প্রাসঙ্গিকতা আছে কোনো, এই সময়ে এসে, লিটলম্যাগ/ছোটকাগজ সম্পাদনা ও প্রকাশের? এই প্রশ্ন ধরে কয়েক প্যারা আলাপের সঞ্চার হোক এইখানে। কেন সহসা গাজীর গীত হেন? ছোটকাগজ, অথবা তার অ্যারিস্টোক্র্যাট ডাকনাম লিটলম্যাগ, গোস্তাকি করেছে কোনো? উপযোগ অর্থে প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, এইখানে, নাকি প্রয়োজনীয়তা অর্থে? নেসেসিটি বলি কি ডিম্যান্ড বলি, কিছুই কি লিটলম্যাগের এখন আর অবশিষ্ট আছে? এইসব ও অন্যান্য নানা পাল্টা প্রশ্ন তুলে আলাপসঞ্চারক বেচারাকে ধরাশায়ী করা গেলেও অসুবিধা নাই, বরং সুবিধা, স্বাধীনভাবে আলাপ সচল রইবে। এইটাও বলে নেয়া ভালো, ছোটকাগজ প্রকাশের প্রাসঙ্গিকতা তালাশের সূত্রমুখ হিশেবে এই লেখা আলবৎ দুর্বল, সূত্রমুখাবয়ব হবার কোনো অভিপ্রায় নেই এর। কোনোমতে একটা আলাপ উত্থাপনের চেষ্টা ছাড়া বাহ্যত অথবা আন্তরিক অন্যবিধ কোনো গৌল্-অব্জেক্টিভ নাই এ লেখাটার। একপ্রকার, বলা যাক, মস্তিষ্কমন্থন তথা ব্রেইন-স্টর্মিং তরিকায় একটুখানি মাথাঝাড়া দেয়াতেই এর লক্ষ্যপূরণ। পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনায় যেটুকু ত্রুটি-ঘাটতি, বিশদ যুক্তিব্যাখ্যানে যেটুকু গলদ, ইত্যাদি সমস্তকিছু খোলাসা হবে পরবর্তী বক্তাদের কাছে যেয়ে। এই দেশে অন্তত, আর-কিছু থাকুক না-থাকুক, বক্তার অভাব থাকার কথা না। তা, অভাব যদি থাকে তো বুঝতে হবে সেই বক্তব্যসূত্রের তথা আলাপটপিকের যথেষ্ট অ্যাপিল নাই। মিডিয়া আবেদন বোঝে, এবং বক্তা ন্যাচারালি মিডিয়ানুসারী।
কিন্তু সেখানেও নয়, এই লেখার মর্মজ্বালা অন্যত্র। ছোটকাগজ তার জীবনচক্রের শুরু থেকে শেষাবধি ক্রিটিক্যাল কনশাস্নেসের জায়গায় দাঁড়ায়ে একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া জারি রাখবার চেষ্টা করত শোনা যায়। সেই সুবাদে প্রতিনিয়ত না-হলেও মাঝেমধ্যে তাকে তার নিজের সমালোচনাটাও করতে হতো। গত দুই/আড়াই দশক ধরে সেসবের বালাই কমপ্লিটলি চুকেবুকে গেছে যেন। ফলে কেন, কিসের তাগিদে, কোন গরজ থেকে এন্তার বর্ণপ্রস্তর ছাপা হচ্ছে, এর কোনো উত্তর পাওয়া যায় না আজকাল। অবশ্য কয়টাই-বা কাগজ প্রকাশ হচ্ছে আজ, অঙ্গুলিমেয় বললেও অত্যধিক হয়ে যায়, অতএব এতদপ্রসঙ্গ ধরে কথা বাড়াবার মানে এক-অর্থে বেহুদা বাতেলা, বাগাড়ম্বর, বটে।
সর্বকালেই লিটলম্যাগ/ছোটকাগজ হেন-কারেঙ্গে তেন-কারেঙ্গে ধুয়া তুলে চিল্লায়েছে, কবুল করছি, কিন্তু কোথাও স্বল্পমাত্রার হলেও প্রকাশাবশ্যকতা তার ছিল তো! অন্তত তখন পর্যন্ত। বর্তমানে, এই সংযোগসুবিধার মস্ত ময়দানে, সেভাবে সে আবশ্যক কি না তা ভাববার ব্যাপার। ভাবা আশু কর্তব্য বটে। স্রেফ শখের বশে পত্রিকা ছাপাবার মামলা হলে অবশ্য আলাদা বাত, তেমন বাতকর্ম নিয়া আলাপ হচ্ছে না। খামাখা খুশিফুর্তির দুই-চাইরটা লেখা নিয়া ছাপা-হওয়া কাগজপত্রাদির চিরদিনই সংখ্যাধিক্য, সেক্ষেত্রে তেমন সমস্যা বা আপত্তি কিছু নাই, দরকার রয়েছে সোসাইটিতে খুশি-সংস্কৃতির। কিন্তু খুশিবাসির বাইরে বেরোনোর অভিপ্রায় হৃদয়ে রেখে ভলান্টারিলি যে-সমস্ত পত্রিকা তথা লিটলম্যাগ/ছোটকাগজ প্রকাশেচ্ছু অথবা প্রকাশচলিষ্ণু, তাদের তো চোখকান খোলা রাখা চাই। নিছক দমাদম-মাস্তকালান্দার গাইলেই তো ভক্তিমূলক ভজন হয়া যায় না।
আর এইটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একদা কোনোকালে লিটলম্যাগ প্রকাশনা শুরু হয়েছিল প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক যাবতীয় মানসিকতার বিরুদ্ধে স্ট্যান্ড নিতে যেয়ে। সেকালে সে তার ডিউটি ভালোভাবেই পালন করেছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের বারোটা বেজেছে কি বাজেনি তা না-জানলেও ওভারওল সাহিত্যের বেশ পুষ্টিঋদ্ধি হয়েছিল জানা যায়। এই বাংলায়, ওই বাংলায়, এবং গোটা দুনিয়ায়। খুশিফুর্তির লেখা ছাপাবার জায়গার অভাব ছিল না, বানানো ব্যথাবেদনার লেখা ছাপাবার জায়গা তো সুলভ অধিক, কিন্তু কোথাও বুঝিবা স্বাধীন ও নতুন লেখা মার খাচ্ছিল। হচ্ছিল না ঠিকঠাক। রবীন্দ্রনাথ জন্মালেন, তো দলে দলে রবীন্দ্রপোষকবৃন্দ, নবাগত জীবনানন্দের মুখ দেখাবার আর জো নাই। তখন দরকার পড়ল ‘কবিতা’ পত্রিকার, এইভাবে এরপরে একে একে অন্যান্য। অন্তত কেউ কেউ মনে করছিল যে তেমন কিছু হচ্ছে না, বা যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, জায়গা চাই নতুন। জন্মেতিহাস তো, ছোটকাগজের, এ-ই ইন-শর্ট। পরবর্তীকালে, একদম সম্প্রতি তেমন পরিস্থিতি তিরোহিত যখন, ছোটকাগজ প্রকাশের খোল ও নলচে নিয়া ভাবার জরুরৎ অতএব অনেক বেশি। কিংবা ভাবার চেয়েও বেশি দরকার সিদ্ধান্ত নেবার, যত নিষ্ঠুর ও নির্মম সিদ্ধান্তই হোক, রাজার হাতি পালনের ডেকোরেশন্যাল কনভেনশন চালু রাখা আদৌ মর্যাদার কি না।
আগেকার দিনে এইসব ছোট ছোট পত্রিকা প্রকাশের কারণসমূহ অবিদিত নয়। একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য কারণ তো এ-ই — চিরকেলে কারণ — লেখকের সংখ্যানুপাতে লেখা প্রকাশের জমিজিরেত ছিল নেহায়েত অল্প। ফলে যে-যার সামর্থ্য মতন নিজেদের লেখাটা নিজেরাই প্রকাশের পথ করে নিয়েছেন, কখনো দল বেঁধে, একা ও কয়েকজন মিলে কখনো-বা। আজ ঠিক তার উল্টো পরিস্থিতিচিত্র। এখন বরং লেখকের চেয়ে লেখা ছাপানোর পরিসর অনেকগুণ বেশি। শুধু বেশিই নয়, সুগঠিত, সুপরিসর, সুসংবদ্ধ, সুব্যবস্থিত প্রক্রিয়া। আর সুযোগ তো সীমাহীন। এবং অবারিত সর্বার্থে। এখন প্রতিষ্ঠানের খবরদারি ও লেঠেলগিরি ছাড়াই লেখা প্রকাশের উপায় ও উৎস প্রত্যেকের তর্জনীশীর্ষে মজুত রয়েছে। ফেসবুক প্রভৃতি প্রকাশমাধ্যম, বহুবিধ ওয়েবপোর্টাল, সোশ্যাল ও পার্সোন্যাল ব্লগ, অনলাইন ডেইলি পত্রিকাসমূহ যেভাবে মনের ও মননের চর্চা উন্মুক্ত করে দিয়েছে, এহেন নজির পূর্বেতিহাসে নাই।
কিন্তু ছোটকাগজ প্রকাশের সবচেয়ে বড় গরিমা ছিল বোধহয় এ-ই যে, সে এমনসব লেখা ছাপাতে তৎপর থাকত যা বিদ্যমান স্থিতাবস্থা/স্ট্যাটাস-ক্যু গ্রহণে অক্ষম বোধগম্য কারণেই। নিছক ছাপাছাপির স্তর ছাপিয়ে উঠে সেইসমস্ত লেখা স্থিতাবস্থার কর্ণমূল ধরে টান দিতে সক্ষম ছিল, ঝাঁকুনি দিতে পারত প্রাতিষ্ঠানিক হেজিমোনির হায়ালজ্জাহীন শরীরকাণ্ডে, সর্বোপরি শিল্পমূল্যাঙ্কন তথা সাহিত্যের নন্দনগত পরিপুষ্টিবিকাশ যথেষ্ট জলপানি পেত। পুরনো বলনকেতা ও চলনচাল পাল্টাবার একটা সংকল্প তার ছিল; অবশ্য গর্জনে সেই সংকল্প যতটা বজ্রনির্ঘোষ, বর্ষণে ততটাই কৃপণ পরিলক্ষিত হতো। তবু ছিল তো, অল্প ঈমান আর টুটাফাটা আমল নিয়া ব্যাপারটা বেশ উপস্থিতি জানান দিত, ঘোষণার আকারে হলেও। অধুনা মান্ধাতাকালীন সংকল্পের ওইরকম চিৎকৃত প্রকাশ দেখে একইসঙ্গে বিরক্তি ও সন্দেহ জাগে। কেননা জামানা পাল্টেছে, স্ট্র্যাটেজিও অতএব পাল্টানো জরুর। আঙুলের একটিপে যেখানে বাঘ-বাইসন ফৌৎ করা যাচ্ছে, সেখানে কামান দাগানোর দরকার তো নাই।
লিটলম্যাগাজিনে লেখককে ডিগ্নিটি দিয়ে লেখা প্রকাশ ও পত্রিকা সম্পাদনার দৃষ্টান্ত অতি অল্প হলেও রয়েছে, সার্টেইনলি, আবার লেখককে অকথ্য অসম্মান করে চলেছেন জিন্দেগিভর এমন সম্পাদক ও পত্রিকার সংখ্যাও কম নয়। একটা দীর্ঘ সময় ধরে পত্রিকাসম্পাদকের দৌরাত্ম্যে লেখকের জিনা হারাম হয়েই ছিল, সম্পাদকের ডিপ্লোম্যাসি বুঝে এবং তাতে মদত না-দিয়ে চললে দশক-জিয়াফতে নেমন্তন্ন পেতেন না বেচারা লেখক। এখন সেই দিন, লেখকের সেই বেচারা-দশা দুঃস্বপ্নদুর্গতির দিন, নাই আর। আল্লার রহমতে এখন লেখক ও লেখা চাইলেই সম্পাদকদৌরাত্ম্যের বাইরে জীবনযাপন করতে পারে, সেই তৌফিক তাদের হয়েছে। লেখক এখন নজিরবিরল স্বাধীন, স্বনির্ভর, অন্তত লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে। অথবা লেখকই নাই আর, পুরানা দিনের লেখক-কন্সেপ্টেরই বিলোপ ঘটেছে; ঠিক যেমনটা অথারের ডেথ ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল রলাঁ বার্ত প্রমুখদের মাইক্রোফোনে, সেইটারই রিয়্যালিটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যেনবা। লার্জার দ্যান ফিকশন সেই রিয়্যালিটি। বিষয়টা আরেকটু বুঝিয়ে বলা যায় না? তা যায়, কিন্তু অথারের ডেথ তথা টেক্সটের রাইজ এইকালে এতই দৃষ্টিগোচর যে এতদপ্রাসঙ্গিক সমস্ত প্রশ্নোত্তর পঠিত বলে গণ্য হওয়া উচিত। তাছাড়া আদাকারবারী এই সূত্রধর জাহাজপ্রসঙ্গে চিরচুপচাপ থাকার সোহবতপ্রাপ্ত। চোখের সামনেই তো রয়েছে সমস্ত। কোনোপ্রকার মডারেটর-এডিটর ছাড়া যেমন প্রকাশভূমি বিস্তর গড়ে উঠেছে, তেমনি বিভিন্ন গ্রুপ ও ঘরানা-ডিস্কোর্সভিত্তিক পাটাতনও রয়েছে প্রভূত সংখ্যায়। সেসব প্রকাশব্যবস্থার মান তথা স্ট্যান্ডার্ড অত্যন্ত ডাইভার্সিফায়েড, ডাইন্যামিক, ডায়ালোগিক। অথবা থোড়-বড়ি-খাড়া হলেও অপরিমেয় সম্ভাবনাবহ। প্রতিমুহূর্তে ডায়ালেক্টিক থাকবার যে টেন্ডেন্সি দৃশ্যমান এই নেটিজেনিক লিখনকর্মের মধ্যে, এর সনে পেরে-ওঠা ট্র্যাডিশন্যাল কাগুজে পত্রিকার পক্ষে কতদূর সাধ্য, সেসব বুঝি দিবসের প্রথম-ও-শেষ সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত নয়?
অ্যাসাঞ্জের বা স্নোডেনের ঘটনার পর অবশ্য পুরো জোর দিয়া বলা যাচ্ছে না আর, যে, লেখক অনলাইন অ্যাক্টিভিটিতেও সম্পূর্ণ মুক্তডানা স্বাধীন। সমস্তই নিয়ন্ত্রিত, জগৎসংসারে, কিছু বুদ্ধিনিয়ন্ত্রিত এবং কিছু রয়েছে পেশিনিয়ন্ত্রিত। সর্বকালেই এমন। তবে বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণ হলেই কেবল আমরা রাগগোস্বা প্রদর্শন করি, কিংবা মুষড়ে পড়ি, কিন্তু কন্ট্রোল/নিয়ন্ত্রণ আমরা চাই ঠিকই, নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ হলে স্বাগত জানাই। নিয়ন্ত্রণের চিরউচ্ছেদ তো আমরা কাউকেই চাইতে দেখি না। আর নিয়ন্ত্রণ তো সিস্টেমের মাইটোকন্ড্রিয়া। নামে কি-বা আসে যায়, এস্টাব্লিশমেন্ট কি প্রতিষ্ঠানকাঠামো, সিরিজ অফ সিস্টেমের এক অনিঃশেষ খেলা। আর এর উল্টোপিঠে অ্যানার্কি — কই, কেউ তো পুকার তোলে না অ্যানার্কির দাবিতে! অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট জপ করতে করতে ফেনা উঠায়ে গেল কত প্রেমাংশুরঙিন পদ্যগদ্যকার! নৈরাজ্যেই সম্ভব সকলের একটা করে পৃথক ও সার্বভৌম রাজ্য — উল্টোবুজলি এই রাজার রাজত্বে — এহেন প্রতীতি প্রচারিতে কাউরেই আগুয়ান দেখা গেল না। খালি সিস্টেমের খেয়ে-পরে সিস্টেমের সনে খুনসুটি। সিস্টেম না-থাকলে দেশের ও দশের ফোকর দিয়া আমার নিজের ফায়দা আমি লুটিব কেমন করে? একজনও মহামানব পাওয়া যাবে না যিনি নিয়ন্ত্রণ তথা সিস্টেমানুরাগী ছিলেন না, আর একটি সিস্টেমের বিরোধিতা করেছেন তারা আরেক সিস্টেম ফেঁদে বসবেন বলে, তাহলে অ্যান্টিসিস্টেম ম্যুভ সবসময় সাময়িক তথা আপেক্ষিক। রিলেটিভ, কিন্তু ইরেলিভেন্ট নয়। নিয়ন্তা হয়ে উঠতে চান সকল আদিম ও আধুনিক দেবতাগণ, হয়ে উঠলে পরে জমিজিরেত তথা নিয়ন্ত্রণাওতা বাড়ায়ে নিতে চান, আগ্রাসনপ্রবণতা মানুষেরই সহজাত। অতএব চিলচিৎকার চলতে থাকবে, সুন্দর বিদ্রোহ রইবে চিরজাগরূক, জন্ম নেবে নিত্যনতুন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ-প্রত্যাখ্যানের গান।
ফলে এই কালে ইস্তেহার ভর করে একটা সাহিত্যগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশ হয়তো সম্ভব নয় আর। কারণ স্ট্যাটাস-ক্যু সম্পর্কে সজাগ এখন পাঠক-লেখক নির্বিশেষে সবাই। পোলিটিক্যাল ও সোশ্যাল কনশাস্নেস্ বেড়েছে সর্বস্তরে যে-কোনো অতীতের তুলনায়। রাইট টু এবং একইসঙ্গে অ্যাক্সেস্ টু ইনফর্মেশন উত্তরোত্তর দ্রুতবর্ধমান। প্রতিদিন নতুন সব প্রযুক্তিবিস্তার, এইটা অ্যাপ্সযুগ, প্রতিদিনই নিজেকে নবায়ন। নতুবা আপনি খাইলেন ধরা। আর এই স্পিডে নবায়ন সম্ভব তো নয় এমনকি প্রতাপাদিত্য পুঁজির কোনো দৈনিকের পক্ষেও।
তো, বলতে চাইছি কি, সিস্টেমের অনুপস্থিতিই সৃজনের প্রসূতি? কিন্তু সিস্টেম ছাড়া জানালাকার্নিশের চড়ুইটারও তো চলে না দেখি। সিস্টেমহারা আইডিয়াল কোনো স্পেস যেহেতু দুনিয়ার দ্বিমাত্রিক অভিজ্ঞতায় অর্জন করা যাবে না, তাই গাহি সিস্টেম শিফ্টিঙের গান। মুহূর্তে একটা সিস্টেম খাড়া হবে, সেই সিস্টেম জগদ্দল হবার আগেই শিফ্ট্ ঘটবে, ফের নতুনতর ব্যবস্থা বা প্রণালি সামনে আসবে। এবং প্রতিটি শিফ্টিং হবে য়্যুজারফ্রেন্ডলি তথা অ্যাপ্লিক্যান্টকোজি। সিস্টেমের ধর্মই তো এমন যে, সেখানে ফাঁকফোকর থাকবে। সিস্টেমের ব্রোকার যারা, বাংলায় বলা যাক শৃঙ্খলাদালাল, তারা চারসেকেন্ডের সুযোগেও ফায়দা বাগিয়ে নিতে জানে। সেই কারণে শিফ্টিং যত দ্রুত হবে, ট্র্যান্সপ্যারেন্সি কিছুটা হলেও বজায় থাকবে এবং সিস্টেমের সুমুন্দি হয়ে গেঁড়ে বসবার স্কোপ তত হ্রাস পাবে। এই জিনিশটা স্বাভাবিক কারণেই বিগ মিডিয়ায় বেশি, সিস্টেমের সুমুন্দিগিরি, কিন্তু ছোটকাগজ তথা লিটলমিডিয়াও মুক্ত নয় এই খাসলত থেকে। এখন, বর্তমানে, সুমুন্দিগিরির বেইল সেই আগের মতো নাই আর, বলা বাহুল্য। বড়কাগজও রোজ ধর্মকর্ম দশবার বদলাচ্ছে, একেবারেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও পুঁচকে ব্লগপত্রিকা ফলো করেও বড়কাগজবাবু কূলকিনারা পাচ্ছে না টাইপের অবস্থা।
তাহলে এবার খোঁজ করা যাক এতাবধি-চলে-আসা বাংলাদেশের সাহিত্যে বিরাটবপু অবদায়ক ছোটকাগজের চরিত্রে লভিত কিংবা মুখে মুখে দৃষ্ট কমন কিছু বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, পুঁজি তথা কর্পোরেট ক্যাপিটাল প্রতিহতকরণের বারফট্টাই। নিজেদের পত্রিকায় লুটেরা ধনিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বর্জন। প্রয়োজনে, এবং একসময় এইটিই হয়ে ওঠে একমাত্র পথ, নিজেদের তথা সম্পাদকের নিজের ফিন্যান্সে ঝলমলে লেবাস ও অকুণ্ঠ অতিকায় অবয়বে ম্যাগাজিন প্রকাশ। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠান ও পণ্যায়ন প্রতিরোধী নিরীক্ষাপ্রবণ লেখা লালন, অনুশীলন ও প্রকাশ। বড়কাগজ নামের এক কল্পিত অরণ্যদানোর বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যয়িত সমস্ত বল ও শক্তিসামর্থ্য। তৃতীয়ত, নোঙরহীন এক উড়োহাওয়ার ধারণা — যার নাম লিটলম্যাগের কন্সেপ্ট — ধানাইপানাই করে একনাগাড়ে বলে চলা। আর এই নিকম্মা ধারণার বশবর্তী হয়ে কে আন্ডাউটেডলি লিটলম্যাগ আর কে নয়, কে নিছক রম্যম্যাগ অথবা কোনটা আলাভোলা সাহিত্যপত্রিকা, কে নির্জলা নিট আর কে জলমেশানো দর্শনার দিশি ইত্যাদি নিয়া বাহাসে বেশ খোশহাল ছোটকাজগজকাল গিয়াছে কেটে। এরপরের চতুর্থ-পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম তথৈবচ। মনে রাখতে হবে সেই ক্লিশে, দশমিক জিরো জিরো সামথিং হলেও ব্যতিক্রম সর্বত্রই বিরাজে সর্বদা; আর তেমন ব্যতিক্রম ওভার্ল্যুক করতে হয় নিয়মালাপের সময়; এক্ষেত্রেও উহা অর্থাৎ ব্যতিক্রমতত্ত্ব প্রযোজ্য।
গত দুই-দেড়দশকে বাংলাদেশের কোনো ছোটকাগজে এমন রচনা কদাচিৎ চোখে পড়েছে যা কি-না বড়কাগজ ছাপতে পারবে না বা ছাপতে অস্বস্তি বোধ করবে। এমন কোনো রচনা নজরে এসেছে কি কারো, যা ছাপা হলে বড়কাগজের তথা বিগম্যাগের অস্তিত্ব টলে উঠতে পারত? নজরে এসেছে এমন রচনা আপনাদের কারো, যা পড়ে আপনার পদতলায় ভূকম্পন টের পেয়েছেন! ডিসপ্লেইসড হয়েছেন আপনি একটিবারের জন্যও কোনো ছোটকাগজবাহিত গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ প্রভৃতি পড়ে? বরং অন্যত্র হয়েছেন এমন, ছোটকাগজের বাইরে, হরহামেশা না-হলেও মধ্যে মধ্যে। এমন কতিপয় লেখা বছরের এ-মাথা ও-মাথা কথিত বড়কাগজেই ছাপা হতে দেখেছি আমরা। আর ছোটকাগজ কেবলই বন্ধুকৃত্য-গোষ্ঠীনৃত্য না-হলেও মুখ্যত বন্ধুকৃত্য-গোষ্ঠীনৃত্যই নিয়মিত। ফলে এন্তার বদখাবার। একগাদা কবিতার দুই-তিনখাঁজে দুই-তিন প্রবন্ধপরিচায়িত নিবন্ধ অথবা নিবন্ধাকৃতির প্রবন্ধ, বড়কাগজে যেমন রম্য রচনাদির এককোণে এক-দেড়খান কবিতা, মুখরক্ষার বইরিভিয়্যু, নিজেকে এবং বন্ধুবান্ধবদেরকে দশকধন্য কবি বানিয়ে গৃহীত সাক্ষাৎকার, আর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যখন-তখন আৎখা দাঁড়ায়ে সম্মিলিত দশকদুরুদ। ছোটকাগজের যে-কয়জন পাঠক খোঁজপাত্তা রাখে এর কন্টেন্টের, কম-বেশ এ-ই তো ওরিয়েন্টেশন।
অত্যন্ত ক্ষুদ্রকায় দেড়-দুইটা ক্ল্যান ছাড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগ পয়দা আজ আর হতে দেখা যাচ্ছে না। ক্ল্যানের বিরোধসূত্রগুলো অনাদিকাল থেকেই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, কন্ট্রোভার্শ্যাল, তবে একটা কালের সীমা পর্যন্ত বেশ পার্পাস সার্ভ করেছে বটে সেইসব স্ববিরোধী রোয়াব। পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার আলাদা, ভালো জানিও না সব, যা-কিছু জানি তাতে যে এন্তার মিথপ্রতিম মণ্ডামিঠাইকিচ্ছা মেশানো সন্দেহ নাই। কিন্তু অত্র বঙ্গে ক্ল্যান বা গোত্রবংশভিত্তিক ছোটকাগজ তথা সাহিত্যবিচরণ খুব বেশি নাই, ছিলও না, সংখ্যায় যেমন বেশি নাই তেমনি ইম্প্যাক্ট তথা অভিঘাত বা প্রভাবের দিক থেকেও নেহায়েত গৌণ। ফলের বেলায় লবডঙ্কা হলেও গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোত্রবদ্ধতা আছে এমনকি আজও, উৎপাত মূর্তিমান, যদিও গোত্রমণ্ডূকতার ফিলহাল স্ট্যাটাস পূর্বকালের চেহারায় নাই আর। চেহারাছিরি পাল্টালেও অত্র বঙ্গীয় গোষ্ঠীবৃত্তির প্রোডাকশন তথা আউটপুট অতি অকিঞ্চিৎকর। শক্তসমর্থভাবে লিটলম্যাগ সঞ্চালনের স্বার্থে একটা ভালো লেখকগোষ্ঠী আশীর্বাদ এবং একইসঙ্গে অভিশাপ। আশীর্বাদের পাল্লাটা ভারী নয়, যতটা অভিশাপ। সচরাচর গোষ্ঠীতে এক-দুইজনের বাইরে লেখক দেখা যায় না, যারা থাকে তারা গুণ্ডা বা স্তাবক প্রভৃতি স্পেসিস। ফলে অচিরাৎ গোষ্ঠী হয়ে ওঠে দুর্বৃত্তদের জিমখানা। পাণ্ডাগিরিতেই প্রহর জুড়োয় এদের।
তবে একটা কথা আজকাল খুব মনে হয়, যে, বড়কাগজের পিঠোপিঠি জিনিশ ছোটকাগজ নয়। ছোটকাগজের বিপরীত শব্দ ছোটকাগজ, ছোটকাগজের সমার্থক শব্দ ছোটকাগজ, ছোটকাগজের প্রায়-সমোচ্চারিত ভিন্নার্থ শব্দ ছোটকাগজই। ঠিক যেমন বড়কাগজ বড়কাগজই। যে যেভাবে বুঝতে চান বুঝুন, তবে একটা আরেকটার পাছার বা মুখের কোনোদিককার কোনো প্রসাধনদ্রব্য নয়, একে অন্যের শত্রু নয় মিত্রও নয়। একজন স্বনামখ্যাত ছোটকাগজ উপযোগ/প্রয়োজনীয়তা হারাচ্ছেন হয়তো, অন্যজনও ওই পথেই তো ক্রমশ। দোষঘাট কারো নয় সেক্ষেত্রে, এটা কালেরই মন্দিরা, সো দোষ যদি কারো স্কন্ধে চাপাতেই হয়, তাহলে সেটা সময়ের। সময় চেঞ্জ হচ্ছে। যেমন জলবায়ু ও বাংলাদেশে বৈদেশিক ফান্ড-ফ্লো। সময় ছিল একদা এমন, যখন গুহাগাত্রে শিকারচিত্র এঁকে সাহিত্য হতো। অতঃপর গাছপাতায়, প্যাপিরাসে, ইদানীং প্রযুক্তিকৃপায় একাধিক পরিসরে। একসময় এদেশে একুশেফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বরষোলো প্রভৃতি সিজনে পাড়াভিত্তিক স্মরণিকায় সাহিত্য হয়েছে, বেশ দ্রোহ-বিষাদ-প্রেম প্রভৃতি বিধৃত ভালো সাহিত্যই হয়েছে, একসময় দেয়ালিকায়, এখন বহুকাল ধরে মণ্ডকাগজের থালায় মুদ্রিত ও সর্বাধুনা মণ্ডবিহীন বৈদ্যুতিন প্রদর্শপত্রে একাধারে ছাপা হয়ে চলেছে উন্নত ও অবনত উভয় সাহিত্যই। এখন স্মরণিকা বার হয় না পাড়ায়, এখন ছোটকাগজও বিরলপ্রকাশ প্রায়, দিন এমনকি বড়কাগজেরও নয় সেই ঋষিঋতু ঊনিশ শতকের ন্যায়।
কথিত বড়কাগজেও, লক্ষণীয়, সাহিত্যপাতার কলেবর চারপৃষ্ঠা থেকে দেড়পৃষ্ঠায় এসে নেমেছে। সেই দেড়পৃষ্ঠার চৌহদ্দিও নিরঙ্কুশ সাহিত্যের নয়, সেখানেও দখলদারি বিবিধ বিজ্ঞাপনের, সেখানেও দরপত্রাহ্বান তথা বাণিজ্যাভিযান। মুখই শুধু নয়, চিবুক-কণ্ঠাহাড়-বুক সমস্তই ঢাকা বিজ্ঞাপনে, রঙবাহারে। এইটা সুদিনের না দুর্দিনের ইঙ্গিত, বোঝা যাচ্ছে না। আবার হাওয়ামাধ্যমে, তথা আন্তর্জালিক পরিসরে, একেবারেই ভিন্ন প্রণোদনা। সেথাকার নিউজপোর্টাল থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের অনলাইন প্রকাশনায় মিনিটে-মিনিটে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় সাহিত্য হচ্ছে। সেখানে যেমন কবিতা-গল্প-তক্কোবিতক্কের ঘণ্ট রাঁধা হচ্ছে, তেমনি বিচিত্র উপাদেয় ব্যঞ্জনও কম হচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, সর্বসাম্প্রত এই স্পেসে এমনসব লেখালেখি হচ্ছে, যেসব লেখালেখি ঠিক সনাতন বলনকেতা-চলনচালের নয়। এই জায়গায় থেকেই, এই পয়েন্ট ধরেই, ভাবতে হবে লিটলম্যাগে-বিগম্যাগে সাহিত্যচর্চার প্রসঙ্গ-উপযোগ-প্রয়োজন রয়েছে কি না আদৌ।
মাধ্যম তথা বাহন তো অত গুরুত্বপ্রাপক হতে পারে না, মাল দিয়াই তো মাধ্যমের মর্যাদা, তা ঠিক। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, সিনেম্যাগাজিনেও গুণসম্পন্ন সাহিত্য হয়েছে, যেমন পঞ্চাশের দশকে এ-দেশীয় সাহিত্যে স্টলোয়ার্ট ফিগারদের ভালো ভালো রচনা বারোয়ারি বিচিত্রাকাগজে প্রকাশিত হতে দেখেছি আমরা। ষাটের দশকে এখানকার একদল তৎকালীন তরুণের লিটলম্যাগকেন্দ্রিক যাত্রারম্ভ হয়েছিল, অচিরেই বাহন বদল। সত্তর দশক পশ্চিমবঙ্গে লিটলম্যাগের, বাংলাদেশে মেইনলি স্লোগ্যানের। আজকের যেই টিমটিমে ছোটকাগজ, অথবা আল্লা-মালুম ছোটকাগজান্দোলন, তার প্রকৃত পরিপুষ্টিবিকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে আশির দশকে এসে। এই সময়েই লিটলম্যাগের কন্ট্রিবিউশন ও পরবর্তীকালে এর ইম্প্যাক্ট লক্ষ করা যাবে। এছাড়া বাকি সময়টুকু, নব্বই ও সহস্রাব্দসূচনা এবং তৎপূর্ব, বড়-ছোট মোটামুটি মিলেমিশে বেরাদরি চালাতে দেখা যাচ্ছে। এইটা গায়ের জোরে বলা গেলেও অসত্য যে, এদেশি শিল্পসাহিত্যের শ্রেয়তর দ্রব্যগুলো ছোটকাগজের পকেট থেকে বেরিয়েছে, যেমন গোগলের ওভারকোট থেকে বেরিয়েছিল মডার্ন ছোটগল্প।
সম্প্রতি, দ্বিতীয় দশকখণ্ডে, দেখা যাচ্ছে একদম নতুন প্রবণতা। লিটল-বিগ কোনোটাই নয়, এমনকি কাগুজে বেড়াল-ব্যঘ্র-সিংহস্বভাবী কোনো পত্রিকা নয়, লেখক উঠে আসছেন অনলাইন প্রকাশনা মারফত। বড়-ছোট কোনোপ্রকার কাগজেরই পৃষ্ঠপোষকতা-ধাত্রিগিরি ছাড়া, সম্ভবত, দ্বিতীয় দশকের সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ। মুক্ত, অবারিত, বহুবিধমাত্রিক সেইসব পাব্লিক্যাশনে এই সময়ের বুদ্ধি-সৃজন-মনন সমস্তকিছুর হার্মোনাইজেশন সম্ভবপর হচ্ছে একই পরিসরে। এইসব প্রকাশনার সংযোগসুবিধা ও প্রকাশনীতি ভিন্ন হওয়ার ফলে এখনকার সাহিত্যে ইন্টার্যাকশন অভাবিত রকমের বেশি ও বৈচিত্র্যবহ। কন্টেন্টেও পরিবর্তন এসেছে, ট্র্যাডিশন্যাল লিটার্যারি জঁরগুলোর বাইরেই এখন মুখ্যত শিল্পসাহিত্য সৃজিত হয়ে চলেছে। নিঃসন্দেহে এই লিবারেটেড অ্যাটমোস্ফিয়ার বাংলা ছাপাছাপির জগতে একঝলক পূর্বকল্পনাতীত প্রেরণা, পাঠক-লেখক উভয়ের জন্য, মরুদ্যানবায়ু। ফলও শুরু করেছি পেতে, একদল তরুণ অনবদ্য লিখে চলেছেন তাদের রচকজীবনের প্রারম্ভলগ্ন থেকেই।
ছোটকাগজ বলি কি বড়কাগজ বলি, লিটলম্যাগ অথবা বিগ, অনলাইন পত্রিকাগুলোর গতিবিধি তীক্ষ্ণ নজরে রেখে এখন জায়ান্ট-মিডি-মিনি কাগুজে অ্যারোপ্লেনগুলোকে তাদের উড়ালরুট ঠিক করে নিতে হবে। এ না-হলে কেবল থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড় হবে সবই। কিন্তু অনলাইনাররাও সোনাদানাপান্নাপাকিজা সাপ্লাই দিচ্ছেন, অতটা ভাবা যাবে না, তবে তাদের পরিসর ও অন্যান্য সুবিধাদি বিস্ময়করভাবে প্রচুর, অভাবিত সব ফ্যাসিলিটি, ফিন্যানশিয়্যাল ইমপ্লিক্যাশনের মতো কোনো ম্যাজর ফ্যাক্টর এখানে সেভাবে নেই বিধায় ইন্ডিপেন্ডেন্টলি পাতা চালানো যায়। সেই সুবাদে বলা যায়, অনলাইনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিন্নতাবাহী লিটলম্যাগ উৎপাদন-প্রকাশন সম্ভবত অসম্ভব, অন্তত আমাদের এ-মুহূর্তের পজিশনিং থেকে। ভবিষ্যতের কথা তো আল্লা জানেন।
কোনো-একটা ম্যুভিতে, মোস্ট-প্রোব্যাব্লি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’ সিনেমায়, না ‘বাঘ বাহাদুর’ পড়ছে না মনে, দেখেছিলাম বাঘছালবর্ণিল জোব্বা পরিহিত অসহায় এক আদমসন্তানের ব্যঘ্রকসরত। করুণ সেই দৃশ্য মনে পড়ে যায় এককালের শৌর্যশালী লিটলম্যাগাজিনের সার্কাস্টিক দশা দেখে। এখন জামানা এমন যে, এমনকি রিয়্যাল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হুঙ্কার শুনেও হাসি পায়, কালাহারি মরুভূমির লায়ন দেখেও লোকে আমোদিত হয়। টেলিভিশনে ন্যাশন্যাল জিয়োগ্র্যাফি চ্যানেল দেখছিলাম, ছোটকাগজের স্তিমিত আন্দোলন চাঙ্গা করার ফন্দি আঁটছিলাম, রূপরেখা আঁকছিলাম হ্যানত্যান, দুর্ধর্ষ গণতান্ত্রিক হাওয়ায় ফ্রাইডে পোহাচ্ছিলাম মুহতার্মা হাসিনার দোয়ায় এবং দয়ায়, আর এইসব আগড়বাগড় ভাবছিলাম।
সম্ভবত ২০১৩/’১৪ নাগাদ কোনো-একটা নাম-ইয়াদ-নাই লিটলম্যাগের কথায় তাড়িত হয়ে ঝটিতি স্পিডে এই নিবন্ধটি লিখিত হয়েছিল। পরে এডিটর তা আর ছাপতে পারেন নাই নিবন্ধের বক্তব্যে আপত্তিকর উপাদান থাকায়, রিগ্রেট প্রকাশ করেন পরিবর্তে। এরও বছর-দেড়েক পরে এইটা বাছবিচার পত্রিকায় ছাপা হয়, আনকাট আস্তটাই, ইমরুল হাসান আগ্রহ দেখায়েছিলেন ছাপতে। ‘বাছবিচার’ লিটলম্যাগ নয়, ওয়েবম্যাগ, তাই বাঁচোয়া। অ্যানিওয়ে। এইবার আরেকটু ঘষেমেজে, প্যারাস্পেস-যতিচিহ্নাদি ঠিকঠাক করে, বেশকিছু শব্দচূর্ণ ও বাক্যাংশ জুড়ে এবং তথ্যভ্রম গড়েপিটে এইখানে আরেকবার প্রকাশ করা গেল। — লেখক
একই বিষয় ঘিরে লেখকের আরেকটি নিবন্ধ
কাগজের অ্যারোপ্লেন বিষয়ে একটি চির্কুট-সন্দর্ভ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS