মনের খামখেয়ালি বোঝা ভার। ফারসি শব্দ খো’আম’খোয়া বাঙালির জবানে খামোকা হলেও, ওই ফারসিরই খাম কথাটার মানে লেফাফা ধরে বলি, মন যে তার খামের মধ্যে খামোকা কোনটা যত্ন করে রেখে দেবে আর কোনটা ফেলে দেবে বলা মুশকিল। আজ যা ঘটেছে, কাল ভুলে যাই। কিন্তু সেই কবে কোন ছোটবেলায় কী ঘটেছে, মন আজও সেটি তুলে রেখেছে ঝকঝকে ছবির মতো!
এমনই এক স্মৃতি ঈদের। আরবিতে ঈদ (EID) শব্দের অর্থ উৎসব, ব্যঞ্জনায় আরো অনেক কিছু, উৎসবের অনেক বেশিই কিছু। নতুন জামা ফিরনি সেমাই পোলাও কোরমা, এসব যাদের ঈদস্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে আমার ছোটবেলার স্মৃতিটা ঠিক মিলবে না। কুড়িগ্রামে আমার জন্ম। আমাদের ও-দেশে মানুষ ছিল গরিব, এখনো গরিব। সে-গরিব যে কতদূর পর্যন্ত গরিব, আমরা কতটুকু তার খবর রাখি? আমার স্মৃতিতে এখনো সেই বালক বয়সের করুণ বিস্ময় টকটক করছে : কুড়িগ্রামের ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে এসেছে মানুষ, তাদের অনেকেরই টুপি কেনবার সঙ্গতি নেই! তাদের জন্য ঈদগা মাঠের বাইরেই পথের ধুলায় বসেছে দোকান। খবরের কাগজ কেটে বানানো টুপি। আলতায় লাল রঙ করা। বিক্রি হচ্ছে এক পয়সায় একটি। সেই টুপি মাথায় দিয়ে উৎসবে শামিল হয়েছে গরিবজন, কাতারের পর কাতার! ওদের ইফতার মানে একমুঠো চালভাজা পাঁচজনে ভাগ করে চিবিয়ে খাওয়া, সঙ্গে বিচিঅলা আটিয়া কলা জুটলো তো সেই কলা একটি, আর কুয়োর লাল পানি। ও-দেশের পানি লৌহভাগের কারণে লাল, তারই জন্য মানুষের এত গলগণ্ড রোগ ওখানে!
ঈদের দিনে দাওয়াত দিয়েছে মোস্তফা। রেললাইনের ধারে সরকারি ঢালু জমিতে ছাপড়া, যার নাম বাড়ি। ঈদের দিনে ভালো রান্না করেছেন মোস্তফার মা। মোটা চালের সাদা ভাতে হলুদের রঙ, এক ফোঁটা সরষের তেলের ফোড়ন, সেই তাদের পোলাও। বাড়ির মুরগিটা জবাই হয়েছে বটে, কিন্তু উপযুক্ত মশলা জোটেনি, তেলপানিতে সেদ্ধ করে কড়া লঙ্কায় তাকে জিভের উপযুক্ত করা হয়েছে। মিষ্টি বলতে আখের গুড়ে রাঁধা জাউ। বছরের আর-দিন মিষ্টির স্বাদ মেটাত বুনো ফুল। মোস্তফার সঙ্গে কতদিন ঝোপ থেকে বুনো ফুল তুলে তার বোঁটা আমিও চুষেছি। গরিবের জন্য বুনো ফুলেও কিছু মিষ্টিস্বাদ দিতে বিধাতাপুরুষ তাঁর অসীম করুণায় ভোলেননি।
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আর গল্পের দিকে আমার ঝোঁক। বাবার কর্মচারী কোবরেজ দেওয়ান খাঁ। তাঁর মুখে কত-যে গল্প শুনেছি। আর পত্রিকার সাহিত্য ও শিশুদের পাতা ছিল আমার আনন্দের খনি। আলীবাবা চিচিং ফাঁক বলে গুহার ভেতরে ঢুকে এত মণিরত্ন দেখেও বুঝি এত পাগল হননি যতখানি আমি হতাম দৈনিক আজাদ-এর সাহিত্য মজলিশ আর মুকুলের মহফিল পেয়ে। রোজার ঈদের সময় তো রীতিমতো রাজভাণ্ডারে গিয়ে পড়তাম। আজাদ-এর ঈদসংখ্যা বেরোত এখনকার মতো ম্যাগাজিন সাইজে নয়, পত্রিকাই আধখানা ভাঁজে লম্বাটে আকারে বাঁধাই হয়ে সে বেরোত। আসত ভোরের ট্রেনে। আমি গিয়ে ইস্টিশনে দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন নামবে পত্রিকার প্যাকেট আর আমাদের কাগজওয়ালা বশিরের কাছ থেকে কখন ছিনিয়ে নেব একখানা।
ঈদসংখ্যার গল্প আর উপন্যাসগুলো পড়তাম ধীরেসুস্থে, কাগজ হাতে পাওয়ার অনেক পরে। কবিতা পড়ে ফেলতাম দিনমানেই। ঈদসংখ্যায় শওকত ওসমানের বনি আদম, হারেস নামে ছেলেটির সেই-যে কলকাতার ময়দানে জনসভায় যাওয়া, হারেসের সেই-যে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে খেতে বসে তরকারির ঢাকা বাটি খুলতেই জ্যান্ত মুরগিছানার বেরিয়ে আসা আর বন্ধুস্ত্রীটির খিলখিল হাসি কেমন বোকা! সেই-যে আবু রুশদের গল্প জয়নাবের বোন বিলকিস, সেই-যে আজকের দিনে শামসুদ্দিন আবুল কালাম নামে যিনি পরিচিত তখন তাঁর উপন্যাসের নিচে আবুল কালাম শামসুদ্দিন (বরিশাল) এই জেলাপরিচয় সহ নামটি দেখে কিছুদিন আমারও নামের শেষে ব্র্যাকেটে কুড়িগ্রাম লেখা, তালিম হোসেনের লেখা মিটমাট-কে শিল্পীর লেখার ছাঁদে ঘিটঘাট পড়ে ওঠা এবং তার অর্থ বুঝতে না পেরে বোকা হয়ে যাওয়া, সৈয়দ আলী আহসানের চাহার দরবেশ নামে দীর্ঘ কবিতার ওই চাহার শব্দটি যে চার বুঝতে পেরেও অবাক হওয়া চার তবে চাহারও হয়, ফররুখ আহমদের কবিতার দুটি পঙক্তি তৎক্ষণাৎ মুখস্থ হয়ে যাওয়া — শত বছরের চাদর টানি কি লাভ? / আয় ইনকিলাব, আয় ইনকিলাব! কিন্তু ইনকিলাব-এর অর্থ বাবা বড়বাবা কারো কাছেই জিগ্যেস করে না পাওয়া, সেই-যে আক্কেল আলী নামে কোনো এক লেখকের গল্পে দেয়া ছবিতে কবি অবাক হোসেনকে হাতে ধরে বিশাল পদ্মের ওপর রবীন্দ্রনাথের বসানো, তখনো বুঝবার বয়স হয়নি যে গল্পটি ব্যঙ্গরচনা, ভেবেছি সাহিত্যিকের আসন বুঝি পদ্মফুলেই আর সেখানে বসতেও হয় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে, আমি কি কখনো অমন ফুলে বসতে পারব? এইসব এখনো পড়ে আছে নীলচিঠির মতো স্মৃতির খামে। এখনো তারা এত দীর্ঘদিন পরে ঈদের একেকটা দিনে বেরিয়ে পড়ে।
মনে পড়ে কবিতাগুলো। ঈদের কবিতা। তখন ঈদসংখ্যার প্রায় প্রতিটি কবিতাই হতো ঈদের ওপর। বাঙালি মুসলমান পদ্যকারের জন্য ঈদ ছিল এক অনিঃশেষ বিষয়। কোরবানির ঈদের চেয়ে রোজার ঈদটাই তারা বেশি পছন্দ করতেন বলে মনে হয়। কোরবানির ভেতরের কথাটি বোধহয় তারা পদ্যের জন্য হয় বেশি রক্তাক্ত মনে করতেন অথবা জটিল। এর চেয়ে কতই-না সহজ রোজার ঈদ! এক মাসের উপবাস! তারপরেই ভোজ! কোলাকুলি! নজরুলের মতো কবিই পেরেছেন কোরবানি আর কোরবানির ঈদকে কবির চোখে দেখতে। একমাত্র তাঁরই এবং তাঁর একটিমাত্র কবিতাই কোরবানিকে তার সকল সত্য নিয়ে বাংলা কবিতায় উপস্থিত। প্রথম পঙক্তিতেই সে-কবিতায় তিনি আমাদের এমন এক ভাবনায় নিয়ে যান যা আগে পরে কোনো কবিই পারেননি। এমনকি সে ঈদ আর কোরবানি ছাপিয়ে তখনকার, বুঝি এখনকারও, রাজনীতির একটা খবর দেয় : ওরে হত্যা নয় আজ, সত্যাগ্রহ! সত্যের উদবোধন! আর এই নজরুলই পারেন রোজার ঈদের ওপর ক্লান্তিকর মিল ও বক্তব্যের শত সহস্র পদ্যের ভেতরে এমন একটি কবিতা লিখতে যা আমাদের চমকে দেয়! এখনো দেয়! আমাদের ও-দেশের কথা যখন মনে পড়ে তখন তো আমিও পারি না ওই কবিতার বিদ্যুতে স্পৃষ্ট ও তড়িতাহত না হয়ে : জীবনে যাদের হররোজ রোজা, ক্ষুধায় আসেনি নিঁদ! জীবনের প্রতিটি দিন যে মানুষ থাকে মানবসৃষ্ট কারণেই অনাহারী, তার আবার কিসের রোজা! কিসের তার ঘুম যখন জগৎ ঘুমিয়ে থাকে পরদিন ঈদের আনন্দে জেগে উঠবে বলে?
বিষয় আর বিষয়ের প্রতি নিজস্ব অবলোকন, কবির যা কাজ, ঈদ প্রসঙ্গে নজরুল ছাড়া আর কোনো কবির ভেতরেই পাই না। ঈদ সম্পর্কে আর-সকল বাঙালি মুসলমান কবি লিখেছেন পদ্যই! পদ্যেরও জাত আছে, উচ্চতা আছে, স্মরণীয় হবার রক্তও থাকে পদ্যের শরীরে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের ঈদ বিষয়ক পদ্যে তার লেশমাত্রও নেই। অথচ গত শতকের বিশ তিরিশ চল্লিশের দশকে না-হলেও কম করে হাজার দুয়েক ঈদপদ্য লিখেছেন এঁরা!
পদ্যের একটা চাহিদা : মিল! ওই মিলের দোহাই দিয়েই পদ্য দাবি করে আমিও কবিতা! নজরুল বাদে বাঙালি আর-সকল মুসলমান কবির পদ্যে না-হয় মিলগুলোই দেখি। ঈদ শব্দটির সঙ্গে মিল! নজরুলের পরে আমিই বোধহয় একমাত্র, যাকে আপনারা হয়তো কবি এবং বাঙালি মুসলমান বলবেন, আমিই লিখেছিলাম ঈদের ওপর কবিতা! সে-কবিতায় ঈদ বিষয়ক বাঙালি মুসলমান পদ্যকারদের রচনার ওপরে কিছু কথা ছিল। এখানে বোধহয় সেই অংশটুকু নিবেদন করা যেতে পারে। কবিতাটি সমিল গদ্যছন্দে লেখা, টানা ছাপায় অংশটি উদ্ধৃত করছি।
… একদিন বঙ্গীয় মুসলমান পদ্যকার তুমুল মেতেছে ঈদ নিয়ে কবিতা লিখতে, কিন্তু পদ্যের সঙ্গে গদ্যের একমাত্র তফাৎ তারা বুঝেছে এ-ই যে, পদ্যে আছে মিল কিন্তু গদ্যে নেই! অতএব বঙ্গভাষায় তার ঈদ-এর সঙ্গে মিল দিতে পারে এমন কোনো শব্দের সংসারে না পেয়ে সন্ধান, এমনকি উল্টেও না দেখে অভিধান, অবিরাম ব্যতিক্রমহীন ক্লান্তিকর তারা ব্যবহার করে গেছে ঈদ — ওই ঈদের সঙ্গে মিল বাজাতে নিদ, উম্মিদ ও তাগিদ! অথচ চোখে পড়েনি, এক্ষুণি আমার চোখে পড়ছে যে-দুটি শব্দ — সুহৃদ আর সম্বিৎ! …
অথচ, কবিতা লিখতে যদি অন্ত্যমিলের দরকারটাই অনিবার্য হয়, তাহলে ঈদ-এর সঙ্গে মেলাতে এখুনি ডজনের ওপর শব্দ যেমন মনে আসছে বলতে পারি : শীত, সিঁদ, গীত, হরিৎ, তড়িৎ, সংগীত, লোহিত, চিৎ, জিৎ, পীত, ভিত, অসিত, হিত, অতীত, বিপরীত, বারিদ। কিন্তু এর কোনোটিই যে বাঙালি মুসলমান পদ্যকারেরা ঈদ-এর মিল হিসেবে ভাবতেই পারেননি, এ বিষয়ে আমার একটি জোর সন্দেহ আছে। সেটি হচ্ছে, তারা শব্দের হিন্দু-মুসলমান ভেদ করেছেন! ঈদ-এর সঙ্গে তৎসম বা তদ্ভব শব্দ, অর্থাৎ সংস্কৃত বা সংস্কৃত থেকে ভেঙে নেয়া শব্দ মেলানোকে ঈদের মাঠে হিন্দুর প্রবেশের মতোই নিষিদ্ধ জ্ঞান করেছেন।
শব্দের এই হিন্দু-মুসলমান বিভাজন বাংলা ভাষার প্রধান এক ট্র্যাজেডি, বড় একটি কলঙ্ক। মানুষের যেমন, তেমনি ভাষারও মুসলমানি আজও আমরা করে চলেছি। এতদূর পর্যন্ত যে ফারসি শব্দকেও আমরা পৌত্তলিক করে ছেড়েছি। খোদা হাফেজ নিষিদ্ধ করেছি। কারণ, খোদা ফারসি শব্দ। আরবি আল্লা হাফেজই এখন আমাদের জবানে। নামাজও উঠে যাবার পথে, কারণ নামাজ ফারসি শব্দ, আর এর শব্দমূলে রয়েছে নমস্ যা থেকে প্রণাম, নমস্কার, নমস্য প্রভৃতি এসেছে। তাই বাঙালি মুসলমানের জবানে শত শত বছরের শব্দ নামাজের বদলে আমরা আরবি সালাত এখন চালাচ্ছি। রোজার বদলে সিয়াম। রোজা ফারসি রোজ’হ্, যার অর্থ উপবাস। উপবাস কেন করব? তার চেয়ে আরবি সিয়াম করা যাক!
যে পুরুষপুঙ্গবেরা করছেন এই কাজ, তারা যেন বিয়ের বদলে নিকাহ্ করেন এবং নিজেকে স্ত্রীর-স্বামীর বদলে আরবি খসম্ পরিচয় দিয়ে জান্নাতের পথ খোলাসা করেন, নইলে যে দোজখে যাবেন পৌত্তলিক শব্দ ব্যবহারের পাপে! আর দোজখ-ও ফারসি শব্দ। তারা যেন পায়জামা-জামা না পরেন, কারণ ফারসি জাম’হ্ থেকে ফারসি দর্জি ও-দুটি সেলাই করে! দুম্বা কোরবানি দেবার জন্য ব্যাকুল না হন, কারণ দুনবহ ফারসি, তারা যেন আল্লাহর দোহাই নবিজির বাহনকে উট না বলেন, কারণ উটের মূল উষ্ট্র আরবি নয়! আর, মসজিদে নামাজ পড়লেও মিনার থেকে যেন আজান না দেন, কারণ মিনার নামে যে ফারসি শব্দ তার অর্থ স্তম্ভাকৃতি চূড়া বা মন্দির!
শব্দের এই হিন্দু-মুসলমান করা, ব্যুৎপরস্ত আর আল্লাওয়ালা করা, এই কাজটি সবার অলক্ষে খুব দ্রুত করা হয়ে চলেছে। এই পাগলামি না থামালে ক্ষতিটা হবে মানুষের — মানুষের ভাষার। ঈদের দিনে কোলাকুলিটা কেবল মানুষে মানুষে না করে, আসুন না, ভাষায় ভাষায় কোলাকুলিটা একবার করি, বন্ধু বলে বুকে গ্রহণ করি!
‘ঈদ’ শিরোনামে এই নিবন্ধটা সৈয়দ হকের ‘কথা সামান্যই’ থেকে নেয়া। সাহিত্য প্রকাশ ঢাকা থেকে এইটা ২০০৬ ফেব্রুয়ারিতে পয়লা ছাপা। ফার্স্ট-প্রকাশ বইয়ের ১১৭-১২০ পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে এই রচনাটি বিন্যাস্ত। — গানপার
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS