বেলাব থেকে উত্তরে, কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় পৃথিবীর সুন্দরতম গ্রাম — সেই গ্রামে গেলাম গতকাল। তিরিশ বছর পর। এক আধ্যাত্মিক সাধক বাস করতেন ওখানে। দূরদুরান্ত থেকে লোক আসত। অদ্ভূত সব লোকেরা। তাদের নাম কেউ জানত না। তাদের ডাকা হতো তাদের গ্রামের নামে, বা মহকুমার নামে। যেমন একজনের নাম ছিল ‘ভাটির চর’, একজনের ‘বরারচর’, একজনের ‘কাস্তুল’, একজনের ‘ডুমরাকান্দা’। তারা এখানেই থাকতেন। কারণ ঐ আধ্যাত্মিক সাধক তাদের কাউকে কাউকে বিদায় দিতেন না। সেখানে ‘বিদায় নেয়া’ ছিল অবশ্যপালনীয় রিচুয়াল। কেউ কেউ ছিলেন, বিশ-পঁচিশ বছর ধরে ‘বিদায়’ পাননি। ফলে বাড়িতে যাওয়া হয়নি।
নিরক্ষর মানুষ তারা, চিঠিপত্র লিখতে পারতেন না। টেলিফোনেরও যুগ সেটা ছিল না। পরিবারও জানত না তারা কোথায়। একসময় তারা ভুলে যেত। নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামের জায়গা দখল করে নিত গ্রামের নাম।
সাধকের বাড়ির অদূরে একটা বড় ছায়াঢাকা টিলার মধ্যে পাগল বাঁধা থাকত, লম্বা লম্বা শেকলে। তারা গান গাইত। গাছে উঠে বসে থাকত। কখনো কখনো শিকল খুলে বা ছিঁড়ে পালাত। মধুপাগলা ছিল খুব তাগড়া। তাকে দেখবার জন্য ঐ টিলায় গিয়ে বসে থাকতাম। নিরাপদ দূরত্বে। একদিন সে শিকল ছিঁড়ে রেখেছিল। আমাকে দেখেই তেড়ে এল। প্রাণভয়ে দৌড়ে এক ভাঙা কবরের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে থাকলাম। তুর্কী ঘোড়সওয়ারের মতো মুখে টকাটক শব্দ করতে করতে মধুপাগলা কোথায় পালায়ে গেল!
সেই সাধক দেহান্তরিত হয়েছেন বহুবছর। সেই বিদায়-না-পাওয়া লোকগুলিও একে একে মরে গেছে। বড় মাজার হয়েছে। এয়ারকন্ডিশনড মসজিদ হয়েছে। ওরশ হয়। প্রচুর লোকসমাগম হয়।
সাধকের ভাইপো এখনকার মোতওয়াল্লি। ছোটবেলায় তিনি আমাকে একটা হলুদ ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। সেই গল্প করলেন। ওই গ্রামে কয়েকমাস আমি স্কুলে পড়ালেখা করেছিলাম। ক্লাশমেটদের একজনের সাথেও দেখা হয়ে গেল।
ঐ গ্রামে আমার পরিচয় আমি ‘ভৈরবের ভাইসাবের’ ছেলে। পৃথিবীর এই একটামাত্র গ্রামেই আমার বাবা এখনো বর্তমান। সবাই চেনে। নতুনরাও। পুরোনোরা তাদের চেনাশোনা গল্পে গল্পে নতুনদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে। ভৈরবের ভাইসাব। নিজের পরিবারের মধ্যেও যেখানে তাঁর স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে।
ভেবেছিলাম, এত বছর পর যাচ্ছি, নতুন নতুন অনেক গল্প শুনব। কিন্তু সব পুরনো গল্পই শোনা হলো। নতুন স্থাপনায় বসে বসে। পৃথিবীতে গল্প খুব বেশি নেই। সামান্য কিছু গল্পের চক্করেই পৃথিবী অনাদিকাল ঘুরছে। এই গ্রামটাও।
- প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটি লেখকের সৌজন্যে পাওয়া। — গানপার
- ১০ কবিতা || হোসনে আরা কামালী - June 26, 2025
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
COMMENTS