আমার বাবা || সোহেল হাসান

আমার বাবা || সোহেল হাসান

২০০০ সালের জুন মাসের ৩ তারিখ প্রচণ্ড গরম ছিল খুলনা শহরে। আমরা খালিশপুরের বিআইডিসি রোডের একটা বাসায় ভাড়া থাকতাম। সকাল দশটার দিকে আমি টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিলাম। তখন আমার সপ্তম শ্রেণীর দ্বিতীয় টার্মফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বাবা তখন এলপিআর-এ। বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ করে অন্য রুমে কান্নার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে যেয়ে দেখি মা এবং বোনরা কান্নাকাটি করছে।

বাবা মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। বাবার মুখ বেঁকে গেছে এবং কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বাবা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়বেটিসের রোগী ছিলেন। তাড়াতাড়ি করে একটা স্কুটার (বেবিট্যাক্সি) ডেকে স্থানীয় কয়েকজন দোকানির সাহায্যে খালিশপুর ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমার পরীক্ষা বলে আমাকে যেতে দেওয়া হলো না।

ক্লাস সিক্সে ক্যাডেট কোচিং করার সময় আমি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তা নিয়ে বাবা-মার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। সুস্থ হয়ে গেলেও আমাকে প্রতিদিন আখের রস খাওয়ানো হতো। সন্ধ্যায় যখন হাসপাতালে বাবাকে দেখতে গেলাম তখন বাবার সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল না। কোনোরকমে কথা বলতে পারছিল। আমাকে দেখেই খুব অস্পষ্ট শব্দে সবাইকে এবং আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল আজ আখের রস খেয়েছি কি না। মৃত্যুপথযাত্রী হয়েও বাবা-মার পক্ষেই মনে হয় একমাত্র সন্তানদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব। সেটাই আমার সাথে বাবার শেষ কথা ছিল।

পরবর্তীতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ধরা পড়লে ঢাকায় নেওয়ার কথা থাকলেও অবস্থার অবনতি হলে খুলনায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তখন খুলনায় কোনো নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ছিল না। হাসান জাহিদুর রহমান স্যার সপ্তাহে একদিন ‘গরীব নেওয়াজ’-এ বসতেন। স্যারকে নিয়ে আসা হলো। আমার বড়দুলাভাই অনেক চেষ্টা করে প্রফেসর আবু বকর স্যারকে নিয়ে আসলেন। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ১০ দিন হাসপাতালে থেকে জুনের ১২ তারিখ বাবা মারা যান। সেবাশুশ্রূষা করার বয়সও আমার ছিল না। আমার এক মামা (টিপুমামা) এবং আমার মেজোদুলাভাই ইমরান হাসান চৌধুরী দশটা দিনই রাতের বেলায় বাবার কাছে ছিলেন। সারারাত জেগে আবার সকালে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেতেন।

আমার বাবা আমাদের উপার্জিত অর্থের সেবা নিয়ে যেতে পারেননি। আমি ১৯৯৮ সালে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলে বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন এবং ঘোষণা দিলেন টাকাটা বাবা তুলতে যাবেন। তখন প্রতিমাসে বৃত্তির টাকা পেতাম ৫০ টাকা এবং বছরে বই কেনার জন্যে ১০০ টাকা। প্রথম ছয় মাসের ৩০০ টাকা বাবা স্কুলের অফিস থেকে তুলে আমাকে একটা CASIO ঘড়ি কিনে দেন এবং সম্ভবত বাকি ৮০ টাকা বাবা নিজের কাছে রেখেছিলেন। বৃত্তি যদি উপার্জনের মধ্যে পড়ে তাহলে বাবা আমার উপার্জনের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশটাই নিয়েছিলেন। বৃত্তির দুটো পরীক্ষার মাঝে যে ফাঁকা সময় থাকত তখন বাবা কোথা থেকে যেন বড় রসগোল্লা এনেছিলেন। সেই স্বাদ আর ভালোবাসা পৃথিবীর কোনোকিছুর সাথে তুলনীয় নয়। এখনও সেই স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। যারা তাদের বাবা-মাকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছে কিংবা উপার্জিত অর্থ দেবার সুযোগ পেয়েছে তারা খুবই ভাগ্যবান। আমার বাবা খুব যে মহান ব্যক্তি ছিলেন তা না, খুব উঁচু স্তরের বংশগৌরবের অধিকারী ছিলেন তা নয়, অল্প শিক্ষিত ছিলেন। কিছুটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। কিছুটা বদমেজাজ ছিল। মাঝে মাঝে রেগে যেতেন হুটহাট। কিছু সময় পরেই শান্ত। কখনো হিংসা বা রাগের বশবর্তী হয়ে কারো ক্ষতি করতে দেখি নাই।

বাবা খুবই সরল মনের ছিল। বাবার টাকা মাইর যাওয়ার গল্পগুলো ছোটবেলায় আমাদের খুব মজা দিত। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের ভালোবাসতেন অবিশ্বাস্য আর অমিতব্যয়ীর মতো করে। বাবারা যেমন বাসেন। নিন্মমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন আমার বাবা। আমার দাদা মারা যায় বাবার যখন পাঁচ কি ছয় বছর বয়স। তিনি তাই মনেপ্রাণে আমাদের দুই ভাইকে তার বাবাই মনে করতেন। কিন্তু আফসোস এ-ই যে আমার দাদা এবং আমরা দুইভাই মানে আমার বাবার বাবারা তার কোনো সেবাযত্নই করতে পারল না।

বাবা, পিতা, আব্বু, বাপজান, বাজান শব্দগুলোর ব্যাপকতা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না; আর এই শব্দের সাথে জড়ানো আবেগ হৃদয়-স্পর্শ-করা। আমাদের অধিকাংশই প্রথম স্কুল যাবার সময় যে-আঙুলটি ধরে ভয়ে ভয়ে পা চালালো তা তার বাবার। খেলনা আর পথের ধুলোমাখা খাবারের আব্দার তাও বাবার কাছে। সাঁতার শেখার সফল কিংবা ব্যর্থ প্রচেষ্টা তাও বাবার সাথে। মলিন হাসি আর পুরাতন একখানা শার্ট পরে সন্তানের সকল সমস্যায় পাশে থাকা লোকটির সামাজিক নাম বাবা। মেয়েকে মা এবং ছেলেকে আব্বা ডেকে কোলে তুলে নেন যিনি তার নাম বাবা। শাসন, ভালোবাসা, স্নেহ আর দায়িত্ব — এই চারের একত্রিত মহামানবের রূপের ইহজাগতিক নাম হলো বাবা। মানসিক বিকারগ্রস্ত বাদে এমন কোনো বাবা খুঁজে পাওয়া যাবে না যার ভালোবাসায় সিক্ত হয়নি তার সন্তানেরা। আমি আমার বাবাকে অনুভব করি প্রতি মিনিটে মিনিটে। আমি তাকে আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে এবং ভালোবাসায় খুঁজে ফিরি। আমার মতোই খুঁজে ফিরে সবাই তাদের বাবাকে।

আমার বাবা একবার আমার জন্মের আগে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন অ্যাক্সিডেন্ট করে। মায়ের কাছে শুনেছি বাবাকে রাখা হয়েছিল মেঝেতে — সিট খালি না থাকায়। ২০১৫ তে সরকারি চাকুরির পদায়ন নিয়ে জেনারেল হাসপাতালে গেলে আমি মেঝেতে তাকিয়ে থেকেছি কতদিন! উদাস হয়েছি, হয়েছি কল্পনামাখা। আমি খুব বেহিসেবী। আমার বাবার কথা মনে হলে আরও বেহিসেবী হতে ইচ্ছে হয়। আমি এসিঘরে ঘুমানোর সময় আমার বাবার কথা মনে হলে ঘামতে শুরু করি। আমি বিমানে উঠলে আমার বাবার ঘামে ভেজা শরীরে সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। আমি দামি কিছু কেনার সময় আমার বাবার পুরাতন রঙ-উঠে-যাওয়া শার্টটির কথা মনে পড়ে।

আমার বাবাকে আমার বেলায়-অবেলায় মনে পড়ে। শতসহস্র দুঃখযন্ত্রণায় মনে পড়ে। স্বপ্ন, আবেগ আর ভালোবাসার নৌকা তীরে ফিরুক আর না-ফিরুক, পালে বাতাস তো লাগুক। এই লেখা পড়ে কেউ যদি তার জীবিত বাবার জন্যে কিঞ্চিৎ বেশিও করে তাতেই লেখা সার্থক। হারিয়ে যাওয়ার আগেই ভাবুন। হাজারবার ভাবুন। হৃদয় দিয়ে, চোখ বন্ধ করে, একাগ্রতার সঙ্গে ভাবুন — এমন ভালোবাসা আর কোথায় পাবেন?

ব্যানারচিত্র হুমায়ুন আজাদের  ‘আব্বুকে মনে পড়ে’  বইয়ের প্রচ্ছদ অবলম্বনে বানানো


সোহেল হাসান, কবি ও গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক, খুলনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা, চাকরিসূত্রে নিবাস সিলেটে


সোহেল হাসান রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you