শারদীয়া গানস্তোত্র :: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শারদীয়া গানস্তোত্র :: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুপ্রভাত

এ দিন আজি কোন্‌ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার?
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হলো কার?।
কাহার অভিষেকের তরে  সোনার ঘটে আলোক ভরে,
ঊষা কাহার আশিস বহি হলো আঁধার পার?।
বনে বনে ফুল ফুটেছে , দোলে নবীন পাতা —
কার হৃদয়ের মাঝে হলো তাদের মালা গাঁথা?
বহু যুগের উপহারে   বরণ করি নিলো কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার।

 

শারদা

শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি॥
শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি॥
মানিক-গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সংগীতে
ওড়না ওড়ায় এ কী নাচের ভঙ্গিতে,
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি॥

 

শরৎ

আজি কি তোমার মধুর মূরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর —
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরৎকালের প্রভাতে।

জননী, তোমার শুভ আহ্বান
গিয়েছে নিখিল ভুবনে —
নূতন ধান্যে হবে নবান্ন
তোমার ভবনে ভবনে।
অবসর আর নাহিকো তোমার—
আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার,
গ্রামপথে-পথে গন্ধ তাহার
ভরিয়া উঠিছে পবনে।
জননী, তোমার আহ্বান লিপি
পাঠায়ে দিয়েছ ভুবনে।

তুলি মেঘভার আকাশ তোমার
করেছ সুনীলবরনী।
শিশির ছিটায়ে করেছ শীতল
তোমার শ্যামল ধরণী।
স্থলে জলে আর গগনে গগনে
বাঁশি বাজে যেন মধুর লগনে,
আসে দলে দলে তব দ্বারতলে
দিশি দিশি হতে তরণী।
আকাশ করেছ সুনীল অমল,
স্নিগ্ধশীতল ধরণী।

বহিছে প্রথম শিশিরসমীর
ক্লান্ত শরীর জুড়ায়ে —
কুটিরে কুটিরে নব নব আশা
নবীন জীবন উড়ায়ে।
দিকে দিকে মাতা কত আয়োজন,
হাসিভরা মুখ তব পরিজন
ভাণ্ডারে তব সুখ নব নব
মুঠা মুঠা লয় কুড়ায়ে।
ছুটেছে সমীর আঁচলে তাহার
নবীন জীবন উড়ায়ে।

আয় আয় আয়, আছ যে যেথায়
আয় তোরা সব ছুটিয়া —
ভাণ্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
ও-পার হইতে আয় খেয়া দিয়ে,
ও-পাড়া হইতে আয় মায়ে ঝিয়ে,
কে কাঁদে ক্ষুধায় জননী শুধায় —
আয় তোরা সবে জুটিয়া।
ভাণ্ডারদ্বার খুলেছে জননী,
অন্ন যেতেছে লুটিয়া।
মাতার কণ্ঠে শেফালিমাল্য
গন্ধে ভরিছে অবনী।
জলহারা মেঘ আঁচলে খচিত
শুভ্র যেন সে নবনী।

পরেছে কিরীট কনককিরণে,
মধুর মহিমা হরিতে হিরণে
কুসুমভূষণজড়িত চরণে
দাঁড়ায়েছে মোর জননী।
আলোকে শিশিরে কুসুমে ধান্যে
হাসিছে নিখিল অবনী।

 

শরন্ময়ী

এই শরৎ-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে
যে ছিল মোর মনে মনে।
তারি সোনার কাঁকন বাজে
আজি প্রভাতকিরণ মাঝে
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি —
ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে।

আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু
পড়ে থাকে তরুর তলে।
হৃদয়-মাঝে হৃদয় দুলায়
বাহিরে সে ভুবন ভুলায় —
আজি সে তার চোখের চাওয়া
ছড়িয়ে দিলো নীল গগনে।

 

প্রকৃতি ৮৭

শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই-বা গেলে
সজল বিলোল আঁচল মেলে॥
পুব হাওয়া কয়,  ‘ওর যে সময় গেল চলে।’
শরৎ বলে, ‘ভয় কী সময় গেল বলে,
বিনা কাজে আকাশ-মাঝে কাটবে বেলা অসময়ের খেলা খেলে।’
কালো মেঘের আর কি আছে দিন
ও যে হলো সাথিহীন।
পূব-হাওয়া কয়, ‘কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’
শরৎ বলে, ‘মিলবে যুগল কালোয় আলো,
সাজবে বাদল সোনার সাজে আকাশ-মাঝে কালিমা ওর ঘুচিয়ে ফেলে।’

 

… … 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Latest posts by রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you