প্রস্থানের এগারো বছর পরে ম্যারিলিনের (Marilyn Monroe) প্রতি নিবেদিত জনের এই গান ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উয়িন্ড’, সূচনাপঙক্তি ‘গ্যুডবাই নোর্মা জিন্’ শিরোনামেও পরিচিত লোকসমক্ষে এই গান, মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাপ্রিয় হয়। এই শ্রোতাপ্রিয়তা পাঁচ-দশজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এক-দুই মাসের বিক্রিতালিকায় শীর্ষস্থ থাকা বা চার্ট দখল করে রাখাও নয়, সেই ১৯৭৩ সনে রিলিজড গানটা সারাবিশ্বে সংগীতসমুজদারদের কাছে আজও প্রথমদিনের ন্যায় আদরণীয়। শোকসমাহিত শৌর্যবিকিরণকারী পিয়্যানোর উপরে বেইস্-করা গানটার লিরিক যৌথভাবে এল্টন জন্ ও বার্নি টপিন মিলে লিখেছেন, সুর ও সংগীত জনেরই করা বার্নির সঙ্গে কোলাবোরেটিভ অ্যাপ্রোচে, গানটা গেয়েছেন এল্টন জন্ তার অপেরা ক্ল্যাসিক্যাল রেন্ডিশনের ছোঁয়াচ-রাখা আশ্চর্য সুষমাদীপ্ত গলায়।
গানটার লিরিক যদি কেউ মনোযোগে খেয়াল করেন তো অবশ্যই স্বীকার করবেন যে এইটা আইকোনোক্ল্যাস্ট একটা কাজ। বহুদিন ধরে যে-মূর্তিটা বানানো হয়েছে ম্যারিলিনের নামে পেপারে-টেলিভিশনে কেচ্ছাকাহন প্রচারের মাধ্যমে, যে-বিগ্রহ গড়ে বাজারে বেচে শোবিজনেসের সমস্ত শিল্পীদেরেই মিডিয়া, সেই বিগ্রহ নস্যাৎ করেই জনের এই গান শুরু হয়েছে এবং শেষ-পর্যন্ত মূর্তিধ্বসানো সংগীতকীর্তি হিশেবে প্যপমিউজিকের অ্যারেনায় গানটা আমরা মনে রাখব। শুধুই যে ম্যারিলিনের মূর্তি/ইমেইজ পুংগর্বী মিচকে শয়তান মিডিয়ার মশলাদার অবমাননাকর সম্প্রচারের খপ্পর থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছে এই গান, তা নয়; যেন অবমাননাকর ভাবমূর্তি নির্মিতির শিকার সমস্ত শিল্পীদেরেই এই গান স্বমূর্তিতে ফেরাতে চায়, ট্রিবিউট জানায়।
ম্যারিলিন (Marilyn Monroe) ইন্তেকাল করেন নাইন্টিন-সিক্সটি-টুতে। এক সকালবেলায় হোটেলকামরায় স্নানের চৌবাচ্চায় তাকে মৃত উদ্ধার করা হয়। একেবারেই অকালপ্রয়াণ বলে যেইটাকে, ম্যারিলিন তার উচ্ছ্বল যৌবনে খ্যাতির একদম চূড়ায় থাকাকালেই মৃত্যুর ধূসর অঞ্চলে পাড়ি জমান। ম্যারিলিনের অভিনয়জীবনের পুরো সময়টাই ছিল ঝড়ো, লড়াই করেছেন বাহ্যত সংবাদপ্রচারক বেনেগোষ্ঠী ছাড়াও হলিউডের চলচ্চিত্রকারখানা এবং বড় অর্থে আধিপত্যশীল পুরুষতন্ত্রেরই বিরুদ্ধে, লড়েছেন ম্যারিলিন তার নিজের কায়দায়। ইন্ডাস্ট্রি তাকে সেক্সসিম্বল হিশেবে এস্ট্যাব্লিশ করেছে, পেপারপত্রিকায় তারে নিয়া হাসিতামাশা হয়েছে লাগাতার হাম্বাগ হিশেবে, ম্যারিলিনের বোল্ডনেস্ তাতে একটুও কমে নাই বেড়েছে ছাড়া। ম্যারিলিন ছিলেন ঠোঁটকাটা, কাউকে ছেড়ে কথা কইবার বা রাখঢাকের ন্যাচার ছিল না তার। ম্যারিলিনের বিস্তর সাক্ষাৎকারে যেসব ঠোঁটকাটা আলাপের অ্যানেকডোট্যাল আজ আমরা পাই, তাতে একটুও সন্দেহ হয় না যে ম্যারিলিন ছিলেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে। এবং পুরুষতন্ত্রের পুংটামি তিনি ভালোই চিনতেন বলে একদম জোঁকের মুখে চুন দিতে পারতেন নিজস্ব যৌনরসাত্মক কথার প্রয়োগে। সেইসময় এইগুলো পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়িয়েছে শুধু, এইসময়ে এসে সেসব কথা আমরা পাল্লাপাত্থরে ওজন করেই স্বীকার যাব যে সেই বিশশতকের দুর্ধর্ষ প্রবচন/অ্যাফোরিজমের কোনো অ্যান্থোলোজি হলে ম্যারিলিনের মুখনিঃসৃত অনেক আপাত-পাগলাটে বাক্যই সেখানে জায়গা পাবে।
এই গানে ম্যারিলিনের ক্যারিয়ারের কোর জায়গাগুলো সনাক্ত করতে পেরেছেন সিঙ্গার-স্যংরাইটার এল্টন জন্ এবং তার দীর্ঘদিনের সহযোগী গীতিকার বার্নি টপিন। উল্লেখ করতে হবে যে এই গান দিয়াই চিরদিন মানুষ জানবে যে ম্যারিলিনের ব্যক্তিনাম বস্তুত নোর্মা জিন্, ম্যারিলিন মনরো তার পর্দানাম। এমনি ফ্যাক্টফাইন্ডিং আরও অনেককিছুই সিগ্ন্যালাইজড ফর্মে এই লিরিকে পোরা আছে, একটু মনোযোগে দেখলে/শুনলেই ক্লিয়ার হবে যে-কারো কাছে। এল্টন জন্ ছিলেন উঠতি বয়সের প্রায়-বালক, ম্যারিলিনের ক্যারিয়ার বিকাশের সময় এল্টন নেহায়েতই বালক এবং সেই বালকচিত্তে যেমন রেখাপাত করেছিল প্রিয় নায়িকার প্রতি চারপাশের আচরণ সেই-সমস্তই তিনি গানে এনেছেন শিল্পসফল রূপায়ণের মাধ্যমে। ম্যারিলিনকে ভোগ্য পণ্য হিশেবে দেখার ব্যাপারটা বালক জনের মনটাকে বিষণ্ণ করে, যেমন সকল বালকেরেই করে তাদের প্রিয় মানুষের/শিল্পীর প্রতি অ্যাডাল্টদের অসদাচরণ, এই বিষণ্ণতা আশ্চর্যভাবে পিয়্যানোর ই-মেজর ভর করে সৃজিত সংগীতের সর্বত্র ছড়িয়ে রাখা।
লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে এই গাননির্ভর এল্টন জনের ‘গ্যুডবাই ইয়েলো ব্রিক’ অ্যালবামটার। এইসব তথ্য অত জরুরি নয় এই নিবন্ধে। এইখানে আমরা বাংলায় এল্টন-ট্যপিন নিবেদিত শ্রদ্ধাগানটা বাংলায় একবার পড়ে দেখতে চেষ্টা করব। উল্লেখ্য যে, একই মিউজিকের ট্যামপ্লেটে একই স্ট্রাকচারে এল্টন জন্ আরেকটা গান করেন প্রিন্সেস অফ ওয়েলস ডায়ানা আকস্মিকভাবে প্যারিসের রাস্তায় কারক্র্যাশে ইন্তেকালের পরে, সেই গান প্রিন্সেসের ফিউনেরালে এল্টন গেয়েছিলেন এবং পরে ডিক্লেয়ার করেছিলেন এই গান তিনি আর কখনো কোথাও স্বকণ্ঠে গাইবেন না। আজও জনের কথার খেলাপ হয় নাই। বিস্তর ভার্শন করা হয়েছে বিভিন্ন কণ্ঠে, এল্টনের কণ্ঠে সেই সাতানব্বইয়ের ডায়ানা-অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে গাওয়াটাই একমাত্র অরিজিন্যাল। ‘গ্যুডবাই ইংল্যান্ডস্ রৌজ্’ সূচনাপঙক্তির গানটা ‘গ্যুডবাই নোর্মা জিন’ গানের সুরবর্তী হলেও দুই গান একই একই বৈঠকে পাশাপাশি শুনলেও অন্য বিষাদব্যঞ্জনা পাওয়া যায়, আর্দ্র হয় লিস্নারদের চিত্ত। উভয় গানেই অকালপ্রয়াত দুই আইকন তাদের অন্তরালের দীপ্তি নিয়া আবির্ভূত হয়েছেন, উভয়কেই ঝড়ো বাতাসের ঝাপটের লগে লড়াই-করা মোমবাতির চিত্রকল্পে ধরা হয়েছে, ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উয়িন্ড’ এই দুই গানেরই সেন্ট্র্যাল ইমেইজারি। নিচে আমরা ম্যারিলিন মনরো ওর্ফে নোর্মা জিনের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধাগানের একটা বাংলা ভার্শন পড়ব।
ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড ১৯৭৩ : গ্যুডবাই নোর্মা জিন্
লিখেছেন যৌথভাবে এল্টন জন্ এবং বার্নি টপিন
ভূমিকা ও বাংলায় তর্জমা : জাহেদ আহমদ
———-
বিদায় জানাই, বিদায় তোমায়, বিদায় নোর্মা জিন্
যদিও আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই কোনোদিন
তুমি ছিলে এক এমন মানুষ নিজেতেই নিজে দাঁড়ানো
চৌদিকে দ্যাখো শত কুতুবের দুরুদুরু ভয়ে হাঁপানো
ওই দ্যাখো ওরা হামাগুড়ি দিয়া কাঠের সিঁড়ির গোড়ায়
মাথা নিচাইয়া চলার মন্ত্র ফিসফিসাইয়া যায়
দ্যাখো ওরা চায় বাঁধিতে তোমারে তাহাদেরই বাঁধা ছকে
নক্লি নামেই চালাইতে চায় তাদেরই শেখানো সবকে
এখন বুঝেছি জীবন তোমার কেটেছে কেমন করে
যেমতি কাটায় মোমের শিখাটি ভীষণ রোষের ঝড়ে
এমন বাদল দিনের বেলায় কাছেপিঠে কেউ নাই
নিঃসঙ্গতা জাপটায় জোরে বৃষ্টিরা মারে ঘাই
বিজনে বসিয়া ভাবি মনে মনে কেমন হইত যদি
চিনপরিচয় থাকিত তোমার সঙ্গে জন্মাবধি!
কিন্তু তখনও বয়স আমার এক্কেবারেই অল্প
পত্রিকাগুলো রসিয়ে ছেপেছে কেচ্ছাকাহনকল্প
মোমের শিখাটি গিয়াছে পুড়িয়া বেইল ফুরাবার আগে
প্রেমিকহৃদয়ে অফুরান তুমি বিপন্ন অনুরাগে
একাকিতা ছিল অতিকায় যেন গোটা জিন্দেগিময়
স্ক্রিনের বাইরে বাস্তবে ছিল সবচে কঠিন অভিনয়
সিনেমাওলারা বানাতে ব্যস্ত স্যুপার্স্টারের অবয়ব
চুকায়েছ তুমি কিমৎ বিলিয়ে আত্মাপোড়ানো শব
ক্যোঁৎ করে গিলে নিয়েছ জখম মরেছ যখন চুপি
মিডিয়া তোমায় তাড়িয়ে ফিরেছে তখনও দৈত্যরূপী
নীল-শাদা-লাল সব পত্রিকা বলেছে সমস্বরে
ম্যারিলিন মরে পড়ে আছে দ্যাখো নগ্ন শরীরঘোরে!
বিদায় জানাই, বিদায় তোমায়, বিদায় নোর্মা জিন্
শেষ সারি থেকে স্যাল্যুট জানাই আমি এক অর্বাচীন
যৌনচক্ষে দেখিনি তোমায় ভাবিনি কল্পতরু
দুঃখদহনে জ্যান্তজীবনে ম্যারিলিন মনরো
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS