সেয়ানার সেমিনার

সেয়ানার সেমিনার

কোনটি সহজ কাজ — কঠিন বিষয় সহজ করে উপস্থাপন, নাকি সহজ বিষয় কঠিন করে উপস্থাপন?

দুইটাই মেনে নেয়া যায়, দ্বিতীয়টা ঘটলে একটু কষ্টমষ্ট করে আমরা লাইন একটা বাইর করেই নিতে পারি নিজের মতন বুঝবার। তবে উপস্থাপক যখন বিষয় রীতিমতো ভুলিয়ে দেন, শুধু বিষয় ভোলানোই নয়, এক্কেবারে বাপদাদার নামও ভুলিয়ে দেন, তখন হাত-পা ছেড়ে কান্দন ছাড়া আমাদের আর গতি থাকে না। ব্যাপারটা সহজ-কঠিনের বাইরে যেয়ে একটা থার্ড ডাইমেনশন পায়। এমন বিপদে কেউ পড়লে একটা কার্যকর উপায় অবশ্য আছে উদ্ধারের, সেইটা আমরা ব্যবহারও করি প্রাচীনকাল থেকে, অতি-উচ্চাসীনদের ক্ষেত্রে এই উপায় কেউ যদি ব্যবহার করেন তো সেইটা নিজ দায়িত্বেই করবেন, বিপদে পড়ে শেষে পস্তাবেন না। উপায়টা হইল সম্মিলিত করতালি। কিন্তু উপস্থাপক যদি এই কমেন্টারি-লিখনরত বান্দার ন্যায় নাছোড় হন, তখন সবাই মিলে সমস্বরে ‘ওয়াহ ওয়াহ … ক্যায়া বাত … বহৎ খুব … ধন্যবাদ আবার আসবেন’ প্রভৃতি শব্দ বর্ষণ করুন, বিফল হইবেন না।

তা, এমনধারা আওয়াজ কিন্তু উঠেছিল একটা সময়, এই তো সেদিন, নব্বইয়ের দশকে, আঁতেলেকচুয়ালদিগের দৌরাত্ম্য রুখিয়া দাঁড়াইতে যেয়ে, এদের বুকনি-বাগ্মিতা-বান্দ্রামি ঠেকাইতে যেয়ে সেই সময়ের তরুণদের মধ্যে এমন একটা এক্সপ্রেশন খুব শোর মাচায়েছিল কিছুদিন — ‘ধইন্যবাদ, ভালোই দিয়া গেলেন!’ তখন স্বৈরশাসন থেকে ছাড়া-পাওয়া বাংলাদেশ, গণতন্ত্রের কচমা বাতাস, সর্বদিগন্তব্যাপিয়া সবক চলছে নবতর, নতুন তাঁতিরা চালাইতেসিলেন পুরান তাঁতমেশিন, খটর-খটর আওয়াজে ঝালাপালা আমাদিগের কান।

তো, খুব দেখা যাইত, কোনো বকাসুর শুরু করলে যেন আর থামতে চায় না, আবেগের আমাশয় ছিল সর্বত্র সেইসময়। ঠিক এমন একটা সার্কাম্সটেন্সেস, আমরা তখন মেট্রিক দিচ্ছি-দিব করছি, লিখনপড়ন করার চেয়ে সেলুনে বা চা-স্টলে বারোইয়ারি গুলতানিতেই প্রীতি অধিক, সেই মুতাবেক যথাসাধ্য মোড়ে মোড়ে প্রেমের পতাকা পতপত করে উড়ছিলও তো, সত্যিকারের এডুকেশন আমরা পাচ্ছিলাম এই সেলুন ও চা-দোকানগুলো থেকে। এবং পাড়ার অপগণ্ড বড়ভাইমার্কা যুবকেরা তখন গলায় মিঠা পানির যোগান পাচ্ছিল প্রচুর, মিঠি মিঠি বাত, নয়া বারিষার গাঙে নিত্য নয়া বান, বহুদিন বাকরুদ্ধ রহিয়া মরোমরো বিপ্লবীরা ঝাণ্ডা উড়াইতেসিলেন নতুন উদ্যমে বিপ্লবের, আর আমরা খালি চারিদিকে এইসব বকরবকর শুনে চলেছিলাম। যদিও ওই বয়সটাই এমন, সর্বাবস্থায় একটা-না-একটা পথ ঠিকই বের করে ফেলার প্রয়োজনীয় হিম্মৎ ছিল আমাদের। তো, বাঁচিয়ে দিল গান।

গণতন্ত্রের গলাবাজ গুরুজনদের গালি-খাওয়া বাংলা ব্যান্ডসংগীত।  অপসংস্কৃতির বিভীষীকা নাম-কুড়ানো তরুণ তেজের বাংলা ব্যান্ডগান। সবকিছু বাদ দিয়ে এইখানে প্রাসঙ্গিক হবে একটা ব্যান্ডের নাম উচ্চারণ, সেইটা ‘ফিডব্যাক’। লিরিক্স ও গায়নভঙ্গিতে ভীষণ পোলিটিক্যাল স্ট্রেন্থ নিয়ে সামনে আসে ফিডব্যাকের ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’, সেইটা বাংলা ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, ঘটনাটা আজও স্মরণীয়। সেই অ্যালবামে গান ছিল ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’, ঘন ঘন কমিটি গঠনের প্রহসনবাতাস বইছিল চারিপাশে দেশ জুড়ে, এবং সেই গানে ছিল এই লাইনগুলা, ব্যালাডধর্মা গান জুড়ে ফিরে-ফিরে-আসা বারবার এই লাইনগুলা — ‘ঢাকার ছেলেরা চিৎকার করে বলেন : ধন্যবাদ ভালো দিয়া গেলেন, ধন্যবাদ, ভালোই দিয়া গেলেন!’ ইত্যাদি। বিদ্রুপ, শ্লেষ ও ক্রোধের এমন শিল্পীত সমাবেশ ঘটেছিল এলবামটাতে, আজও যা তুলনারহিত।

তো, কাজের কথায় ফেরা যাক। একজন বললেন, এহেন পরিস্থিতিতে সেমিনারে স্লিপিং ইজ দি বেস্ট পলিসি। ভালো ও উত্তম সল্যুশন। তবে এমন উপস্থাপকও আছেন, যাদের গলা ও হাত-পা আইটেম-স্যঙের মতন এত ক্যাকোফ্যানি তৈরি করে যে, শান্তিমতো ঘুমাইতেও দিত নায় আপনারে। সেক্ষেত্রে একটা বিকল্প হাতের কাছে রাখা যায়, যেমন মনের মানুষ তথা যাদের সঙ্গে গ্যুড-টার্ম আছে তেমন লোকদের পাশাপাশি নিজের আসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। তাতে একটা লং-টাইম এন্ডিউরিং সোশ্যালাইজেশন হবার সম্ভাবনা জোরদার থাকে। বিশেষত উপস্থাপক যদি শ্রোতার পূর্ব-অভিজ্ঞতার আওতাধীন হন, তথা শ্রোতা যদি সেই উপস্থাপক কর্তৃক পূর্ব-ভুক্তভোগী হন, তখন এইসব বিকল্প সল্যুশন মজুদ রেখে আসন গ্রহণ করা জীবন-রক্ষাকারী নির্বিকল্প উপায়।

কিন্তু এই ধরনের সেমিনার-সুবোধ সুশীল সশব্দ লোকজন কখনো কখনো আমাদের উদ্ধারকারীও বটে। যেমন ধরুন, চিফ গেস্ট আগমনে লেইট হচ্ছে, তো টাইম কিল করা দরকার, তখন আপনি ওই সেমিনারশিল্পী গলাবাজকে মাইক্রোফোনে ঠেলে দেন, লোকে অবশ হয়ে বসে বসে চিফ গেস্টের আগমনপ্রার্থনা করতে থাকবে হেন মুসিবত হইতে রেস্কিউ লভিতে। কিংবা ধরুন কোনো কারণে আপনি নিজে সেই সেমিনারে ওইদিন পার্ফোর্ম করতে অনিচ্ছুক, তো বাঁচার পথ একটাই, সেই সেমিনারশিল্পীর হাওলা করে দিন আপনার মাইক্রোফোন-মাউথপিস, লোকে তখন দোয়া করবে এরপর আপনে যেন কথা না-বাড়ান অধিক। কাজেই দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটার মেরিট-ডিমেরিট দুইটাই আছে। এখন, সম্মানিত সুধী, এই হইল অবস্থা। আপনাদের কোনো কোয়ারিজ থাকলে বান্দা হাজির। ধন্যবাদ। ভালোই দিয়া গেলাম!!!

জাহেদ আহমদ ২০১৪

COMMENTS

error: