উজানের সাহসটুকু ঘরে বাইরেতে যেটুকু পেয়েছি আরেকটু নেড়েচেড়ে দেখি, বোধহয় রবি ঠাকুরের দলটির লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কোনও একটা পর্যায়ে এসে নিখিলেশ লিখল : “আমার পণ এই যে, কোনও একটা উত্তেজনার কড়া মদ খেয়ে উন্মত্তের মতো দেশের কাজে লাগব না। আমি বরঞ্চ কাজের ত্রুটি সহ্য করি, তবু চাকরবাকরকে মারধর করতে পারিনে, কারও উপর রেগেমেগে হঠাৎ কিছু একটা বলতে বা করতে আমার সমস্ত দেহমনের ভিতর একটা সঙ্কোচ বোধ হয়। আমি জানি, আমার এই সঙ্কোচকে মৃদুতা বলে বিমল মনে মনে অশ্রদ্ধা করে – আজ সেই একই কারণ থেকে সে ভিতরে ভিতরে আমার উপর রাগ করে উঠছে যখন দেখছে আমি বন্দে মাতরম হেঁকে চারিদিকে যা-ইচ্ছে-তাই করে বেড়াইনে।” সমস্ত দেশটাই যখন ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করার দিকে ঝুঁকেছে, সন্দীপের দল যখন এতটাই ভারী, তখন নিখিলেশের এই সঙ্কোচটুকু লক্ষণীয়। রোজকার কাগজ পড়ে নিরীহ মানুষের দল যখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মনে করে : “এই কাজে কি এতটুকু সঙ্কোচ এল না?” তখন নিখিলেশকেই মনে করে, নিখিলেশের স্রষ্টাকে মনে করে। জাতির এই সঙ্কোচটুকুতে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি উজান বাইবার সাহস জাতি ভোলে না।
কিন্তু একটা ব্যাপারে সাবধান। ত্যাগের শক্তি বনাম ভোগের শক্তি, এই তর্ক যদি ওঠে তাহলে রবি ঠাকুরের দল সহজে বেছে নিতে পারবে। পথ সহজ নয় কিন্তু পছন্দটা সরল। গোল বাঁধে যখন ত্যাগের শক্তির বিরুদ্ধে ত্যাগেরই শক্তি এসে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের উল্টোদিকে আমরা যখন গান্ধীকে পাই। নিছক ত্যাগের কথাই যদি ওঠে তাহলে গান্ধীর জুড়ি নেই। প্রাণ দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন ওই বস্তুটার জন্যও তাঁর লোভ নেই। এহেন গান্ধী মহারাজের চেলারা যদি বন্দে মাতরম হাঁকড়ে ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করতে থাকে নিখিলেশ করে কী?
এর উত্তরে বলব নিখিলেশ ঠিক যা করেছিল তা-ই যেন করে। নিখিলেশের সঙ্কোচ তো ত্যাগের বিরুদ্ধে নয়, সে নিজেই তো ত্যাগের শক্তি, নিখিলেশের সঙ্কোচ ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করে বেড়ানোর বিরুদ্ধে। সেই সঙ্কোচ বেঁচে থাকুক। গান্ধী সম্পূর্ণ অন্য কথা ভাবছিলেন। তিনি দেখছিলেন মেরুদণ্ড ভাঙা একটা জাতি, দেশে ভয়ের রাজত্ব। গান্ধীর অহিংসা দেশের অভয় মন্ত্র। স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা গান্ধী কোনোদিনই চাননি। কিন্তু সমাজে উন্মত্ততা গান্ধী ভয় পেতেন না। অহিংসা দিয়ে উত্তেজনাকে জয় করা যায়, এই ছিল তাঁর জীবনবিশ্বাস। কতটা বাস্তবে কাজ করেছে বলতে পারব না। তবে, গান্ধী এই বিশ্বাসে কাজ করেছেন, সেইটুকু হলফ করে বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী সবসময় গান্ধীর কানে বেজেছে। জাতির অতন্দ্র প্রহরীরূপেই গান্ধী গুরুদেবকে দেখেছিলেন। এ কথা ভাবা অসম্ভব যে, চৌরার সিদ্ধান্তে নিখিলেশের সঙ্কোচ কোনও ভূমিকা নেয়নি। যারা এই যোগটা দেখতে পান না তারাই বোধহয় বর্তমান উন্মাদনার জন্য বিশেষ ছাগলের খোঁজ করেন।
চলবে
… …
- শুকিয়ে যাওয়া ফুলেরা || মাহমুদুর রহমান - July 30, 2025
- জীবনের ঋতুসমুদয় || শিলামনি - July 20, 2025
- কেইটের কামাই - July 12, 2025
COMMENTS