আমার রবীন্দ্রনাথ || সৈয়দ শামসুল হক

আমার রবীন্দ্রনাথ || সৈয়দ শামসুল হক

আমার জননীও জানতেন না, কার সে অমৃত রচনা? – শৈশবে তাঁকে দেখেছি গুনগুন করে এই একটি পদ গাইতে, ঘুরেফিরে বারবার গাইতে গাইতে গৃহকাজ সারতে, আমার মনে হতো সারাদিন সারাবেলা অমন কোনো দিনে, যখন তাঁর প্রথম যৌবনের কাল এবং বুঝিবা পৃথিবীর ভেতর থেকে যখন তিনি শুনে উঠতেন অতল জলের এক অস্পষ্ট আহ্বান – ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে;’ – আমি বালকের চপলতা ভুলে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম জননীকে ঈষৎ-সবুজছোঁয়া বিশাল আমাদের আঙিনায়; সেই প্রথম আমার হৃদয়ের ওপর হাত পড়ে, এখন জানি, রবীন্দ্রনাথের। গানের সেই রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ একদিন কবি হয়ে আমার অস্তিত্বকে আর্ত করে তোলেন যখন ইশকুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণ উৎসবে আমি মনোনীত হই আবৃত্তি করবার জন্যে সেই দুটি পাখির কাব্য যার একটি ছিল বনে আর অপরটি খাঁচায়; খাঁচা আমি চিনে নিই কবির শব্দগ্রন্থনা থেকে, যে-কবির প্রতিকৃতি প্রতি বৎসর কী অনায়াসে আঁকতে পারত আমাদের গ্রামটির এখন-তার-নাম-আর-মনে-নেই কোনো সদ্য যুবক এবং বীণাপাণি নাট্যমন্দিরে পঁচিশে বৈশাখে মঞ্চের সমুখে সেটি স্থাপিত হয়ে থাকত – অঙ্কিত তাঁর মস্তক ও মুখকেশের প্রবহমান গুছিগুলো মনে হতো নিকটেই যে ধরলা, তখন পর্যন্ত আমার দেখা একমাত্র নদী, তার বুকে যেন স্রোতোরেখা। কোনো কোনো রাতে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি, মনে পড়ে, কেউ আমাকে খাঁচার ভেতর পুরে লাগিয়ে দিচ্ছে খিল, আমি চিৎকার করে জেগে উঠি – কিন্তু গোপন করি বর্ণনা আমার পিতার কাছে যখন তিনি জানতে চান কোন দুঃস্বপ্ন? ভয় হয় তিনি নিষিদ্ধ করে দেবেন আমার কবিতা পড়া যার বাতিক লক্ষ করে এবই মধ্যে তিনি আমাকে জানিয়েছেন, হয়তোবা মুসলিম তাঁর কাছে একমাত্র গ্রাহ্য, কবি নজরুলের ছন্নছাড়া জীবনের উদাহরণে, যে কবিরা হয় নষ্ট, অলক্ষ্মী ঘোরে পায়ে পায়ে।

কিন্তু ততদিনে আমি ধরলার স্রোতোধারা আবিষ্কার করে ফেলেছি, বনের পাখিটির কথা জেনে গেছি এবং কী অর্থ হয় এই বাক্যবন্ধের ‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ আদৌ না বুঝে, প্রতি বৎসর পঁচিশে বৈশাখের উৎসবের সূচনায় গানটি হতো গীত একই যুবকের কণ্ঠে যিনি বাঁ-হাতে বাজাতেন হারমোনিয়াম, গাইতেন মাথাটিকে সুরের অনুসরণে বারবার নত ও উন্নত করে, আমি নতুন কোনো জন্মগ্রহণের জন্যে আত্মার ভেতর কেবলি অনুভব করছি অস্পষ্ট অশান্ত এক পাশফেরা।

তাহলে গানের ও কবিতারই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার সেই বালকবেলায় সকলের চেয়ে প্রত্যক্ষতর এক সঙ্গী, অন্তর্গত পরামর্শক ও প্রণেতা; তারপর কৈশোরের তাপ মন্থন অকালে হয়তো বালকটিকে যুবকের ভাবে মজিয়ে থাকবে, সে কি-না আমি, বড় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকি করোটির ভেতর নির্জন কোনো বাড়ির বাতায়নে অপরাহ্নে-বসে-থাকা একাকিনী সেই ‘কে তুমি’-র দিকে, যার অঙ্গের জলতেলমেশা ঘ্রাণ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে, শাড়িটিতে বাতাসের আঁচল-খেলা কিন্তু তার মন নেই যে উঠিয়ে নেবে কাঁধে, হাতে কবিতার বই; আমার নয়, রবীন্দ্রনাথের; – হায়, আমার কি সে ভাগ্য হবে কোনোদিন? রবীন্দ্রনাথের কবিতা সে পড়ছে শতবর্ষ পরে; – শতবর্ষ কতদিনে হয়? শুধু মনে হয় সে বড় দূরের সময়, যখন আমি থাকব না; শতবর্ষের ওপারে যদি রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান কবিতার বই হয়ে তার কাছে, আমিও কি ভাসাতে পারব না? – যদি পারতাম – আমারও সামান্য ভেলা ঠিক তারই কাছে?

এইভাবে কবি হয়ে উঠি : লাজুক, নিঃসঙ্গ, শ্রমশীল; অকস্মাৎ এক পক্ব বালিকা আমাকে দেয় কালজয়ের চেয়ে চুম্বনজয়ের প্ররোচণা, একেকটি কবিতা লেখার পুরস্কার মেলে তার ওষ্ঠ থেকে – প্রতিদিন, বহুদিন; কুড়িগ্রামে আমাদের সব উপকরণ, গুরুগন্ধে ভরে থাকত, তারই ভেতরে শতবর্ষ জয়সাধনে রবীন্দ্রনাথের প্রতিযোগী এই কিশোর নিচ্ছে আশু ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পুরস্কার, মনে পড়ে; – আর মনে কি পড়ে না, বালিকাটি প্রতি সন্ধ্যায় শীর্ণ ও চিরবিরক্ত এক শিক্ষকের কাছে শিখত গান, রবীন্দ্রনাথের একটি গান সে শিখে নিচ্ছে এই কথা একদিন সে জানালে কিশোরটির বড় অভিমান হয়। জন্মের প্রথম প্রেমে আমার যে-প্রতিদ্বন্ধী, তিনিই তখন আমার রবীন্দ্রনাথ যাঁকে আলিঙ্গন করে বড় হতে চেয়েছি।

কবিতা ও গানের রবীন্দ্রনাথ যখন এই আমার রবীন্দ্রনাথ, যখন তিনি আমার দিগন্তে এসে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক যেমন আমাদের শহরে শীত নেমে এলে ধরলার পাড়ের ওপারে বহুদূরে নীল হিমালয়, তখন একদিন ইশকুলে রটে যায় আমার করিতা লেখার কথা, আর ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষক আমাকে বলেন, “কবিতা লেখো? রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পড়েছ? রাশিয়ার চিঠি পড়েছ?” – আমি বই দু’টি পিতার পায়ে পড়ে আনিয়ে নিলাম কলকাতা থেকে; সেই আমার প্রথম দেখা এবং প্রথম পাওয়া রবীন্দ্রনাথের কোনো বই : গীতাঞ্জলি ফেলে রাশিয়ার চিঠি নিয়ে পাতা ওল্টাই – আমার জানা ছিল না যে কবিতা বা গান ছাড়া রহস্য ও অমরত্বে স্থিত এই মানুষটি গদ্যও লেখেন, তাই গদ্যে কী লিখেছেন জানতে বড় অস্থির হয়ে পড়ি; কিন্তুরাশিয়ার চিঠি সেই বয়সে আমাকে এড়িয়ে যায়, কবির কলমে খাপছাড়া বলে বোধ হয়, মনে হয় যেন তাঁর নয় অন্য কারো লেখা এই বই এবং একজন কবির সঙ্গে এর যোজনা স্থাপন করতে না পেরে আমি বড় বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

তবে, কিছু সুখের মুহূর্তে আমাকে এনে দেয় রাশিয়ার চিঠি বইটিতে ছাপা রবীন্দ্রনাথের কিছু ফোটো;  এর আগে কুড়িগ্রামের সেই যুবক-অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার কাছে একা একটি মুখ, বিশ্বে তিনি নিঃসঙ্গ, কিন্তু না তিনিও যে মানুষের মধ্যে বাস করেন, তাঁকে ফোটোর বাস্তবতায় এই প্রথম দেখলাম অনেক মানুষের সঙ্গে – একটি ফোটোয় অদ্ভুত টুপিপরা কিছু বালক আছে তাঁকে ঘিরে, আ, আমার যদি জন্ম হতো রাশিয়ায়; কবিতা পড়বার জন্যে তখন আমি বারবার ফিরে যেতাম গীতাঞ্জলির কাছে, কিন্তু কবিকে দেখবার জন্যে রাশিয়ার চিঠি ওল্টাতাম, বারবার মিলিয়ে দেখতাম কবির সঙ্গে কবিতাকে : এই তবে হয় করিব মুখ? – কবি রবীন্দ্রনাথ আমার স্বপ্নের মানচিত্র হয়ে যান কবিতা ও প্রতিকৃতি মিলিয়ে।

তখনো কুড়িগ্রাম ছাড়িনি কিন্তু জানতাম না যে আর-কয়েকমাসের মধ্যেই আমাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হবে শহরটিকে, ঢাকা হবে রাজধানী, আমার পিতা চাইবেন আমাকে বড় শহরে বড় হবার জন্যে পাঠাতে এবং এক দীর্ঘ-দীর্ঘদিনের জন্যে ঢাকায় প্রবেশ করতে হবে আমাকে; এই সময়ে সদ্য-স্বাধীন ভারতে চলে যাবার সময়ে আমার দু’ক্লাস ওপরের গৌরদা’ – আমাকে বড় ভালোবাসতেন তিনি – শেষ উপহার হিসেবে দিয়ে গেলেন চটি একটি বই, বস্তুত নানা লেখকের লেখা গল্পের একটি সঙ্কলন, তার ভেতরে প্রথমেই যাঁর গল্প তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পের নাম ‘ছুটি’; রবীন্দ্রনাথ তবে গল্পও লেখেন? আমার বিস্ময় প্রায় শরীরী হয়ে ওঠে; গৌরদার ভোরের ট্রেন কলকাতার দিকে বুকভাঙা বাঁশি বাজিয়ে কুড়িগ্রাম ছেড়ে চলে যায় : জলছাপানো চোখে আমি ‘ছুটি’ পড়তে বসি; ফটিকের জন্যে মন কেমন করে, কিন্তু আত্মাকে সে ছোঁয় না, কিংবা ছোঁয় – কবিতার বিমূর্ত-কথনে নয়, নাম-পরিচয়-সংলাপ-বর্ণনাসমেত গল্পে বাস্তবকথনে যে সৃষ্ট হয় বেদনা তা বড় স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ এবং চারদিকের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়া কোনো কিশোরের পক্ষে কষ্টসাধ্য নয় বলেই আমি হয়তো গল্পের রবীন্দ্রনাথকে আমার রবীন্দ্রনাথ বলে গনে নিতে চাই না, আমি গীতাঞ্জলি – তখন পর্যন্ত তাঁর একমাত্র কবিতা মেলানো গানের বই আমার সংগ্রহে ও উচ্চাশায় – তারই কাছে ফিরে ফিরে যাই।

হায়, গল্পের সে-রবীন্দ্রনাথই কবিতার চেয়ে অচিরে আমাকে অধিক স্পর্শ করে, কেবল ঐ একটি গল্প ছুটিতেই হয় সেই সাধন; তেরো বছরের আমি এসে ঢাকায় লক্ষ্মীবাজারে বিশাল – তখন তা-ই মনে হতো – বাড়িতে উঠি পেছনে সাবাইকে ফেলে, বাবা আমাকে ইশকুলে ভর্তি করে মাসাবধি ঢাকায় থেকে আমার সব ব্যবস্থা করে দিয়ে ফিরে যান, আমি একা, একা হয়ে যাই, বাড়িটির সমুখবাড়িতে তখন বাস করত ব্রাহ্ম একটি পরিবার, মাঝে মাঝে ছাতে উঠে শতরঞ্চ পেতে হারমোনিয়াম টেনে সন্ধেবেলায় তারা গান গাইত বড় উদাস করা, চঞ্চল করা, ধীর লয়ে, নক্ষত্রজ্বলা গম্ভীর আকাশখানির মতো সে-গান, একজন বড় শান্ত মহিলা ধুপছায়া শাড়িপরা কার্নিশ থেকে ঝুঁকে আমাকে নীরব হাতছানি দিয়ে সন্দেশ এনে দিতেন, চোখ ছলছল করে উঠত আমার, মন হুহু করে উঠত বাড়ির জন্যে, মায়ের জন্যে, ধরলার জন্যে, ডাকবাংলোর পদ্মফোটা পুকুরটির জন্যে, খেলার সব বন্ধুদের জন্যে কুড়িগ্রামে – ছুটির পাতায় ফটিক আমি হয়ে যাই হঠাৎ; ফটিকের মতো যদি আমি মরে যাই – এইভাবে নিজের অস্তিত্বকে আমি আবিষ্কার করি, ‘মা, আমি বাড়ি যাচ্ছি’ বাষ্প হয়ে জমে থাকে সারাদিন আমার কণ্ঠের ভেতরে; গল্পের রবীন্দ্রনাথ কবিতা ও গানের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক হয়ে যায়।

অতঃপর যে-নগরী হবে আমার হয়ে-ওঠার ক্ষেত্র, হবে আমার স্থায়ী ঠিকানা, আটচল্লিশের সেই নির্বান্ধব ঢাকায় আমি ভূতগ্রস্তের মতো কবিতা, গান ও গল্প লিখে চলি অবিরাম, প্রতিদিন, ইশকুলের পড়াশোনায় মন আমার লাগে না, রবীন্দ্রনাথ আমাকে সঙ্গ দেন – আরো অনেকের লেখা তখন পড়তে শুরু করেছি, পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি তখন অন্য কবি ও কথাসাহিত্যিকদের লেখাই অনেক বেশি পড়ে ফেলেছি রবীন্দ্রনাথের তুলনায় – কিন্তু তাঁর মতো কেউ আর পিতা নন, বন্ধু নন, আদর্শ নন, লক্ষ্য নন আমার; – সেই আমার একাকী কিশোর জীবনে।

ইশকুলের শেষ বর্ষে ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই প্রথম পাঠসূচির কল্যাণে; তারপর বাড়ি পালিয়ে বম্বে নগরীতে, আমারই মতো বাড়িপালানো কিন্তু আমার অনেক আগে এবং কিছু বড় বয়সী এক বন্ধুর প্ররোচণা ও শিক্ষকতায় শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ’, সমারসেট মম্, কিটস আর এলিয়টে প্রবেশ করি, ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথকে, একেবারে ভুলে যাই, তাঁর না-গান না-কবিতা না-গল্প কিছুই আমাকে আর টানে না বা হানে না; এই বম্বে নগরীতেই তারপোরওয়ালার বিশাল বইয়ের দোকানে একদিন রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির একটি জমকালো অ্যালবামও আমার গোচরে আসে, কয়েকটি ছবি দেখি বটে, সবগুলো দেখি না – বহু পরেও রবীন্দ্রনাথের ছবি যখন আমি ভালো করে দেখি নিয়েছি, তাঁর কবিতার মতো আমাকে তা মৌলিকভাবে বদলে দেয়নি, তাঁর ছবির মূল্য ভারতীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে শিল্পের চেয়ে ঐতিহাসিক বলেই বিবেচনা করেছি ও এখনো করি, যদিও এ অনুতাপ থেকে যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের চিত্রের জগৎ যদি কবিতায় প্রবেশ করত – প্রথম যুবক আমি ছবির রবীন্দ্রনাথকে হাত থেকে দ্রুত ফেলে দিই, কবিও যে ছবি আঁকেন এই মৃদু বিস্ময়টি হয়তো থাকবে – মনে পড়ে না; রবীন্দ্রনাথকেই মনে পড়ে না আর; লিখব এবং লেখাই হবে আমার একমাত্র কাজ – এই সিদ্ধান্ত ততদিনে নিয়ে ফেললেও রবীন্দ্রনাথ কোনো অর্থেই আমার কাছে আর ঐ বয়সে জরুরি রইলেন না।

বাহান্নর শেষভাগে ঢাকায় ফিরে এসে গল্পের প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, যুবনাশ্ব … এঁরা, আর কবিতার বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম উদ্দাম তুমুল সব সাহিত্যসংঘ আর আড্ডায়; রবীন্দ্রনাথকে অস্পৃশ্যের মতো এড়িয়ে চলাই হয়ে উঠল আমার সচেতন যাত্রাকথা।

কোনো রবীন্দ্রনাথই তখন আমার জন্যে প্রাসঙ্গিক বা প্রয়োজনীয় নন আর; বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আমি, পার্শ্ববিষয় দু’টির একটি হচ্ছে বাংলা সাহিত্য, বাংলার ক্লাসে অধ্যাপক পড়াচ্ছেন ‘বলাকা’ – আমি দূর এবং কৌতুকস্মিতমুখে শুনছি কেবল, মন ছুঁয়ে যাচ্ছে না, মন তখন তিরিশের মিলিত পাঁচ কবির পরিচর্যায় রচনা করছে নশ্বর কিন্তু রবীন্দ্র নয় পঙক্তিমালা। এরই ভেতরে এক ব্যক্তিগত বিপ্লব ঘটে গেল; বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনার প্রেমে পড়ে গেলাম, আমার নিবেদন-উচ্চারণ শুনে – আজ বুঝি – তিরস্কার করেই তিনি এক চিঠি লিখলেন যার শুরুতেই ছিল এমন দু’টি পঙক্তি ‘নামহীন, দীপ্তিহীন, তৃপ্তিহীন আত্মবিস্মৃতির অন্ধকার মাঝে / কোথা হতে অকস্মাৎ করো মোরে খুঁজিয়া বাহির তাহা বুঝি না যে।‘ – এইটুকু বুঝে যাই যে এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, বুঝে যাই – কারণ, ততদিনে জেনে গেছি বড় কবির বড় একটি কাজ এই যে তাঁর বলার ভঙ্গিটি থাকে না আর ব্যক্তিগত, হয়ে যায় সে ভাষার সকেলের; – এবং এই সকলের একদিন হয়ে যায় বলেই নতুন কবিকে নতুন ‘ভাষা’ তৈরি করে নিতে হয়।

সেদিন ঐ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপ আমাকে ক্ষ্যাপা করে তোলে; নারীটিকে না-ই পাই, তার ও আমার মধ্যে যে দাঁড়িয়ে আছেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে তবে আমার চিনে নিতে হবে। সংগ্রহে ছিল না সঞ্চয়িতা – সেইদিন দুপুরেই বাংলাবাজারের দোকান থেকে কেনা হলো; প্রথম পঙক্তিযুগল দিয়ে; পুরস্কার আরো আমি পেয়ে গেছি ততক্ষণে – কবিতা ছাপিয়ে গেছি ব্যক্তিগত প্রেম  – মেধা ও রক্তের ভেতর অমৃতের মতো বইতে শুরু করেছেন সঞ্চয়িতার পাতা ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ। একটা ঘোরের ভেতর অতঃপর পড়ে উঠেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ রচনা পুরো একটি বৎসর দান করে। এবং আরো একবার তাঁর সম্পূর্ণ রচনাবলি, ১৯৭২ সালের লন্ডনে; জানুয়ারি মাসে এক সন্ধ্যায় প্রবল বরফপাতের ভেতরে প্রথম খণ্ডটিকে গ্রেটকোটের বুকে ধরে শীতার্ত ছোট ঘরে ফিরে শুরু করি, শেষ খণ্ডটি যখন শেষ হয় – বাইরে জুনের সোনার পাতের মতো রোদ্দুর পড়ে আছে আর আমি পাতালরেল থেকে নেমে ঈষৎ পাহাড়ের চড়াই ভেঙে গিয়ে দাঁড়িয়েছি হ্যাম্পস্টেডের একটি বাড়ির সমুখে যার দেয়ালে নীল ফলকে লেখা আছে ‘এখানে ভারতীয় কবি টাগোর বাস করতেন’।

সেই মানুষটিই আমার প্রধান রবীন্দ্রনাথ তারপর থেকে – তিনি আমাকে কবি, প্রেমিক ও বাঙালি করেছেন, তিনিই আমাকে নাটকে নামিয়েছেন, আমার ছবিআঁকার তুলি হাতে তুলে দিয়েছেন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পরপর, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সময়ে আমার এক প্রাণের বন্ধু – এখন প্রয়াত – যিনি নাগরিক কলাবিদ্যায় আমার গুরু, আমাকে একদা ভজাতে চান যে – পাকিস্তানশাসিত এদেশে বাংলাভাষায় লেখার চেয়ে বিড়ম্বনা আর কিছু নেই বর্তমানে, তথা এ দেশটিরই নেই কোনো ভবিষ্যৎ, অতএব তুমি ইংরেজিতে লিখতে শুরু করো, ইংল্যান্ডে বই প্রকাশ করতে শুরু করো; বন্ধুটির প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও যে তাঁর কথায় মজিনি, সেও রবীন্দ্রনাথের জন্যেই; তাঁর সকল কাজ মিলিয়ে যে রবীন্দ্রনাথ সেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাংলায় – ভাষায় ও মৃত্তিকায় – ধরে রেখেছেন।

তিনি শুধু কবিতার, গানের, গল্পের, উপন্যাসের, নাটকের, ছবির রবীন্দ্রনাথ নন, একই সঙ্গে একই গুরুত্বে সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষা, কৃষি ও ভূমিব্যবস্থা নিয়ে আমাদের চিন্তাবিপ্লবের স্থপতিও বটেন।

আমরা এমন ভাবতে ও বলতে অভ্যস্ত যে মূলত তিনি কবি এবং কবি বলেই তাঁর অপর সকল দিকেই ঘটেছে এক আশ্বর্য কবি-সম্ভব উদ্দীপন; আমার এখন ধারণা ভিন্ন – রবীন্দ্রনাথকে আমার পাঠ ও প্রশিক্ষণের প্রধান ক্ষেত্র করে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথকে ‘ব্যবহার ব্যবহার ব্যবহার’ করে আমি এখন এই সিদ্ধান্তে স্থির যে, জন্মগত প্রতিভা বলে যদি কিছু থাকে তো রবীন্দ্রনাথের বেলায় সেটি ছিল সাংগীতিক প্রতিভা, সংগীত থেকেই উৎসারিত তাঁর কবিতা এবং পরে পরে অপর সকল, যদিও সংগীত রচনা নয়, কবিতার হাত ধরেই ছিল তাঁর যাত্রাশুরু – সংগীত নয়, কারণ ভাষা আমরা শৈশবেই ‘পেয়ে যাই’ কিন্তু সংগীত দাবি করে নির্দিষ্ট ও বিশেষিত শিক্ষা, বালক রবীন্দ্রনাথকেও তাই অপেক্ষা করতে হয় সংগীতে অবতীর্ণ হতে তাঁর অপটু পদ্যের পরও অনেককাল। সংগীতেই রবীন্দ্রনাথের আদি-প্রতিভা কারণে তিনি তাঁর চেতনা ও প্রতিভার ভেতরে এক বিপুল বিশ্বছন্দ অনুভব করে ওঠেন এবং কবিতা থেকে কৃষিতে পর্যন্ত সেই বিশ্বছন্দের যোজনা তিনি আজীবন করে চলেন; তাঁর সহায়তায় এই বিশ্বছন্দের অনুভবই বাঙালিকে তার সংকীর্ণ বলয় থেকে টেনে তোলে, সাহায্য করে আমাদের সাবাইকে একই সঙ্গে বাঙালি ও বিশ্ববাসী হতে; আমার ক্ষেত্রে, সেই যৌবনকালে, ইংরেজির প্রলোভন সত্ত্বেও ইয়োরোপবাস হেলায় ফেলে আসতে।

সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সবার ওপরে রাজনৈতিক – বাঙালির বর্তমান দুর্দশায় আমি রবীন্দনাথের কথা প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করি, না করে পারি না; – কে পারে?

সংগীত, কবিতা, নাট্য, চিত্র – কলাসৃজনের সকল ক্ষেত্রেই সাক্ষাৎ পাই রবীন্দ্রনাথের উত্তরসুরির, এমন উত্তরসুরি যাঁরা রবীন্দ্রনাথে স্থির নন – তাহলে তো সকলই স্থবির – যাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে অগ্রসর হয়েছেন বিপুল ও তুমুলভাবে, এমন পথে ও এমন গন্তব্যের দিকে যার কল্পনা তাঁর পক্ষেও করা সম্ভব ছিল না, না হবারই কথা – যারা তাঁকে গ্রহণ করেছে সম্পদ-ব্যবহারের অর্থে, বর্জন করলে সেই করবার ক্রিয়াতেই মেনে নিয়েছেন তাঁর অস্তিত্বকে এবং তিনি সক্রিয়ভাবে স্পর্শ করেননি এমন মাধ্যমেও যাঁরা এসেছেন পরে – যেমন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক বা মৃণাল সেন – তাঁদের ভেতরেও রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরিতা প্রতিফ্রেমে উপস্থিত।

কিন্তু আমি একজন রবীন্দ্রনাথের অভাব, সেই বিশেষ রবীন্দ্রনাথের অভাব আজ এই বাংলাদেশে অনুভব করি – তিনি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কর্মী রবীন্দ্রনাথ, দূর ছেলেবেলায় রাশিয়ার চিঠি বইটিকে অপঠিত ফেলে না রাখলে হয়তো যাঁর সন্ধান আমি আরো আগেই পেতে যেতে পারতাম।

এই বাংলাদেশে আজ সকল রবীন্দ্রনাথের ওপরে যে-রবীন্দ্রনাথের পদচ্ছাপ দেখতে চাই তিনি শিলাইদহের শিশুপাঠশালার রবীন্দ্রনাথ, কৃষিঋণ ও কৃষকের উন্নত চাষব্যবস্থার রবীন্দ্রনাথ, কুষ্টিয়ার আখমাড়াইকল ও সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের রবীন্দ্রনাথ, স্ত্রীশিক্ষার রবীন্দ্রনাথ, নারী ও শিশুদের রোগ-অকালমৃত্যু-স্বাস্থ্যবিচলিত রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ।

আমার জন্যে এখন তিনিই রবীন্দ্রনাথ, সেই রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরির জন্যেই এখন এই বিশ্বের দরিদ্রতম দেশটিতে অপেক্ষা করে আছি।

 

[রচনাটা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। এইখানে রিপ্রিন্টকালে বেশ কতিপয় বানানসাম্যের ব্যাপার ছাড়া করা হয় নাই কিচ্ছুটি রদবদল বা সম্পাদনা। স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ শামসুল হক; প্রথম প্রকাশ শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে, ২০১৩, ঢাকা। – গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you