মহম্মদ সাদি : মৃত্যুমর্সিয়া || আহমদ মিনহাজ

মহম্মদ সাদি : মৃত্যুমর্সিয়া || আহমদ মিনহাজ

জীবনানন্দের বোধ কবিতাকে সার্থক প্রতিপন্ন করে সাদি মহম্মদ চলে গেলেন। সব কাজ, চিন্তা-প্রার্থনা তুচ্ছ-পণ্ড করে বিদায় নিলেন আকস্মিক। এভাবে যাওয়াটা সঠিক মনে হয়েছে তাঁর, তাই হয়তো গিয়েছেন। ইচ্ছে করলে আরো কিছুদিন যাপন করতে পারতেন জীবন। মাটির পৃথিবীতে রোগশোকে জীর্ণ মানুষ তবু বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার ক্লান্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে সাদিও থাকতে পারতেন আরো কিছুদিন। একরাশ অনুযোগ-অভিমান বুকে চেপে ছাত্রদের গানের তালিমে কেটে যেত বেলা। তাদের মধ্যে আগামীর কোনো সাদিকে দেখার আনন্দ হয়তো ছলকে উঠত কখনো। তানপুরা আর হারমোনিয়াম টেনে রেওয়াজ, বাঁচার একঘেয়েমি কাটানোর আয়ুধ হিসেবে কাজ করত ঠিকঠাক। শিবলী মহম্মদের সঙ্গে গান শোনা, ছবি দেখার দৈনিক অভ্যাস, দুই ভাই মিলে চালিয়ে নিতেন দিব্যি। ফেলে আসা দিনগুলোর রোমন্থন সঙ্গী হতো সেখানে। অনেককিছু হতে পারত, ঘটতে পারত অনেককিছু, তবু ক্লান্তি কি পিছু ছাড়ত তাঁকে? নিষ্কৃতি কি জুটত কপালে? যার জন্য ক্রমে মরিয়া হয়ে উঠছিলেন সাদি।

বেঁচে থাকার মন্ত্র একটাই,—যা ঘটার ঘটুক, তবু বাঁচো। দম বন্ধ হয়ে আসছে জেনেও বাঁচো। বাঁচাটা হলো অভ্যাস। জয়নুল আবেদিনের আঁকা গুনটানা ছবিটি দেখোনি? বেঁচে থাকা সেরকম লড়াই বটে! স্রোত ঠেলে নৌকা সামনে এগুতে পারছে না। খরস্রোতের কুম্ভিপাক থেকে তাকে টেনে বের করতে মাঝি তীরে নেমেছে। দড়ি দিয়ে বাঁধা নাওকে প্রতিকূল স্রোতে টেনে নিচ্ছে অনিবার। বেঁচে থাকার অর্থ খানিক মালুম হয় যদি সিসিফাসকে ভাবো একপল। ভারী পাথরখানা ঠেলেঠুলে পাহাচূড়ায় উঠানোর পেরেশানিতে বেচারি নাকাল প্রতিদিন। চূড়ায় তোলার মুহূর্তে পাথর হাত ফসকে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ওটাকে টেনে তোলো এখন। পাথর ফের গড়িয়ে পড়ছে নিচে। ফের ঠেলে তোলো। খেলাটি অন্তহীন! যার ঘাড়ে ওটা একবার চেপে বসে কেবল সে বোঝে এর যাতনা। সাদি মহম্মদের পাথরটা জাস্ট আর ঠেলতে ইচ্ছে করেনি। ঠেলাঠেলি থেকে কীভাবে নিষ্কৃতি মিলবে সেই ফয়সালা অবশেষে নিজেই নিয়েছেন। যেহেতু নিয়েছেন, তাঁর জন্য ক্রন্দন অর্থহীন!

সাদি এভাবে যাবেন, তাঁর ভাগ্যললাটে এটা লেখা ছিল। তকদির!—নির্ধারিত ছিল তিনি এমন করেই যাবেন। রোজা ভেঙে ইফতারটা সেরে নিবেন চুপচাপ। তানপুরা টেনে রেওয়াজ করবেন কিছুখন। যাওয়ার বন্দোবস্তে নেমে পড়ার আগে ক্লাইমেক্স রচিবেন নিজ হাতে। স্বেচ্ছামরণকে ক্লাইমেক্স ছাড়া আলিঙ্গনে জড়ানো কঠিন। জীবনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে মানুষের প্রেরণা লাগে। অনেক অনেক প্রেরণা। নিজেকে মেরে ফেলতেও তাকে চাই। প্রেরণা ছাড়া স্বেচ্ছামরণ কভু ঘটার নয়। আবেগের পারদকে চড়ায় তুলতে না পারলে জীবনরথের চাকা থামানোর সিদ্ধান্তে স্থিরসংকল্প হতে পারে না মানুষ। মরণটা তখন আসি-আসি করেও আসতে দেরি করে। তানপুরা হাতে সাদির শেষ রেওয়াজটা ছিল ক্লাইমেক্স। নিজেকে শেষ করতে সে তাঁকে সাহায্য করেছে। অনামা বিধাতার সাধ্য ছিল না একে থামায়। সাদি মহম্মদ, হতে পারে গত পাঁচ-দশ বছরে একটু-একটু করে তিনি কীভাবে যাবেন তার ফিকিরে ছিলেন। পৃথিবীকে বিদায় বলার প্রাক মুহূর্তে শেষ প্রেরণা কী হবে সেটাও হয়তো ঠিক করে নিচ্ছিলেন সংগোপন। যদি তাই হয়, তাঁকে এইবেলা রোখা স্বয়ং বিধাতার জন্য নীতির বরখেলাপ হতো।

সাদি মহম্মদের প্রস্থানপটের সঙ্গে আন্দ্রেই তারকোভস্কি নির্মিত নস্টালজিয়ার সর্ষে পরিমাণ সম্পর্ক নেই। তাঁর স্বেচ্ছামরণের খবর শুনে ছবিটির কথা তবু মনে পড়েছিল তাৎক্ষণিক। পাগলাটে ভাবুক ডোমেনিকোর মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মানুষ ও মানবতার পতনকে নিজের পতন ঠাউরে নিয়েছিল হতভাগা। গায়ে আগুন লাগানোর মতলবে নিজের সাজানো বক্তৃতামঞ্চে মানবতার পতন লক্ষ করে উচ্চকিত ভাষণ দিতে উঠেছিল। ভাষণে ছেদ টানার মুহূর্তে চড়া সুরে মিউজিক বাজানোয় সম্মতি ছিল তার। ডোমেনিকোর জন্য ওটা ছিল ক্লাইমেক্স। আগুনে জীবন বিসর্জনের অন্তিম প্রেরণা। সাদি মহম্মদের প্রস্থান সিনেমাটিক নয়। ডোমেনিকোর নিষ্ফল চিৎকারে বিদীর্ণ নয়, যদিও নির্বেদবিষে তাঁরা দুজনেই সমান নীল সেখানে।

মানুষকে শেষবার খাদ থেকে উঠে আসার আহবান, পাগলাটে বাতিকটি সাদির ওপর ভর করেনি, তা-বলে জখমি কি ছিল না হৃদয়? বিলক্ষণ ছিল। জগদ্দল সমাজে রবি ঠাকুরের গান আর মা-বোন-পরিবার আঁকড়ে বেঁচে থাকা মৃদুভাষী চিরবিনয়ী শিল্পীর জখমগুলোর সঙ্গে পাগলাটে ডোমেনিকোর জখমে অতিকায় প্রভেদ নেই। একটা সিনেমার পর্দায় ঘটেছে। অন্যটা বাস্তবে। একটা ফিকশন, অন্যটা রিয়েলিটি। প্রভেদ আছে কিন্তু হরেদরে দুটোই একে অন্যে বিলীন। ডোমেনিকোর আত্মাহুতি ফিকশনের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবে ঢুকে পড়ছিল আর সাদির স্বেচ্ছামরণ বাস্তবের সীমানা পেরিয়ে ফিকশনে মুক্তি খুঁজেছে। সেইসব প্রেরণার অভাবে তাঁরা জখমি ছিলেন যেগুলো বাদ দিলে বেঁচে থাকার ঘটনাকে নিছক মশকরা ভাবতে মন বাধ্য হয়। তানপুরা হাতে রেওয়াজ ছিল সাদির বাঁচার নিশানা। মরণেও ওটা সঙ্গী হলো তাঁর। একে ভরসা মেনে মুখ ফেরালেন অসীম অজানায়। আজ নয়তো কাল মুখ ফিরাতেই হতো। সাদি আগেভাগে দায়টি সেরে ফেলেছেন মাত্র। যতি টেনেছেন যোগ-বিয়োগে ভারাতুর জীবনাঙ্কের। যারা বেঁচে আছি তাদের জন্য সংবাদটি মর্মান্তিক হলেও তাঁর জন্য ওটা ছিল মুক্তি। জীবন নয়, একমাত্র মরণ পারে মানুষকে মুক্তি দিতে। সাদির জন্য স্বেচ্ছামরণটা মুক্তি। অনেককিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারার দায়ভার থেকে মুক্তি। তাঁর রিডেম্পশন

বিংশ শতাব্দীতে, / মানুষের শোকের আয়ু / বড়জোর এক বছর…;—জেলখানায় বসে কবিতাটি লিখেছিলেন নাজিম হিকমত। প্রিয়তমাকে মানা করেছিলেন তাঁর জন্য শোক বুকে পুষে রাখতে। সমাজকে সমাজমাধ্যমে আটকে ফেলা একশিংশ শতকে শোকের আয়ু মেরেকেটে কয়েকদিন। এক মিনিট নিরবতা পালনের পুরাতন প্রথার মতো সাদি মহম্মদ বিস্মৃতির গর্ভে নির্বাসিত হবেন। দু-চার দিন না যেতেই আপনা থেকে থেমে যাবে কোলাহল। নতুন কারো চলে যাওয়ার খবর জানবে পৃথিবী। সমাজমাধ্যমে শোরগোলে মাতবে সবাই। এভাবে সব হবে, সব ঘটতে থাকবে, এভাবেই চলতে থাকবে সবকিছু…পৃথিবী চিরঘুমে নিথর হওয়ার অন্ত অবধি। কাজেই শোক বৃথা!


সাদির স্বেচ্ছামৃত্যুর খবর শুনে তাৎক্ষণিক মনে পড়ল শহরে কাকের সংখ্যা দ্রুত কমছে। প্রকৃতির ঝাড়ুদার নামে তাকে ডাকার চল ছিল একসময়। প্রতিদিন একুনে কত কাক গায়েব হচ্ছে, হাওয়ায় উবে যাচ্ছে তার সঠিক হিসাব আমার জানা নেই। যোগ্যরা বেঁচে থাকবে, বাকিরা নিকাশ হবে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে না পারার দোষে;—ওদের দ্রুত উবে যাওয়া কি তবে সে-কারণে ঘটছে? উত্তর জানা নেই। টেড হিউজ বেঁচে থাকলে হয়তো উত্তরটা দিতে পারতেন ঠিকঠাক। কাক নিয়ে ভেবেছিলেন বিস্তর। তাঁর কথায় যদি বিশ্বাস যাই তাহলে কাকের গণমরণ হওয়ার কথা নয়। সৃষ্টির আদিলগ্নে তারা ছিল স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগ। আদিপাপে মানুষের ওপর রুষ্ট হলেন ঈশ্বর। আদম ও হাওয়াকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হতে হলো। জীবন অমৃত ও বিষের ভাণ্ড;—স্বাদটি বুঝাতে মাটির পৃথিবীতে দুজনকে নামিয়ে দিলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর ও বনিআদমে চলতে থাকা মানভঞ্জনের বিহিত যখন কাকস্যপরিবেদনা বোধ হচ্ছে তখন কাক তার খেল দেখিয়েছিল।

আদিপাপের জের ধরে এই সম্ভাবনা লুপ্ত হলো,—মানুষ যখন কাঁদবে মনে হবে ঈশ্বর কাঁদছেন, আর ঈশ্বরের রক্তক্ষরণকে মনে হবে মানুষের। মানুষ কভু ঈশ্বরের প্রতিরূপ হয়ে উঠবে না। না ঈশ্বর কভু মানুষকে ভাবতে পারবেন সরলতার প্রতিমায়। দুর্গন্ধে আবিল সেতুর কিনারে দাঁড়িয়ে তারা একে অন্যকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। নিরাময় অযোগ্য এই সহাবস্থান;—ঈশ্বর এবং মানুষের…শুভ এবং অশুভের… ক্রন্দন এবং রক্তক্ষরণের…মরণ এবং স্বেচ্ছামরণের! নিষ্পাপ যেখানে নির্বাসিত। কাকের হাসি কেবল জানিয়ে দিবে, মানুষকে ঈশ্বর তাঁর শত্রু বলে সাব্যস্ত করেছেন। প্রিয় সৃষ্টির ওপর তিনি এখন বিতৃষ্ণ। তাকে ভালোবেসেছিলেন এবং এখনো বাসেন, তবে সে-ভালোবাসার মধ্যে সারল্য নেই, আছে বিতৃষ্ণা;—সত্যটি রাষ্ট্র করতে স্বর্গ ও পৃথিবীর সংযোগস্থল জুড়ে কাকের পক্ষসঞ্চালন চলবে। সৃষ্টির বিলয় ও সংস্থিতির উপমা হয়ে তিমিরবরণ কাকের পাখসাট পৃথিবী যতদিন আয়ুষ্মান রবে, ততদিন থামবে না!

টেড হিউজ কাককে নিয়ে জটিল ভাবনায় পতিত ছিলেন বিলক্ষণ। প্রাক্তন স্ত্রী কবি সিলভিয়া প্লাথ, চার বছরের কন্যা শূরাসহ প্রেমিকা আসিয়া ওয়েভিলের ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে স্বেচ্ছামরণ হিউজকে কাকের পাখসাট নজর করতে মজবুর করেছিল। শুভ ও অশুভ দুটোকেই যুগপৎ নিজের পক্ষপুটে গ্রাস করতে ওটা উড়ছে। উড়ছে তো উড়ছেই। হিউজের কাকদর্শনে তবু ভাবনাটি বাদ পড়েছে,— কাকের আয়ু ইশ্বরের ইচ্ছা ও পরিকল্পনাধীন নেই আর! মানুষের পৃথিবীতে তাকে গায়েব হতে হচ্ছে অমাবস্যায়, যেখানে থেকে সকল কিছুর উদয়। অমাবস্যা কি তাহলে মৃত্যু? ঠাকুরের ভাষায়, ‘সমুখে শান্তি পারবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ যেখানে একবার তরণী ভাসালে বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার বিচ্ছেদ কেউ টের পাবে না? হতে পারে। সাদির স্বেচ্ছামরণ হয়তো এ-কারণে, শহর থেকে সদলবল গণআত্মহননে যাওয়া কাকের পাখসাট তিনি মোহাম্মদপুরের জীর্ণ ভবনে বসে টের পেয়েছিলেন। এছাড়া কোনো মানবের পক্ষে স্বেচ্ছামরণ নাহি সম্ভবে!

রমজানের ইফতার শেষে সাদি মহম্মদের নীরব প্রস্থান বিবর্তনের নিয়মফেরে কি নিশ্চিত হলো? নাকি এখন সকলে মিলে যেসব কারণের দিকে আঙুল তুলছেন, কারণগুলো তাঁকে প্ররোচিত করেছে জীবনাঙ্কে যতি টানতে? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। উত্তর থাকলেও কিছু যায় আসে না। সাদি আর ফিরছেন না! তিনি গমন করেছেন নিরালোক। সুতরাং এই অনুমানটি স্বীকৃত বড়োজোর : কাক ও সাদিকে অভিন্ন করতে প্রস্থাননাটক সময় নিজহাতে সাজিয়েছে। এটা হলো একুশ শতক। শোকের মাতম এখানে বড়োজোর চব্বিশ কিংবা আটচল্লিশ ঘণ্টা। আরো কম হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। যোগ্যর বেঁচে থাকা আর বাদবাকির বিলোপ-সম্ভাবনাকে এখন উপেক্ষা করা কঠিন। সত্যটি টের পেলেও একে মোকাবিলা করার মতো ব্রহ্মাস্থ সাদি মহম্মদের ঝুলিতে মজুদ ছিল না।

বিনয়ী ও অমায়িক সাদি কার্যত যাপন করছিলেন অন্যদের সময়। নিজের সময় তিনি ফেলে এসেছিলেন পেছনে। অনেক পেছনে! বেঁচে থাকার প্রেরণাগুলো সেখানে কবর দিয়ে যাপন করছিলেন প্রেরণাহীন এক অসময়! দেহটা কেবল এর মধ্যে ছিল। প্রাণ তিনি গচ্ছিত রেখেছিলেন বিগত সময়, যাকে ফেরত পাওয়ার নয়। সময়ের তীরকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে তাকে নাগালে পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানের থিয়োরি তাই বলছে বটে! কল্পবিজ্ঞানে বাস্তব হয়ে ওঠে পেছনে ফেরার যত রোমাঞ্চ! বাস্তবে ওসবরে দেখা পাওয়া ভার! মোহাম্মদপুরের যে-বাসভবনে সাদি মহম্মদ কাটিয়ে দিলেন গোটা জীবন, সেখানে গুলিতে ঝাঁজরা পিতার মুখচ্ছবি আর ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে আসা প্রাণবন্ত গানের হল্লার সবটাই ছিল মমিকরা। সময়ের তীরে আটকে পড়া জাদুঘরকে আঁকড়ে ধরেছিলেন গায়ক। একে ঘিরে তাঁর রোমন্থন। পাওয়া না পাওয়ার আনন্দ ও হাহাকার। তিনি এর সম্মোহিত উপাসক। বাসভবনটি তাঁকে কাবু করে ফেলেছিল। ধীরে-ধীরে গ্রাস করছিল দেহ। একুশ শতকে তিনি ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর বাড়িটি যে প্রস্তরযুগের ঘোড়া! নিওলিথ-স্তব্ধতায় তাঁকে গুম করছিল শ্বাসরোধ করে মারবে বলে। সাদির স্বেচ্ছামরণ নাটিকায় মোহাম্মদপুরের বাসভবনটি হয়তো অভিশাপ। ওটা তাঁকে গিলে খেয়েছে।


যে-সময় সাদি যাপন করছিলেন গত তিন দশক ধরে, সেটি তাঁর পরিচিত ছিল না। সময়টি সজ্জনদের নয়। বিনয়ীর নয়। ভানহীন ভদ্রতা ও অমায়িক সারল্যের নয়। ওগুলো এখন নিজেকে Intellectually Corrupt বলে দাগানো স্লাভয় জিজেকের পরিহাসদীপ্ত শব্দবোমার সম্মুখীন হয় আকসার। একে মোকাবিলার মতো মারণাস্ত্র যে সাদির ঝুলিতে নেই! অন্তরতম অনুভূতি থেকে ঠাকুরের গান তিনি গলায় তুলে নিতেন। তাঁর দরাজ কণ্ঠে মিশে থাকত রবিরাগের রোদনভরা বিশ্বাসের ছটা। অন্তরতম অনূভূতি ও বিশ্বাস অন্তত এই সময়, কারুবাসনায় অমোঘ সাফল্যের গ্যারান্টি নয়। মাকে প্রানপণ আঁকড়ে থাকা সাদি, পিতৃহত্যার শোক বুকে চেপে ঘাতকের বিরুদ্ধে ঘৃণায় তেতে উঠতে অক্ষম সাদি, পিতার লাশে একটি দেশকে প্রতীত হতে দেখা সাদি, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে রবিগানে সমাহিত সাদি… জিগ’স পাজলের এক-একটি টুকরোকে মিলিয়ে নিলে যে-সাদিকে পাচ্ছি, তাঁর পক্ষে একুশ শতক পেরিয়ে ছুটতে থাকা সময়ে তাল মিলানো দুরূহ ছিল। কারো মুখাপেক্ষী না হয়েও সাবলম্বী ছিলেন, কেবল সময়ের তীর তাঁকে ভীষণ জব্দ আর একা করে দিয়েছিল। একাকিত্বে খুঁজে নিয়েছিলেন আনন্দ। ওটা ছিল তাঁর যাপন। বেমানান চারপাশে বেমানান এক মানুষের একলা যাপন। সময়জব্দ মানুষটিকে নিয়ে কাজেই আফসোস বৃথা।

সময় তাঁর হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু একে মুঠোয় চেপে ধরার প্রেরণা কিছুতেই নিজের ভিতর তিনি জাগাতে পারছেন না;—ভাবনাটি তাঁকে উতলা করেছে হয়তো। তাঁর মতো শুদ্ধচারী বিনয়ীর পক্ষে খোলস বদলে ফেলাটা ছিল আত্মপ্রতারণার শামিল। সুতরাং যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। সাদি আরো প্রবলভাবে জীবনসংগ্রামে জয়ী মাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা খুঁজেছেন। শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে,/বলতে পারে এই সুখেতেই/মায়ের নাম সে বলে;—ঠাকুরের পঙক্তি তাঁর জীবনে এভাবে অকাট্য ট্রাজেডিতে মোড় নিয়েছিল।

মায়ের বিদায়, অন্তত সাদির কাছে প্রেরণার অবসান। বেঁচে থাকতে বড়ো বেশি প্রেরণা লাগে। সাদি এখন কার কাছে প্রেরণা ভিক্ষা করবেন? ফয়সালা তাঁকে করতেই হতো একটা। এসপার নয় ওসপার। কাউকে বুঝতে না দিয়ে সেটি করেছেন। যারা ভাববেন এ তাঁর পরাজয়, তারা ভাবতে পারেন। এই সময়ে যার যেমন ইচ্ছা ভাবতে বাধা নেই। প্রতিবাদ করতে সাদি আর ফিরছেন না। আমার কাছে এটা তাঁর বিজয়। সাদি মহম্মদের স্বেচ্ছামরণ অকারণ নয়। নিজের সিদ্ধান্তে তিনি নিখাদ। সাচ্চা শহিদ। নিজেকে বেমানান ভাবার যাতনা থেকে মুক্তি দিতে বেছে নিয়েছেন বন্ধনক্ষয়। যেখানে…বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়/পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় মহা-অজানার। তাঁর এই মরণকে হাজার সেলাম।


মহম্মদ সাদি ট্রিবিউট
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: