সহজ করে নির্মোহভাবে জীবনের সত্য উচ্চারণ করা কঠিন। কেউ কেউ সেই কঠিন কাজটিই সহজে করে থাকেন। ‘খানসাহেবের খণ্ডজীবন’ পড়তে পড়তে আবারও সেই কথাটি মনে হলো। গ্রন্থটি সাহিত্যের কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত হবে, পড়ার পর এমন একটি ধাঁধা কাজ করে। কিন্তু ভালো করে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় যে, লেখক সিরাজুদ দাহার খান অন্য একটি চরিত্রের মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে একটু দূর থেকে অনেকটা তৃতীয় নয়ন দিয়ে নিজেকেই দেখার চেষ্টা করেছেন, সে-হিসেবে এটিকে আত্মজৈবনিক গ্রন্থই বলা যায়।
লেখক ‘পূর্বাভাস’ দিয়েছেন এই বলে যে, —
“খানসাহেব কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়; বাস্তব জীবনভিত্তিক! তিনি বিচিত্র প্রকৃতির এক মানুষ! কখনো জটিল, কখনো রহস্যঘেরা ও হেঁয়ালীময়। আবার কখনো শিশুর মতো সরল। বাইরে হাস্যরসে তোলপার করা। আবার কখনো কখনো এমন ভাব-গম্ভীর যে, অন্যরা তো দূরের কথা, তিনি নিজেও নিজেকে চিনতে পারেন না।
আমার সাথে তাঁর পরিচয় জন্মজন্মান্তরের। কিন্তু আমিও তাঁকে নিখুঁতভাবে চিনে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে তাঁর অবচেতন মনে কী খেলা করে, তা আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট। তাঁর জীবনবোধ, সমাজভাবনা-রাষ্ট্রচিন্তা, জীবনজীবিকার ধরন এবং ম্যানার্স- কোনো কিছুই একতালে যায় না; পরস্পরবিরোধী। একেকসময় একেক রকম।”
তাই কেবল আত্মজৈবনিক গ্রন্থ বলে খানসাহেবের খণ্ডজীবনকে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেললে গ্রন্থটির প্রতি সুবিচার করা হবে না বলেও মনে হয়। লেখকের লিখনশৈলীর কারণে এটি কখনো কখনো এনে দিয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাসের আমেজ। তবে যা-ই বলি, গ্রন্থখানি যেমন কালের স্বাক্ষর, একটা সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বয়ান; তেমনি এটি মধ্যবিত্ত পরিবার ও এক মানুষের স্বপ্ন, স্বপ্নের ভাংচুর, জোড়াতালি, আবেগ, সংগ্রাম, আপোসের এক নিপুণ বুনন। ‘খান সাহেব’ অনেক মানুষের হয়ে কথা বলেছেন, হয়ে উঠেছেন মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি বা প্রতিচ্ছবি।
গ্রন্থটি যদিও ২৯টি শিরোনামে বিভক্ত, কিন্তু প্রতিটি শিরোনামই একটি গল্প শোনায়। আর এই গল্পগুলো জোড়া লাগালে এমন একটি বড় ক্যানভাস হয়ে যায়, যাকে পূর্ণ বলা যায় না বটে, তবে পূর্ণতার বিকাশপথ তো অবশ্যই।
গ্রন্থটি পড়তে পড়তে পাঠক বারবার নিজের দিকে তাকাবে, আনমনে নিজেকেই খুঁজে ফিরবে এমন এক আঙিনায় যেখানে স্বপ্নেরা খেলে বেড়াতে চায় ইচ্ছেমতো কিন্তু হোঁচট খায়, ব্যথায় কুঁকড়ায় আবার একটু পরেই হেসে ওঠে বিমল আনন্দে। এভাবেই ‘খান সাহেবের খণ্ডজীবন’ হয়ে উঠেছে এক অখণ্ড জীবনের ধ্যান।
এই ধ্যানকে মন্ত্রমুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করেছে গ্রন্থের শেষে পর্যায়ে যুক্ত ‘আয়নায় ৬২ বছর’ শিরোনামে অধ্যায়টি। এটি মূলত লেখকের এ-পর্যন্ত পথহাঁটার খতিয়ানের একটি বয়ান। যেখানে অবারিতভাবে উঠে এসেছে এমনকিছু বক্তব্য, যা থেকে লেখকের মনোভঙ্গির একটা পরিচয় পাওয়া যায়। পাঠকের বোঝাপড়ার জন্যে সেখান থেকে কিছু কথা তুলে ধরা হলো :
“দেশপ্রেমে জীবনদানকারী মুক্তিযোদ্ধা দেখেছি; স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রবিরোধী আলবদর-রাজাকারদের আস্ফালন দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবের মুক্তি কামনায় নফল নামাজ আদায়কারীদের জামাতের মহিলা শাখা মহিলা জামাতের পাল্লায় পড়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী হতে দেখেছি; তাদেরকে রাজাকারদের হাতে নিহত ভাই বা মামার মৃত্যুকে স্বাভাবিক ও আবশ্যক ভাবতে দেখেছি। আওয়ামী-বিরোধীতার নামে কমিউনিস্টদেরকে রাষ্ট্রবিরোধী জামাতকে সমর্থন দিতে দেখেছি।….
শহুরে বুলিকপচানো মুক্তমনা নাগরিকদেরকে অলক্ষে মুক্তচেতনাবিরোধী সংস্কৃতি দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মগজের কোষে কোষে গেঁথে দিতে দেখেছি।…
তত্ত্ব নিয়ে বিবাদে লিপ্ত কট্টর সাম্যবাদীদের জনসম্পৃক্ততা তলানিতে নামতে দেখেছি এবং দেখছি, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হতে দেখেনি নিজ বাসভূমে। শেখ মুজিবের বিরোধিতা করতে করতে জামাতিদের উত্থান হতে দেখেছি; তাদের হাতে সাম্যবাদী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তমনাদের খুন ঝরতে দেখেছি, জোটবদ্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে সাম্যবাদীদেরকে লড়তে দেখেনি।”
এমন বিক্ষুব্ধতার পর লেখক সিরাজুদ দাহার খান ঠিকই পাঠকদেরকে এক আশার রূপকল্পে নিয়ে যান, গ্রন্থের শেষে এসে যখন তিনি বলেন, —
“এখনও মানবতার পতন হতে দেখলে, বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দম্ভ দেখলে, বাংলাদেশ বিরোধীদের হাতে দেশের অপমান হতে দেখলে রক্তে নাচন লাগে, জ্বলে উঠতে ইচ্ছে করে আগের মতো —
মাগো, ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি
তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বটেশ্বর বর্ণন ।
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS