লিটলম্যাগের মেমোরিচারণ

লিটলম্যাগের মেমোরিচারণ

গ্রন্থী  নবযাত্রা সংখ্যাটা সেদিন একজনের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এলাম ফোটোগ্র্যাফিভিত্তিক আহমদ মিনহাজের লেখাটার ধরনধারন দেখার জন্য। এনে পড়তে লাগি শুরুতেই ছায়া-সম্পাদকীয়টা। পড়লাম। পত্রিকার মূল ক্রোড়পত্রও দেখলাম এই ভিত্তিকই, সেলিব্রেইট করা, তিরিশ বছরের স্মৃতি উদযাপন। মন্দ নয়। পুরানা সিলেট উঠে এল একঝলক। বছর-তিরিশ আগে এই পত্রিকাকেন্দ্রী কিছু বন্ধুবান্ধবের আড্ডা-উল্লাসের তারুণ্যঝঙ্কৃত যৌবনের দৃশ্যমালা পাওয়া গেল। মনে করার কারণ নাই যে কেবল স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ গ্রন্থী তিনদশকপূর্তি ‘তেরো মার্চ দুইহাজার বিশ’ সনে বেরোনো পুনরাগম/কামব্যাক সংখ্যাটি, আছে আরও অনেক জিনিশই, যেমন থাকে ইন-জেনারেল ছোটকাগজগুলায়, আছে কবিতা আছে গল্প আছে অনুবাদপদ্য, সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় ও সুদীর্ঘ ছায়া-সম্পাদকীয়, ‘সময়ের মুখচ্ছবি’ নামফলকের আওতায় তিনজনের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্যের গদ্য, ‘ভাষার সাতকাহন’ শীর্ষক ফলকের আওতায় আরও তিন গদ্য, ‘গল্পগুচ্ছ’ শিরোনামে ফোটোগ্র্যাফিভিত্তিক আহমদ মিনহাজের গদ্য যেইটার কথা বলতেসিলাম পয়লা লাইনে, আছে আরও সাত-সাতজন কথাসাহিত্যিকের ছোটগল্প, ‘ছোটকাগজ : অতীত ও সাম্প্রতিক’ শীর্ষক ক্রোড়পত্রের ফার্স্ট পার্ট, ‘গ্রন্থীযাপন’ শীর্ষক সেকন্ড এবং ‘গ্রন্থীযাপন : পুনর্মুদ্রণ’ শীর্ষক পার্ট থ্রি। ভিতরের মালমশলাগুলা ভালোই, চিত্তাকর্ষক ছাপা, সাইজ ও বাঁধাই সবই। নিশ্চিত নিঃসন্দেহ বলা যায় কাগজটা সমৃদ্ধ।

তবে যে-কথাটা আপাতত বলবার, এই পত্রিকার ক্রোড়পত্রাংশটুকু পড়তে পড়তে যেই কথাগুলা আমার মনে হলো, অতি সংক্ষেপে তা প্রকাশের ট্রাই করব। ছোটকাগজ নিয়া আসলে তেমনকিছু বলার থাকতে পারে না আপনার বা আমার, কারণ এই জিনিশটা আপনাকে বা আপনার মতো অন্য কাউকে যে কিনা কেবলই বিচিত্র রচনায় বাজিয়ে যেতে চেয়েছিল সময়টাকে — স্পেইস দেয় নাই, দিতে চেষ্টাও করে নাই, ইন্সপায়ার ইন্সটিগেইট তো করে নাই-ই; কিন্তু সময় তো চলে গেছে, সেই প্রথমদিনের লেখাতাড়না সৃষ্টিতৃষ্ণা আর তো ফিরবে না আপনার-আমার, কাজেই, ছোটকাগজ নিয়া আমার বা আপনার দিল্লাগি দিলচস্পি থাকতে পারে না বলেই মনে করি আমি। কী করুণ জন্তুর মতো অসহায় সময় পার করেছি আমরা সেই সময়টায় আশ্চর্য সমস্ত উজবুকবেষ্টিত হয়ে! এবং কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন অনেকেই আপনারা বা খানিকটা আমিও, ছুপা রুস্তুম হয়ে, উজবুকদের একবারও মনে হয় নাই যে এই লোকটার লেখার মূল্যবান সময় ব্যাহত হচ্ছে এইধারা কামলা খেটে! বেশিরভাগ দেশবরেণ্য ছোটকাগজ বা বাহারি লিটলম্যাগ, সেইগুলার এডিটর, উজবুক বলব না তো কী বলব, আমার দশকের অমুক তমুক, একটা আস্ত জিন্দেগি পারায়ে গেল অথচ এরা সামান্য প্রুফরিড করাটা শিখতে পারল না! আমার মনে হয় যে এই লিটলম্যাগ জিনিশটা নিয়া আমরা যদি স্মৃতিমেদুরতা বা বাৎসল্য বাদ দিয়া আলাপ শুরু করতে পারি, ভয়ঙ্কর একটা ছবি ফোটানো সম্ভব হবে। সেই সময়টা আসলেই ভয়ঙ্কর ছিল, মূর্খামির ভয়ঙ্কর সময়টায় আমরা টাইম কিল্ করতেসিলাম হাবার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে চৌকস উজবুকদের জুতাজামা-আচকানের জেল্লার পানে। এবং একটা টাইমে এমনও মনে হইতেসিল যে এইসব পত্রিকায় লেখাপ্রকাশ রকেটে চেপে স্পেসট্র্যাভেলের মতোই দীর্ঘ মহড়াসাপেক্ষ ও মহাকাশবিদ্বানের ব্যাপার, আমার-আপনার পেটের বা চেটের ব্যথা নিয়া কাগজগুলা ভাবেটাবে না।

অ্যানিওয়ে। একটা কারণে অ্যাডমিট করতে পারি লিটলম্যাগ নিয়া আলাপচালনা/আলাপালোচনা, আর তা হচ্ছে যে এই আলাপ দিয়া আজকের ওয়েবম্যাগটাইমে এক্সপেরিয়েন্স এনরিচ করা। তা কীভাবে হবে এখনও জানি না। আজও কবিতার একটা মাইন্ডব্লোয়িং ওয়েবম্যাগ হলো না বাংলায়। ইংরেজিতে যেসব কবিতাম্যাগ দেখি ওয়েবে, কেবল দেখে নয় পড়ে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। অথচ বাংলায় যা-কিছু ওয়েবকন্টেন্ট তার ম্যাজোরিটিই কিন্তু কবিতাকেন্দ্রী। লিটলম্যাগগুলার বাঁদরামি এইখানেও হবহু অবিকল, কেবল লিটলম্যাগ ছিল ডোরলকড বাঁদরামির জায়গা আর ওয়েবম্যাগ অবারিতদ্বার।

তবে একটা কথা আপনি নিশ্চয় স্বীকার করবেন, লিটলম্যাগ বলতে যে-ঘটনাটার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ সেইটা পশ্চিমবঙ্গের। ওদেরটা খেয়ে আমরা গায়েগতরে ডাঙ্গর হয়েছি। কিন্তু আমাদের এখানকার কাটা সাপের মুণ্ডু গল্পের স্রষ্টা আর শালুক-শাপলা ম্যাগাজিনের কবিসম্পাদক, এরা আপনার মগজে বা হৃৎপিণ্ডে এমনকিছু রক্ত পাম্প করতে পেরেছে বলে তো মনে হয় না। খামাখাই গুণ্ডামি হয়েছে।

একজীবনেই দেখে গেলাম সেই দাদাদাদির শেখানো বুলির সত্যতা : গুণ্ডামি বেশিদিন থাকে না। কাজটাই থাকে। তেমন ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল কাজ কই লিটলম্যাগের? পশ্চিমবঙ্গে বেশুমার আছে, আমাদের নাই। এই কথাটা কবুল করতে যেয়ে দ্বিকোটিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাচ্যাৎনা আমারে বাধা দ্যায় নাই।

কিন্তু দেখেন কী অপোগণ্ড কারবার, দশবছরেরও অধিক কাল অতিবাহিত হয়ে গেল নয়া মাধ্যমে লেখালেখি বাস্তবতার, আজও ছোটকাগজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী মানুষেরা ভাবেন যে ওয়েবম্যাগে লেখা ছাপানো খুব-একটা কাজের কিছু না! কাগজের বসুন্ধরাপাতায় ছাপা লেখাগুলাই রিয়্যাল লেখকসাহিত্যিকের লেখা। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধবও সম্ভবত এই চিন্তারই সাবস্ক্রাইবার। গ্রন্থী  এই সংখ্যায় যারাই স্মৃতিচারণ করলেন, লক্ষ করে দেখলাম, এক আহমদ মিনহাজ ছাড়া বাকি সকলের মধ্যেই চাইল্ডহুড রোমন্থন করার একটা টোন। ভাবটা এমন যে, এখন তো বড় পরিসরে লিখি, এখন অ্যাডাল্ট হয়েছি খোদার ফজলে, একটু ছোটবেলা নিয়া আলাপ করা যায় কাজেই। কিন্তু হতো যদি উল্টাটা, তাইলে বুঝতাম ছোটকাগজ তার একটা ছাপ রাখতে পেরেছে এককালের লেখকদের মধ্যে।

অ্যানিওয়ে। লিটলম্যাগ নিয়া আরও দুইটা লেখা আছে সেই ২০১০ সনে লিখেছিলাম কোনো-এক/একাধিক পত্রিকার ডাকে, শেষে লেখাগুলা ছাপা হয় নাই আমার ‘জাজমেন্টাল’ কনক্লুশনের কারণে। নানান কান্নাকাটি শেষে আমার বক্তব্য অভিন্ন হয় : লিটলম্যাগ অত মহান কিছুই করতে পারে নাই বাংলাদেশে, যা করেছে তার নাম পাপ, ক্ষমার আওতায় আসে না এমন পাপ, বেশকিছু ভালো লেখক ও লেখা সারাজীবন তিনশ কপির চকির তলায় তেলাপোকায় কাটায়া নাশ করবার পাপ। এইটা পাপ নয়, পাপ তো ব্যক্তিগত, সমষ্টির ক্ষতি হয় না তাতে, এইটা অপরাধ, ক্ষতি হয়েছে এতে গণগোষ্ঠীরই, নিরানব্বইটা গাধার দঙ্গলে একটা ঘোড়াকে খাটিয়ে মেরে তার দুর্ধর্ষ লেখাটাকে ওয়াইডলি সার্কুলেইট না করবার অপরাধে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ পত্রিকা অপরাধী।

সন্দীপন ঘুরিয়েফিরিয়ে একটা কথা বলে গেছেন যে জীবনানন্দের গদ্যলেখাগুলা টাইমলি প্রকাশিত হলে বাংলা গদ্যের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো। আমি তা বিশ্বাস করি। এমনকি, আমি তা প্রায়ই চোখ বুজে প্রমাণও করি বিরল অবসরে। লিখতে কে চায় এই দেশে? এই হুল্লোড়ের মজমায়? লিটলম্যাগের ক্ষেত্রেও সন্দীপনের কথাটা আমি কিছু অভিযোজিত করতে পারি : কিছু অন্তত গদ্য এবং অজস্র অসহনীয় পদ্যের নর্দমা থেকে কিছু অন্তত পদ্য সবাই সব পত্রিকাই যদি সার্কুলেইট করত সর্বত্র, অন্তত লক্ষ লক্ষ অপোগণ্ড সাংবাদিকের জায়গায় আমরা কিছু গতিশীল কব্জিওয়ালা সাংবাদিক পেতাম, হয়তো এদের মধ্য থেকেই মার্কেস বেরিয়ে আসতেন বাংলায়। আমি বাংলাদেশে একজনও সাংবাদিক দেখি না যে একটা সামান্য পরিস্থিতির বিবরণ ঠিকঠাক দিতে পারে। এত বড়াই আমাদের সাজে না, কাজেই, যা করতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।

শুধু একটা ছোট্ট কথা আর। আপনাদের কারোর কি ইয়াদ আছে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের লিটলম্যাগগুলা সাক্ষাৎকারে কেমন আবিল হয়ে উঠেছিল? কবিদের কারোরই ডেব্যু বই বাইর হয় নাই, কিন্তু সাক্ষাৎকার বেরিয়ে গেছে সাতটা। আমাদের লেখালেখি ডিরেইলড হয় ওই সময়েই। এর আগের দশকে, আশিতে, যারা লিটলম্যাগে কবিতাগল্প লিখছিলেন তারা আমার বিচারে কেবলই নির্বিচার হাবার মতো কলকাতার অনুকারবৃত্তি করে গেছেন। তখনকার নায়ক শান্তনু চৌধুরী স্মরণ করছি। কিংবা সাজ্জাদ শরিফ তো গোড়া-আগা জয় গোস্বামী। ছুরিচিকিৎসা  তা-ই।

কিন্তু হচ্ছে। এখন গত দশ বছরে ফেসবুকে ব্যক্তিগত পাতাগুলায় যারা লিখছে তারা দারুণ করছে দেখতে পাই আমি। কবিতায়। কিন্তু শোকেইসিং দরকার। দরকার শোকেসের। পত্রিকার। অনলাইন পত্রিকার জরুরৎ নিয়া আপনাকে এবং আমাকেও অনেক চিল্লাপাল্লা করতে হবে নেক্সট আপকামিং দিনগুলায়। কিন্তু নিজের অভিপ্রেত প্রোজেক্টগুলা ব্যাহত করে নয়, চিল্লাপাল্লা করতে হবে তাৎক্ষণিকা  টাইপের মাধ্যমে ম্যাক্সিমাম। তাতেই অনেক হবে। দায় স্বীকার এবং দায়িত্ব পালন। গদ্যের জন্যে কেন হুৎকো মোটা বাঁশপাতার কাগজ করতে হবে আজকে? ডিসগাস্টিং লাগে না?

কাগজ দরকার কবিতার। শুধু কবিতার। বিচিত্র উপায়ে এবং নকশায় প্রেজেন্টেশন দরকার কবিতার। শুধু ‘সুচিন্তিত’ ও ‘সুপরিকল্পিত’ সংকলন হতে পারে গদ্যলেখার। আর, সংকলন পরিকল্পনা তো কোনো সুস্থ সম্পাদকের রোজকার কাজ হতে পারে না মনে হয়। সেজন্যে একটা টাইম লাগে লম্বা স্প্যানের। রোজ রোজ পদ্য পড়ব, ধর্মীয় শ্লোকের জপতপের মতো, গদ্য পড়ব হপ্তায় বা মাসেচান্দে। এই বয়সে এসে এমন কতিপয় ভাবনা জাগায়ে গেল ‘গ্রন্থী’ কামব্যাক সংখ্যাটা।

পত্রিকার সম্পাদক শামীম শাহান, সহযোগী টি এম আহমেদ কায়সার, উভয়েই বোধহয় বিদেশবাসী, ইংল্যান্ডের অ্যাড্রেস দেখে তা-ই মনে হলো। পত্রিকার কলেবর ৩১২ পৃষ্ঠা ছাড়াও অন্তিমে আছে আরও একফর্মা কালারফ্যুল গ্লসি কাগজের কমার্শিয়্যাল বিজ্ঞাপনাংশ। হাদিয়া ১৫০ বিডিটি। রিলিজের দিনই পত্রিকাটা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মিলনায়তনে মহরৎ আয়োজন করেছিল যেখানে লেখক-কবিদের সম্মিলন ঘটেছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। ‘তেরো মার্চ দুইহাজার বিশ’ সনে বেরোনো পত্রিকাটা বাইরাবার দিন-দশেকের মাথায় দেশে এবং দুনিয়ায় প্যান্ডেমিকের লকডাউন শুরু হওয়ায় এর মার্কেটিঙটা আশানুরূপ হয় নাই আন্দাজ করতেসি। আবার এইটাও ঠিক যে লিটলম্যাগ জিনিশটার মার্কেটিং লাগে না। ম্যাগসম্পাদকেরা মার্কেটিং জিনিশটায় বেজায় উদাসীন। অভিজ্ঞতায় জানি। লিটলম্যাগ মরামুর্দাদের আর ফরিশতাদের পড়ার জিনিশ, পাপাত্মা পাঠকের খবর জানিয়া কাজ নাই।

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: