এক বিস্ময়কর সংগীতসাধকের কথা || বারী ভিবজিয়র

এক বিস্ময়কর সংগীতসাধকের কথা || বারী ভিবজিয়র

আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করতে আমরা যেসব উপাধি দিয়ে তাঁকে অলঙ্কৃত করি সেগুলো হচ্ছে ‘গিটারের যাদুকর’, ‘রকস্টার’ কিংবা ‘বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের উত্থানে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিত্ব’। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চুকে অনুধাবন করতে গেলে তার মেধার প্রকৃত মূল্যায়নের প্রয়াস কামনা করলে তার দিকে আরেকটু মনোযোগী হওয়া, এবং তার কর্মকাণ্ডের পাঠ নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে।

আইয়ুব বাচ্চু সংগীতসাধনে নিমগ্ন এক পরিপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। যতদূর জানা যায় আইয়ুব বাচ্চু ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় প্রথম একটি গিটারের মালিক হন, যেটি তার বাবা তাকে কিনে দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তার বাবার সাথে দুরত্ব তৈরি হয় সংগীতে আসক্ত হয়ে পড়ার জন্যই। ‘স্পাইডার’ ব্যান্ডের জ্যাকব ডায়াস-এর কাছে আইয়ুব বাচ্চুর হাতেখড়ি হয়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সে-সময়ে অর্থাৎ ১৯৭২-১৯৭৩ সালে গিটার চাওয়া এবং পাওয়া দুটোই অত্যন্ত ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে গিটার তখন পরিচিত ছিল না। ব্যান্ড বা সংগীতগোষ্ঠী তৈরি করার ধারণা বাংলাদেশে তখনও প্রচলিত হয়নি। সে-অর্থে বাবার কাছে গিটার চাওয়া নিঃসন্দেহে বালক বাচ্চুর সংগীতজগতের প্রতি আকুলতার লক্ষণ।

স্কুলে পড়াকালীন একসময় আইয়ুব বাচ্চু তার সংগীতে আগ্রহ থেকেই ‘স্পাইডার’ ব্যান্ডে যোগ দেন। পরবর্তীতে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে যোগ দেন। মাঝখানে তিনি ‘গোল্ডেন বয়েজ’ এবং ‘আগ্লি বয়েজ’ নামে স্কুলের বন্ধুদের সাথে দুটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন বলেও জানা যায়। বাংলাদেশে অগ্রণী ভুমিকা পালনকারী প্রথম ব্যান্ড ‘সোলস’-এ আইয়ুব বাচ্চু একসময় যোগ দেন। তপন চৌধুরী জানান, আইয়ুব বাচ্চু তপন চৌধুরীকে অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন তাকে সোলসের একজন সদস্য হিসাবে নেওয়ার জন্য। অন্যদিকে  সোলসের গিটারিস্ট ব্যান্ড ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় সেইসময় একজন দক্ষ গিটারিস্টের প্রয়োজন পড়ে। চট্টগ্রাম শহরে একজন গিটারিস্ট হিসাবে তখন আইয়ুব বাচ্চু পরিচিত ছিলেন। ফিলিংস ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। তখনও তিনি এবি হননি। দক্ষ গিটারিস্ট হিসেবে কিছুটা সুনাম থাকায় সোলসের সব সদস্যই তাকে গিটারিস্ট হিসেবে দলে নিতে একমত হন।

আইয়ুব বাচ্চু গিটার শেখার জন্য কতটা নিমগ্ন ছিলেন তা বোঝা যাবে কিছু তথ্য জানা থাকলে। আইয়ুব বাচ্চু এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তখন গিটার বাজানোর পাঠ নেওয়া মোটেও সহজ ছিল না। এখন যেমন আমরা ইউটিউব কিংবা ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিটারের কর্ড সম্পর্কে জানতে পারি বা বিভিন্ন পাঠ পেয়ে যাই তখন সে-সুযোগ ছিল না বিধায় কেবলমাত্র কানে শোনার উপর নির্ভর করে গিটারের আওয়াজ বের করতে হতো। এমনও হয়েছে একটি নির্দিষ্ট সুর বের করার জন্য মূল গানকে কয়েকশবার শুনতে হয়েছে। সে-যুগে ফিতার ক্যাসেট প্রচলিত ছিল বিধায় একটি গানকে বারবার রিওয়াইন্ড করে শুনতে হতো। যে-কারণে ফিতা পেঁচিয়ে গিয়ে ক্যাসেট নষ্ট হাওয়ার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে ক্যাসেটপ্লেয়ার অ নষ্ট হয়ে যেত। এবি আরেক সাক্ষাৎকারে এও জানিয়েছেন যে ফিলিংস ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রুডি থমাস তাকে সারাদিন দরজা-জানালা বন্ধ করে আটকে রেখে গিটার শিখতে উৎসাহমূলক চাপ দিয়েছেন।

আইয়ুব বাচ্চু গিটার শেখার বিষয়টাকে সাধনা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর প্র্যাক্টিস করার অকল্পনীয় ধৈর্য ছিল। বাংলাদেশের সূচনালগ্নের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সোলস ব্যান্ডের দুই সদস্য এবং দুই কিংবদন্তি তপন চৌধুরী ও নকীব খান জানিয়েছেন, কোনো প্রোগ্র্যামের আয়োজনের দিন যখন ব্যান্ডমেম্বাররা প্র্যাক্টিস করার জন্য সময় ঠিক করে রাখতেন, আইয়ুব বাচ্চু সেই নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌছে প্র্যাক্টিস শুরু করে দিতেন। প্র্যাক্টিসের পর প্রোগ্র্যাম শুরু হওয়ার আগে যখন বাসায় গিয়ে রেডি হয়ে আসার পর্ব আসত, আইয়ুব বাচ্চু অন্যদের বলে দিতেন যে, তিনি প্র্যাক্টিসস্থল থেকেই প্রোগ্র্যামে গিয়ে অংশগ্রহণ করবে,  অন্যরা যেন নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে রেডি হয়ে আসেন। অর্থাৎ তিনি মাঝের সময়টায়ও প্র্যাক্টিস করবেন। সোলস ব্যান্ডেরই প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য আহমেদ নেওয়াজ জানিয়েছেন যে, আইয়ুব বাচ্চু কোনো প্রোগ্র্যাম শেষ হয়ে যাবার পরও অনেক রাত পর্যন্ত একা একা প্র্যাক্টিস করতেন। আইয়ুব বাচ্চুর বেশকিছু কালজয়ী গানের গীতিকার শহীদ মোহাম্মদ জঙ্গী জানিয়েছেন, আইয়ুব বাচ্চুর সাথে কারও দেখা হলে কথা শুরু হতো কুশলাদি দিয়ে আর কথা শেষ হতো সংগীত দিয়ে। যে-কোনো স্থানে আইয়ুব বাচ্চু গেলে, হয় গিটার সাথে করেই যেতেন তিনি অথবা গিটার তার আগেই পৌঁছে যেত। সোলস ব্যান্ডেরই আরেক মহান শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন, তিনি এবং আইয়ুব বাচ্চু আগ্রাবাদ হোটেলের একটি স্থান পেয়েছিলেন গান প্র্যাক্টিস করার জন্য। তারা আগ্রাবাদ হোটেলে বিভিন্ন গানের প্রোগ্র্যামে অংশগ্রহণ করেন বলেই অনুগ্রহপূর্বক একটু জায়গা পেয়েছিলেন দিনের বেলায় প্র্যাক্টিস করার জন্য। শর্ত ছিল কোনো ফ্যান চালানো যাবে না কেবল একটিমাত্র লাইট জ্বালানো যাবে। বিদ্যুৎখরচ যাতে কম হয় এজন্যই এরূপ শর্ত আরোপিত হয়েছিল। কুমার বিশ্বজিৎ এবং আইয়ুব বাচ্চু সকাল ৯.০০টা থেকে বিকাল ৪.০০ টা পর্যন্ত গান প্র্যাক্টিস করতেন কিছু না খেয়ে। যখন তারা দুজন বিকেলবেলাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হতেন, আগ্রাবাদ হোটেলের নিকটস্থ টিউবওয়েলে পানি পান করতেন। কয়েক বছর আগে সেই টিউবওয়েলের সন্ধানে দু-বন্ধু গিয়েছিলেন বলেও কুমার বিশ্বজিৎ জানিয়েছেন।

আইয়ুব বাচ্চুকে আমারা অনেকেই চিনি ‘এলআরবি’ গঠিত হওয়ার পর। সংগীতসাগরে ডুব-দেওয়া আইয়ুব বাচ্চু সংগীতে অবদান রাখছেন তার অনেক আগে থেকেই। এবং তার অবদান এত গভীর যা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা এবং জানলে ভীষণভাবে হোঁচট খেতে হয়। বাংলাদেশের ব্যান্ডজগতে সোলস ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’-এর সব গানের মিউজিক কম্পোজিশন এবং লিডগিটার বাজানোর কাজটা আইয়ুব বাচ্চুরই করা। আমরা আরও অবাক হব যদি জানি যে সোলসের দ্বিতীয় অ্যালবাম বের হবার অনেক আগেই সোলসের আরেক কিংবদন্তি নকীব খান ব্যক্তিগত কারণে ব্যান্ড ছেড়ে ঢাকা চলে যান। তিনি ছিলেন সোলসের গানের সুরকার। দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘কলেজের করিডোরে’-র সকল গানের সুর আইয়ুব বাচ্চুর করা। আর যথারীতি লিডগিটার বাজানো এবং কম্পোজিশন তো করেছেনই। সোলস ব্যান্ডের এই অ্যালবামের গানগুলো অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। এবং গানগুলো রক ধাঁচের নয়। সেগুলো ক্ল্যাসিক ধাঁচের না-হলেও বাংলা গানের স্বাভাবিক প্যাটার্ন ধরে রেখেছিল। মুল ভোক্যালিস্ট তপন চৌধুরীকে তো আমরা বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল গানের কণ্ঠধারী হিসেবেই জানি!

আমরা যদি আইয়ুব বাচ্চুর নিজের প্রথম সলো অ্যলবাম ‘রক্তগোলাপ’-এর গানগুলো ইউটিউবের সহায়তা নিয়ে শুনি, তাহলেও আমরা অবাক হব। সেখানেও বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল গানের বর্ধিত আধুনিক রূপের ধারা দেখা যাবে। আইয়ুব বাচ্চুর গানে তবলার ব্যবহার বিশ্বাসযোগ্য না হলেও এ-অ্যালবামে আপনি তা-ই শুনবেন। সংগীতের টানেই একসময় আইয়ুব বাচ্চু চট্রগ্রাম শহর ছেড়ে, তাঁর নিজের বনেদি পরিবার এবং পারিবারিক বনেদি ব্যবসাতে যুক্ত না হয়ে মাত্র ছয়শ টাকা নিয়ে রাজধানী ঢাকাতে চলে আসেন এবং জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক-পর্যায়ে বন্ধু কুমার বিশ্বজিতের সহায়তায় মগবাজারে ভাড়া থাকা শুরু করেন। যতদিন আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে ছিলেন সংগীতই ছিল তার পেশা এবং নেশা। অনেক বরেণ্য শিল্পীই সংগীতচর্চার পাশাপাশি ব্যবসা বা চাকরি করেন। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু সংগীত ছাড়া সারাজীবন আর কিছুই করেননি। সোলস ব্যান্ডের মূল ভোক্যালিস্ট শ্রদ্ধেয় তপন চৌধুরীর প্রথম সলো অ্যালবাম মেগাহিট হয়েছিল। এই অ্যালবামের জনপ্রিয় এবং মানুষের মুখে মুখে যে-গান তখন প্রতিধ্বনিত হতো, তার সবগুলো গানের সুরকার আইয়ুব বাচ্চু। অবিশ্বাস্য ! “পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে”, “আমার গল্প শুনে”, “মনে করো তুমি-আমি”, “অনাবিল আশ্বাসে” … এই গানগুলোর সুর আইয়ুব বাচ্চুর করা? হ্যাঁ, আমিও বিস্মিত হয়েছিলাম জেনে। কারণ এগুলো তো ইংলিশ গানের ধারার মতো নয়; মানে রক গানের মতো নয় আর-কি ! এই গানগুলোর সুর বিশ্লেষণ করলে এটাই বোঝা যায় যে, আইয়ুব বাচ্চু একজন স্বভাবজাত সংগীতভক্ত। প্রাকৃতিকভাবেই সংগীতধারণা (মিউজিক সেন্স) প্রাপ্ত। এই অ্যালবামের প্রত্যেকটি গানই বাংলা ক্ল্যাসিক্যাল বা ধ্রপদী ধারার।

আইয়ুব বাচ্চু তার গিটারবাদনে মুন্সিয়ানা আনার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ কথা আমাদের মানতেই হবে যে-কোনো বিদ্যাই আয়ত্ত করতে হয় একাগ্রতায় এবং চূড়ান্ত রকমের নিবিষ্টতায়। ‘ওয়ারফেজ’ ব্যান্ডের কিংবদন্তিতুল্য লিডগিটারিস্ট কমলভাই একটি টিভিচ্যানেল-সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তিনি তার স্টুডেন্টদের ১ বছর কেবল সারেগামা-ই শেখান। সেই একই প্রোগ্র্যামে আইয়ুব বাচ্চু আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে এখন সবাই গিটার শেখা শুরু করার পরপরই জানতে চায়, আমি কবে বাজাতে পারব। ঠিকই বলেছেন আইয়ুব বাচ্চু। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেককিছুই সহজে জানা যায়, গিটার সহজে পাওয়াও যায়। গিটার হাতে নিলে কেউ ‘অপসংস্কৃতি’ বলে তিরস্কারও করে না। কিন্তু শিখতে হবে সেই সাধনার পথ ধরেই। না হলে শুধু জানাই হবে, শেখা হবে না। আইয়ুব বাচ্চু দৃপ্ত কণ্ঠে এও বলেছেন যে, ব্লুজ শিখতে হবে আগে, কারণ ব্লুজ হচ্ছে বেসিক; তারপর রক শিখতে হবে।

গিটারের বাদনে সিদ্ধহস্ত হতে হতে এক-সময় আইয়ুব বাচ্চু বাংলা গানকে পাশ্চ্যাতের সুরে অ্যাডপ্ট করার চেষ্টা করলেন। তার দ্বিতীয় সলো অ্যালবাম ‘ময়না’-তে আমরা ২টি গানে ‘সাইকাডেলিক রক’-র ছোঁয়া পাবো। ‘ময়না’ অ্যালবাম বের হওয়ার সময়ও আইয়ুব বাচ্চু সোলস ব্যান্ডেই যুক্ত ছিলেন, তবে সোলস তখনও তাদের নিজস্ব ধাঁচের আধুনিক বাংলা গানই পরিবেশন করত। আইয়ুব বাচ্চুর ২য় সলো অ্যালবামই তাকে সাধারণের কাছে পরিচিত করে তোলে। এরও ৩ বছর পর ১৯৯১ সালে সোলস থেকে এবি বেরিয়ে আসেন এবং এলআরবি গঠন করেন। এলআরবি-র ১ম গান যেটা বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল সেটা হচ্ছে “একদিন ঘুমভাঙা শহরে”। যতদূর মনে পড়ে এলআরবি-র ডাবল অ্যালবাম প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই গানটি বিটিভিতে প্রচার হয়েছিল। এই গানটি যখন বিটিভিতে প্রথম শুনি তখন মনে হয়েছিল কোনো বিদেশী সুরে বাংলা গান শুনছি। কিন্তু গানটির কথা জঙ্গীভাইয়ের লেখা এবং সুর আইয়ুব বাচ্চুর নিজেরই করা। গানের শুরুতেই মুখ দিয়ে রক ধাঁচের যে আওযাজ বের হয়, তা-ই যেন বাংলা গানের আরেক ধারা তৈরির ঘোষণাপত্র। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি এই গানটি বাংলা গানের ইতিহাসে আজীবন থেকে যাবে। গানের কথা ও সুর দুটোই কালজয়ী।

অধিকাংশ বাংলা গানের যে প্রচলিত ধারা ছিল সে-ধারা বা প্রথা ভেঙে নতুন বিষয়বস্তুকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায়, এই বিপ্লবের এক অন্যতম গুরু হচ্ছেন এবি । গদ্যকবিতাকেও গানে পরিণত করা যায়, তা দেখিয়েছেন ৯০-এর দশকের কিছু শক্তিশালী গীতিকার এবং রকশিল্পীরা যুগপৎভাবে। এবি সুর তৈরি করতে পারতেন অবলীলায়। তার মনন-মগজ নতুন সুরের সন্ধান পেত এক নিমিষেই। কুমার বিশ্বজিতের গানে সুর দিয়েছেন তিনি। হাসান আবিদুর রেজা জুয়েলকে আমরা চিনেছি এবির কথা, সুর ও মিউজিক কম্পোজিশন দিয়েই। গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী এবি-র অনেক কালজয়ী গানের কথা লিখেছেন। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “হাসতে দেখো, গাইতে দেখো” গানটি প্রথমে এবি সুর তৈরি করেছিলেন। এই সুরের সাথে তাল মিলিয়েই গানের হৃদয়ঙ্গমী কথাগুলো শিবলীভাইয়ের মনে এসেছিল। পাশাপাশি এও জানিয়েছেন, এবি প্রায় সময়ই বিভিন্ন জায়গায় গানের গীতিকারদের নাম স্মরণ করে সবার সাথে শেয়ার করতেন, সেটা অন্য অনেক গুণী শিল্পীদের মধ্যেই বিরল। লতিফুল ইসলাম শিবলী এ কথাও জানিয়েছেন যে এবির গলাতে মেলোডি ছিল বলে যে গানের কথাতে মেলোডি বা সুরেলা কণ্ঠ প্রয়োজন মনে করতেন সেই গান এবিকে দিয়ে গাওয়াতেন। অন্যদিকে প্রথাগত হার্ডরকের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কণ্ঠের প্রয়োজন মনে করলে সেই গান আরেক রকগুরু জেমসকে দিয়ে গাওয়াতেন। আর্ক ব্যান্ডের জনপ্রিয় ভোক্যালিস্ট হাসান জানিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু যে-কোনো পরিস্থিতিতেই কোনোপ্রকার ব্যাকগ্রাউন্ডমিউজিক ছাড়া কেবলমাত্র ‘ডিলে ইফেক্ট’-এর উপর ভিত্তি করেই অসাধারণ মিউজিক কম্পোজিশন করতে পারতেন। হাসানের কাছ থেকে এও জানা যায় এবি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সংগীত পরিবেশনা করেছেন।

এ-প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা স্মরণযোগ্য। একটি টিভিচ্যানেলের লাইভ প্রোগ্র্যাম চলাকালীন আইয়ুব বাচ্চু সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়াকে ফোনের মাধ্যমে আসার অনুরোধ জানালে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পার্থ সত্যি সত্যি উপস্থিত হয়ে চমকে দেন সবাইকে। সেই লাইভ প্রোগ্র্যামেই এবি পার্থ বড়ুয়ারই একটি গানে কোনোপ্রকার পূর্বপ্রস্তুতি এবং পূর্বের কোনোপ্রকার প্র্যাক্টিস ছাড়াই অনবদ্য গিটার বাজান। সেই প্রোগ্র্যামে পার্থ বড়ুয়া অত্যন্ত বিনয় ও শ্রদ্ধা দেখান তার গিটারগুরু এবির সাথে গিটার বাজানোর মতো স্পর্ধা নেই এ-রকম ঘোষণা দিয়ে।

আইয়ুব বাচ্চু সুর দিয়েছেন সোলসের আরেক মহান শিল্পী নাসিম আলী খানের সলো অ্যালবামেও। এই মুহূর্তে একটি গান মনে পড়ছে “যতীন স্যারের ক্লাসে, আড়চোখে তাকিয়ে ছিলে”। সংগীতশিল্পী আগুন যখন বিভিন্ন হতাশা থেকে সংগীত ছেড়ে কিছুটা নেশার জগতে চলে যাচ্ছিলেন, আইয়ুব বাচ্চুই তখন আগুনকে বড়ভাইসুলভ ধমক ও উৎসাহ দিয়ে আবার সংগীতে নিয়ে এসেছেন। আগুনের লেখা কথাতে সুর দিয়ে নিজেই গানের কম্পোজিশন করে দিয়েছেন। সংগীতই ছিল আইয়ুব বাচ্চুর একমাত্র ধ্যান। সংগীতপাগল এবির উপর ‘ মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের ভোক্যালিস্ট মাকসুদুল হক রাগ করেছিলেন ২০১২ সালে এবি হার্টঅ্যাটাক করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর পুরোপুরি সুস্থ না হয়ে, হার্ট মাত্র ৩০% সক্রিয় হওয়ার পরে কলকাতাতে সংগীত পরিবেশনা করতে গিয়েছিলেন বলে।

এবি সম্পর্কে এত দ্রুত সবকিছু বলে শেষ করা যাবে না। এতক্ষণ শুধু সংগীতজ্ঞ আইয়ুব বাচ্চুকে কিছুটা বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। মানুষ এবি কেমন ছিলেন তা বলার চেষ্টা করব, অন্য কখনো, যদি সুযোগ মেলে। এই বিষয়টি লক্ষ করার মতো যে, এবিদের যুগে কাভার করার মতো কোনো বাংলা রক গান ছিল না। এবি, জেমস এবং তাদের সমসাময়িক সব আগ্রহী শিল্পীদেরকে ইংরেজি গান কাভার করতে হয়েছে। কিন্তু এখনকার সব তরুণ শিক্ষানবিশ শিল্পীরা এবি, জেমস এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত বাংলা রকশিল্পীদের গান কাভার করে প্র্যাক্টিস করতে পারেন। এটি আমাদের বাংলাদেশের গর্ব।

তপন চৌধুরী জানিয়েছিলেন তাদের সময় অনেক সাধারণ মানুষই গিটারকে বেহালা বলত। এক প্রোগ্র্যামে ড্রামসেট নিয়ে যেতে পারেননি এ-কথা জানানোর পর ১ টি বাড়ির মালিক পানির ড্রাম-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন! তিনি ড্রাম বলতে পানির ড্রামকে বুঝেছিলেন! সেই অবস্থা থেকে আমাদের কিছু লিজেন্ড শিল্পী বাংলা গানের এই ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এদের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী আমাদের এবি। পশ্চিমবঙ্গের ‘ফসিল’ ব্যান্ডের রূপম ইসলামের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের একটি বাক্য দিয়ে আমি আজকে বক্তব্য শেষ করতে চাই। এবি এবং ফিডব্যাক ব্যান্ডের মাকসুদভাই রূপমকে উৎসাহ দিয়েছিলেন রকগানের জন্য, যদিও পশ্চিমবঙ্গে রূপম খুব-একটা সমর্থন পাচ্ছিলেন না। পরবর্ততীতে রূমপ রকগানে সফল হন এবির শিক্ষা ‘power’এবং ‘aggression’ দিয়ে। যখন রূমপ সফল হলেন এই গত ডিসেম্বরে এলআরবি এবং ফসিল কলকাতাতে নজরুলমঞ্চে পারফর্ম করেছে। এবি রূপমকে বলেছেন “See, What I predicted then, is reality now. Rock Music is here and you have brought out the challenge.” এবিও চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হওয়া এক ব্যাক্তি বিশেষ। এক টিভিচ্যানেলে উপস্থাপিকা যখন জানতে চাচ্ছিলেন আবহমান বাংলা গান সম্পর্কে এবি কি ধারণা রাখেন, তার জবাবে এবি দুষ্টুমি করে বলেন আবহমান বাংলা গান তাঁর হৃদয়ে অবস্থান করে আর নতুন রক ধাঁচের অ্যাডপ্ট-করা বাংলা গান তাঁর হৃদয়ের অল্প উপরে অবস্থান করে। “আমি দেখাতে চাই যে রক আমরাও গাইতে পারি।”

হ্যাঁ, তিনি তা খুব ভালোভাবেই দেখিয়েছেন।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you