আহমেদ স্বপন মাহমুদকে নব্বইয়ের অনেকের তুলনায় অধিক যুগপ্রাসঙ্গিক মানতে হয়। যাত্রাপালার বিবেকের অধুনা সংস্করণ প্রেরণাদায়ী বক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার দিন এখন আর নাই। স্বপনের কবিতা এই আছর থেকে মুক্ত থাকায় তাঁর ভাষাঅঙ্গে প্রকটিত দ্বিরাভাসে স্থানকালপাত্র গলেমিশে কালাতীত সমাধি লাভ করে এবং পাঠক-হৃদয়ে অমীমাংসিত বেদনার রেশ বহায় :—
আজ পৃথিবীর ঘোড়াগুলো আকাশে উড়ছে, তারা বাতাসে ধাবমান—
মহাকালের-কোনো শাশ্বত নগরীর খোঁজে অজস্র ধ্বনি ও বর্ণের, ধ্যানের আলোকমালায়, আমাদের ঘোড়াগুলো আজ উড়ে যায়…
(ঘোড়া)
…
একটি প্রজাপতি উড়ছে
একটি কালো গোবরে পোকা মাটি খুঁড়ছে
আর ক’জন শববাহী এগিয়ে আসছে
কতগুলো বৃক্ষ, বনানী, ভাঙা সাঁকো পেরিয়ে
হরিৎ পত্রাদি ঘেরা নিঝুম জায়গায়
কবরে শব রেখে লোকজন চলে যাচ্ছে।
একটি মৃত্যুর সাথে এভাবে মানুষ প্রজাপতি, পোকামাকড়
বৃক্ষ, বন, হলুদ এবং বিবিধ বর্ণ ইত্যাদি জড়িয়ে যাচ্ছে,
আবার প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছে বিবিধ প্রাণপ্রজাতি;
জীবিতদের কে কে ভাবছেন মরণের কথা!
(মৃত্যু)
…
পাহাড়ের উচ্চতার সমান পানশালায় ঢুকে
গ্লাসে চুমু দিতেই তোমার ঠোঁট প্রসারিত হতে হতে
আমার ঠোঁটে এসে মিশে। একা।
আমরা তখনো নিঃসঙ্গ নদীর মতন
নদী তীরের একাকিত্বের মতন।
শুকনা বাঁশপাতার ওড়াউড়ির মতন, একা।
একাকী উড়ে উড়ে সে কোথা যায়?
আমি একা থাকি। একা মরে যাই। একার হাওয়ায়…
(চোখ বন্ধ, মন সহজ)
…
একবার কোনো এক শীতের রাতে
একটা বনমোরগ খাদে পড়ে গেল
খাদে পড়ার আগে সে উড়ছিল
উড়বার আগে সে ডাকছিল
ডাকবার আগে কয়েকটা তারা খসে পড়ছিল।
আমার কোনো বনমোরগ নাই।
আমরা তারাদের বোন, তারাদের ভাই
আমরা মরে গিয়ে শূন্যে মায়ার তারা হয়ে যাই।
(বনমোরগ)
…
আকাশে আমরা ঘুরে ঘুরে ফিরে আসি
তোমাকে দেখে, তোমাকে না দেখে ডুবি আর হাসি।
(সন্ধ্যার আগে যেকোনো বিকেলেই)
স্বপনের মেদহীন ঝরঝরে বয়ান স্থানকালের চেনা করতল থেকে অচেনা, অনির্ধারিত ও সংজ্ঞাতীত পরিধিতে কবিকে নিক্ষেপ করে এবং পাঠক তাঁকে অমীমাংসিত কোবিদ রূপে সেখানে বিচরণশীল টের পায়। সংক্ষুব্ধ বাংলাদেশের যেসব চালচিত্র আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতা ইদানীং ধারণ করে সেগুলো কবির দেশকাল ও সমাজ সচেতন মনের পরিচয় তুলে ধরলেও পৃথক স্বকীয়তার জন্ম সম্ভব করে না। রাজনীতি সচেতনা বাংলা কবিতার মর্মে প্রবাহিত। সমৃদ্ধ এই সংগ্রহশালায় এত কবির নাম রয়েছে সেখানে স্বপনকে পার্থক্যসূচক স্বাতন্ত্র্যে আবিষ্কার করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। স্থানবাস্তবতায় গতিশীল দৃশ্যপ্রবাহের ফাঁক গলে অধিবাস্তব জগতে পাড়ি জমাতে ইচ্ছুক কবিতায় তাঁর স্বকীয়তা যেন ঠিকরে বের হয়! সাকার স্থানবাস্তবতা থেকে নিরাকার অধিবাস্তবতায় কবির অনুপ্রবেশ বস্তুগত ও মরমি উভয় অর্থে ঘটে :— ‘নীলে, লীলায় / শূন্যতায়— / নাই হয়ে যাব।— / লা শরিকে।’ (দ্রষ্টব্য : যখন কিছুই ছিল না)। কবির এহেন উক্তি সুফি ফানাফিল্লাহয় নিরুদ্দেশ হওয়ার মরিম চোরাটানকে ফিরিয়ে আনে। অন্যদিকে কবি যখন বলেন, ‘আমি প্রাণ প্রকৃতির ঐক্যের নামতা পড়ি। এই ধারাপাত আমার। আমি সমগ্র। নীরব ও শূন্য।’ (দ্রষ্টব্য : চোখ বন্ধ মন সহজ), তখন এই উচ্চারণ শূন্যতাকে শুদ্ধ নিরাকারে কবি-অস্তিত্বের সমাধি ভাবতে আপত্তি জানায়। ভিন্ন মেজাজের দুটি কবিতাকে একত্রে পাঠ গেলে পাঠকের চেতনায় দ্বিরাভাস ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এ হলো সেই দ্বিরাভাস যেটি প্রাচীনকাল থেকে অধুনা অবধি ‘শূন্যতা’ সম্পর্কিত সকল প্রতিপাদ্যকে প্রহেলিকা নামে আখ্যায়তি করে চলেছে।
‘কিছু না থাকার পরিবর্তে রয়েছে কেন?’ — এই প্রশ্নের মীমাংসা আজো ঘটেনি, কাজেই ‘শূন্যতা’ বলতে ঠিক কী বোঝায় সে-নিয়ে দ্বন্দ্বের অন্ত নেই! বিজ্ঞানীরা বিগত কয়েক দশক জুড়ে নিদান হেঁকে চলেছেন মহাবিশ্বে একরত্তি স্থান খুঁজে পাওয়া মুশকিল যাকে ‘কিছু নেই’ অথবা তথাকথিত অর্থে ‘শূন্য’ ভাবা সম্ভব। অবিনাশী শক্তির ভুতুড়ে তরঙ্গ আপাত সীমানাবিহীন মহাবিশ্ব জুড়ে বিদ্যমান থাকায় তাকে স্থানকাল-অতিরিক্ত ভাবা অপলাপের নামান্তর। সংজ্ঞাতীত অধিবাস্তবতায় মহাবৈশ্বিক স্থানবাস্তবতার অবক্ষয় ও পুনঃবিকাশ লাভের ঘটনাকে বিবেচনায় নিলে অস্তিত্বের মুত্যু নেই, এর পরিবর্তে ভুতুড়ে শক্তিতরঙ্গে মিশে নতুন রূপান্তর লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। দুটি বাস্তবতার পারস্পরিক আপতনের কারণে অস্তিত্বের ক্যালিডোস্কোপে জীবনের আগমন-নির্গমনের কোন রূপটি শাশ্বত সে-বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন! এই বিস্ময় আশির কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের ‘অস্তিত্বের শ্লোক’ কবিতার স্তবক স্মরণ করতে পাঠককে প্ররোচিত করে :—
আমাকে হত্যা করো
প্রতাদেশে
প্রভুকে হত্যা করো
আমার আদেশে,
আমি প্রভু
প্রভু আমি
প্রেমের পালক।
হৃদয়ে তোমাকে পেলে
প্রেম;
প্রাণ দিতে প্রাণ নিতে
আর প্রাণহীন হতে
শূন্যে আরো শূন্য হই
সকল সময়।
(অস্তিত্বের শ্লোক, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার)
অধিবাস্তবতার অভিমুখে আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতার গমন দ্বিরুক্তিতে ভরা অস্তিত্ব যাপনের ফেরে অনিবার্যতা লাভ করে! মানবঅস্তিত্বকে ঘিরে যত অনুষঙ্গ বিরাজ করে তারা সকলে মিলে সামগ্রিক জীবনবোধের প্রতীক। অনুষঙ্গরা চিরকালীন নয় এবং সে-কারণে তাদেরকে কেন্দ্র করে বিরচিত সামগ্রিকতাও অচিরস্থায়ী। একটি সামগ্রিকতা নিজের বিলোপের ক্ষণে নতুন সামগ্রিকতায় সাকিন খোঁজে! সম্মোহক এই সামগ্রিকতার অনুধ্যানে নিয়োজিত কবির পক্ষে সময়সারণি-মাঝে নিজের যাপন ও বিলয়ের চরিত্রটি কেবল উপলব্ধি করা সম্ভব :—
ঘোড়াগুলো ক্রমশ ধেয়ে আসে, যেখানে ওপরে আকাশ, পাখির প্রেম আর জলপাতা ছেয়ে যাওয়া বনের নগর, অথবা কোনো আদিম, কোনো ভবিষ্যৎ সভ্যতার সম্ভাবনা-ঘেরা বর্তমানের — আমাদের কালের মূর্তির ধ্বনি, নাকি বিলুপ্ত নগরীর অভিশাপ — যেখানে কেবল আলো আর গান, নাকি বিধ্বস্ত উত্থান
(ঘোড়া)
…
সুন্দরবনের গল্পে একপ্রকার সম্মোহন আছে।
সারারাত হরিণীর পেছনে চিতাবাঘ
চিতার পেছনে আকাঙ্ক্ষা
আকাঙ্ক্ষার পেছনে আগুন
আগুনের পেছনে সম্মোহন
ইত্যাকার গল্পে একপ্রকার ধ্যান নিহিত।
আমি যেই সম্মোহনে তার দিকে তাকালাম
যথামাত্র অজস্র জৈব-মেঘ উড়ে এল
আর তার চোখের লুকানো আগুন
অন্ধ হলো নিমেষেআগুনের ভরা অন্ধকার।
(সুন্দরবনের গল্প)
সুন্দরবনের গল্প বয়ানের ছলে আকাঙ্ক্ষা ও সম্মোহনের ফাঁদে বন্দি কূটাভাসে নিজেকে সংযুক্ত করায় নব্বইয়ের সময়সারণিতে আবশ্যক দ্বিরুক্তি সংযোজনে যেসব কবি অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন সেখানে এই কবির নামটি প্রাসঙ্গিক হয়। কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ স্বাদু তাঁর বাকভঙ্গির সহজতায়। পঙক্তিমালার আড়ালে নিহিত অর্থস্তরে কূটাভাস সৃষ্টি কিংবা ‘আগুনের ভরা অন্ধকার’-র মতো সময়-প্রাসঙ্গিক পঙক্তি যোজনার কারণে তিনি জটিলও বটে! নব্বই-পরবর্তী কালপর্বে ভাষা যেসব বৈশিষ্ট্যের দিকে মোড় নিয়েছে সেখানে কবির দ্বন্দ্বসঙ্কুল অবস্থান গ্রহণ জরুরি, বলাবাহুল্য কাব্যযাত্রার শুরু থেকে সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে স্বপন নিজেকে ভাষা দিয়ে চলেছেন। এই পথে তাঁর বাকসিদ্ধি! অবশ্যই সেই পথে নয়, যেখানে তিনি বাংলাদেশে বিদ্যমান স্থানবতাস্তবতা পাঠ করতে নেমে গতানুগতিক পঙক্তির ফেনায় নিজের শক্তি ও স্বকীয়তার অপচয় ঘটান! স্বপন স্বচ্ছন্দ যবে এই উচ্চারণ তাঁর কলম দিয়ে নামে,— ‘মানুষ চিরকাল পরাশ্রয়ী — তুমি খণ্ডিত আশ্রয়ে থাকো — আর সবকিছু পড়ে থাকে মৃত্যুর মতো, অনাস্থায়।’ (দ্রষ্টব্য : আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল)। পাঠক তাঁকে আগামীতে এরকম পঙক্তিস্রোতে বারবার পড়তে চাইবে, যা তিনি ত্রিশ বছরের মধ্যবর্তী পর্বে সম্ভবত অধিক লিখেছেন।
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
COMMENTS