আকিরা কুরোসাওয়া (Akira Kurosawa) দেখছেন — কোনো কাট ছাড়াই টানা পাঁচ মিনিটের লম্বা কান্নার দৃশ্যটি কীভাবে তার অভিনেতা ফুটিয়ে তুলছেন। সময়টা ১৯৪৮, আর ছবির নাম ‘দ্য কোয়ায়েট ডুয়েল’। হঠাৎ কুরোসাওয়ার পাশের লাইটটা খট খট করে কাঁপা শুরু করল। উৎস খুঁজতে গিয়ে উপলব্ধি করলেন তিনি নিজেই এই শব্দের কারণ; অভিনয় দেখতে দেখতে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেননি, কখন যেন ফুঁপাতে শুরু করেছেন। তাকিয়ে দেখলেন তার পাশের ক্যামেরাম্যানের অবস্থাও একই। পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, ফোকাস ঠিক রাখার জন্য তাড়াতাড়ি চোখ মুছলেন তিনি। ক্যামেরার সামনে আর পেছনে এভাবেই শক্ত মনের মানুষেরাও কোনো আবেগঘন মুহূর্তে দ্রবীভূত হন।
অভিনেতার নাম তোশিরো মিফুনে (Toshiro Mifune)। মারা গেলেন ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ শীতে ৭৭ বছর বয়সে জাপানের মিতাকার এক হাসপাতালে। দেখতে দেখতে দুই দশক হয়ে গেছে দ্য লাস্ট সামুরাই প্রস্থানের। চলচ্চিত্রজীবন তার সব মিলিয়ে ৫০ বছরেরও বেশি হবে। ক্যারিয়ার দীর্ঘ, সফল এবং তাৎপর্যপূর্ণ। স্বদেশবাসীর কাছে তিনি এমন একজন যিনি “বাইরের দুনিয়ায় জাপানি ছবির সবচেয়ে বড় প্রতিভূ”। আর সারাবিশ্বের দর্শকের কাছে তিনি এমন একজন যিনি সমস্ত জটিলতা আর সামর্থ্য সহ এক মহান জাতীয় চলচ্চিত্রের পৌরুষদীপ্ত রূপ। ‘রশোমন’ (১৯৫০)-এর দস্যু হিশেবে তার আন্তর্জাতিক উত্থান থেকে শুরু করে ১৯৮০-র সেই হলিউডি মিনি সিরিজ ‘শোগ্যুন’ পর্যন্ত পথপরিক্রমা লক্ষ করে বলা যায়, মিফুনে ছিলেন শতাব্দীর সেরা এশীয় চলচ্চিত্রতারকা। গ্যং লি-র কথা আমরা ভুলে যাইনি, ভুলে যাইনি অন্য অর্থে খ্যাতিমান ব্রুস লি কিংবা জ্যাকি চ্যানের কথা; তারপরও মিফুনে-ই সেরা।
মিফুনে-র শ্রেষ্ঠতা মাপার একটা সহজ উপায় হচ্ছে কুরোসাওয়ার তৈরি বিভিন্ন ছবির হলিউডি রিমেকে মিফুনে-র করা চরিত্রগুলো কারা রূপায়িত করেছেন তার একটি তালিকার দিকে একটু নজর বুলানো। তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে শুধু এশিয়ায় কেন সারাবিশ্বে আর কারো ক্ষেত্রেই বোধহয় এমনটি হয়নি — একজন অভিনেতার করা বিভিন্ন ছবির রিমেকে এতগুলো হলিউডি মুখ বিরল। তার অভিনীত ছবি থেকে করা রিমেকে কাজ করেছেন স্টিভ ম্যাক্যুইন (‘সেভেন সামুরাই’ থেকে করা ‘ম্যাগ্নিফিসেন্ট সেভেন’), ক্লিন্ট ইস্টউড (‘ইয়োজিম্বো’ থেকে তৈরি ‘অ্যা ফিস্টফ্যুল অফ ডলার্স’), প্যল নিউম্যান (‘রশোমন’ থেকে তৈরি ‘আউটরেইজ্’), ব্রুস উইলিস (‘ইয়োজিম্বো’ থেকে তৈরি ‘লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং’); আর জর্জ ল্যুকাস যেমনটি বলেছেন, — ‘হিডেন ফোর্ট্রেস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি তার ‘স্টার ওয়ার্স’ তৈরি করেছিলেন, সেটি সত্য বলে ধরে নিলে এই তালিকায় হ্যারিসন ফোর্ডকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তা, এইসব মস্ত মস্ত হলিউডি তারকারা কি শিখেছেন মিফুনে-র অভিনয় থেকে? ‘ইয়োজিম্বো’ দেখে ইস্টউড শিখেছেন নড়াচড়ায় মিতাচারী হতে; পাশাপাশি গ্রহণ করেছেন মিফুনে-র ক্রুদ্ধ ভ্রূভঙ্গি আর কামোদ্দীপক খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সযত্নে লালিত তিন/চারদিনের অযত্নে-বেড়ে-ওঠা দাড়ির এই ফ্যাশন এখনও কোলোন অ্যাডের পুরুষ মডেলের মুখে দেখা যায়। তবে এসব বাঘা বাঘা অভিনেতাদের কেউই মিফুনে-র পুরো ইম্প্যাক্টটা আনতে পারেননি। এমনকি একই মহাদেশের অভিনেতা চাও-উন-ফাৎ — উনিও পারেননি মিফুনে-র ধারেকাছেও পৌঁছতে, যদিও ‘অ্যা ব্যেটার টুমরো’-তে মিফুনে-র বিখ্যাত ট্রেডমার্ক টুথপিক ধারণাটি ধার করেন।
কুরোসাওয়ার ছবিগুলোতে মিফুনে যেন এক রাজকীয় জন্তু — সদা গর্জমান, লম্ফমান, ড্যামকেয়ার। চুপ করে বসে থাকতে তিনি পারেন না, স্থির অবস্থায় তাকে দেখা গেছে কদাচিৎ, একটা-না-একটাকিছু করছেনই; — হয়তো টিপে টিপে উকুন মারছেন (‘ইয়োজিম্বো’), নয়তো থাপড়িয়ে মাছির গুষ্টি নিপাত করছেন (‘রশোমন’) কিংবা এমনভাবে থুতনি খোঁচাচ্ছেন যেন আক্ষরিক অর্থেই চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে (‘সেভেন সামুরাই’)। জনশূন্য নোংরা কোনো রাস্তা দিয়ে লম্বা ভারী পদক্ষেপে তার চলে-যাওয়ার মুহূর্তকে সহজেই সঙ্গ দিতে পারে ক্যাটলড্রামের শব্দ। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন পৃথিবীর থরথরিকম্প। আর কথা বলেন তিনি দ্রুত, শব্দগুলো বেরিয়ে আসে সরাসরি কণ্ঠা থেকে, আলাদা আলাদা কিন্তু পরিষ্কার উচ্চারণে। প্রতিটি মিফুনে-উচ্চারণে আছে এক অলৌকিক শক্তি। নরম গলা আর বিনয়ী এক সমাজে মিফুনে যেন মূর্তিমান বিদ্রোহ, অহং আর অবচেতন প্রবৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ।
আধুনিক চরিত্রেও তিনি অভিনয় করেছেন। তবে বিজনেস-স্যুটপরিহিত মিফুনেকে মনে হয় স্ট্রেইট জ্যাকেটে বন্দী এক সিংহ। তারপরও তার তেজস্বী ভাব — এই হয়তো নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন, পরমুহূর্তেই ফেটে পড়ছেন রাগে — দর্শককে মনে করিয়ে দেয় এ হচ্ছে ভালোমন্দে মেশানো এক সত্যিকার মানুষ।
উত্তরপূর্ব চিনের কুয়িংডাও অঞ্চলে মিশনারি বাবা-মায়ের ঘরে মিফুনে-র জন্ম ১৯২০ সালে। ১৯৪৬ সালে তোহো স্টুডিয়োর নতুন অভিনেতা সংগ্রহ অভিযানে সাড়া দেন মিফুনে। কুরোসাওয়ার সুপারিশে তাকে নেয়া হয়। আবেগকে দ্রুত ফুটিয়ে তোলার বিষয়ে তার দক্ষতা লক্ষ করে কুরোসাওয়া তাকে একদল চমৎকার অভিনেতার মধ্যমণি বানিয়ে দেন। প্রথমদিকের ছবিগুলোতে বয়স্ক প্রাজ্ঞ তাকেশি শিমুরার বিপরীতে মিফুনে যেন এক বন্য শাবক। পরবর্তীকালে ‘ইয়োজিম্বো’-তে করলেন ঠাণ্ডা মাথার তাৎমুরা নাকাডেই-এর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এক দুর্ধর্ষ সামুরাই চরিত্রে অভিনয় — সেখানে মিফুনে যদি হন জন ওয়েইন তবে নাকাডেই এলভিস।
১৯৪৮ থেকে ১৯৬৫ সময়সীমায় তৈরি একটামাত্র ছবি বাদে কুরোসাওয়ার প্রত্যেকটি ছবিতেই মিফুনে অভিনয় করেছেন — সাকুল্যে ১৬টি ছবি। সমালোচকদের মতে কুরোসাওয়ার সেরা কাজ প্রায় সবগুলো এই ১৬ ছবির মধ্যে আছে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এত গভীর এবং ফলপ্রসূ অভিনেতা-পরিচালক সম্পর্ক খুব বেশি নেই। আন্তোনিয়োনির জন্য যেমন মনিকা ভিট্টি, শ্যাব্রলের জন্য স্টেফানি আর্ডেন, ঝাং ইমৌ-র গ্যং লি, গুরু দত্তের ওয়াহিদা রেহমান, কুরোসাওয়ার জন্য তেমনি মিফুনে। এরা শুধু অভিনয়শিল্পীই নয়, এরা ছবি তৈরির চালিকাশক্তিও বটে।
কিন্তু ১৯৬৫-তে ‘রেড বিয়ার্ড’-এর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কুরোসাওয়া-মিফুনে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমৃত্যু অটুট ছিল এই বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের কারণ ‘রেড বিয়ার্ড’ নির্মাণে কুরোসাওয়ার অসম্ভব দীর্ঘসূত্রিতা, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কয়েক বছর বেশি সময় লেগে যায় কাজটা শেষ করতে। এ-সময় ছবির প্রয়োজনে দাড়ি রাখার কারণে অন্য ছবিতেও কাজ করতে পারছিলেন না মিফুনে, আবার তাকে দাড়ি কাটতেও দিচ্ছিলেন না পরিচালক। ছবিটি নির্মাণকালে কোনো অভিযোগ করেননি মিফুনে। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর গ্যুডবাই জানালেন তার আবিষ্কারককে — বাকি জীবন আর কখনো একত্রে কাজ করেননি তারা। এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ — দাড়ির জন্য ছাড়াছাড়ি! এমনকি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেও অনীহা ছিল তাদের। আর উভয়েই এটা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চরমভাবে। পরে মিফুনে হলিউডের পরিচালকদের সাথে কাজ শুরু করলেন।
অথচ কুরোসাওয়া সহ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিফুনে-ই আগে চলে গেলেন! যার শিল্পনৈপুণ্য একদা তাকে কাঁদিয়েছিল সেই পুরনো বন্ধু এবং শত্রু বিষয়ে বলতে গিয়ে ৮৭ বছরের পরিচালক শুধু জানালেন, — “আমি তাকে শুধু এ-ই বলতে চাই, ধন্যবাদ, শান্তিতে বিশ্রাম নাও!”
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জামিল বিন সিদ্দিক
[সংগৃহীত রচনাটার উৎস ঢাকা থেকে প্রকাশিত ১৯৯৮ ফেব্রুয়ারি ২য় বর্ষ ১৯ সংখ্যা আনন্দভুবন। উৎসস্থলে প্রকাশিত রচনার নাম ছিল ‘তোশিরো মিফুনে : দ্য লাস্ট সামুরাই’। মূল রচনার সঙ্গে যুক্ত তথ্যসূত্র : টাইম, হলিওয়েলস্ ফিল্মগোয়ার্স অ্যান্ড ভিডিয়োভিয়্যুয়ার্স কম্প্যানিয়ন, আওয়ার ফিল্মস্ দ্যেয়ার ফিমস্]
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS