গল্প সমুজদারের

গল্প সমুজদারের

শেয়ার করুন:

বিদঘুটে এক বাকোয়াজের জন্য সন্ধ্যাটা পুরা মাটি হয়ে গেল। অবশ্য গল্পটা আজকালকার নয়, সেই কবেকার, ২০০৬ সালের। বহুদ্দিন হুয়ে, ইয়ার! লেকিন মনে হয়, এই তো সেদিনের, মনে হয় যেন গতকালকার গল্প। অথচ রূপকথার মতো দূর কোনো কালের ঘটনাপুঞ্জ বস্তুত। তো, ওই এক বকাবাজের খপ্পরে পড়ার গপ্পো এটা, বা কাহানির নাম হতে পারে—জনৈক সমুজদারের খপ্পরে এক সন্ধ্যা।

শাওন খুব আপ্লুত বাংলার নতুন-বেরোনো গানের অ্যালবামটি শুনে। সে-বছর ওই ফোক বেইজড ফিউশন ব্যান্ডের বেরিয়েছে দ্বিতীয় অ্যালবাম, ‘প্রত্যুৎপন্নমতি’। এর ইমিডিয়েট বছর-তিনেক আগে এদের ডেব্যু অ্যালবামের নাম ছিল ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’, শ্রবণসুখকর হয়েছিল খুব। এসেই ওরা—গানের এ-দলটি—মাত করে দিয়েছে একেবারে। সেইসময় এদের ক্রেজ ছিল তুঙ্গস্পর্শী। কিন্তু অল্প পরে ব্যাপারটা পাল্টে যেতে থাকে, সেইটা আলাদা আলাপ, যা-হোক। তবু মনে পড়ে, এই শতাব্দীর শুরুর দিকে একটা পাগলা হাওয়া বাংলা  নামের ব্যান্ডটি নিয়ে এসেছিল। পুরা বাংলাকে প্রায়, একে একে সমস্ত তরুণ, মায় দু-দশটা বুড়াধুড়াকেও, মত্ত করে তোলে এই গানদল। পয়লাবার শুনেই সবার মনে হয়েছে, এই বুঝি শেষ হতে চলল জেমসযুগের দাপড়ানি, খতম হয়ে গেল বুঝি জেমসম্যানিয়া! আরও মনে হয়েছিল, শুরু হলো এইবার আনুশেহম্যানিয়ার কাল! তখনকার দিনে অবশ্য রঞ্জিত ছিল না কথাটা।

শাওনের বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা চেপে জিন্দাবাজার পর্যন্ত এসে টের পেলাম, সম্ভব নয়, শুনতেই হবে গান। বেগ বাড়ছিল দ্রুত, দুইজনেরই ভিতর, বাংলার লাগিয়া। শাওন শুনে নিয়েছে আগের রাতেই, যদিও। উচ্ছ্বসিত খুব, শ্রবণোত্তর। কিছু ওদিক-এদিক হাঁটাহাঁটির পর দুজনে ঠিক করলাম যে গানগুলো কোথাও শুনতেই হবে, এবং আজই, আজ রাতেই। ক্যাসেটযুগ একেবারে ক্রান্তিতে এসে গেছে তখন, অতএব সিডি—কম্প্যাক্ট ডিস্ক। খরিদ করা তো হলো, সত্তর টাকা খর্চে, এখন শোনার পালা। তা, শুনি কোথায়? শুক্রবার দিন, সব চেনা দোকানঠেক বন্ধ। কোথায় যাই? দুই-দেড়বার মাথায় চাটি মেরে মনে পড়ল শওকতদের বাসা, কাছেই, তাঁতিপাড়ায়, হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায়। যন্ত্রব্যবস্থাও রয়েছে তাদের তোফা।

শওকত ইমাম, সরদার শওকত ইমাম, সহকর্মী ছিলাম আমরা তৎকালে। এর আগেও একবার শওকতদের বাসায়, তাঁতিপাড়ায়,  গিয়ে সদ্য-কেনা গান শুনে এসেছি। অতএব যাওয়া আরবার এবং আসনপিঁড়ি বসা হলো তিনজনে। শুনিতে বাংলার গান মিলে তিনজনায়। ‘প্রত্যুৎপন্নমতি’। ট্রিবিউট টু লালন সাঁই। সংকলনে ধৃত সব-কয়টি গান লালনের। ভালোই। আখড়াগানের ভিন্ন আমেজ। শুনতে গিয়ে একটুও পীড়াকর মনে হচ্ছে না, ভালোই প্রীতিপ্রদ, সুখকর মনে হচ্ছে বেশ। দুইটা পারায়া তিনটায় গেছি সবে, ক্যাসেটে, হেনকালে উদিলা কোথা হতে আসি ওই উজবুক বাকোয়াজ!

গল্পে এবার গতি এসেছে এতক্ষণে, এই প্যারায়, হিরোর প্রবেশদৃশ্যে। সেই বিশিষ্ট সমুজদার আমাদের গল্পের, আমাদের এই সিনেমার, কেন্দ্রীয় চরিত্র। সম্প্রতি ইহাদের সনেই সম্প্রীতি শাওনের, দিল্লাগি ইয়ারানা, এদের সঙ্গেই ওঠবস সকালবিকালরাতভর। আপত্তির কিছু নাই তাতে। বরং নগদানগদ লাভটাই বেশি। সম্ভব-অসম্ভব সবধরনের মানুষের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া জরুরিও অনেকাংশে। ধানগাছের সঙ্গে তো বলতে হয় না, সুযোগে-সময়ে কচুঘেঁচুর সঙ্গে মিশে যেয়ে দেখা যেতে পারে কারে বলে গলা-চুলকানি। ওইটিকে, ওই বাকোয়াজটিকে, কচুঘেঁচু বৈ ভিন্ন কিছু মনে হয় না আমার।

আমাদের সঙ্গে ওই বিশিষ্ট বকাসুরের বয়স-দূরত্ব—কত হবে শাওন?—বছর-দশেক তো হবেই মিনিমাম। বাকোয়াজ এসেই—এসেছে শাওনকে নিতে এই ত্রয়ীর জলসা থেকে তুলে—দিয়াছে শুরু করে তার আজন্ম-আচরিত আফইবাফই। বিতিকিচ্ছিরি কথাদম্ভ, অভদ্রতা, উন্নাসিকতা। আল্লার দুনিয়ার তা-বড় তা-বড় শিল্পী তার চেনা, জানিজিগর চিন-পহেচান তার সনে সকলের, বাপ রে বাপ! তো, খুব ভালো কথা। মাগার তোমার অত অংবংচং কেন পুত্তর! উচ্চকিত গলায় নিজের ভালোলাগা-খারাপলাগা জানিয়ে দেয়া কেন, চাপিয়ে দেয়া কেন, অন্যের ওপর! অভিজ্ঞতা যার যার, বড়জোর বিনিময় হইতে পারে, কিন্তু জোরপূর্বক অভিজ্ঞতা আরেকজনের পেটে ঠেসে প্রবিষ্টকরণ তো ভদ্রে ভালো কথা নয়। শুনছি তিনজন বসে গান, স্টিরিয়োয়, এসেই শুরু করেছে সে তার উদ্ভট-উজবুক আত্মসংকীর্তন। হেনতেন ভ্যানভ্যান। ব্যাটা বানোয়াটের বান্দর!

সোহেল নাম তার, গল্পের খাতিরে, সেই বিশিষ্ট সমুজদারের। দুই সোহেল আছে চেনাজানা, আমাদের চারিপাশে ভনভনরত, অত্র অঞ্চলের মানবসমাজ দুইজনেরেই এলার্জি জ্ঞানে সতর্ক পরিহার করে চলে। একজন ‘পাতলা’ হিশেবে খ্যাত সর্বত্র, লোকে ডাকে পাতলা সোহেল, পাতলা শব্দটা একইসঙ্গে তার নামের অভিধা ও চরিত্রের বিশেষণ। অন্যজন অনুরূপ সূত্রানুসারে ফাউল সোহেল বলিয়া সমাজে সমধিক পরিচিত। আমাদের এই হিরো লোকটা নিজের রুচির ব্যাপারে খুব পরিষ্কার, খুব কনফিডেন্ট। অপরের চিন্তাচেতনার ওপর বিশেষ আস্থা তার নাই। নিজেরে ছাড়া অন্য কাউরেই সে ভ্যালু দেয় না। তার লাফালাফিমূলক কথার তোড়ে থাকতে না-পেরে একপর্যায়ে আমি আমার স্বভাবপ্রসূত বিরক্তি প্রকাশ করলাম বাধ্য হয়ে। এইটা ভেবে বেশ লেগেছে পরে যে, মুখের ওপর লোকটার থোতায় একটা গুঁতা দেয়া গেছে।

এক কবিতাবাকোয়াজের দৌরাত্ম্যে এককালে এত সাফার করতে হয়েছে যে, একঘরে হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ওই মিঁউমিঁউ কবিতাবাকোয়াজটি মুখস্থ কতিপয় বই, লেখক ও ছোটকাগজের নাম বলে বেড়াত আর মিয়াঁউ-মিয়াঁউ করে ফিরত। কথা বলতে পারে না ব্যাটা, ধান্দাবাজের রাজা, বাট কবিতাটা কিন্তু খারাপ লেখে না। আর তুমি আমার মফিজআলি, সিনেমার হিরো আমার গোপালভোগ আমের খুশবু, তুমি কী এমন করেছ যে তোমারে কোলে নিবার লাগব? তুমি বাবা থাকো তোমার উঁচিমার্গী রুচি লৈয়া, এই নিচিমার্গীগোর দরবারে উড়ি-আসি-জুড়ি-বসি দাঁতমুখ খিঁচাও কিল্লাই? উমর তো বহুৎ হইসে বাপ, আমাগোর, তোমারও। এতখানি বয়সেও যখন কিছুতেই কিছু হয় নাই, হবে বলে ভরসাও খুব কম, তোমার এঁকেবেঁকে এঁড়ে মন্তব্যে বিরক্তিই বাড়ে আমাদের, অনুরক্তি আসে না। এইটা ভালোয় ভালোয় বুঝে ফেললে মাঝিমধ্যি তোমার লগে খুচরাখাচরা হাই-হ্যালো বলন-কওন যায়। নাইলে তো মুশকিল।

তোমার অতশত লফ্টি চিন্তাধারা, এলিভেইটেড টেইস্ট, আননেসেসারিলি আপলিফ্টেড নাসিকা সঞ্চালন দেখেই বোঝা যায় তুমি নিয়মিত পোলাও খাও না। মাঝেমাঝে নাক-কুঁচকানোর বহর ও মাত্রা দেখে মনে হয়, তোমার গোতেবংশে কোনোদিন পোলাও ভক্ষণ করে নাইক্কা। তারা শুধু পোলাও খাওয়ার গল্প শুনেছে মুখ হা করে লালা ঝরিয়ে। তুমিও হালা তাদেরই এক্সটেনশন মাত্র। ফলে তোমার ঢেঁকুর ওঠে ঘনঘন। আর, মাবুদআল্লা, কী বদগন্ধ ঢেঁকুরের! তা, একই কথা ওই ভাব-ধরে-বসে-থাকা বাকোয়াজ কবি বিড়ালতাপস মরমির বেলাতেও খাটে। দুনিয়ার সমস্ত নিয়াই তোমার/তার অব্জার্ভেশন আছে, ইয়া এলাহি! যেমন : জয়ের প্রথম খণ্ডটা ভালো, পরের জয় অ্যাকচ্যুয়ালি নিঃশেষিত কবিমূর্তি এক…পরের দিকে এসে জয় কেবল পপুলারিটির পিছে পরিশ্রম দিয়েছে।…ব্যাডা! তোমার মুণ্ডু! উদাহরণ আবারও, যেমন : আমি অমুকের গান খুব কাছ থেকে শুনেছি দিনের পর দিন।…তোমরা আর কী বুঝবা সুরের সান্নিধ্য কারে বলে! ছেলেবেলা থাইকাই আমি বড় হইসি সুরের পরিমণ্ডলে।…তোমার মাথা!

এদেরকে শূলে চড়ানো দরকার, এবং অতিসত্বর, এই ভাব-ধরা বাকোয়াজ চমকবাজদের। এদের কোনোই রাইট নাই গরিবের সন্ধেগুলো সর্দিসর্দি উচ্চাঙ্গশাস্ত্রীয় সংগীতের সাষ্টাঙ্গ ভক্তিকথায় নষ্ট করে দেয়ার। শালা, আমাগেরে গান-কবিতা বোঝাও! আছিই তো গানে, আছি কবিতায়। মানে, আমরা জীবন যাপন করি, ভানভনিতা যাপন করি না। এবং যাপন করি যে-জীবনটা, সেইটা নিজেদের। জাল জীবন নয় সেটা। আপনা জীবন, আসলি চিজ। বড়ি হ্যায় মাস্ত-মাস্ত। আর জীবন মানে গান-কবিতা, দরকারমতো গলাবাজিও। যত্রতত্র ফলানো/ফোলানোর জিনিশ নয় জীবন। শালা পশ্চাদ্দেশভারী প্রতিভাবানের পুরাকীর্তি কোথাকার!

পরে আর জমে নাই সন্ধেটা। গানও শোনা হয় নাই বাংলার। হিন্দি শুনলাম, এ.আর. রাহমান অমনিবাস, শওকতের কালেকশনে সঞ্চিত সুন্দর কিছু পপুলার সুর। শালা আমারেও দেখি ওই পশ্চাদ্দেশভারীদের পাপে ধরসে! নইলে পপুলার সুর—এইটা আবার কী? পপুলার সুরের উল্টোদিকে কি পণ্ডিতি সুর? সুরের আবার পপুলারিটি-পণ্ডিতি কী গো মা! “তারা বলো, কী হবে / বিফলে দিন যায় মা”…কমলাকান্তের গান। শুনেছিলাম, বহুকাল আগে, ক্যাসেটপ্লেয়ারের যুগে। এখনও মনে পড়ে, ভাসায়, ভাবায়ও।

ব্যাটা, ছাড় এইগুলা, ভাঁড়ের ঘরের ভাঁড়! উজির-এ-আলা খামাখার! আর গলাবাজি-বাকোয়াজি ছেড়ে দেড়দুইটা গান শুনে নে, বেইল তো ফুরায়া যায় রে! এত মিথ্যে বলাবলি আর চলাচলির এই দুনিয়াই, এর চালে এর চিত্রে এর চরিত্রে, এত্তবড় মিছামণ্ডল তুই, তোর মুখ থেকে খালি থুতুগন্ধ আসে।

জাহেদ আহমদ ২০১৩

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you