নাইয়রপুরাণ || সজলকান্তি সরকার

নাইয়রপুরাণ || সজলকান্তি সরকার

শোনো শোনো দেশের লোক নাইয়রও পুরাণ
নারীর মনে কত গো ব্যথা কত বলি দান॥

ভাটির কৈন্যা আদুরি গাঙের পারে বাড়ি।
অল্প বয়সে হইছে বিয়া দয়ামায়া ছাড়ি॥

মা-বাবার আদর যখন বুক জুড়ে ছিল।
মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে বধু করে নিল॥

কিসের লাগি হয় বিয়া মা-বাবা ছাড়িয়া।
আদুরি তা বােঝে না গাে বয়সের লাগিয়া॥

কোন ভূলােকে, কতদূর প্রাণপতির ঘর।
কোনোকিছু জানে না সে সবই যেন পর॥

মনের পাখি বনে যায় বাঁধতে নতুন বাসা।
অবলা আদুরির হায় গাে এমনি দুর্দশা॥

বিদায়কালে কেঁদে বলে ভুইল না আমারে।
নারীকুলে জনম বলে দিলে পরের ঘরে॥

নতুন বাড়ি নতুন ঘর নতুন মানুষজন।
একচরণে দাসী হইয়া কাটে গাে জীবন॥

দিন যায় বছর যায় স্বজনে নাই দেখা।
কতদূরে বাবার বাড়ি ঠারে যায় না রাখা॥

কচি কচি হাতের ডেনা কচি তাহার বুক।
এমনও সময় কালে পায় না বিয়ের সুখ॥

কাঁদতে কাঁদতে বধূ সেজে হয়ে যায় ঘরনি।
গৃহকর্ম স্বামীসেবায় শােকায় চোখের পানি॥

মাগন গায় গাঁয়ের মুনশি গাজির গীত লইয়া।
খবর দিল আষাঢ় মাসে নাইয়র নিব আইয়া॥

এই আশাতে অভাগিনী পথে মেলে আঁখি।
হায় কপাল আর কতকাল আষাঢ়ের বাকি॥

শাশুড়ি কয় কাইন্দ না গাে বড়বাপের ঝি।
তােমার বাপে নিব নাইয়র দেখে পাঞ্জিপুথি॥

আষাঢ় মাসের ভাসাপানি করে টলােমল।
বড়জাল গেছে নাইয়র আদুরির বদল॥

এখন যদি নাইয়র নিতে তার কেউ আসে।
শাশুড়ি দিবে না নাইয়র বধূশূন্য দোষে॥

কে বলবে গাে এইসব কথা আদুরির বাবারে।
আষাঢ়েতে নাইয়র নিতে আয় না যেন তারে॥

আদুরির হায় পােড়া কপাল দুঃখে কাটে কাল।
আষাঢ় গিয়ে শ্রাবণ এল ফিরল বড়জাল॥

বড়জালের রঙের নাইয়র শাশুড়িরে কয়।
নতুন শাড়ি হাতের চুড়ি টাঙে ভইরা থয়॥

বড়জাল কতকিছু আনছে নাইয়র করি।
পিঠাপুরি পানসুপারি বিলায় বাড়িবাড়ি॥

আদুরিরে নেয়নি নাইয়র শ্রাবণ হইল শেষ।
ভাদ্র মাসে হয় না নাইয়র শাশুড়ির আদেশ॥

আদুরি কয় নাইয়র নিতে কেন গাে আসে না।
বাবার বুঝি শইল খারাপ মায়ে করছে মানা॥

শ্রাবণ গেল ভাদ্র গেল আইল আশ্বিন মাস।
আদুরির হইল না নাইয়র শুধুই দীর্ঘশ্বাস॥

কার্তিকেতে হয় না নাইয়র পেরতকার্তি দোষে।
আশ্বিন মাসের সাতদিন আছে নাইয়রের আশে॥

অগ্রহায়ণ মাসে কৃষিকাজ নাইয়র হয় না তাই।
বছর বুঝি ফুড়াই যাবে আর তাে আশা নাই॥

এই আশ্বিনে সাতদিন তাই নাইয়রের আশা।
গনার দিন ফুড়াইয়া গেলে সকলি নিরাশা॥

দুইদিন পরে দেখা গাে দিলো আশ্বিনা বাওড়।
আফালে চলে না নাও কেমনে হয় নাইয়র॥

চার দিনের দিনে রে ভাই ঠিক হাইঞ্জা গইয়া।
নাইয়র নিতে আইল বাপে চিড়া-মুড়ি লইয়া॥

বাপেরে দেখিয়া তার আহা কী যে সুখ।
খুশিতে নাচিয়া উঠে আদুরিরও বুক॥

আর, তার পরে কী বলিব অতি দুঃখের কথা।
গােয়ালের গাই মরল বলে নাইয়র হইল বৃথা॥

কান্দে বাপে কান্দে ঝিয়ে গলায় গলায় ধরে।
বিধির লিখা এমন দশা নাইয়র গেল ফিরে॥

স্বপ্ন ভাঙল নিদ্রাদোষে, দই হইল মাঠা।
মাঝির দোষে নায়ের পথে বিধিল গাে কাঁটা॥

কাইন্দা কাইন্দা কয় আদুরি তাহারও বাবারে।
সামনে আমার নিদানকাল কইয়ো আমার মারে॥

প্রাণে যদি বাঁচি গাে আমি হইতে পারে দেখা।
ভাইধনরে বুঝাইয়া কইয়ো করতে পড়ালেখা॥

কেরাইয়া নাও ফিরে গেল নাইয়রি নাই তার।
আদুরির মুখ না দেখিয়া পরান কান্দে মার॥

আদুরির মায় কেঁদে বলে কেন এমন হলো।
কোন কারণে আদুরিরে নাইয়র নাহি দিলো॥

আদি অন্ত সব বৃত্তান্ত কয় আদুরির বাবা।
সুখের ঘরে দুঃখের অনল নিবাইবে কেবা॥

নিদান কালের কথা শুনে আদুরির মা কয়।
অল্প বয়সে হইছে বিয়া কী জানি কী হয়॥

যেই কথা সেই কাম ঘটিল প্রমাদ।
আদুরির দেখা দিলো মাতৃত্ব বিষাদ॥

মাথা ঘুরে বমি করে দেহে করে জ্বালা।
আদুরির সােনার অঙ্গ হয়ে গেল কালা॥

দিনেদিনে মাস ফুরাইল বছর হইল শেষ।
দেশজুড়ে দিলো দেখা সংগ্রামের আবেশ॥

হানাদারের বর্বরতায় দেশে শান্তি নাই।
ঘরবাড়ি ছাড়িয়া লােকে খোঁজে গােপন ঠাঁই॥

কেহ মইল যুদ্ধ করে কেহ রােগে শােকে।
কেহ মইল ভাত বেগারে কেহ আয়ু রেখে॥

এহেন সময় কালে আদুরির দিনমাস।
শরণার্থী হয়ে তারা করছে বসবাস॥

পাকিস্তান আর বাংলাদেশ হইল ভাগাভাগি।
কত মানুষ দেশ ছাড়িয়া হইল গাে বিবাগী॥

আদুরি ফিরল না দেশে মাতৃত্বের লাগিয়া।
স্বাধীনদেশে পায় না তারে মা-বাবা খুঁজিয়া॥

হলো না তার রঙের নাইয়র নতুনশাড়ি পাইয়া।
জনমের লাগি দেশের মাটি গেল গাে ছাড়িয়া॥

আদুরির হইল জন্মের নাইয়র সকলি যে পর।
নীল আসমানে সাদামেঘে বান্দা তাহার ঘর॥

দীনবন্ধু কয় ভাবিয়া, ফল হয় কর্ম দিয়া।
বাল্যকালে দিও না কেউ সােনামণি বিয়া॥

দিশা :
মরি হায় রে হায় বাল্যকালে কৈন্যা দিল বিয়া।
রঙের নাইয়র হইল না গো জনমের লাগিয়া॥
[পুঁথিঢঙে এই টেক্সট বাদ্যযন্ত্রসমেত গলায় গেয়ে ফেইসবুকে শেয়ার করেছেন অসীম সরকার, সেই রেকর্ডের লিঙ্ক এইখানে লেখার সঙ্গে রেখে দেয়া যাচ্ছে। আগ্রহীরা ফেইসবুকে লগইন করে দেখে/শুনে নিতে পারবেন। — গানপার] 

COMMENTS

error: