগে তাঁর আস্থা নেই, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। (কথাটা আবার পড়ি : ‘মাকর্সবাদের কোনো সরল প্রয়োগে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আস্থা নেই, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া’ — সম্পাদক) ঐতিহ্য বা আধুনিকতার প্রশ্নে তার অবস্থানকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, অথবা জাতীয়তা-আঞ্চলিকতা-আন্তর্জাতিকতার সম্পর্ক অনুধাবনের চেষ্টায়। দেশাত্মবোধক গানের থেকে গণসংগীত কোথায় আলাদা — এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যেমন বলবেন, প্রথমটির জাতীয়তাবাদ থেকে দ্বিতীয়টির আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে উত্তরণের কথা, আবার গণসংগীতের সৃষ্টিপথকে ফিরিয়ে আনতে চাইবেন লোকসংস্কৃতির প্রবাহিত ঐতিহ্যে। লোকসংস্কৃতির স্রষ্টারা নিজেরাই নিজেদের মুখোমুখি হচ্ছেন, নিজেদের নবজীবনের গান লেখবার তাগিদে। এইরকম একটি স্বপ্নপ্রকল্পকে অবলম্বন করে লিখে গেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই লেখাগুলো একটি বিশেষ অর্থে গণনাট্য আন্দোলনেরই সৃষ্টি।”

আমরা এই ভূমিকার অংশ বিশেষ পড়লাম। আমরা জানি যে, আমাদের দেশে জনগণকে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ (আইপিটিএ)-র একটা বেশ ভূমিকা ছিল এবং তখন বেশকিছু গণসংগীত রচনা করা হয়েছে। সেই গানগুলো আমাদের বিভিন্ন সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষকে উদ্দীপিত করেছে, উজ্জীবিত করেছে। তো সেই গানগুলো আমাদের সংগীতের ভাণ্ডারে বিশেষ সম্পদ। সেই চারের দশক, পাঁচের দশক, ছয়ের দশক পার হয়ে গণসংগীতধারাটি আজ খুব ম্রিয়মাণ। এখন শুধু সেই গানগুলোরই অনেকটা বিবর্তন কোথাও কোথাও হচ্ছে। তার পরবর্তী গানটাকে আরো বেশি জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য অনেকে একটু একটু চেষ্টা করেছেন, জনগণের মনের ভাষা বা কথা বলবার ভাষাকে রপ্ত করার মধ্য দিয়ে।

গণসংগীত বললে, একধরণের বিশেষ সংগীতের কথাই আমরা ভাবি এবং সে-গানের ধরন সম্পর্কে আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকি — ‘এখন গণসংগীত পরিবেশন করা হবে’ বললেই শ্রোতারা সে-সম্পর্কে বুঝে যায় এবং অনেকেই তারপরে আর কান দিতে চায় না। ভাবে, — এটি গুরুত্বহীন এবং বিরক্তি উৎপাদনের গান। কিন্তু ‘গণনাট্য সংঘ’-এর সময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীতগুলোই অনেক লোকে শুনত। রাজনৈতিক বক্তৃতা শেষে অনেক রাত পর্যন্ত গান, নাটক এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের জন্য মানুষ অপেক্ষা করত, শুনত। এখন সেই জায়গাটা এমন হয়ে গেছে যে, ‘গণসংগীত’ শুনলেই বিরক্তি মনে করে লোকজন উঠে যায়, শুনতে চায় না, আগ্রহ প্রকাশ করে না। আর, তাছাড়া এখনকার সময়ে এটি হয়ে উঠেছে হেলাফেলার জিনিস। যে-বামরাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত গণসংগীতকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, তারাও কিন্তু এই গণসংগীতকে যেন অনেকটা ভাত খাওয়ার পর পান খাওয়ার মতো করে দেখে। রাজনৈতিক আলোচনা বা বক্তৃতার মতোই যে গণসংগীতও একটি সমান গুরুত্বের জিনিস, তা যেন তারা অনেকেই উপলব্ধিতে নিতে চান না। এজন্য সংগীত পরিবেশনার অংশটুকুকে তারা অনেকটা হেলাফেলাভাবে উপস্থাপন করেন। এজন্যও গণসংগীতের শ্রোতা যেমন কমছে, তেমনি গণসংগীতের পারফর্মাররাও চর্চার অভাবে অনেক সময় বেসুরো গলায় বা দুর্বল করে গান। এতে করে শ্রোতাদের একধরনের বিরক্তির কারণ তৈরি হয়। পাশাপাশি আধুনিক গান বা এ-জাতীয় অন্যান্য গানগুলোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।

গণসংগীতের এই সমস্যাগুলো — ভালো গান হচ্ছে না, জনগণের জন্য সংগীত অথচ জনগণ শুনছে না, সমস্ত সংগীতের মধ্যে গণসংগীতের অবস্থান কোথায়, লোকসংগীতের সাথে গণসংগীতের কি সম্পর্ক, উচ্চাঙ্গ-রবীন্দ্র-নজরুল সহ সব ধরনের সংগীত সম্পর্কে আমাদের ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বাঙলা কবিতার মতো আধুনিক বাঙলা গানের ধারায়ও পঞ্চপাণ্ডবের কথা বলা হয়। এরা হলেন, — রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। এই আধুনিক বাঙলা গানের ধারারই বিবর্তনে এসেছে আজকের চিহ্নিত গণসংগীত বা অনেকে এর নাম দিয়েছে জীবনমুখী গান। এ ধরনের গানের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে ‘আইপিটিএ’ বা ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন যার পুরোধা পুরুষ। সলিল চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, নির্মলেন্দু চৌধুরী, কলিম শরাফী, ভূপেন হাজারিকা, রমেশ শীল, মুকুন্দ দাস, আলতাফ মাহমুদ, পিন্টু ভট্টাচার্য — এঁদের পরে বেশ কিছুটা শূন্যতার পর এ-ধারায় সম্প্রতি বেশ কিছুটা উজ্জ্বলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়। সুমনকে ওখানে, ওপার বাঙলায়, অনেকে বর্তমানে মধ্যবিত্তের জনপ্রিয় গান গাইতে দেখছেন এবং পরবর্তীতে প্রতুল আবার আরো কম ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে খালি গলায় গানকে সকলের উপলব্ধির একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এবং সেখানে অনেকে গান শুনছে আগ্রহভরে এবং অনেকে আন্দোলনের জন্যও প্রেরণা পাচ্ছে। আমাদের এখানে, এপার বাঙলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে, নতুন ধরনের গানের ক্ষেত্রে, মানুষকে রক্তের ভেতর দোলা লাগানোর গানের ক্ষেত্রে, একটি ঘাটতি ছিল এবং এটা অনেকে বলেছেন যে আমাদের এখানে দেশবিভাগের পরে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং আমাদের একটি জাতি হিসাবে, জাতীয়তাবোধ এবং একটি সমৃদ্ধির জায়গায় যেতে যে শূন্যতা, সেই শূন্যতার ফলে সম্ভবত এখানে-যে সেই ধরনের মেধাবী লোকজনের একটুখানি ঘাটতি দেখা দিয়েছিল, সেই ঘাটতির জায়গাটা উপলব্ধি করে তা মেটানের জন্য এখন অনেকের মধ্যে, বলা যেতে পারে বাংলাদেশে ইয়াং ফোর্সের মধ্যে, এখন সেই প্রেরণাটা বোধটা আসছে, অনেকে নতুন গান নতুন সুরে করার চেষ্টা করছেন এবং মানুষকে সেই গান দ্বারা উদ্বুদ্ধ করার জন্য, মোহিত করার জন্য, উজ্জীবিত করার জন্য চেষ্টা করছেন। সেখানে আমরা, আমাদের এই বাংলাদেশে, এই গানের ক্ষেত্রে অল্প কয়েকজনের নাম পাই। দেখি, এর আগে আমাদের যে গণসঙ্গীতের জায়গাটা ছিল সেটা কিছুটা ম্রিয়মাণ। আমাদের দেশের এখন যে মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়ে পপগান, ব্যান্ডগান — এ-জাতীয় পাশ্চাত্য সংগীতের কিছু দ্রুত বিট-লয়ের গানে মেতে থাকছে কিন্তু সেই গানগুলো আবার আপামর শ্রমিক-কৃষকদের আকৃষ্ট করছে না।

আমরা সেই শ্রমিকের গান, কৃষকের গান গাওয়ার জন্যে এবং তাদের মনের ভাবটাকে প্রকাশ করার জন্যে কয়েকজনকে দেখছি। সেখানে আমাদের মধ্যে আছেন, আমার সামনে কফিল আহমেদ একজন, আমার পাশে আছে অমল আকাশও একজন, যারা গান নিয়ে নতুন করে ভাবছেন, নতুন করে সুর দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং আমাদের আড়ালে হয়তো-বা অন্য কেউ কেউ গান করার চেষ্টা করছেন। তো, এর আগে আমাদের ‘শ্রুতি’ থেকে যে অর্ধযুগপূর্তি উৎসব হলো, সেখানে আমরা পাঁচজন নতুন শিল্পীর অর্থাৎ পাঁচ তরুণের গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। সেখানে কফিল আহমেদ, অমল আকাশ — এঁরা ছিলেন, আতিক রহমান ও মোশারফ হোসেন ছিলেন, এছাড়া ছিলেন কামরুদ্দীন আবসার। এর বাইরে পূর্বে ‘চারণ’-এর সাথে যুক্ত মাহমুদুজ্জামান বাবুও কিছু নতুন গান করার চেষ্টা করেছেন। তো, সত্যিকার গানটাকে একটু মুক্তি ঘটাবার জন্য, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘আইপিটিএ’-র গানের পর নতুন আর কাজ হলো না। বাঙলা কবিতার ক্ষেত্রে বলা হয়, তিরিশের দশকের কবিরা রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে এসে যে আন্দোলন করার চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরা যে পথ কেটে গেছেন, সে-ধারাটা অনেকটা থেমে গেছে এবং গত শতাব্দীর ওই-যে নব্বই দশকে অনেক ইয়াংরা, তরুণরা ভিন্নভিন্নভাবে অনেক কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কেউই আর জীবনানন্দ দাশদের বাইরে নতুন কবিতা তেমনভাবে লিখতে পারছেন না, সেভাবে বেরিয়ে আসছে না। তো, আমাদের গানের ক্ষেত্রেও এ-রকমটা ঘটছে। একটু আশাবাদী হচ্ছি, কাউকে কাউকে দেখলাম যে এ-ব্যাপারে ভাবছেন এবং শূন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। সেখানে আমাদের কফিল আহমেদ আছেন কিছুটা দ্যুতি নিয়ে। অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তিনি  ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ পরিবেশন করছেন। চর্যার গানে সুরারোপ করেছেন। তিনি ঢাকার ‘মাতৃধারা সাংস্কৃতিক কমান্ড’-এর সাথে জড়িত। আমরা তার সাথে আলোচনায় বসেছি।

প্রথমেই আলোচনায় জানতে চাই, একটু আগে আমি যে ভূমিকার কথাগুলো বললাম, কফিল আহমেদ, আপনার এই সংগীত সম্পর্কে কী ভাবনা? কী ধরনের আপনি ভাবেন এবং আপনার কাছে কি মনে হয়, এই জায়গাটায় শূন্যতা আছে এবং এখানে নতুন করে কিছু কাজ করা দরকার বা কাজ করার দরকার নাই, যা চলছে সেভাবেই চলতে পারে অথবা নতুন করে যদি করা প্রয়োজন মনে হয়, তাহলে সেখানে কিভাবে করা যেতে পারে এবং গণসংগীত বলতে যে একটি বিশেষ ধারা বা ট্রেন্ডকে ধরা হচ্ছে, সেটা আসলে কি হওয়া উচিত? জনগণের, সেই শ্রমিক-কৃষকের, সাধারণ মানুষের কথা — এই বিষয়গুলো একটু বলুন।

কফিল আহমেদ :: বেশ ভালোই হলো যে, আমাদের বাঙলা গানের নিবেদিত সংগ্রামী শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে দিয়েই, তাঁকে সঙ্গে নিয়েই — তাঁর বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং সংগ্রামের একটা বড় জায়গা থেকেই আমরা আমাদের আলোচনাটা শুরু করেছি। তো, হেমাঙ্গ বিশ্বাস মনেহয় খোলা হাওয়ার লোক, ফলে চারপাশের শোষণ-শাসন, জবরদখলের দমবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে গানে গানে টানটান লোক। প্রথা-প্রচলনের বিরুদ্ধে স্পষ্টতই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, শ্রেণিবৈষম্যের উচ্ছেদের সংগ্রামে আমৃত্যু ডাকনাম। মনে রাখতে হবে, প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলি এই ডাকনাম নেয়নি। এই ডাকনাম গ্রামে গ্রামে, হাটে-জনপদে, শহরে কারখানায় না পৌঁছাবার পেছনে যে রাজনৈতিক-সংস্কৃতির শূন্যতা, এই শূন্যতার ওপর দাঁড়িয়ে আরো কঠিন অচলায়তন ভাঙবার দিন আজ। আজকের দিনে প্রচলিত প্রবণতার সমস্যা-সংকটগুলি খোলা করেই আমাদের গানের সংগ্রামের দায়টুকু স্পষ্ট করা চাই। সময়ের প্রেক্ষিত, পটভূমি — এই ভূমি, ভূমির মানুষ, মানুষের কর্ম-কোলাহল, শ্রম ও শ্রমজীবিতা, নদী, গাছপালা; ওপরের আকাশ, নক্ষত্ররাজি, দূরের-অদূরের পাহাড়, সাগর-সমুদ্দুর, সব নীরবতার মাঝ থেকে উপচানো সুর-সংগীত, এসবের সামনে-পিছনে মাটি-মাংসের পরতে পরতে রঙ-রক্ত-জল-ঝোল সহ, আলো-অন্ধকার সহই সকল অস্তিত্বের টানাপোড়েনের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত দশা-দুর্দশা-প্রত্যাশা-ভালোবাসার দিকগুলি একে একে উন্মোচন করেই আমাদের এগোতে হবে। কারণ, আমরা খুঁজছি সংগীত। সমগীত। শ্রমগীত। যখন জনপদের মানুষের বাঁচা-মরা, হাজার বছরের সংগ্রাম-ভালোবাসার প্রত্যক্ষ জায়গাটিকেও লোকগান-লোকসংস্কৃতির নিতান্ত ‘ঐতিহ্যে’ ঠেলে দিয়ে, একে নিতান্ত কৌতূহল-উপভোগের জায়গায় রেখে যে-ব্যক্তিবাদিতার, রাষ্ট্রবাদিতার, সর্বোপরি বাজার ও পণ্যবাদিতার আক্রমণ, সাম্রাজ্যবাদিতার আগ্রাসন — এর থেকে মুক্ত হবার জন্য, মুক্ত করবার জন্য সব-ধরনের খণ্ডিত চিন্তার মুখোমুখি হয়েই একটা পাল্টা কিন্তু মূল্যবোধের সামগ্রিক লড়াই নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে চাই। কেননা দেখুন, একটা মাঠ, মাঠের ফসলাদি, একটা নদী, নদীর জল নৌকা ও মাছ, একটা পাহাড়, পাহাড়ে পাহাড়ে গাছ ও পাথর, একটা রাস্তা, রাস্তার দু-পাশের বাজার, বাড়িঘর, কারখানাসুদ্ধ সকল মানুষজন যখন ব্যক্তিমালিকানায় আটক, তখন একটা পাহাড় নিয়ে — একটা প্রচলিত ভুপালী নদী নিয়ে — নৌকা নিয়ে — একটা ভাটিয়ালী, গাছ নিয়ে, গাছের ওদিকে সূর্যকে নিয়ে ভাঁইরো কিংবা ভৈরবী কিংবা জলে-স্থলে-আকাশে মাছের পশুর পাখির সকল হাঁকডাক নিয়ে একটা জয়জয়ন্তী, — ও-সকল রাগ-রাগাশ্রয়ী শাস্ত্র কিংবা তাল-বাদ্যের যাবতীয় অ্যারেঞ্জড বা আরোপিত বিষয়গুলির সবই বদলাতে বাধ্য — গানের ভালোবাসার জন্য, ভালোবাসবার নতুন সংগ্রাম রচনার জন্য। কথাগুলো বললাম এইজন্য যে, সকল কিছুর মতোই সংগীত এবং গণসংগীত — এই দুইয়ের প্রচলিত ব্যাখ্যাটি এমন দাঁড়ায় যে, মনে হয়, দুটি দু-রকম — আলাদা আলাদা বিষয়। এসবের চলতি ব্যাখ্যাটি খুব খণ্ডিত। চিন্তায়, লক্ষ্যে, চর্চায় সামগ্রিকতার বড় ধরনের ঘাটতি। যেমন আলাদা করা হচ্ছে রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি মাধ্যমকে, তেমনি সংস্কৃতি থেকে রাজনীতি মাধ্যমকে। ফলে বিচ্ছিন্নতা দাঁড়ায়। বৈষম্য দাঁড়ায়। আর প্রচলিত রাজনীতির ভাবনাটা এমন যে, মনে হয় সমাজ বলতে শুধু মানুষই আলোচ্য, মানুষই বিষয়, প্রচলিত সংস্কৃতির ভাবনাটাও এমন যে, মানুষ ছাড়া চরাচরে আর সকল অস্তিত্বই কেবল উপমা-উৎপ্রেক্ষার বিষয়। ফলে চিন্তায়, চর্চায় আন্তঃসম্পর্কের ঘাটতি। মিশে যাবার, মিলে থাকবার টানটুকু অনুভব করা চাই। আমার কাছে সংগীত অবশ্যই সকল প্রাণ ও প্রাণপ্রবাহের একটা একীভূত ঐকতান। সমগীত। আমাদের ভাবতে হয় একদল পিঁপড়ে কিংবা পাখির ডিম নিয়েও। ভাবতে হয় একটা জ্যান্ত আধমরা বাঘের গা থেকে থেকে চামড়া খুলে নেবার ঘটনার সাথে — সাধারণের মনে আজকের পুঁজির সম্পর্কটাতে কতটা রক-রক হিংস্রতা, কতটা উত্তেজনা! আর ভূমিকার উদ্ধৃতিতে মার্কসবাদের ‘সরল প্রয়োগের’ যে আস্থা-অনাস্থার কথা বলা হয়েছে, এ-বিষয়ে বলতে চাই — সংগ্রামে, সৃষ্টিতে, দ্বান্দ্বিকতায় মার্কসীয় দর্শনের নিবিড় সত্যটি কোনো-ধরনের ‘সরলীকরণে’ আচ্ছন্ন বা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না সামগ্রিকতার স্বাচ্ছন্দের প্রয়োজনেই। সংগ্রামে দ্বান্দ্বিকতার সত্যটি তো বিকাশের সংকট ও সম্ভাবনা দুটোকেই টের পায়। টের পেয়ে বিকাশের সম্ভাবনাটাকেই সংগ্রামের আমৃত্যু প্রেরণায় রাখে। আর গান করবার প্রশ্নে আমাদের ভাবতে হয় যে-কোনো শোষণ কিংবা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পিছনে যেমন সম্পর্কিত প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গ্রাম ও শহরের গঠনকে নিয়ে, কাঠামের স্তরে স্তরে এসবের প্রতিটি পদক্ষেপকে নিয়ে, পাশাপাশি এসবের বিপরীতে — দিকে-দিকে পাল্টা গানের, পাল্টা রাজনীতির, পাল্টা জীবনের সামগ্রিক প্রস্তুতির প্রয়োজনে গ্রাম-শহর-রাজধানী ভেঙে ভেঙে ঐক্যে-সংগ্রামে-ঐক্যে সমস্তটা প্রকৃতিসুদ্ধ পৌঁছাতে হবে সমগীতে, পৃথিবীজোড়া সশ্রম কমিউনে।

আবীর পরশ :: আমরা এতক্ষণ কফিল ভাইয়ের কাছ থেকে গান সম্পর্কে তাঁর চিন্তাভাবনাটি কি জানতে চেয়েছিলাম। সংগীতের যে অ্যারেঞ্জড ব্যাপার, সুরও যে অ্যারেঞ্জড, সেটার ব্যাপারে উনি দৃষ্টি আকর্ষণ 19964858_10211089050754752_1477390135_nকরলেন এবং যে একটি প্রি-কন্সেপ্ট দ্বারা এখন অনেকে চালিত হচ্ছে, সে-ব্যাপারের দিকে আমাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করলেন এবং সর্বোপরি, সাম্রাজ্যবাদ যে ব্যক্তিতাবাদের খুব জয়গান করে এবং পণ্যে পরিণত করে সব জিনিস, সে-ব্যাপারটাও তুলে ধরে বললেন যে, আমাদের সংগ্রামটা হচ্ছে সেই সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে। জনগণের সেই সত্যিকার সংগীতের উৎস, যে-জায়গা থেকে তারা কাজের প্রেরণা পায়, সংগীত বলতে যে উপভোগের বিষয়কে অনেকে বলেন, সেটা না-হয়ে যেভাবে প্রেরণার, কাজের অংশ হিসেবে অটোম্যাটিক্যালি উদ্ভুত হয়, সেই-যে একটি বধূর বেদনার কথা একটু পূর্বে ইনফর্মাল আলোচনায় বলেছেন, সব মিলিয়ে ঐ বধূর বেদনার কথাটাও তুলে আনলেন সংগীতের উৎপত্তির কথায়। কবিতায় আমরা দেখি,  যে-‘অধরা মাধুরী’-র কথা বলা হয়, ‘অবাঙমানসগোচর’-এর কথা বলা হয় অর্থাৎ কবিতার কিছু অংশ ধরা যায়, কিছু ধরা যায় না — এভাবে সংগীতের ক্ষেত্রেও তিনি বললেন যে, কিছু কিছু জিনিস আছে সামনে আনা হয়, কিছু জিনিস আনা হয় না, ধরা যায় না। যাকে তিনি সুর-শিল্প হিসাবেও আখ্যায়িত করতে চাইলেন না — তো, সেই সংগীতের উৎপত্তির কথাটা আমাদের বললেন। প্রকৃতির পাখির কলতানকে ধরা, বিভিন্ন প্রাণীর ডাক অনুকরণ — এইভাবে যে সেই আদিকালিক প্রকৃতিকে ধরার মানুষের সমবেত চিৎকার, শিকারে যাওয়া — এই সমস্ত বিভিন্ন কারণে মানুষ তার ভাষা তৈরির পূর্ব থেকেও প্রকৃতি থেকে, বিভিন্ন উপদান সংগ্রহ করে প্রকৃতির সুরগুলোকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছিল — এগুলো আলাপ করছিলাম। তো, কফিল আহমেদ আমাদেরকে সংগীতের কিভাবে জন্ম, সেই জিনিসটা তুলে ধরছিলেন। এখন এই বিষয়টা — শ্রম থেকে যে-সংগীত, যেটা পল রবসনও চেষ্টা করেছিলেন; এছাড়া পাশ্চাত্যের আরো আরো সংগীতবোদ্ধা সহ আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ আলাউদ্দিন খাঁ, তাঁরা সকলেই লোকসংগীতকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সংগীতের ক্ষেত্রে আমরা উচ্চাঙ্গ সংগীতকে সব সংগীতের স্রষ্টা বা মাতা বলে থাকি কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরাও, সেই উচ্চাঙ্গ সংগীতের রচয়িতারাও লোকসংগীতকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। লোকসংগীতের উপর ভিত্তি করেই অন্যান্য সংগীতের ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে। তো, এই বিষয়ে অর্থাৎ লোকসংগীত এবং এর ভেতর দিয়ে শ্রমসংগীত — এ-বিষয়ে কফিল আহমেদের কি চিন্তাভাবনা একটু শুনি।

কফিল আহমেদ :: শ্রমসংগীত তো স্তরে স্তরে জীবনের ক্লেদ-গ্লানি সহই, শ্রমের আনন্দ-বিষাদ সহই একটা বিদ্রোহের-জাগরণের নির্ভয় ছন্দের দিকে এগোবে। সে-আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে পারি। আর যে-মানুষ মাঠের, তার চোখে-মনে সে-মাঠের উদাম হাওয়া। হাওয়া ফসলের, বৃষ্টির এবং হাওয়া মন্বন্তরের আগুনের। যে-মানুষ নদীর কিংবা নদীর পাড়ের, তার শরীরে নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ, ধ্বনি। শরীর। ছন্দ। যে-মানুষ কাজ করে, কাজের ক্লান্তি ও আনন্দটুকু, সংগ্রামটুকু সহই তার হাঁটবার তার চলবার তার ভাষার গতিধারা। সেই গতিধারায় সবই মিশেছে। মিশেছে সেই হাওয়ার — সেই জলের — সেই শ্রমের ছন্দ এবং সেই পরিজন সেই পরিসর ও পরিবেশবেষ্টিত সে — যে-গরুমোষের সঙ্গে সঙ্গে, পায়ে পায়ে তার বিচরণ — তা-ও মিশেছে তার ছন্দে, গানের সুরে। ঘরের কবুতর আর গাছের পাখির ঘু ঘু ডাকও তার সুরে, সুরের ছন্দে, সবই থাকে। থেকে থেকে ঘুমায়, হারায়, আবার জাগে। জেগে ওঠে। সাথে একটা অসীমের তাড়না, সুদূরের ডাক। যে-টানাপোড়েনে সে বিচলিত, উদ্বিগ্ন, শোষণ ও বঞ্চনার থেকে জর্জরিত থাকার চাপ ও ছাপটুকু সঙ্গে নিয়েই সে গাইতে চেয়েছে, গেয়ে উঠেছে আক্ষেপে-ঘৃণায়-ভালোবাসায়। গেয়ে উঠেছে উপকথায়, রূপকথায়। আবার মোহ এবং আধ্যাত্মটুকু সহই, সকল অবসাদটুকু সঙ্গে নিয়েই, সে গাইতে চেয়েছে মায়ায়-মমতায়-বেদনায়। গেয়ে উঠেছে — অনেক ভাটিয়াল, ভাওয়াইয়া, একটা কান্নার বিলাপের সুরগাথায় অসংখ্য অসংখ্য বিয়ের গীত, যা কি-না জনপদের মানুষের জীবনযাপনেরই প্রামাণ্য। আবহমানতায় জীবন্ত। জান্তব। এই জীবন্ত জান্তব জায়গাটা যেন গবেষণার নিতান্ত উপহাসে পরিণত না হয়। উপনিবেশের পর উপনিবেশ, শোষণের পর শোষণ — অনেক অনেক ধকল সইতে হয়েছে যে-জনপদের মানুষকে — সেই জনপদের মানুষের জীবনের প্রামাণ্যকে সংগ্রামের প্রেরণায় না এনে শুধুমাত্র ঐতিহ্যের ম্যুজিয়মে আটকে বা লুকিয়ে রাখার প্রবণতার থেকে মুক্ত করে আজকের দিনের সংগ্রামে সম্পর্কিত ও জীবন্ত করা দরকার। আর হ্যাঁ, শ্রমিকের মুক্তির আন্দোলনে ছন্দ আনবার জন্য, শোষণের কাঠামোর চারপাশ ভাঙবার জন্য, মুক্তির মিছিলে প্রাণ জাগাবার জন্য শ্রমসংগীতে শ্রমমনষ্কতার মূল্যবোধ দরকার। সেই ক্ষেত্রে লোকগানের শিল্পীরও শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গির জায়গার থেকেই মুক্তির দায় থাকা চাই। অঙ্গীকার থাকা চাই। কেননা দেখুন, সংস্কৃতির সুবিধাভোগী ঠিকাদার-মালিকেরা রাস্তা বা ছাদ ঢালাইয়ের সময়েও যে পালাগানের আসর বসাচ্ছে, তাতেও এদের লক্ষ্য থাকে মূলত শ্রমিকের পুরো শ্রমটাকে পালাগানের ছন্দে ছন্দে হরণ করা, সাধারণের শ্রমকে শোষণ করবার কৌশল হিসেবেই; শ্রমিকের আনন্দের জন্য কিংবা লোকগানের টানে নয়। এই-যে মানুষ, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ যে কাজও করছে, সাথে রূপকথার কিংবা লোককথার সুরগুলি, রূপগুলি, চরিত্রগুলি তার মনে দোলা তৈরি করছে, এই দোলায় শুধুমাত্র আচ্ছন্ন না থেকে যদি ছন্দকে, চরিত্রকে নিজেদের জীবনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আনে, বিদ্রোহ করে, তখনই এর গণমুখিনতা প্রকাশিত হয়। কখনো কখনো সংগ্রামকে প্রত্যক্ষ করতেই হয়। প্রত্যক্ষ হবার — প্রত্যক্ষ করবার জন্যই কিন্তু গণসংগীতের জন্ম।

19964708_10211089051234764_2072661119_nআবীর পরশ :: আচ্ছা, এই জায়গাটায় আমরা একটু অন্য প্রশ্নে আসি। আপনি বললেন যে, সেই জায়গাটিকে আবার প্রত্যক্ষ করার জন্য গণসংগীতের জন্ম। একটু আগে আপনি বলছিলেন যে, সংগীত বা সুর একটুখানি অ্যারেঞ্জড ব্যাপার — তো, এই অ্যারেঞ্জড ব্যাপারে আপনার একটু আপত্তি। তাহলে কি আমাদের এই গানের ক্ষেত্রে বা এই গণসংগীতের ক্ষেত্রে, এই সুর-স্বরের অ্যারেঞ্জমেন্টের ব্যাপারটি কি নাই? আমরা জানি, প্রকৃতিতে যে-স্বরগুলো বিরাজ করে সেগুলো হলো এক-ধরনের  নাদ-অনুনাদ। তাকে আমরা অনাহত নাদ বলতে পারি। আর যন্ত্রের মধ্যে, বিভিন্ন যে সুরেলা যন্ত্রগুলো আছে, ধরা যাক বীণা-সেতার-হারমোনিয়াম — সেখানে একটা নাদ-অনুনাদ তৈরি হয়, সেটা আহত নাদ। তো, আমাদের সংগীতের মুক্তি তাহলে কোথায়? আসলে আমার মনে হয়, ‘আহত নাদ’-এরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, ‘অনাহত নাদ’-এরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই দুইটাকে একটা মহাসঙ্গমের মিলনস্থলে নিয়ে পৌঁছানো এবং যাতে করে একটি ‘দুয়েন্দে’-র সৃষ্টি হয়, অনাস্বাদিত একটি ‘নাদ’-এর তৈরি হয়। মানুষ যেন কেমন বিস্ময়ে তন্ময় হয়ে যায় বা পরবর্তীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে কাজে এবং তার শ্রমটাও লাঘব হতে পারে — এই বিষয়ে তাহলে আপনি কি ভাববেন? তাহলে কি কোনো চর্চার স্তরের দরকার নেই? বা এই দুই ব্যাপারটাকে — এই আহত-অনাহত নাদ কীভাবে মহাসংগীতের সৃষ্টি করে জনগণকে আন্দোলিত করতে পারে, উদ্দীপিত করতে পারে, সে-ব্যাপারে কিছু বলুন।

কফিল আহমেদ :: নিজেকে সমষ্টির সঙ্গে যুক্ত করবার জন্য, কাছে টানবার জন্য, কাছে ডাকবার জন্য সাংগীতিক যে ভাষা — সেই ভাষার ক্ষমতা মনেহয় অনেক অনেক বেশি। প্রবল এবং অপ্রতিরোধ্য। এ-মুহূর্তে সেই হাইতি দ্বীপের কথাটাই বলি, দ্বীপের নারীরা তাদের আচারের জায়গা থেকে বছরের একটা সময় সাগরের ধারে যে পাহাড়, সেই পাহাড়ে যায়। উপরে ওঠে। একে একে অনেকে দল বেঁধে যায়। ওরা ওদের ভাষায়, সুরে, সুরে-সুরে গাইতে থাকে। তখন সাগর, সাগরের পাড়, পাহাড় — সকলকিছু মিলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয় যে, সাগরতলার থেকে কচ্ছপ, মাছ সুরের টানে উপরে উঠতে থাকে। এটাই হচ্ছে সুরের টান। অর্থাৎ কমিউনিকেশন। প্রাণের থেকে কমিউনিকেশন। মাছ, কচ্ছপ — ওরাও কিন্তু সেটা কমিউনিকেট করে। ডাকটা আঁচ করতে পারে। কাজেই সেই সুরের গভীরতা কিংবা সেই সুরের ডাকটা খুবই তাৎপর্যের। খুবই গভীর। খুবই কাছে টানবার। শিল্পকলার অ্যারেঞ্জড বা আরোপিত বিষয়টিতে এই শক্তি থাকতে পারে না। ডাকটা মুক্ত এবং গভীর হওয়া চাই। তো মানুষকে, মানুষ সহ আমাদের আশপাশকে কমিউনিকেট করবার জন্য ও সব রকমের অবরুদ্ধ দশার বিরুদ্ধে, শোষণের শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে, একটা দুর্বার বিদ্রোহ দরকার। আবার বিদ্রোহ করবার জন্য, বিদ্রোহের প্রস্তুতির জন্য, বিদ্রোহের সামনে-পিছনে আমাদের সকল স্বপ্ন-ভালোবাসার রূপ-দশাটিকে দেখিয়েই, সুরের বিদ্রোহের ডাকটা দরকার। আমরা যুগ যুগ ধরে জনপদের মানুষ, জনপদের গরুবাছুর, পাখপাখালি, গাছপালা সবাই পরস্পরের থেকে কতটা দূরের হয়ে থাকছি! আর ব্যক্তিমানুষ পরস্পর পরস্পরের দিকে ভালো করে তাকাতে পারছি না! প্রত্যেকেই যেন খাপ থেকে খোলা ছুরি বের করে বসে আছি! ঘুরছি তো ঘুরছিই! এই সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, ব্যক্তিমানুষকে কতটা ভয়ানক জায়গায় ঠেলে দিয়েছে! তো শুধুমাত্র ব্যবস্থাকে, ব্যবস্থার অসংগতিগুলোকে দায়ী করেই আমরা অজুহাতে অজুহাতে নির্বিকার থাকব নাকি? এই প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গির সামগ্রিক প্রস্তুতি দরকার। মনটা চাই। সমাজ ও প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যা-কিছু বৈষম্যের, যা-কিছু দূরত্বের, যা-কিছু বিচ্ছিন্নতার — মূলবোধের গভীরে কোথাও একটা রুগ্ণতার থেকেই, জড়তার থেকেই। এসবের থেকে মুক্ত না হয়ে উপায় নাই। মানুষ যে-সময়টাতে অরণ্যে গুহার গভীরে ছিল, আকাশ দেখতে পারত না, সেই সময়টাতে কিন্তু তার চোখের বিস্তৃতি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায়নি, আকাশ ছাড়িয়ে যাওয়া তো আরও পরের কথা। মুক্ত হবার উপায়ও ছিল না। কিন্তু সে যখন গুহা থেকে বেরিয়ে ওপরের খোলা আকাশটাকে দেখল, বন থেকে বেরিয়ে সে তার সামনের মাঠ-প্রান্তর, সাগর-সমুদ্র দেখল, তখনই কিন্তু তার মধ্যে সৃজনশীলতার একটা বড় দরজা খুলে গেলো। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এই-যে দেখবার, বুঝবার কিংবা আঁচ করবার — সুদূরের, অসীমের কিংবা খুব কাছে যে সৌন্দর্যের জায়গাটিকে অনুভবে আনবার যে-সম্ভাবনাটুকু মানুষের ছিল, আছে, সেই জায়গাটুকুকে একটা আন্তঃসম্পর্কের ঐক্যের জায়গায় না নিয়ে, ব্যক্তিবাদিতার কর্তৃত্বের দখলের দ্বারা সে হরণকারী হয়েছে। সংগীতের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত একটা একীভূত সম্পর্কের কাছাকাছি পৌঁছানো। আহত কিংবা অনাহত, সুর কিংবা অ-সুর — আমরা যা-ই বলি না কেন, সব মিলিয়ে শুধুমাত্র শাস্ত্রীয়করণÑনিয়ম-পদ্ধতি-শৃঙ্খলার টানাহেঁচড়াটাই বেশি হয়েছে। কিন্তু মহাজাগতিক অর্থেই আন্তঃসম্পর্কের একটা নিঃশর্ত নিবিড় ঐক্য দরকার। ডাকটা দরকার। সেই ডাক ঝড়েরই হোক, গরুরই হোক, রান্নাঘরের হেঁশেলের বা কারখানার পিস্টনের আওয়াজই হোক, সকল হিংস্রতার নৃশংসতার দাঁত-শিং ভেঙে দিয়ে সুরের ডাকের গর্জনটা হোক — অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ভালোবাসার নিবিড় মমতার অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের পক্ষে। এই ঐক্যে, সময়ে বা সমকালের প্রতিদিনের টুকরাটাকরা বিষয়-উপাদানগুলিও সমগীতে প্রাণ পেতে চাইবে। এটাই দুয়েন্দে বা সাংগীতিক দ্যোতনার জাগরণের মৌলিক লক্ষণ-দিক।

আবীর পরশ :: এই ব্যাপারটা খুবই গভীর; তাৎপর্যপূর্ণ কথা বললেন যে, এটার একটা দায় রয়েছে; কিন্তু সেইভাবে সমস্ত সুরগুলোকে মেলাবার, একটা মহান ঐকতান সৃষ্টি করার ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক অনেকের মধ্যে দেখি না এবং সবাই শুধুমাত্র ব্যক্তিবাদী চর্চা করে। একক হিরো হওয়ার দিকেই আমাদের আধুনিক সময়ের শিল্পীদের একটা প্রধান প্রবণতা। আপনি যে-কথাটি একটু আগে বলছিলেন, সংগীতের মধ্যে একটা ঐক্যের ব্যাপার আছে। আমার ক-দিন ধরে মনে হচ্ছিল যে, আমরা যদি সংগীতটাকে সন্ধি-বিচ্ছেদ করি, তাহলে পাবো, সঙ্গীত=সম্+গীত — মানে, সমবেতভাবে গীত হওয়ার জন্যই সংগীত, অর্থাৎ সমবেতভাবে গাওয়ার জন্য। অতীতে আমরা গ্রিক সংস্কৃতির ইতিহাসেও দেখি, সেখানে সংস্কৃতির অনেক ক্ষেত্রে কোরাস প্রবণতা ছিল। প্রায় সমস্ত জিনিসেই — সমবেতভাবে কোরাস কণ্ঠে অভিনীত হওয়া — কোরাস কণ্ঠে গান গাওয়া — এ-বিষয়গুলি ছিল এবং আমাদের এখানেও পুরনো, হাজার বছরের আগের গানে আমরা এই ব্যাপারগুলি দেখি। আমাদের অনেক জারি-সারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগীতের ক্ষেত্রে সমবেতভাবে গাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আমাদের মধ্যযুগের কীর্তনের মধ্যে আমরা দেখি একটি দোহার ধরার ব্যাপার আছে। কোরাসটাকে দেখি, সারিবদ্ধভাবে প্রধান গায়ক গেয়ে যাবার পর তার সাথে গলা মেলাতে। বয়াতিদের বা বিভিন্ন কবিগানেও আমরা দেখি, দোহার-এর একটি অংশ আছে তাদের বা তাদেরকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য, সমবেত কণ্ঠে কোরাস গাইবার জন্য। কিন্তু আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে এ-ব্যাপারটা দেখা যায় না। এই ক্ষেত্রটা যেভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, সেটা আমরা খুবই তাৎপর্যের সাথে হয়তো ভাববো। তাহলে সেই চারপাশের যে-সমস্ত সুর-নাদ-ধ্বনিগুলোকে মেলাবার একটি দায়িত্ব রয়েছে যে বললেন, সেই ব্যাপারে, মানে সংগীতের — বা, এই সুরগুলোকে বুঝতে খুব গভীর অভিনিবেশ না হলে মেলানো যাবে না। এই-যে ঝড়ের ডাকের কথা বললেন, পাতার মর্মর ধ্বনি বা নদীর বা নদীর কুলকুল ধ্বনি — এই জিনিসগুলোকে বুঝতে হলে সংগীতের সূক্ষ্ম স্তরের অনুভূতি বা সূক্ষ্ম স্বরের পর্দার ব্যাপারগুলোকেও আমাদের আয়ত্ত করা দরকার। আবার একটু আগে চর্চার কথাটাও বললেন। আসলে এই দুই মিলিয়েই সেই একটি জায়গা — মহাজাগতিক ঐকতান সৃষ্টি করাটা — আমাদের তাহলে লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রথমে যে ভূমিকায় বলছিলাম এক্ষেত্রে ক্রাইসিস চলছে। একটি মানে সেইভাবে জিনিসটা করা যাচ্ছে না বলেই আমাদের এই সমস্ত সুন্দর জিনিসগুলোর প্রতি দর্শকবিমুখ অর্থাৎ জনগণকে টানতে না পারার সমস্যায় আমরা আছি। আমাদের যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সংগীতের ভাণ্ডারে অবদান রাখার ক্ষেত্রে, সেখানে সৃজনশীল মেধাবী লোকদের অভাব আছে। যে-জায়গায় নিজ নিজ সামর্থমতো অনেকেই হয়তো কাজ করেছেন — বাউলসম্রাট লালন ফকির তাঁর মতো করে আমাদের বাঙলার যে সাধারণ সুর, তাঁর গানে তা আনার চেষ্টা করেছেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথও তাঁর সংগীতকে, সমস্ত সংগীতকেই একটা জায়গায় নেয়ার জন্য বেশ চেষ্টা করেছেন। আপনি কিছুদিন আগে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একটি কথা বলেছিলেন যে, আমাদের লোকগানের মধ্যে সাধারণ একটা ব্যাপার আছে — একটি বাঁশির সুর লক্ষ করা যায়। বাঁশির যে একটা উদাত্ত ব্যাপার আছে, একটু ধীরলয়ের একটা মেলোডি এবং একটু আগে আপনি যে করুণ সুরের কথা বললেন, যে বেদনার কথা বললেন — সেই ব্যাপারটা বাঁশিতে দেখতে পাই। আমরা রাধাকৃষ্ণের, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সেই বিরহসংগীতগুলোর মধ্যে এই বিষয়গুলো দেখি। তো, এই সমস্ত বিষয়গুলোকে অনুধাবন করে বিভিন্ন শাস্ত্রকাররা যন্ত্রের মধ্যে সেই সুরগুলোকে ধরার জন্য যে চেষ্টা করেছেন এবং সে-ব্যাপারে তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও বললেন। এই বিশাল বিষয়কে অনুধাবন করার মতো কেউ কেউ আপনার দৃষ্টিতে আছে কি-না বা আমরা নিজেরা এই শূন্যতা পূরণ কিভাবে করতে পারি, করলে আমরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলো পাবো কি-না, বা তা দ্বারা জনগণ সেইভাবে আবার উদ্বুদ্ধ হতে পারবে কি-না, এই ব্যাপারে আপনার মতামতটা জানতে চাইছি।

কফিল আহমেদ :: লোক্যালিটিতে যে একটা বাঁশির সুরের বেদনা আছে, আনন্দের ঘুঙুর-মন্দিরা আছে, এই আনন্দ-বেদনার প্রকাশটার সাথে, কথাটাকে আজকের এবং সকল সময়ের করে — সকল আনন্দ-বেদনার উদাত্ত-অনুদাত্ত মন্দ্র প্রকাশটার সাথে — ভাবনাটাকে আমি আরো একটু নিঙড়ে বলি, বলতে চাই — প্রকৃতিতে — জীবনে-আচরণে-প্রকাশেÑপ্রকাশ্যে যে সুর ভাষা দৃশ্য আছে — সেই সুর-ভাষা-দৃশ্যের আবডালে আরো করুণ আরো বিষাদ আরো গভীর বেদনার আর্তি কিন্তু চাপা পড়েই থাকছে। ব্যাপারটা অনেকটা এ-রকম — একজন কসাই, যে কি-না ছাগল জবাই করে; ছাগল জবাই করবার সময় কিন্তু সে ছাগলের গলাটাকে এমন টানটান করে যেন ছুরিটা সহজেই চালানো যায়। সেইসাথে সে ছাগলের থুতনিটাও মাটিতে চেপে ধরে! তো, থুতনিটা মাটিতে চেপে ধরবার পেছনে কসাইয়ের মনে-অবচেতনে আরেকটা বিষয়ও কিন্তু কাজ করে। সেটা হচ্ছে, যাকে জবাই করা হবে সে যেন জোরেশোরে আর্তনাদটুকুও করতে না পারে। মুখ চাপা দিয়ে সে জবাই করে। কিন্তু প্রাণ বাঁচাবার লড়াইয়ে ছাগলটা তো অপ্রাণ লড়ে। ছটফট করে। সে জবাই হয়। পেরে ওঠে না। ফলে শব্দ যেটুকু বেরোয় — তা একটা অস্ফুট গোঙানি! এই গোঙানিটা ঘরে-বাইরে-দোকানে-কারখানায়-রাষ্ট্রে — প্রকৃতির সবখানে — প্রতিটা অস্তিত্বে থাকছে! এই-যে বাঁচবার কালে, মরবার কালে, যে গা-ছেড়ে আর্তনাদটুকু করে যেতে পারল না, সেই আর্তনাদটুকু — ডাকবার ইচ্ছাটুকু —কোথায় লুকালো! জীবনে — প্রকৃতিতে — কত কথা, কত আর্তনাদই-না লুকিয়েছে, শুকিয়েছে! চাপা পড়ে আছে। অস্তিত্বগুলি কি একে একে অপ্রকাশের চাপটুকু চিরকালই বয়ে বেড়াবে না-কি! প্রকাশের প্রস্তুতিটুকু চাই। এই যেমন ‘ধাবমান’, এটা একটা পরিসর। প্রস্তুতির সংগ্রামের পরিসর। এখানে অনেক অনেক প্রাণ, প্রাণের প্রকাশের অনেক সম্ভাবনা আছে। বিষয়ও আছে। প্রস্তুত হতে হতেই, পরিণত হতে হতেই প্রকাশের প্রস্তুতির সংগ্রামে তা দিকে দিকে আরো সম্পর্কিত আরও বিস্তৃত আরও ছড়িয়ে পড়বে নিশ্চয়।

আবীর পরশ :: এ-ব্যাপারে দেখছি আপনি বেশ আশাবাদী।

কফিল আহমেদ :: খুবই আশাবাদী এবং আশাবাদী বলেই তো আজকের এই আলাপ। আজকের আলোচনা তো সেই আকাঙ্ক্ষার, সেই ইচ্ছার সংগ্রামের জায়গা থেকেই।

(চলবে)

[লেখার সঙ্গে — লেখার অভ্যন্তরভাগে — ব্যবহৃত স্থিরচিত্রগুলো ‘নগরনাট’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত উৎসব চলাকালীন ২০১২ সনে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সিলেটে উন্মুক্ত মঞ্চে তোলা। আলোকছবিগুলোর ধারক আহমদ সায়েম। প্রোক্ত অনুষ্ঠানে নগরনাটের আমন্ত্রণে এসে সিলেটের সান্ধ্য অন্ধকারে মাঠভরা মানুষের ময়দানে গেয়ে-বাজিয়ে শ্রোতাদেরে দীপিত করেছিলেন কফিল আহমেদ এবং তার সঙ্গে আগত অমল আকাশ ও বিশ্বজিৎ সোহাগ প্রমুখের ‘সমগীত’ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। — গানপার]

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you