পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে এবং গোবিন্দ হালদার সৃষ্ট সুর ও সংগীতাঞ্জলি || জিয়া হাসান

পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে এবং গোবিন্দ হালদার সৃষ্ট সুর ও সংগীতাঞ্জলি || জিয়া হাসান

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে অসাধারণ কিছু গানের স্রষ্টা গোবিন্দ হালদার প্রয়াত হয়েছেন। উনার সম্মানে আমি ‘পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটাকে  একটু ক্রিটিক্যালি অ্যানালাইজ করব।  ক্রিটিক করতে গিয়ে আমরা দেখব, কী অসাধারণ সুর এবং কথার সমন্বয়ে এই গানটি লিখেছিলেন গোবিন্দ হালদার! এবং এই গানটি আজকে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও, হাটবাজারে বাজাতে বাজাতে আটপৌরে করে ফেলার সম্ভাবনা থাকলেও, গানটা কেন এখনো এত ফ্রেশ লাগে। এবং প্রতিবার গানটা শুনলে রক্তের মধ্যে বান দেয়। প্রথমেই আমরা লিরিক্সটা দেখি —

পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রের
রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল।।

বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল,
হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।।

শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে
অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে
রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে
নয়া বাংলার নয়া শ্মশান, নয়া শ্মশান।

আর দেরি নয় উড়াও নিশান
রক্তে বাজুক প্রলয়বিষাণ
বিদ্যুৎগতি হউক অভিযান
ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রুজাল, শত্রুজাল।

লিরিক্সটা পড়লেই বুঝবেন, এইটা মুলত একটা ণসংগীত
এইটা যুদ্ধের সময়ের গান। দেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। বাংলা তখনো পরাধীন, হায়েনাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। কিন্তু তিনি বলছেন, সূর্য উঠেছে এবং সেই সূর্যের আলোতে চারিদিক রক্তিম। সেইটা শুধু সূর্যের রক্তিম রঙে নয়, মানুষের রক্তে রক্তিম। এইটা একটা অদ্ভুত কন্ট্রাস্ট। কারণ, নতুন সূর্য নতুন দিনের কথা বলে।  কিন্তু নবীন দিনকে তিনি বলছেন, রক্তের রঙে লাল, যা যুদ্ধের রক্তক্ষরণকে দারুণ একটা উপমা দিয়ে বুজিয়ে দেয়।  ফলে গানের স্টার্টিং লাইনেই একটা বৈপরীত্য আছে।  তিনি ঘোষণা দেন শোষণের দিন শেষ হয়ে আসছে এবং বাংলা শোষকের জন্যে শ্মশানে পরিণত হবে। কারণ, রক্তের মধ্যে আগুন প্রতিরোধ করে। এবং তিনি নিশান উড়াতে বলেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরে ডাক দিচ্ছেন শত্রুর জাল ছিঁড়ে ফেলতে। পরিষ্কারভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দেয়ার জন্যে এই গান। এইটা একটা রণসংগীত, যুদ্ধের সংগীত।

কিন্তু, আমার হিসেবে গানটার লিরিক্স অসাধারণ কিন্তু অসামান্য নয়। অসামান্য হলো গোবিন্দ হালদারের সুর এবং সেই সুরের সাথে কথার সম্মিলনে যেই প্রসডি। (এই প্রসডি শব্দটার দুঃখজনকভাবে কোনো বাংলা এখনো পাই নাই। এর মানে হইল, একটা শব্দ বা লাইনের মিনিংটাকে এমনভাবে গাওয়া যার কারণে কথাতেই  সুরটা ফুটে ওঠে)। এই অসাধারণ প্রসডি একটা অসাধারণ লিরিক্সকে অসামান্য করে তোলে। যেমন ধরেন,  যখন তিনি সুর করলেন, রক্তলাল , রক্তলাল, রক্তলাল — তখন, বারবার রিপিট করা এবং সুরটার সেই জায়গাগুলোতে আপনার রক্ত গরম হয়ে উঠবে।  এই পুরো গানের লিরিক্সকে  সুরের মধ্যে যেভাবে  এক্সপ্রেস করা হয়েছে, সেইটা শুধু অসামান্য নয়, স্যংরাইটিঙের সর্বোচ্চ এক্সেলেন্স। এর থেকে ভালো গান এবং সুর হয় না, হওয়া সম্ভব না।

আমরা আরো একটু ডিপে সুরটাকে বিশ্লেষণ করলে দেখব, প্রয়াত গোবিন্দ হালদারের মুন্সিয়ানা গানের টেনশন এবং রেজুলুশানকে নিয়ে
স্যংরাইটার মাত্রই জেনে থাকবেন, একটা সুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সুরকে একটা টেনশনের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং তাকে আবার রেজুলুশান করা। সুরে যদি টেনশন না থাকে, সেইটা হয়ে পড়ে পানসা। কিন্তু, ‘পূর্বদিগন্তে’ গানটায়, গোবিন্দ হালদার, প্রতি মুহূর্তে শ্রোতাকে চড়ান আবার নামান, তুলেন আবার ছাড়েন। এবং এই গানটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি টেনশনকে বারবার রুটে এনে রেজুলুশান করেন না। পুরো গানে, গানটার রুট নোটকে স্পর্শ করেছেন তিন কি চারবার।  অনেক ক্ষেত্রে পুরো রেজুলুশান না করে আরো হাই  টেনশনে চলে যান। এইটা একটা অনাবদ্য সৃষ্টি, যা আমার মনে হয় না খুব বেশি বাংলা গানে পাওয়া যায় এবং মেজাজের দিকে,  আমার কাছে মনে হয়েছে এই গানটায় ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মেলোডির কিছু কম্পোজারের  ছাপ  পাওয়া যায়। আমি জানি না, গোবিন্দ হালদার, সেই স্কুলে ট্রেইন্ড কি না ,কিন্তু এই গানটিকে অ্যানালাইজ করতে গিয়ে আমার  ধারণা হয়েছে, উনার সেই ট্রেইনিং আছে।

সুরের বিশ্লেষণ।
আমরা সাধারণত গান শুরু করি রুট থেকে, বা ‘সা’ থেকে। কিন্তু, এইটা শুরু হয়েছে ফিফথ থেকে। এবং ‘পূর্বদিগন্তে’ অংশে, গানটা ফিফথ থেকে মেজর থার্ডে ম্যুভ করে, এই ম্যুভমেন্টের সময়ে মনে হয়, ফিফথের নোটটাই বোধহয় রুট । কিন্ত, কারণ, ‘পূর্বদিগন্তে’ সুরটাতে, এবং ‘সূর্য উঠেছে’ — উভয় জায়গায় ফিফথে গিয়ে রেজুলুশান হয়, যার  থেকে মনে হতে পারে ফিফথটাই গানের রুট, মানে  মনে হয় ঘরে ফিরে এসেছে।  কিন্তু, পুরো ভার্শনটা শেষ করার পরে, গানটা একটা হোমে গিয়ে রেজুলুশান হয়।

এই অংশে গোবিন্দ হালদার অনেক শান্ত। তিনি জানান দিচ্ছেন পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে, কিন্তু তার রক্তিম আভার যেই লাল, তা সারা বাংলায় যে রক্তে-রঞ্জিত মাটি,সেইটাকেই ঘোষণা দেয়।  কিন্তু, ‘রক্তলাল, রক্তলাল, রক্তলাল’ তিনবার যখন গাওয়া হয় একটা থার্ড ইন্টার্ভেলে, টোন ম্যুভমেন্টের সাথে। এইটা একটা ব্যাপক ড্রামা নিয়ে আসে, ‘রক্তলাল’ সুরটাতে। ‘জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে’, — এরপরে আবারো সেই থার্ড ইন্টার্ভেলে, কিন্তু সেইটা এইবার হয় ফিফথ থেকে এবং ফাইন্যালি রেজুলুশান হয় রুটে গিয়ে।

এই থার্ড ইন্টার্ভেলের টোন ম্যুভমেন্ট পুরো গানের একটা বৈশিষ্ট্য যেইটা একটা চরম নাটকীয়তার সৃষ্টি করে। এইটা এই গানের সুরের সৌন্দর্যের একটা অনাবদ্য  নিদর্শন। ইতোমধ্যে তিনি তার হোম বা রুটকে শ্রোতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ফলে শ্রোতা হোমে স্বচ্ছন্দ। কিন্তু তখন তিনি পুরো অক্টেভ ইন্টার্ভেল দিয়ে গেয়ে ওঠেন ‘বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল’,  — প্রথমবারের মতো এত লম্বা ইন্টার্ভেল আরেকটা সুন্দর মেলোডি নিয়ে আসে, যেইখান থেকে নবীন সুরকারদের অনেককিছু শেখার আছে। সাধারণত, অনেক ড্রামাটিক সুরে পুরো অক্টেভ ইন্টার্ভেল আসে গানের প্রথমে কিন্তু, গোবিন্দ হালদার সেইটা কোরাসের দ্বিতীয় স্ট্যাঞ্জাতে এনেছেন, যেইটা শ্রোতাকে নতুন একটা জায়গায় নিয়ে যায়।

কিন্তু শ্রোতা জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে, এই জায়গায়
এই অংশে গোবিন্দ হালদার নিশ্চিত সুরে বলেন না, ‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে’। তিনি সেইটা আশার বাণী হিসেবে ঘোষণা করেন। তাই এইখানে তিনি ব্যাপক টেনশন সৃষ্টি করেন। এবং সেইটা করতে তিনি এইবার মেলোডির সাথে আশ্রয় নেন সুরের নোটগুলোর বিট লেংথের উপরে। এতক্ষণ পর্যন্ত গানের নোটগুলো পড়ছিল চার বিটে বা আট বিটে; এই জায়গায় তিনি চলে যান ১৬ বিটে। দ্রুত লয়ে তিনি বলেন, ‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে’।  এবং ‘অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে’, — এইগুলোতে আবার ব্যবহার হয়েছে দুইটা করে ট্রিপলেট। খুবই ড্রামাটিক এবং বলতে গেলে, ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল। ফলে  শ্রোতা অবাক হয়ে যায়। কি হচ্ছে, আবার একটা ড্রামা??? এইখানে উনার নোট চয়েসও অনবদ্য, রুট, থার্ড, ফিফথ এবং সিক্সথ এবং  সাথে কি … ইয়েস, ফ্ল্যাট সেভেনথ?  এই প্রথম তিনি মেজর স্কেলের গানে মেজর স্কেলের বাহিরের একটা নোট ব্যবহার করেন।  ফলে,  ‘শেষ হয়ে আসে’-র শেষ নোটের জায়গাটা অসম্ভব সাস্পেন্সযুক্ত একটা নোট।

‘অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে’ — এই জায়গায় তিনি অক্টেভ নোট থেকে, ক্রমেটিকলি ফিরে আসেন রুট, মেজর সেভেন্থ, ডমিনেন্ট সেভেন্থ এবং সিক্সথ সবগুলোকে পরে পরে ব্যবহার করে, যেইটা একটা ফ্যান্টাস্টিক টিউন। এবং পর পর চারটা ক্রমেটিক নোট হওয়ার কারণে যুক্ত হয় আরও টেনশন। এইটা খুব জটিল সুর। ফলে এই  জায়গায় গায়কেরা প্রায়ই ভুল করেন, একেকজন একেকভাবে গান। কারণ, অনেকেই ঠিকমতো  ধরতে পারেন না, কোন শব্দটা কোন নোটে কি গাওয়া হয়েছে। অ্যানালাইসিস করার দরকারে আমাকে অনেকবার চেক করে শিওর হতে হয়েছে, আসলে কি হচ্ছে।

কিন্ত নাটক শেষ হয়নি,
‘রক্তে আগুন প্রতিরোধ করে’, — এই জায়গায় তিনি সিক্সথ থেকে আবার একটা থার্ডের ম্যুভমেন্ট করেন এবং সেইটা তিনি চারবার রিপিট করেন। এবং’ রক্তে আগুন প্রতিরোধ করে’ — এই ধরনের একটা অংশ চারবার এত শক্ত উচ্চারণ গানটাকে একটা চরম  স্লোগ্যান টাইপের মেজাজ এনে দেয়। কারণ, একই সেন্টেন্স একই জায়গায় বারবার রিপিট করাটা স্লোগ্যানের বৈশিষ্ট্য।  কিন্তু তাও গোবিন্দ হালদার ক্ষান্ত নন। তিনি আরো একটা সাস্পেন্স নিয়ে আসেন যখন এই স্ট্যাঞ্জাটা তিনি শেষ করেন ‘নয়া বাংলার নয়া শ্মশান, নয়া শ্মশান’ অংশটুকুতে। সুরটাকে লম্বা করে, ‘নয়া শ্মশান’ বলে, রিপিট করেন।কারণ, এই প্রথম তিনি গানটাতে নোটলেন্থ চার বিট করে গেয়েছেন।

ফলে, এইখানে আমরা খুব কম সময়ের মধ্যেই, চার বিট, আট বিট, ষোলো বিট এবং আবার এক বিট দৈর্ঘ্যের নোট পাই। ফলে, গানটা আড়াই মিনিটের একটা গান যেখানে শ্রোতারা আলোর কথা শোনেন, ঠাণ্ডা মাথায়, কিন্তু এরপরেই টেনশনে পড়েন, টেনশন আর রেজুলুশান থেকে ঘুরে ঘুরে এসে একটা লম্বা নোটে ডাক দিয়ে ফিরে আসেন, ফিফথে। যেই নোটে এই ভার্সটা শেষ হয়। ইন্টেরেস্টিংলি তিনি হোমে ফিরেন নাই।

এইটা যে কী অসাধারণ অনবদ্য সৃষ্টি সেইটা প্রতিবার শুনে বোঝা যায়। কারণ, অজস্রবার শোনার পরেও এই গান পুরনো হয় না, কারণ, পুরো গানে, তিনি যেইভাবে টেনশন সৃষ্টি করেন এবং অনেক জায়গায় তিনি টেনশনটাকে রিলিজও করেন না, এক টেনশন থেকে আরেক টেনশনে চলে যান। শ্রোতা একটা অস্বস্তির মধ্যে থাকে, কিন্তু গানের সুরে সুরে, শ্রোতার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে।

যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধে মিউজিকের থিয়োরির মতো টেনশন রেজুলুশান হয় না, প্রিয় মানুষেরা মারা যায়, ধর্ষণ হয়, কাছের মানুষেরা হাত পা হারায়, শরণার্থী হয় কোটি কোটি মানুষ — এই পুরো  টেনশনটা তিনি পুরো গানে ধরে রেখেছেন। এবং রেজুলুশান করেছেন খুব কম ক্ষেত্রেই। এবং রেজুলুশান করলেও, সেইটা রুটে না হয়ে ফিফথে হয়, যার ফলে কিছুটা হলেও সাস্পেন্স রয়ে যায়।

এই ধরনের একটা সুর সহ গান, যুদ্ধের মধ্যে একহাতে রাইফেল আর একহাতে কলম ধরে লেখা সম্ভব
একজন স্যংরাইটার যত দক্ষ হন, তার সেই প্যাশন এবং ক্ষোভ এবং স্পৃহা না থাকলে, এই ধরনের অরিজিন্যাল গান লেখা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। ফলে এইটা শুধু গান নয়, এইটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা খণ্ডচিত্রও বটে। গোবিন্দ হালদারের প্রয়াণের পরে উনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমাদের জন্যে এইসব অসাধারণ  কালজয়ী সৃষ্টিগুলো রেখে যাওয়ার জন্যে।

আরো জানতে :ঘুরে আসুন

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you