লাল দিদ্দি || মাহমুদ আলম সৈকত

লাল দিদ্দি || মাহমুদ আলম সৈকত

তালা ছু-য়ে জুয়ুস তা পিয়েত্থা চুখ নাতসা
ভানতা মালি মন খিত পাছান ছু-য়ে
সরুই সম্বৃত য়াতি ছু-য়ে মাছান
ভানতা মালি আন্না খিত রুতছা ছু-য়ে

মধ্য-এশিয়ার সিল্করুটের সদর দরজা বলা হয় কাশ্মির অঞ্চলকে। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এবং সিল্করুটের বদৌলতে কাশ্মির ঋদ্ধ হয়েছে বহুধাবিস্তৃত সংস্কৃতিতে। সেই বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বলিষ্ঠ সদস্য হিশেবে আছে সুফিবাদ। এই অঞ্চলে সুফিবাদের সিলসিলা হাজার বছরের কাছাকাছি। এই সিলসিলায় বরাবরই উল্লেখিত হয়েছেন সৈয়দ শরীফ-উদ-দিন আবদুর রেহমান, সৈয়দ আলি হামদানি, শাহ্ মখদুম, রেশ মীর সাহিব প্রমুখ। এবং অনুল্লেখিত রয়ে গেছেন লাল দেঢ়! বিষয়টি বোঝা খুবই সহজ। লাল দেঢ়-এর লৈঙ্গিক পরিচয় ‘নারী’। এমনকী কাশ্মিরের সাহিত্য-ইতিহাসেও তার নাম আতশী কাঁচের তলায় রেখে খুঁজতে হয়।

ভক্তি আন্দোলন, যা অষ্টম শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতে শুরু হয়েছিল এবং যা সতেরশ শতাব্দী অবধি উত্তর ভারতেও  ছড়িয়ে পড়েছিল, তা বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্যিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মোর্চা হিশেবেই এগোয়। এটি পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদের সাথে মেশে এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের একের পরে এক উদ্যোগে এক জটিলতর মিথষ্ক্রিয়া হিশেবে যুথবদ্ধ হয়। ভক্তিকবি বা সাধুকবি, প্রায়শই যাদের এই অভিধাতেই ডাকা হতো, তারা আনুষ্ঠানিকতার ভেতর দিয়েই অনানুষ্ঠানিক, চলমান চালচিত্রের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত এবং সংস্কৃতের সাথে আঞ্চলিক ভাষার এই গাঁটছড়াকে  (ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত) পছন্দ করেছিলেন। ভক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত কবিরা (যা ভজ, বাংলায় ‘ভজা’ শব্দ থেকে এসেছে) আপনাপন ঐশ্বরের প্রতি বা দার্শনিকভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া বা সমালোচনা হিশেবে কাজ করে এমন একটি বিমূর্ত ভক্তির সাথে নিজেদের কাব্যিক প্রকাশকে একীভূত করেছেন। ভক্তি-স্বতন্ত্র ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানের অধিগম্যতা, ন্যায়সঙ্গত জীবনযাপন, সারগ্রাহী বিশ্বাস এবং সকল অস্তিত্বমূলক ও বৈষয়িক দাসত্বের মুক্তির অন্বেষা সহ আধ্যাত্মিক ও কাব্যিক প্রতিভাকে কেবলই নিচুতলার বিষয় না রেখে সমাজে সার্বিকিকরণের দিকে পরিচালিত করেছিলেন।

পুরুষ ভক্তিকবি যেমন, বাসব (দ্বাদশ শতাব্দী), কবির (পঞ্চদশ শতাব্দী) এবং সুর দাশ (ষোড়শ শতাব্দী)-রা প্রতিমা পূজা, ধর্মের পরম্পরা ইত্যাদির সমালোচনা করেছিলেন এবং সমতা, ন্যায্যতা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংহতিকে জোর দিয়েছিলেন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সমসাময়িক সমাজ কর্তৃক তারা উপহাস এবং নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছিল এবং এতে করে তাদের বাণীসমূহ আধ্যাত্মিকতা এবং রহস্যবাদকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেছিল, দলিতদের পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠে পরিণত হয়েছিল। আনদল (অষ্টম শতাব্দী), লাল দেঢ় (চোদ্দশ শতাব্দী) এবং মীরাবাই (ষোড়শ শতাব্দী)-এর মতো নারী ভক্তিকবিরাও ঠিক একই বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক বিধিনিষেধ এবং গার্হস্থ প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ হতে হয়েছিল তাদেরও।

লাল্লা মা, লাল্লা আরিফা, লাল দিদ্দি, লাল্লেশ্বরী, লাল্লা যোগেশ্বরী … এ-রকম নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। ‘লাল’ বহুলাংশে ‘প্রিয়’ শব্দেরই ভিন্নরূপ। হিন্দি-উর্দুতেও ‘লাল’ প্রিয় হিশেবেই উদ্ধৃত। কাশ্মিরে দাদি-নানিকে ডাকা হয় ‘দেঢ়’।

লাল দিদ্দির জীবনীকথা, অল্প কয়েকটি বাক্যে সারি। জন্ম ১৩২০ (অনুমান, গবেষকরা ১৩০১ থেকে ১৩২০-এর মধ্যে ধারণা করেন!), কাশ্মিরের পেন্ড্রাথান-এ (বর্তমান শ্রীনগরের উপকণ্ঠ)। অল্প বয়সে বিয়ে, সংসার। সংসার-সমাজ ভালো লাগত না কৈশোর থেকেই। পার্শ্ববর্তী দুর্গম জঙ্গলে শিবমন্দির। সেই মন্দিরের প্রতিই তার দুর্মর কাঙ্ক্ষা। হুটহাট চলে যেতেন, ফিরতেন খেয়ালখুশিমতো। একদিন সংসার ত্যাগ করলেন, বয়স ২৪। শৈববাদে দীক্ষা নিলেন। কিন্তু সমস্যা এখানেও। এই প্রথম কোনও নারী শৈববাদে দীক্ষিত হলেন! নানা বঞ্চনার পর তিনি গুরুর শরণ ছেড়ে একা বেরিয়ে পড়লেন। তারপরের বছরগুলো তিনি গোটা কাশ্মির উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেহত্যাগ করেন ১৩৯২ সালে।

লাল দিদ্দির ভখস্ বা লোকায়ত কবিতা একাধারে শৈববাদ, একেশ্বরবাদ, বৌদ্ধ তন্ত্রবাদ, সুফিবাদ এ-মতন ধারার স্মারক। ধারণা করা হয়, তিনি এ-সকল ধর্ম বা মত-পথের মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁর চলার পথে। তাঁর কবিতায় এ-মতন ভাববাদ প্রকাশের পাশাপাশি নারীজীবনের বঞ্চনা, যন্ত্রণা, দুর্দশার প্রতি যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপনে সমুজ্জ্বল। লাল দেঢ় কেবল একজন অগ্রগণ্য কাশ্মীরি কবিই ছিলেন না, এই অঞ্চলের লোকায়ত ঐতিহ্যের অন্তর্নিহিত অংশও, পাশাপাশি একজন শীর্ষস্থানীয় তেজস্বী নারী সাধক-কবি। তিনি সকল পোশাকি সম্পর্ক থেকে দূরে সরে আসার পাশাপাশি সাহসী এবং তথাকথিত সীমালঙ্ঘনকারী হিশেবে অভিযুক্ত হন বারবার। মূলধারার সমাজ তাকে একটি ‘নিরাপদ’ দূরত্বে রাখার প্রয়াসে উন্মাদ বলে চিহ্নিত করেছিল, পাছে তার উগ্রপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি লোকেদের তার প্রতি আকৃষ্ট হতে অনুপ্রাণিত করে এই আশঙ্কায়। তিনি সামাজিক নিষেধাজ্ঞাগুলির বিষয়ে নিতান্তই অযত্নবান ছিলেন এবং জীবন ও আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে তাঁর শিক্ষাগুলি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার কবিতা আত্মার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে এবং প্রকৃতিতে গভীরভাবে আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন। তবে তিনি তাঁর ঈশ্বরের প্রতি তার কাঙ্ক্ষা প্রকাশের যে ভাষাটি বেছে নিয়েছিলেন তা একইসাথে আবেগমথিত এবং মানবিক।

কাশ্মির অঞ্চলে বর্তমানে উর্দু-হিন্দি ভাষা প্রচলিত হলেও, প্রাচীন ভাষাভঙ্গিটি বেশ দুরূহই। শারদা লিপি, ফারসি-আরবি লিপি এবং দেবনাগরী, এই তিনটি লিপিই গত হাজার বছরে কাশ্মিরের ভাষা হিশেবে চর্চিত হয়েছে। লাল দিদ্দির সব লেখাই শারদা লিপিতে। ফলে শারদা লিপিতে তাঁর কবিতা পাঠ করা দুরাশাই। তবুও অন্তর্জালের বদৌলতে শারদা লিপির ইংরেজি ফোনেটিক ট্রান্সক্রিপ্ট কিছু উপলব্ধ আছে। আমার ভরসা সেসবই। শারদা লিপির বাংলায়ন টেক্সট দেওয়া যেতেই পারত এখানে। তবে নিতান্তই অপরিচিত একটি ভাষা পাঠে বিরক্তি উৎপাদন হতে পারে ভেবে ক্ষান্ত দিলাম। পাশাপাশি, বাংলা-হিন্দি-উর্দু কবিতার ছন্দ বা ভাষাভঙ্গির যে খেলা, দুরূহপ্রিয়তা, তা-ও লাল দিদ্দির কবিতায় নেই। তার কবিতা সহজ-সরল, অনেকটাই বক্তব্যপ্রধান। তবুও যৎসামান্য চেষ্টা রইল এখানে। আসুন কবিতা পড়ে নিই।

ক.
যে-পথে এলাম আমি, ফিরিনি সে-পথে
দেখি আজ পড়ে আছি পথেরই কিনারে
দিন গিয়েছে আধেক তবু শেষ হলো না পথ
আঁচলের খুঁটে কানাকড়ি নাই,
যদিও মাঝির দেখা পেয়ে যাই, নেবে কি আমায়?
ব্যর্থ মনোরথ।

খ.
নাচছো মাতাল ভ্রমের ঘোরে ঘটিয়ে বিলয়
দেখতে পাওনি নিচে আছে গভীর জলাশয়
দেখে নাও, শোনো সব টাকাকড়ি, লুট করেছো যা
ভিখ মাঙো আজ তারই কাছে, কিছু সঙ্গে যাবে না।

গ.
গুরু আমায় তত্ত্ব দিলেন :
বাহির ভুলে, আপনাতেই তুই মজিস না কেন?
আমি বটে পাগলিনী, গুরুর তত্ত্ব প্রাণে ধরি
আদুল শাড়ি, দ্বিগ্বিদিকে নেচে নেচে মরি।

ঘ.
অসংখ্যবার আমি একই প্রশ্ন করে গেছি,
প্রভু, অনাম্নীকে আমি কোন নামে ডাকব?
সকল জিজ্ঞাসা একে একে হারিয়ে যায়
নামহীন কায়া, আমি তবু ভাবি
যা-কিছু দেখতে পাই তার উৎস কোথায়?

ঙ.
তুমি জ্ঞানী, তবুও বোকা হয়েই থাকো
জানি দেখতে তুমি পাও, তবু চোখটা বুঁজেই রাখো
শুনতে ঠিকই পেলে, বলি বধির হয়েই বাঁচো
তোমার দেখা সকল আর সমস্ততে তুমি
নরম হৃদয়, সহিষ্ণু প্রাণ, স্বরূপ যেমন ভূমি
রপ্ত রপ্ত করো
এই পথেরই শেষপ্রান্তে ‘সত্য’ পাবে তুমি।

চ.
পবিত্র গ্রন্থগুলো পাঠ করে করে
জীর্ণ হয়ে গেছে  আমার কণ্ঠা এবং জিহ্বা
তবু শেখা হলো না কিছুই
প্রভু, যাঞ্চা হলো না আর কিছুতেই
জপমালা জপে শুধু আঙুল ক্ষয়েছে
আঙুলে আঙুলে তাঁকে বলেছি
দোনামোনা মন আমার
কী করে সরাই এই দ্বিধার পাথার?

ছ.
খুঁজে ফিরেছি তোমাকে দিনমান
আড়াল নিয়েছো আমারই ভিতর
যখন আমারই আত্মায় পেয়েছি তোমার ঠাঁই
বাউলা হয়েছি
কখনও-বা আমি তুমি হয়ে যাই ,
কখনও তুমিই আমি হয়ে রই!

জ.
ওঠো নারী! নৈবেদ্য সাজাও,
তোমার ঈশ্বর ভালোবাসে মদ, মাংস, মিঠাই
জানতে চাও আসল পথ কোন দিকে?
সব বাধা ঠেলে প্রজ্ঞা ঠিকই আসবে ছুটে।

ঝ.
আমি, লাল্লা, শুধুই তাঁকে খুঁজে খুঁজে ফিরি,
শক্তি ফুরায়, শরীর ভাঙে, দরজা বন্ধ রয়
চেয়েছিলাম প্রেমরসে, আকুল হয়ে ডাকব তাঁকে
দৃষ্টি আমার তার কপাটে, আর প্রাণে না সয়।

ঞ.
চেতনা এক বিরল পাখি, মন
দূরে খুঁজলে পাবে না, তোমাতেই বাঁধে বাসা
ইচ্ছা তাড়াও, মনকে হটাও, ছাড়ো মিছে কল্পনা
মগ্ন হও নিজের ভেতর, শূন্যে মেলে শূন্যতা।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you