অন্নদারঞ্জন দাসের জন্ম ১৯৩১ সালে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার মিত্রিমহল গ্রামে। গর্ভাবস্থায় তাঁর বাবা অধরচন্দ্র দাস লোকান্তরিত হন। কাকা লবকিশোর দাস তাঁকে স্নেহ-ভালোবাসায় বড়ো করে তোলেন। শৈশবে অন্নদা নিজগ্রামে পঞ্চমশ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং পরে কাকার কর্মস্থল আসামের পাথারকান্দিতে চলে যান। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং কাকা তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। অন্নদার পরিবার সংস্কৃতিমনস্ক ছিল, কাকারা গানের দল করতেন। দলে অন্নদা দোতারা বাজিয়ে দক্ষতা অর্জন করেন, এবং একই সঙ্গে গান-গাওয়ার কৌশল অর্জন করেন। আর পনেরো বছর বয়সে পেশাদার শিল্পী হিসেবে সংগীত জগতে প্রবেশ করেন।
গত শতকের তিরিশের দশকে সিলেট অঞ্চলে ‘ডফ’ নামে এক ধরনের যাত্রাগানের প্রচলন ছিল। সেই সংগীতের ধরন ও উপস্থাপন পদ্ধতি বালক অন্নদাকে আকৃষ্ট করে। তাই নিজে ওই ধরনের সংগীত-সাধনায় ঝুঁকে পড়েন। শিল্পী কামিনীমোহন পাল, যোগেন্দ্রকুমার দাশ ও কুশলচরণ দাসের কাছে তিনি সংগীত-শিক্ষা নেন। এঁরাই অন্নদাকে শাস্ত্রীয় শিক্ষা দেন এবং দক্ষ করে তোলেন। এঁদের কাছে তিনি সর্বমোট চার/পাঁচ বছর সংগীতশিক্ষা নিতে পেরেছিলেন। এছাড়া তিনি সিলেট শহর থেকে দুর্বিন শাহের গানের বই কিনে শিতালং শাহের সুরে গানের চর্চা করতেন।
অন্নদার বয়স যখন নিতান্ত কিশোর, পাশের গ্রাম গৌরীনগরে বাউলগানের আসরে সাধককবি দুর্বিন শাহের সঙ্গে পরিচয় হয়। আসরে কেউ অন্নদার সুকণ্ঠের কথা দুর্বিন শাহকে বললে নবীন কিশোরকে তিনি মঞ্চে গান গাওয়ার অনুমতি দেন। আসরে অন্নদা যথাক্রমে দুর্বিন শাহের ‘বন্ধু যদি হইতে রে বাতাস / সর্বদা লাগিত অঙ্গে পুরাইতাম মনের বিলাস’ ও ‘তুমি হইতে গলের মালা চিকন কালা’ গান-দুটি পরিবেশন করে সবাইতে তাক লাগিয়ে দেন। গান শুনে দুর্বিন শাহও মুগ্ধ হন এবং অন্নদাকে নিজের গানের দলে যুক্ত করেন। এই আসরেই দুর্বিন শাহ তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করেন। সেই থেকে অন্নদার জীবন অন্যপথে ধাবিত হয়, সিদ্ধান্ত নেন জীবনে সংগীত সাধনাই করবেন।
সময়ের ব্যবধানে অন্নদা পল্লিগীতি, মালজোড়া, যাত্রা, মুর্শিদি, সারি, ধামাইল, ঘাটু, কীর্তন, বাউল সহ নানা ধরনের গানে দক্ষতা ও খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন। যৌবনকালে উপনীত হতে না হতে তাঁর সুনাম বৃহত্তর সিলেটে ছড়িয়ে পড়ে। একে একে তিনি সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোণা প্রভৃতি অঞ্চলের তরুণ ও বৃদ্ধদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আসরের গানে। দুর্বিন শাহ, শফিকুন্নুর, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, রুহী ঠাকুর, আমির উদ্দিন, রহিমা বেগমের সঙ্গে নানা আসরে অন্নদা গান গাইতে থাকেন এবং নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
এদিকে ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনেও অন্নদারঞ্জন দাস নিজের ভূমিকা রাখেন। ছয়দফা আন্দোলনের পক্ষে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন। সত্তরের নির্বাচনের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে তিনি গোয়াইনঘাটে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী জনসভায় দীর্ঘ সময় ধরে সংগীত পরিবেশন করেন। জনসভাটি দুপুর বারোটায় হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিলম্ব হওয়ায় প্রায় তিনঘণ্টা ধরে স্বাধীনতার সংগ্রামী গান গেয়ে বিপুল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্নদারঞ্জন দাস সংগীতের মাধ্যমে অনন্য অবদান রাখেন। এ-সময়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় বেহালার সুরে সুরে স্বাধীনতার চেতনার গান পরিবেশন করেন। মুক্তিফৌজের ক্যাম্পেও তিনি সংগীত পরিবেশন করে যোদ্ধাদের প্রেরণা দেন। পরে অবশ্য ভারতের শিলিকুড়ি ক্যাম্পে অন্নদা সপরিবার আশ্রয় নেন। সেখানেও তাঁর পরিচয় ছিল একজন সংগীতশিল্পী; শিলচরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গান পরিবেশন করে ভারতীয় পদস্থ কর্মকর্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে আবারও সংগীতে মনোযোগ দেন। ১৯৭২ সালের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে সিলেট স্টেডিয়ামে তাঁর দল স্বাধীনতাকে নিয়ে মালজোড়া গান পরিবেশন করেন। পরের দিনগুলোতে রাষ্ট্রীয় অনেক প্রচারাভিযানে, বিশেষ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রমে শিল্পী হিসেবে নিজের ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীনতার পর অন্নদারঞ্জন দাস বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। সিলেট কেন্দ্রে গাওয়া তাঁর প্রথম গান দুর্বিন শাহের ‘কী সুখে রইয়াছি আমি গো সখী, জানে বন্ধে দেখে না/ গেল বন্ধু আর আইল না’। পরে বাংলাদেশ বেতারের পালাগানের আসর ‘পানকৌড়ি’-তে তিনি পল্লিগীতি, আঞ্চলিক গান, পালাগান প্রভৃতি নিয়মিত পরিবেশন করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তিনি গান পরিবেশন করেন। ১৯৯১ সাল থেকে অন্নদারঞ্জন দাস বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে নিয়োগ পান। উদাত্ত কণ্ঠ ও পরিবেশনারীতি দর্শক-শ্রোতাদের খুব আকৃষ্ট করত বলে তিনি দূর-দূরান্ত থেকেও সংগীতের ডাক পেতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণী ওসমানী অন্নদার গান পছন্দ করতেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের পর কোম্পানিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সম্মেলনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অন্নদাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সমাবেশে ওসমানী সহ দেশের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। হাজার হাজার শ্রোতার সামনে সেদিন গান পরিবেশন করে অন্নদারঞ্জন দাস সবাইকে মুগ্ধ করেন। অনুষ্ঠানটি বেতারের বহিঃপ্রচার বিভাগ রেকর্ড করে এবং পরে তা প্রচারও করে।
১৯৮৩ সালে অন্নদারঞ্জন দাস দেশের বাইরে গান পরিবেশনের জন্য নিমন্ত্রিত হন। সে বছরের আগস্ট মাসে তিনি বিলেতে যান মালজোড়া গাইতে। বিলেত-প্রবাসী সিলেটিরা একদল শিল্পী নিয়ে বিলেতের বিভিন্ন স্থানে গানের আয়োজন করেন। অন্নদারঞ্জনের সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী রুহি ঠাকুর, আমির উদ্দিন, রহিমা বেগম ও ওস্তাদ রামকানাই দাস। অন্নদারঞ্জন দাস বিলেতে তিন মাস অবস্থান করে বিলেতি বাঙালিদের গানে গানে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন।

অন্নদারঞ্জন দাস মালজোড়া গানের আসরেই জাঁদরেল শিল্পী ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন ধরনের গানেও ছিলেন সমান দক্ষ। নিজে গান লিখতেন ও সুর করতেন। তাঁর গানের বিষয় ছিল বিচিত্র; অধ্যাত্মচিন্তা বা তত্ত্বালোচনার বাইরে সমাজ, রাজনীতি ও সমকালীন জীবনও তাতে প্রতিফলিত হয়েছে। সংখ্যায় খুব কম গান পাওয়া গেলেও তাঁর গানের কবিত্ব, শিল্প ও জীবনবোধ অতুলনীয়। পেশাগত জীবনে তিনি কয়েক বছর ইউপি সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সারাজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া অন্নদারঞ্জন দাস ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন পর্যন্ত পল্লিগীতি, ধামাইল, বিয়ের গান, মালজোড়া সহ বিভিন্ন গানের সর্বমোট ৩৫টি অডিও ক্যাসেট বের হয়। এগুলোর মধ্যে নিজের লেখা গানও রয়েছে।
অন্নদারঞ্জন দাস খুব বেশি গান লিখেননি; গান লেখার চেয়ে গাওয়াটা ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তবে খুব স্বাভাবিকভাবে সিলেট অঞ্চলের বাউল-বৈষ্ণব-সুফি শিল্পীদের মতো স্বকীয় ভাবকে একসময় গান আকারে লেখার তাগিদ বোধ করেন। নিজে শিল্পী হওয়ার কারণে নিজের লেখা গানে সুরারোপ করে গাইতেন থাকেন গানের আসরে। অন্নদা তাৎক্ষণিক গান লিখতে পারতেন এবং তাতে সুর দিতে পারতেন। নিজের লেখা তাঁর গানের বিষয়ও ছিল বিচিত্র। তিনি ঈশ্বর-বন্দনা, আল্লা ও নবি-বন্দনা, দেব-বন্দনা, মা-বাবা ও গুরুবন্দনা ছাড়াও বাউল ও বৈষ্ণব ঘরানার তত্ত্বগান রচনা করেছেন। এছাড়া প্রেম ও বিচ্ছেদ, বারোমাসী, গণসংগীত, বিয়েরগান সহ সমাজসচেতনতামূলক গানও রচনা করেছেন। সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এসব গানের ভাষা সহজ, সরল ও কবিত্বে ভরা। অন্নদারঞ্জন দাসের গানের প্রায় সারা জগৎজুড়ে রয়েছে পরমেশ্বরের সাধনা, আত্মমুক্তি ও নিবেদন। নিজের লেখা ভক্তিমূলক আঞ্চলিক গানের জন্য তিনি গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় ছিলেন।
বাংলা লোকগানে যে-তত্ত্বজ্ঞানের অন্বেষণ কিংবা আত্ম-অনুসন্ধান অন্নদার গানেও তা দেখা যায়। নিজেকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন তাঁর। জগতের স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগৎ নিয়েও অনেক জিজ্ঞাসা। জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি নিয়েও অনেক প্রশ্ন। একই সঙ্গে আশংকাও,
কই থাকি আইলাম আমি কইবা যাইতাম
কিতার লাগি আইয়া কিতা-বা যাই করিয়া
মাজন জিগাইলে হউ দিন কি জুয়াপ দিতাম।।
ঠেকলাম মায়ার জালে দিন গেল বিফলে
পইড়া কুমতির দলে হকল খুয়াইলাম
এখন দেখি চাইয়া বেইল গেছে ডুবিয়া
লগে কি ধন লইয়া দেশে যাইতাম।।
এই চিন্তা থেকে মূলত ভগবত শক্তির প্রতি তাঁর অনুরাগ, আকর্ষণ, জিজ্ঞাসা ও ভক্তি। যেহেতু তিনি সনাতন ধর্মের অনুসারী ছিলেন সুতরাং হিন্দু-ঐতিহ্যের অধ্যাত্মচেতনা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে। তবে গানে প্রচলিত দেবদেবীর পরিবর্তে তিনি জগৎপ্রভুর শংসা ও স্মরণ করেছেন—
ওহে প্রভু নিরঞ্জন নাম তোমার করি স্মরণ
প্রথমে ভক্তি জানাই তোমার চরণে।
তোমারই কৃপা বলে আসিলাম এ ভূ-মন্ডলে
তুমি বাঁচাও তুমি মারো এই ভুবনে।।
অন্নদার বিশ্বাস-অনুযায়ী জগৎপ্রভু মানবমুক্তির অভিপ্রায়ে বারে বারে পৃথিবীতে এসেছেন অবতার স্বরূপ। শ্রীকৃষ্ণ কিংবা শ্রীরাম নামে জগৎপ্রভুর এই আবির্ভাবে মানবজাতি আলোকিত ও মুক্তির পথ পেয়েছে, তাই অন্নদাও এঁদের কাছে মুক্তি চান ভক্তি-সহযোগে,
ওহে প্রভু বিশ্বপতি, নিজগুণে দাও হে মুক্তি
রাখো মিনতি রাঙ্গা পায়।।
তুমি হে করুণা সিন্ধু, পাপী-তাপীর দীনবন্ধু
উদ্ধারিতে আসিলে ধরায়।।
পাপ করেছি রাশি রাশি, যা হয় তোমার করো খুশি
প্রাণ সঁপেছি তব রাঙ্গা পায়।।
বাউল-ফকিরদের আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মমুক্তির প্রশ্নে যে-সাধনা তার জন্য পথ-সন্ধানী গুরুর প্রয়োজন হয়, অন্নদাও সেই গুরুকে মানেন। তাঁর গুরু ছিলেন দুর্বিন শাহ; দুর্বিন শাহই তাঁকে জীবন ও জগতের পথ দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন পরমেশ্বরের সান্নিধ্যের পথও। গুরু নিয়ে তাঁর কথা হচ্ছে,
যদি তারে ধরতে চাও, সৎগুরুর নিকটে যাও রে
তারে ভক্তি ভাবে বেঁধে নাও করো গুরুর উপাসনা।।
একই সঙ্গে বাংলার সমন্বয়বাদী ধর্মদর্শনের রূপ অন্নদার গানের মধ্যে দেখা যায়—
তেত্রিশ কোটি দেবগণ, এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর
বন্দী করি জনে জন যে যেখানে।
যোগী-ঋষি, মুণিবর, পির-আউলিয়া, পেগাম্বর
আমি অধম হইয়া কাতর বন্দী সব জনে।।
এই সমন্বয়পন্থা অন্নদার জীবনদর্শনকে বিশেষত্ব দিয়েছে। দেখা গেছে সর্বধর্ম ও সর্বধর্মের মহাপুরুষদের প্রতি অন্নদার শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি তাঁর জীবনাচরণে যেমন ছিল, তেমনি বাণীতেও প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামের প্রধান নবি ও রসুল হজরত মুহম্মদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি ও অনুরাগ। একটি গানে তার প্রকাশ ঘটেছে এভাবে,
আরব দেশে মানব বেশে এল একজনা
যার পরশে মরুদেশে মাটি হয় খাঁটি সোনা।।
সত্যধর্ম প্রচার করতে সত্যের বাণী নিয়ে আসলে ধরার বুকেতে
আমি কি আর বলব তাতে, যার গুণের নাই তুলনা।।
এটা সাধারণ বিষয় নয়। যে-হিন্দু-সমাজে তিনি অবতীর্ণ ছিলেন, সেই সমাজের একজন হয়ে ইসলামের বাণী ও ঐতিহ্য দিয়ে গান লেখা কিংবা গাওয়া সহজ ছিল না। মন ও আদর্শের দিক থেকে একজন মানুষ কতটা অসাম্প্রদায়িক ও শক্তিশালী হলে এমনটা করতে পারেন তা অনুমেয়। এ-সংক্রান্ত তাঁর একটি গান খুব জনপ্রিয় হয় সিলেট অঞ্চলে, গানটির অংশ হচ্ছে,
কে যাও হে মদিনা পথে ওহে মুসাফির
আমার সালাম দিও দরবারে নবির।।
লালনের গানে হিন্দু-মুসলমানের যে মিলন এবং যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেখা যায় অন্নদার গানেও সেই একই ভাব প্রতিফলিত হতে দেখি। তবে লালনের গানে এসেছে তা বাউল পথে, আর অন্নদার বৈষ্ণব ও সুফি পথে। বাংলার লোকায়ত মন অন্নদার গানে খুঁজে পাওয়া যায়।

বৃহত্তর সিলেটে তখন রাধারমণ দত্তের বৈষ্ণবভাবের গান খুব মান্য ও জনপ্রিয় ছিল। এর প্রধান কারণ স্বয়ং চৈতন্যদেবের সঙ্গে সিলেটের সম্পর্ক। রাধারমণের গানের শান্ত-স্নিগ্ধ প্রেমভাব দ্বারা পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমান অনেক লোককবি এই অঞ্চলে বৈষ্ণবভাবের একটা বলয় তৈরি করেছিলেন। অন্নদার গানেও সে প্রভাব রয়েছে। বৈষ্ণবীয় রসতত্ত্বের জীবাত্মা ও পরমাত্মার নিত্যবিরহ ও নিত্যমিলনের বিষয়গুলো তাাঁর গানে অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে,
সখি গো অঙ্গ শুকাইল পিরিতে
গেল কালা দিয়া জ্বালা, দুঃখ রইল বুকেতে।।
কি আগুন জ্বালাইল চিত্তে, পারি না অনল নিবাইতে গো
সখি তোরা বল তারে ঔষধ নাই কি আর জগতে।।
ভক্তিবাদও অন্নদার গানের একটি বিষয়। শান্তরসের এই ভক্তিবাদ বৈষ্ণবীয় বলে ভাবা সম্ভব। তবে মধ্যযুগের ভারতের ভক্তিবাদী সাধকদের প্রেমধর্ম ও ভক্তিবাদের সঙ্গে যে তাঁর পরিচয় ছিল তাও অনুমান করা সম্ভব। একটি গানে নিমাইচাঁদের উল্লেখ যেমন পাই, তেমনি আরেকটি গানে সাধক রবিদাসেরও উল্লেখ রয়েছে,
এসো দয়াল ওই আসরে ডাকি কাতরে
তোমার ভক্তের বাঞ্চা পূর্ণ কর আসিয়া ওই আসরে।।
তোমার যারা সঙ্গের সাথি, অধমে জানাই মিনতি আসরে আসরে
তোমার কৃপা না হইলে পড়ব গো ভীষম ফেরে।।
মন চন্দন তুলসি দিয়া ভক্তি প্রেম শিখাইয়া পূজব তোমারে
ভক্তের কাছে আর কী আছে দিব দয়াল তোমারে।।
…
নামে শক্তি, নামে মুক্তি, নামে ভক্তি থাকা চাই
কলিযুগে এই কথাটি বলে গেছেন এ নিমাই।।
…
জীবে দয়া নামে রুচি নামে পাগল রুই দাশ মুচি
থাকতে হবে সদা শুচি নাম ছাড়া আর উপায় নাই।
প্রেম ও বিচ্ছেদ অন্নদার গানের প্রধান বিষয়। নারী ও পুরুষের জবানিতে এই প্রেমের প্রকাশ। বিশেষ করে নারীর জবানিতে,
তুমি আমার বন্ধু রে, আমি নি তোমার
তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে জীবন করলাম সার রে।।
…
এত আশা দিয়া আমায় প্রেম বাড়ালে
এখন আমার নয়নের জল সার করিলে।
কাঁদতে কাঁদতে তোর পিরিতে যদি চক্ষু যায়
ইহকালে পরকালে দায়ী থাকিবায় রে।।
অন্নদার প্রেমের গানগুলো প্রেমের চিরকালীন উৎকণ্ঠা, প্রতীক্ষা, দুঃখ-দুর্দশা, স্নেহ-ভালোবাসায়—মায়া, বেদনা ও বিধুরতায় ভরা। প্রেমের সর্বগ্রাসী রূপ ও বিচ্ছেদের দারুণ জ্বালা লৌকিক রূপক ও প্রতীকে একটি গানের পঙক্তিতে এভাবে উঠে এসেছে,
দুঃখে দুঃখে জনম গেল দুঃখ আমার ভালা
দিবানিশি সইতে হয় আমার শিংগি মাছের গালা।
সাধারণ মানব-মানবীর প্রেমতৃষ্ণা; মান-অভিমান, বিচ্ছেদ ও মিলন তাঁর গানের প্রধান বিষয় হলেও ধুলোমাটির মানুষের এই প্রেম ও প্রণয় শেষ পর্যন্ত দয়াময়ের প্রতি নিবেদিত হয়ে যায়। এটা অন্নদার গানের একটা বিশেষত্ব,
অন্নদার এই মিনতি বন্ধুয়ারই পায়
যুগল চরণ দিও তুমি যেদিন প্রাণ যায়।
তোমার চরণে ধরি যদি হই বিদায়
তবু জীবন সফল হবে একদিনের দেখায় রে।।
জনসচেতনতার জন্য বাংলাদেশ সরকার যখন পরিবার-পরিকল্পনা বিষয়ে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করে, তখন অন্নদারঞ্জন দাসকে গান লিখে সুরারোপ করে গাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার আহ্বান করে। তিনি সেই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে অনেক গান লিখেছিলেন। এসব গানের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে তাঁর সৃজনশীলতাকে কাজে লাগান। পরিত্যক্ত ভূমিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে কৃষিকে বর্ধিত করা যায়, অন্যদিকে ছোটো পরিবার সুখী পরিবার এমন প্রচারণও তাঁর গানে প্রাধান্য পায়। এমনটি গানের অংশ নিম্নরূপ—
আরে ও কৃষক-শ্রমিক ভাই
খেত-খামারে ফসল বাড়াও আনন্দের সীমা নাই।।
…
ভাই রে ভাই বাড়ি ঘর আর কবর, শ্মশান, রাস্তাঘাট দিয়া
আস্তে আস্তে জায়গা জমি আসতেছে কমিয়া
পরে নিজে দেখবে চাইয়া খেতের জমি নাই।।
ভাই রে ভাই আগে খুঁজলে রাস্তা মিলে, শাস্ত্রে গেছে কইয়া
ছোটো পরিবার নিয়া থাক শান্তিতে বসিয়া
কয় অন্নদা কাতর হইয়া নইলে উপায় নাই।।
এভাবে বহুমাত্রিক বিষয় অন্নদার গানে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এই বিচিত্রতা তাঁর গানের এক সৌন্দর্য।
অন্নদার জীবন-সাধনার মূলে ছিল আত্মমুক্তি ও পরম বা দয়ালের সান্নিধ্য। তিনি জানতেন প্রেম বিনে ভাব নেই, তাই এই ভাবের পথেই জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। জীবন নশ্বর, দয়ালকে পাওয়ার পথে অনেক বাধা; মানুষের আপন শরীরে ছয় রিপু শত্রু সেজে বসে আছে। এদেরকে বশ করতে না পারলে পরমকে পাওয়ার পথ খোলাসা হবে না। এটি এক সংকট ও সংগ্রাম বটে মানুষের কাছে। এই সংকট ও সংগ্রাম কঠিন, তবে অসাধ্য নয়। মানুষের মাঝেই দয়াল বিরাজ করছেন, বিরাজ করছেন সর্বজীবে। তাই সর্বজীব ও মানুষকে ভালোবাসলেও দয়ালকে পাওয়া সহজ হয়। সে ভালোবাসাও এক সাধনা। সংগীত ও গানের মাধ্যমে অন্নদারঞ্জন দাস প্রেমের সেই সাধনা করে গেছেন। যেমন নিজেকে অনুসন্ধান করেছেন, তেমনি জগৎপ্রভুর সান্নিধ্যলাভের প্রচেষ্টা করেছেন। তাই তাঁর গান চিরকালের ভাবুক, প্রেমিক ও ভক্ত-হৃদয়ের প্রেমের উপাচার হয়ে থাকবে বলে ধারণা করতে পারি।
গানপারে জফির সেতু
- আজ বাজার মে পা-বা-জৌলন চল / ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ || তর্জমা / নাফিস সবুর - December 27, 2025
- লোককবি অন্নদারঞ্জন দাস ও তাঁর গান || জফির সেতু - December 27, 2025
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025

COMMENTS