আমার গল্পগুরুগণ || সজলকান্তি সরকার

আমার গল্পগুরুগণ || সজলকান্তি সরকার

শেয়ার করুন:

প্রত্যেক পরিবারই গল্প শোনার ও শেখার ক্ষেত্র আর সেক্ষেত্রে পরিবারের বয়স্ক সদস্যগণ গল্পের মূল রূপকার। তাছাড়াও বাকি সদস্যদের জীবননির্ভর বেঁচে থাকার গল্প তো থাকেই। আমার বাবার বাবা ‘কর্তা’ এবং মার বাবা ‘দাদামশয়’ ছিলেন আমার ছেলেবেলায় গল্প শোনানোর গল্পকার। তারা দু’জনেই ছিলেন তৎকালের মায়না পাস বিদ্বান। কর্তা প্রমোদ চন্দ্র সরকার। শিক্ষকতার চাকুরি তোয়াক্কা না করে পরগণার সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করেন। ছিলেন কৃষিডিলার। ভাটির গৃহস্থ। গৃহস্থালির পাশাপাশি গানের দল ও পালা মঞ্চায়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব নেন। বাড়ির আলগঘর ছিল তখন রিহার্সেলঘর। ঠাম্মা পূর্ণমণি সরকার ছিলেন এ কর্মের নিরলস যোগালু।

অন্যদিকে দাদামহাশয় নরেন্দ্র চন্দ্র সরকার (সুয়াবাবু) ছিলেন কামরূপ ফেরৎ বিখ্যাত যাদুকর। ছিলেন চারণকবি ও চারুকারুশিল্পী। উরিগান ও কবিগানের সরকার হিসেবেও এলাকায় তাঁর সুখ্যাতি এখনও লোকমুখে প্রশংসনীয় গল্প হয়ে আছে।

আমার দুরন্ত শৈশবে এ দু-জনের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছে অনেক। শুধু তা-ই নয়, ঘুমের বিছানায় দু-জনের মাঝখানে শুয়ে রাতভর গল্প শোনার অভিজ্ঞতাও কম নয়। একটা গল্প কোনোরকম শুরু হলেই আর থামত না। দু-জনের মধ্যে শুরু হয়ে যেত গল্পবলার প্রতিযোগিতা। আর আমি তখন নীরব শ্রোতা হয়ে মনভরে তা উপভোগ করতাম।

কর্তা তো বলতে গেলে ছিলেন আমার ছাত্রজীবনে বন্ধু ও শিক্ষক। কথায় কথায় ছিল যাঁর উপদেশ আর উপমা। দাদামহাশয় ছিলেন সংস্কৃতিচর্চার কর্ণধার। ছবি আঁকা তাঁর কাছেই শিখি। আমাদের বাড়িতে দাদামহাশয় এলে যাদুর আসর হতো। কীর্তন পালাগান সহ নানা আসর জমতো। বিশেষ করে ঘরের বারান্দায় গল্পের আসর বসতো সকলে মিলে। পাড়ার অনেকেই আসতেন গল্প শুনতে। তখন গ্রামাঞ্চলে গল্প ছিল বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম। রসে ও তামশায় বেশ জমে উঠত গল্পের আসর। তবে আসরে নীতিবোধ ও ধর্মীয় ভাবধারার গল্পের কদরই বেশি ছিল। আর এ কাজে তাঁরা দু-জনেই ছিলেন মহামহিম। তখন থেকেই শুরু হয় আমার গল্পপ্রেম।

হাওর নিয়ে খুব বেশি গল্প আমি শুনিনি তবে হাওরবাসীর ত্যাগ, সংগ্রাম ও সাহসিকতার কিছু গল্প আমি শুনেছি। হাওরের প্রাণবৈচিত্র্য, সমাজজীবনের আনন্দ-বিষাদ ও মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও অনেক গল্পের গল্প হয়ে আছে। সেজন্যই মনে হয় বাংলার হাওরেই রয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ ও শিক্ষণীয় গল্পউপাদানের বৃহৎ খনি। গল্পের বই ‘আলগঘর’ তারই কিঞ্চিৎ প্রয়াস। মূলত এ বইয়ের গল্পগুলো হাওরবাসীর বাস্তব জীবনধারার গল্পরূপ। অল্পপরিসরে স্বাধীনতা সংগ্রাম, কৃষিসংগ্রাম, জীবনসংগ্রাম, সমাজনীতি ও উর্বর সংস্কৃতির কিছু দিক এই বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

এক সময় হয়তো হাওরভিত্তিক এই বাস্তব গল্পগুলো কাল্পনিকও মনে হতে পারে। তাই হাওরবাসীর ঐতিহ্য ও জীবনমান গল্পেগল্পে ধরে রাখাই এ বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি বিষয়গুলো পাঠকমহলে জানিয়ে দেয়ারও প্রয়াস। আর এ প্রয়াসের সামিল অনেকেই। তাদেরকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে প্রকাশক সুফি সুফিয়ান ও তার নাগরী  প্রকাশনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

৩০ আগস্ট ২০২৫


সজলকান্তি সরকার রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you