আমার জানলা দিয়ে যায় না দেখা ইসলামাবাদ
শুধু দেখি আমি রোজ আমার পাশের বাড়ির ছাদ —
একটা হলদে শাড়ি শুকোচ্ছে আজ মোজার রঙটা নীল
আজ পৃথিবীটা বড়ই রঙিন …
[গান : আমার জানলা; অ্যালবাম : কলকাতা-১৬; আর্টিস্ট : অঞ্জন দত্ত]
কয়েকটি হাঁস, তিনটি আসলে, জল-নেমে-যাওয়া পুকুরপাড়ের পানি-চ্যাপচ্যাপা ঘাসপাতালির ছোবায় খুঁজে ফিরছে খাদ্যকণা। খাবার খুঁটছে একমনে তিনহাঁস, মনে হচ্ছে যেন তিন প্রাচীন দরবেশ, সহজমনা পিরফকিরের মতো মৌন ও সমাহিত। হয়তো মরে-শুকিয়ে-ওঠা কোনো পানিপোকার মাংসহীন শুষ্ক খোলস মুখে পেয়ে গেল, অমনি তারা আহ্লাদে আটখানা। আহ্লাদের ডানাশব্দ টের পাই আমি, এই দশহাত দূর থেকে আমার জানালায় বসে। জানালাটি পুবমুখো, ছোট, চৌকো। না, আমার জানালায় এখনো গজিয়ে ওঠেনি কোনো পড়শিবাড়ি। আমার পড়শিরা লালনগানের মতো সংলগ্ন-সন্নিকট অথচ সুরম্য সুদূর। ফলে এখনো অনেক খোলা, অনেক মেলা, অনেক আলোপুষ্ট অনেক বাতাসবাহী আমার জানালা। আমার জানালাভর্তি অনেক রোদ, সেই রোদের রং ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। পাল্টে পাল্টে যায় প্রহরের সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, ঘাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিয়ে। এরচে বৃহৎ বিস্ময় আর কী হতে পারে যে, আমার জানালায় ঝাঁপানো ওই জানালাহাইট অল্পবয়স্কা আমগাছে দেখি ঝিলমিল ঝিলমিল আমপাতা রৌদ্রচড়ুইয়ের সনে খুনসুটি করে চলেছে সকাল থেকে। সেই পাতারাজির হাস্যোজ্জ্বল সরস মর্মরধ্বনির দৃশ্য চোখ দিয়ে চেখে চেখে দেখবার মতো, কথায় এর দ্রব্যগুণ গুবলেট হয়ে যাবার জোর আশঙ্কা। চাইলেই হাত বাড়িয়ে পাতা ছিঁড়ে বানাতে পারি পিত্পিতি বাঁশি। আহা! শৈশবের আমপাতাবাঁশি! কচমা আমপাতায় একরকম সাউন্ড এফেক্ট, পোক্ত পাতায় ডিফ্রেন্ট। এই মুহূর্তে গাছভর্তি গুটি গুটি আম, কৈশোরক চপল, পাতলা সবুজ হর্ষ থোকা থোকা। রেশমগুটির মতো আম্রগুটি ঝোপা ঝোপা। আরও দেখি ডেঁয়োপিঁপড়ার সারি পার হয় এ-ডাল ও-ডাল — লাল, কিন্তু লাল নয় পুরোপুরি, অনেকটা ওই কচি-কচমা আমপাতারঙা — গাছকাণ্ড জুড়ে শুধু পিঁপড়ারা হন্তদন্ত চরে ফিরিতেছে। এই পার্টিকুলার পিঁপড়াকে আমরা বলি ডোল। বলি ডোলপিঁপড়া। আমার ছেলেবেলার গাছবিরিখ ছিল ডোলপিঁপড়ার বাসায় ধনাঢ্য। ডোলভাত গাছে গাছে। ছেলেবেলায় দেখেছি আমি হাজার হাজার ডোলপিঁপড়ার বাসা। আমগাছে, ছাতিমগাছে, রেইনট্রির মগডালে বা মাঝডালে ঝুলে ঝুলে থাকা পাতায়-পাতায়-জট-পাকানো সুনির্মিত ডোলপিঁপড়ার বসতভিটে। সেই পিঁপড়াবাসার খোঁজে প্রতিদিনই কিছু লোক লম্বা আঁকশি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াত এ-পাড়া ও-পাড়া। আর মনপসন্দমতো ডোলের বাসা পেলেই চলত ভাঙার আয়োজন। কঞ্চিবাঁশের আঁকশিশীর্ষে টুকরি বা বেতের-তৈরি পাত্র বেঁধে সেই টুকরিতে/পাত্রে শুকনো খড়পাতা ছড়িয়ে আগুন ধরানো হতো। পর্যাপ্ত ধোঁয়া আর অল্পআঁচ আগুনের টুকরিটা/পাত্র উঁচিয়ে ধরা হতো ডোলবাসার গায়ে, ঠেসে রাখতে হতো অল্পক্ষণ যেন উৎপাতি পিঁপড়াগুলো পথ পায় পালাবার, তারপর ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে নামিয়ে আনা হতো কাঙ্ক্ষিত বাসাটিরে। আর আগুনে-সেদ্ধ অজস্র ডোল আধাপোড়া-তাতাপোড়া হয়ে ছেয়ে ফেলত আমাদের বাড়ির পেছনউঠোন। পাতার বাসাটি ভেঙে পাওয়া যেত ডোলপিঁপড়ার ভাত, তাতে চমৎকার চলত মাছধরার কাজ। ডোলান্ন বড়শিতে গেঁথে লোকজন মাছ ধরছে, অলস গ্রীষ্মথমথমা আগুনবাতাসে শ্যাওড়াগাছের ছোট্ট ছায়ায় কিংবা মাথলাছাতার তলে বসে, এই ছবি ডিভিডিপ্রিন্ট সিনেমার মতো সুদৃশ্য দেখতে পাই চোখ খুলে চোখ বুঁজে। বড়শিতে মাছও পড়ত প্রচুর, উপচে উঠত খালুই, দিনশেষে মাগ্রেবের আজানের লগে-লগে লোকজন বড়শি গুটিয়ে কোমরে খালুই ঝুলিয়ে আয়েশে-এলানো-ভঙ্গি নিয়া বাড়ির পথ ধরত। আমাদের উঠান, পিছবাড়ি, পুকুরপাড় আর ছাড়াভিটা/খালিবাড়ি দিয়া মাছমানুষেরা তাদের ঘরে ফেরার সময় আমরা তাদের খালুই টেনে উঁকি দিয়ে দেখতাম মাছের খলবল। বড়রাস্তার ধার দিয়ে বয়ে-যাওয়া সরকারি খাল ভরতি ছিল মাছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশজোড়া খাল-খনন কর্মসূচির চমৎকার চিত্র দেখেছি ছেলেবেলায় আমরা আমাদের শহরতলির গ্রামে। খালের জল ছিল স্বচ্ছ ও সুন্দর, এখনকার মতো অত পলিউশন ছিল না। খালে পথিকলোকে অসংকোচে মুখ ধুয়ে নিত। হায়! এইসব মনে পড়ে…মনে পড়ে এইসব আমার পুবখোলা জানালায় বসে। আমার মুফতে-পাওয়া অবসরের অনিন্দ্য জানালা…জানলা আমায় সকালবেলায় শোনায় ভৈরবী / আর সন্ধেবেলায় শোনায় জন কল্ট্রেইন…আহা…আমার জানালাজোড়া স্মৃতিচিত্রাবলি! জীবনের জল ও জটিলতাবাহী পিকচার গ্যালারি…
—জাহেদ আহমদ ২০১৩
- জানালাবায়োস্কোপ - January 23, 2025
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
- মর্মস্পর্শী মিসকিনদের দেশে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড - January 1, 2025
COMMENTS