সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে আমার-যে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি ছিল, তা তো নয়। মাঝেমধ্যে ঢাকা কিংবা সিলেটে তাঁর সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। সে-সুবাদে সাহিত্যযশপ্রার্থী এক অনতিতরুণের বেশকিছু জিজ্ঞাসার জবাব অতি আন্তরিকতার সঙ্গে দিয়েছিলেনও। এমনকি প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম ও লোকগান নিয়ে আমার কয়েকটি কাজের মৃদু প্রশংসাও করেছিলেন – এতে আমার তো প্রায় বর্তে যাবার অবস্থা। যাঁর মার্জিনে মন্তব্য পড়ে-পড়ে আমাদের লেখক হয়ে ওঠার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, সেই হকভাইয়ের কাছ থেকে সামান্যতম স্তুতিবাক্য তো আমার কাছে প্রার্থিত এবং অমৃতসম। এমনতর স্মৃতিকথনে হয়তো আমার অহংবোধ কিছু প্রকাশ পেলো, তবে যেহেতু এ-লেখার মূল বিষয়ই হচ্ছে হকভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত গল্পটা বলা – তাই শুরুতেই এ-রকম স্মৃতিটুকু বর্ণনার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
হকভাই নানা কাজে, নানা অনুষ্ঠানে, সিলেটে এসেছেন। আমি সিলেটেই থাকি, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সঙ্গে বারকয়েক দেখাও হয়েছে। সে-সময় তাঁর ব্যক্তিগত সান্নিধ্য ছিল আমার জন্য এক মধুর স্মৃতি। কবি শুভেন্দু ইমামের বাসায় ইফতারপূর্ব এক দীর্ঘ আড্ডায় ছিল কতই-না অন্তরঙ্গ কথাবার্তা! তিনি শোনালেন তাঁর কল্পনাপ্রসূত সৃষ্টি আধকোশা নদী আর জলেশ্বরী জনপদ নির্মাণের গল্প। সৃজনশীল বইয়ের বিপণন প্রতিষ্ঠান বইপত্রতে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বই দেখছিলেন আর কথা বলছিলেন বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পের গতিবিধিসংক্রান্ত প্রসঙ্গ নিয়ে। আমি চুপচাপ তাঁর কথা শুনছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম – তাঁর বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস খেলারাম খেলে যা-র বাবর চরিত্রের কথা, ভাবছিলাম তাঁর রচিত নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যের কৃষকনেতা নূরলদীনের কথা, যে-নূরলদীন ‘একদিন কালপূর্ণিমায়’ হাঁক ছেড়েছিল ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
ভাঙা-ভাঙা স্মৃতিতে তো মনে পড়ে কতকিছুই। মনে পড়ে বৃষ্টিস্নাত এক সকালে সিলেট শহরের বুক চিরে প্রবহমান সুরমা নদীর তীরে রেলিঙে ধরে কালো শার্টপ্যান্ট-বেল্টপরিহিত হকভাইয়ের নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা, মনে পড়ে শাহজালাল মাজারশরিফে দু-হাত উপরে তুলে নিমগ্ন প্রার্থনারত মুখাবয়ব, মনে পড়ে তথ্যচিত্রনির্মাতা নিরঞ্জন দে-র বাসায় শিল্পী অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর কণ্ঠে কবির প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলো শোনা, মনে পড়ে সাংবাদিক আহমেদ নূরের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হকভাইয়ের দরাজ কণ্ঠের বক্তৃতা। তবে এসব ছাপিয়েও যেটি খুব করে মনে পড়ে তা হলো কবির স্বকণ্ঠে কবিতা শোনার অভিজ্ঞতা। সেদিন ছিল ২০১১ সালের ১ জুলাই, শুক্রবার, সন্ধ্যা সাতটা। সিলেট নগরের নয়াসড়ক এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় নিরঞ্জন দে চারুবাক সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজন করেছিলেন ‘কবির কথা, কবিতার কথা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানের। সে-অনুষ্ঠানে কথায়-আবৃত্তিতে কবি টানা কয়েক ঘণ্টা ঘোরলাগা এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাতিয়ে রেখেছিলেন উপস্থিত সুধীজনদের। আহা, কী ভরাট কণ্ঠেই-না তিনি সেদিন আবৃত্তি করেছিলেন তাঁর লেখা ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি :
আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে?’
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে।
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে।
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দিরবেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে।
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে।
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে।
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে।
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে।
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে।
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে।
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?’
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই –
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের –
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস,
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোস করিনি কখনোই আমি – এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাসপ্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি –
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।
সেদিনের সে-অনুষ্ঠানের পর আরও কয়েকবার হকভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। শেষবার দেখা হয় ঢাকায়। সেবার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমার সদ্য-সম্পাদিত গানের ছোটকাগজ দইয়ল। তিনি পত্রিকাটির প্রচ্ছদ, অঙ্গসৌষ্ঠব ও লেখা নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন এবং নিজ থেকেই বলেছিলেন পরের সংখ্যার জন্য একটি লেখা দেবেন। কিন্তু সেই লেখা আর তাঁর দেওয়া হয়নি।
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS