বিষ, ভালোবাসা অ্যান্ড অন্যান্য ব্যাপার্স

বিষ, ভালোবাসা অ্যান্ড অন্যান্য ব্যাপার্স

যা নাই তা দেয়ার নাম ভালোবাসা।
— জাক লাকাঁ

বাক্যটা, উপরোক্ত, পড়সিলাম অনেককাল আগে একটা বাংলা বইয়ের উৎসর্গপৃষ্ঠায়। সলিমুল্লাহ খান লিখিত আমি তুমি সে : জাক লাকাঁ বিদ্যালয়  নামীয় বইবিসমিল্লায়। এই জেলাশহরে, যেখানে মুই গোঙাইতেসি রভসে দিবারাতি, কথিত মননশীল পাঠকের একটি বইদোকানে রেগ্যুলার সান্ধ্য ঢুঁ দিতাম এককালে। এখন বই দেখলেই ভল্লুকজ্বর ভর করে শরীরে। সেই দিনগুলোতে ছিলাম আমি সিসিফাসের চেয়েও দু-চামচ বাড়া, মানে, পাথর নিজহাতে ঠেলে তুলে ফের নিজহাতেই শীর্ষপর্বত থেকে নামায়া আনতাম সমতলে। সেই দিনগুলো ছিল এমনতর যুক্তিহীন তর্কমুখর, চুক্তিহীন কর্মযজ্ঞের, মধুরতম মর্মযন্ত্রণার। দিনগুলো কবেই বিলীন লোলচর্ম বয়সগর্ভে, জীবিকাবাঘের পেটে!

যে-কথা বলছিলাম, আজ্ঞে, সেই বইদোকানের বারান্দায় ফেলে আসা দাঁড়ায়া-দাঁড়ায়া আড্ডার অপরাহ্ন ও সন্ধ্যাগুলোর ধূসর দৃশ্যাবলি। ঠিক এমনই এক গাড়িঘোড়া-হুড়োহুড়ি সন্ধ্যায় সেই বইদোকানে রুটিনচক্করের একফোকরে দেখতে পাই বইটি, এবং দুইচাইরপাতা এদিক-ওদিক নেড়েঘেঁটে ফিরে আসি ঘরে।

ফিরে আসি, কিন্ত তার আগে পায়া যাই ওই বাক্যটি। পাওয়ামাত্র পকেটস্থ করি হৃদয়ের, অথবা উল্টে বললে হৃদয়স্থ করি পকেটের। পকেটের কোনো হৃদয় কিংবা হৃদয়ের কোনো পকেট আছে কি না আদৌ, সে-তর্কে যাওয়া যারা উচিত কাজ মনে করেন, তাদের সনে এই পত্রে আপাতত কোনো কথালাপ হবার নয়। তারা বরং অন্যত্র চেষ্টা করুন; — বাংলাদেশে আর-যা-ই হোক, টকশো ঢঙের খাজুরি-আলাপ-জুড়বার টেলিপ্ল্যাটফর্মের অভাব নাই নিশ্চয়ই। অতএব, তাদের অসুবিধা হবার কথা না, আমারে উনারা যেন ক্ষেমাঘেন্না করেন। আমি বরং চেষ্টাচরিত্তির করে দেখি আশেপাশে কোথাও চন্দনের বন-টন খুঁজে পাই কি না। কখন কে ডাক দেয় ভ্রুপল্লবে, বলা তো যায় না! ভ্রুপল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে … আহা! আমি বরং দেখি দেয়া যায় কি না তারে, মম সুখদুঃখজাগানিয়া মধুহৃদিটিরে, যা নাই তা! যা নাই তা তৈয়ার করায় রত থাকি বরং, ততক্ষণ!

বিষ ভালোবাসা বিষয়ে একটি বিতর্কিত সদ্যপ্রসূত ছদ্মদর্শন
বিষের মধ্যেও কি ভালোবাসা থাকে? কিংবা ভালোবাসার ভিতরে বিষ? কঠিন প্রশ্ন, মুশকিল-কা-সওয়াল। দ্বিতীয় প্রশ্নের একটা উত্তর নিশ্চয়ই অনেকের কাছ থেকে আসবে, এবং হুড়মুড় করে, যে হ্যাঁ, ভালোবাসায় রয়েছে মারাত্মক বিষ। কূটাভাসপ্রিয় যারা, বলে উঠবেন : মারাত্মক মধুরতাময় বিষ! আর কে না জানে, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এবং চেতনে বা অবচেতনে, আমরা প্রত্যেকে প্রেমিক একেকজন, অন্তত নার্সিসাস অর্থে প্রেমিক তো অবশ্যই। আর প্রেমে পোড়-খাওয়া — সোজা মুখে ছ্যাঁকা-খাওয়া — সংখ্যায় তারাই তো বেশি। নয় কি? অতএব, সংখ্যাগুরুর উত্তর অভিন্ন হবে — এ আর আশ্চর্য কী!

কিন্তু প্রথম প্রশ্নের বেলায়? ওই যে, বিষের মধ্যেও ভালোবাসা থাকে কি না — এমন শিকওয়ার কেমনতর জওয়াব কাঙ্ক্ষিত? সহসা আশাও করছি না উত্তর। তবু মনে হয়, হ্যাঁ, থাকতে পারে। বিষের মধ্যেও ভালোবাসা থাকতে পারে বৈকি। উদ্ভট উত্তর, সন্দেহ নেই। তবে প্রমাণ-যুক্তি দেখালে পরে কেউ আমাকে আর-যা-ই-হোক উন্মাদ ঠাওরাবেন না। কি, ঠিক বলছি তো? হ্যাঁ। একটা হাল্কা উদাহরণ ভাবা যাক। ধরুন, কোনো ঘনিষ্ট বন্ধু বিলেতফেরত মোলাকাতে কিংবা আপনার প্রেমিকা আপনাকে একপ্যাকেট চুরট উপহার দিলেন, বিদেশি সিগার অথবা দেশি বিড়ি — এবং আপনি অধুমপায়ী নন, বলা বাহুল্য। তখন? এইবার বুঝলেন তো, যদিও এইটা অতি সরল একটা যুক্তি, বিষে ভালোবাসা বেশ ভালোভাবেই বিরাজ করে কি না?

হ্যাঁ, বিষেও ভালোবাসা থাকে। একটা বাড়তি ইঙ্গিত অবশ্য প্রকাশ থাকা জরুর যে, কেবলই বিষাক্ত কিংবা আস্ত মধুভাণ্ডের মতো কোনো জায়গায়, নির্বিষ মধুর বা নির্মধু বিষধর কোনো ক্ষেত্রে, এই জিনিশ তথা ভালোবাসার অস্তিত্ব মুমূর্ষু ও সন্দেহসংকুল। মধু ও বিষের সমন্বিত এক আজব যৌগ হলো ভালোবাসা, আর এর আলক্যামি নিরূপণ করার জন্যই তো জন্ম হয়েছে আমাদের। ভালোবাসা নামের এই চিচিংফাঁক রসায়ন-বিক্রিয়াটি মানুষ যেদিন ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারবে, সেই দিন সেই মুহূর্তেই পৃথিবী নিঃশ্বাসবান্ধব হয়ে উঠবে, বেশিরভাগ দুনিয়াবি ফিৎনা আপনাআপনি নিরসন হতে শুরু করবে, জগৎ হয়া উঠবে জলের মতো সাবলীল। এই এক সমুদ্র, নাম তার ভালোবাসা, যেখানে মানুষ ডুবে যেয়েও মরে যায় না, বাঁচে বেশি করে বরং।

লোকে এত ভালোবাসা-ভালোবাসা করে, বেহুদার তরে এত মাথা কুটে মরে — সখি, ভালোবাসা কারে কয়? — সে কী কেবলই মেকি ও মিষ্টি বিষময় নয়? সে কী নয় ভীষণ বোকাহাঁদা বনবার আবহমান প্রক্রিয়া? সে কী কেবলি মতিভ্রম, মোহ ও মনোরোগ, কেবলি পিছল পথভ্রমণ? সকলি ধান্দা আসলে, কিছু-না-কিছু হাতানোর/হাসিলের কোশেশ কেবল, লাইফ হেল করার পরিকল্পিত প্রাচীন পাঁয়তারা — আমার এক বন্ধুর সখেদ বিবৃতি ছিল এই-প্রকার, যে একটা ছ্যাঁকা সামলে উঠে তৎকালে বলদিয়া ভিসা নিয়ে অ্যারাব কান্ট্রিতে এক্সাইলে চলে যায়। এই ঘটনা বারো বছর পূর্বেকার, যুগপূর্তি পালন করা যেতে পারে একটি ভালোবাসা সম্পর্কিত থিসিসের, চলতি বছরে বন্ধুটি দেশে ফিরে বিয়ে-থা করেছে বলে খবরে প্রকাশ। পর সমাচার, বক্ষ্যমাণ অভিসন্দর্ভে সেই বন্ধুটির কোনো গোপন কাহিনি ডিসক্লোজ করব না, এখানে কেবল কতিপয় অসমর্থিত সূত্রে প্রাপ্ত কথাবার্তা টুকে যাব। অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে গেলে এর সুপারভাইজার সন্দর্ভকারীকে রেকমেন্ড করবেন, অন্যথায় একটা অ্যারেঞ্জমেন্টে যেতে চাইবেন, উপায় একটা বেরোবেই যা-হোক তা-হোক। চরৈবেতি ইজ দি বেস্ট পলিসি।

যখনই কাউরে চেঁচাতে শুনি ভালোবাসা-ভালোবাসা তারস্বরে, ভারি সন্দেহ হয়, শুনে ভারি সন্দেহ হয় আমার। রবীন্দ্রনাথ সন্দেহতালিকার শীর্ষে তবে? আলবৎ! অমরতার ধান্দা, ঠাকুর তাতে সফল। ইন্ট্রেস্টিং! হ্যাঁ। এই সময়ে এসে, এই বর্তমানে, এই দুই-হাজার-তেরো অথবা বাইশ সৌরঅব্দে, ভালোবাসা এক বিরাট ধাপ্পাবাজি এবং নতুন সহস্রাব্দের সর্ববৃহৎ কিংবদন্তিপনা। নারী-পুরুষ মধ্যকার বিশেষ একটা ব্যাপার এই থিসিসের বাইরে রাখা যাক আপাতত। অন্য অধ্যায়ে এইটা আলোচিতব্য।

ওকে, ফাইন। ওই একটা ব্যাপার ছাড়া যাবতীয় অন্য সমস্ত জাগতিক বিষয়ব্যাপার এই থিসিসের আওতাভুক্ত বলে সন্দর্ভপ্রণেতার অভিমত। সন্দর্ভকর্তার বিবৃতি ধর্মগ্রন্থোক্ত অমোঘ আয়াত মনে করে মেনে নেয়ার কোনো স্কন্ধ-মটকানো জোরজবরদস্তি-চাপাচাপি এইখানে নাই, বরং সকলেই বাজায়ে দেখে নিন। বিনা বাক্যে মাল সমঝিবেন না, মালসামান দর-কষাকষির ভিত্তিতে টেপেটুপে খরিদ করিবেন, বাণিজ্যমন্ত্রীর বুলিতেও কভু মজিবেন না। কাজেই, প্রিয় ক্রেতা-সাধারণ ভাইবোনবন্ধু-কলিগেরা, ভালোবাসা বুঝিয়া লউন! বিকিকিনির এই বিন্দাস সভ্যতায় সবচে সুলভ যে-পণ্যটি, এবং সবচে বেশি কাটতি যার, এবং আপনি খরিদ করে চলেছেন যারে ভক্তিভরে দিনের-পর-দিন, তারে নিয়া কথা তোলা হচ্ছে এই সন্দর্ভে! আপনি সাবধান হউন, কর্ণ-চক্ষু খরশান ও খোলা রাখুন! দেখুন, বাঙ্গালা সাহিত্যে ধুন্দুমার চুটিয়ে চলিতেসে যত ভালোবাসাবাদী কবিদের পরাক্রমী কাল, যারা করে বেড়ায় সোচ্চারে ভালোবাসার জয়স্লোগ্যান! অবশ্য পলিটিশিয়ানদের বুকে টেনে নিন, উহাদের ভালোবাসা সাচ্চা, ঘন ঘন এনজিওগ্রাম করান। এনজিওর ভালোবাসা সারে-জাহাঁ-সে-আচ্ছা! আর নোবেল-নাইট এনজিও হলে তাহাদেরে আপনার তামাম তালুক তুলিয়া দিন, তাহারা নিশ্চিন্তে ভালোবাসাব্যবসায় মনোনিবেশ করুন, দেশে ভালোবাসার গ্যুড-প্র্যাক্টিস রেপ্লিকেইট হোক জোরেশোরে। কবিদের কাজ কবিরা করুক, কবিদের পাশে আপনি কিংবা আপনার পূর্বসূরি প্লেটো কোনোদিনই ছিলেন না, তাদের কাজ অপ্রশংস ভালোবাসা বানানো ও সবার মাঝে শ্রেণি-নির্বিশেষে ডিসেমিনেইট করে যাওয়া আমৃত্যু।

নির্বিশেষ দ্রষ্টব্য  : পোপ ফ্র্যান্সিস সম্প্রতি ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশেষ ভালোবাসাবাণী দিয়েছেন আমাদের বিপর্যয়ে কেঁপে, তাই-না দেখে আমাদের সেই বিশ্বখ্যাত ভালোবাসামালিক ও প্রেমের পাওয়ারটিলার মুহম্মদ ইউনূস সহসা ধ্যান ভেঙে ভোদড়ের ন্যায় নেচে উঠেছেন। অরিন্দম কহিবার আগে একটু বিষাদপর্ব অতিক্রম করেন, অস্বাভাবিক না ব্যাপারটা বরং পুরাণসম্মত মহৎ, অরিন্দম বরাবরের মতোই বিশিষ্ট হয়ে রইলেন। উহার বিশিষ্টতা জানিতে কিছুই বাকি নাই, আমরা বিশিষ্টের কদর করব নিশ্চয়ই, ইতিহাসে। চেনা চেনা লাগে যেন, তবু নহে চেনা বলে মনে হয় কেন? ১৭৫৭ সালের মামলা, আর আমাদের স্মৃতিও খুব ফলফ্রুট-খাওয়া নয় তো, তাই। ঠিক আছে, সেমিনার শেষ এবং ঘুমও জবর পেয়েছে, এবার বাড়ি যাই।

লেখা / জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you