বছরের প্রথম দিন চলে গেলাম গাজীপুরে। জাকারিয়াভাই নিয়ে গিয়েছিলেন গাজীপুরে যেখানে তিনি তার এক নানার মালিকানাধীন জমি লিজ নিয়ে শীতকালীন সব্জির আবাদ করছিলেন। এই নানার এক ভাই গত টার্মে মন্ত্রী ছিলেন, ছোট ভাই এখনো মন্ত্রী। বড় ভাইয়ের অবশ্য ডায়লগ বলায় জুড়ি মেলা ভার। যেমন কোভিড টিকার এই মচ্ছবের মধ্যে তিনি টিকা নিয়ে সাংবাদিক যখন প্রতিক্রিয়া জানতে চাইল তখন তিনি মন্তব্য করলেন, ‘নো ফিলিং অ্যাট অল’। ইংরেজির পরত দিয়ে বিভিন্ন সিচ্যুয়েশনে এ-রকম মেলোড্রামাটিক কথাবার্তা বলতে তিনি অত্যন্ত পারঙ্গম।
গাড়িতে বসে বিভিন্ন কথা হয, উঠে আসে কিটো ডায়েট ও ডক্টর জাহাঙ্গীরের কথা। শরীরের মধ্যভাগের চর্বিই না-কি সকল নষ্টের মূল! আমাদের বাঙালি তথা উপমহাদেশীয় সর্বোপরি এশীয়দের শরীরের মধ্যভাগের এ-চর্বিই হলো সব ক্ষতির মূল কারণ। বিজ্ঞানীরা এ-ধরনের শরীরকে বলেন আপেল শেপড বডি, মানে মধ্যভাগ স্ফীত। আরেক ধরনের শরীর হলো পিয়ার শেপড বডি, মানে বাহু-কাঁধ-হাত-পা পেশিবহুল হলেও মধ্যভাগ সরু। আমরা হলাম আপেল। পৃথিবীর এ-অঞ্চলে তাই দ্রুত বাড়ছে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হৃদরোগের ঝুঁকি। তাই শর্করা অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলেও খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে, আর খেতে হবে বেছে। যে-শর্করায় অপেক্ষাকৃত কম গ্লুকোজ উৎপন্ন হয়, সেটাই না-কি আদর্শ।
মহাসড়কের উপর বেশ জায়গা পেরিয়ে টঙ্গী ব্রিজ পার হলাম, তবুও পথ যেন শেষ হয় না। জুম্মাবার বলে জুমার নামাজ পড়ার তাড়া আছে। তবে ডানদিকে মোড় নেওয়ার পর গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি চলতে শুরু করল, তখন আমরা রাস্তার আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে জাকারিয়াভাইয়ের টান দিয়েছে, তিনি নেমে পড়লেন।
কর্মসম্পাদনের পর ফেরত এসে তিনি একটি নতুন হাইপোথিসিস দিলেন। তার মতে, ডক্টর জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে তাতে নিকটভবিষ্যতে বিবাহ-শাদির অনুষ্ঠানগুলোতে না-কি গরুর মাংশের সংকট দেখা দিবে। ভাত তথা পোলাও রয়ে যাবে। কিন্তু, সবাই প্রোটিন বেশি খাওয়ায় অচিরেই বিয়েবাড়িতে মাংশ শর্ট হবে। মাছে-ভাতে বাঙালি থেকে শুরু করে ভাতঘুম, বাসিভাত, পান্তাভাত, বসাভাত, মাছভাত, ঘি–ভাত … আমাদের সংস্কৃতিতে কত রকম ভাতসংক্রান্ত শব্দের ছড়াছড়ি! অন্যদিকে রুটি খাওয়া পাঠান বা আফগানদের নিয়ে কতই-না রসিকতা! সেই বাঙালি কি আদতে ভাতকে ভুলতে পারবে?
লন্ডনের দিনগুলোতে যখন আমি নিজে রান্না করতাম, তখন একবার রান্না করতে গিয়ে দেখি ভেজিটেবল শেষ। পূর্বলন্ডনের অনেকেই হোয়াইট চ্যাপেলের স্ট্রিটশপগুলো থেকে সব্জি কেনেন। যা-ই কিনেন তখন সবই ছিল এক পাউন্ড। ডিস্ট্রিক্ট লাইনে হোয়াইট চ্যাপেল থেকে মাইলএন্ড না নিয়ে হেঁটে ফিরতাম। আমার ঠিকানা ছিল ই১ ৩এনবি, মাস্টার্স স্ট্রিট। সব্জিবাজার তখন রাত্রিতে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো এখানে বাজারগুলো গভীর রাত অবধি খোলা থাকে না, স্ট্রিটশপ তো নয়ই। সেন্সবুরিতে ঢুকে সেদিন মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
ছোট এক প্যাকেট যেখানে ৫ থেকে ৬টি ঢেড়সের টুকরা রয়েছে যার মূল্য লেখা রয়েছে তিন পাউন্ড। মনে মনে হিসেব কষে দেখলাম এ-রকম প্যাকেট দিয়ে ছোট তরকারি রান্না করতে গেলেও আমাকে কমপক্ষে ১৫ পাউন্ডের মতো খরচ করতে হবে। খোলা ঢেড়স পাওয়া যায় কি না এজন্য সব্জির সেকশনে উঁকিকিঝঝুঁকি করতে দেখে সেন্সবুরিতে কর্মরত এক বাঙালি ভাই এগিয়ে এসে বলল যে সুপারস্টোর থেকে ঢেড়স কিনে আমাদের তরকারি রান্না করা পোষাবে না। এগুলো সাদা চামড়ার সাহেবদের জন্য যারা হাফ-বয়েল করে কয়েক টুকরা সব্জি ডিনারে খায়।
সাহেবদের মুণ্ডুপাত করতে করতে স্টোর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমরা বইপুস্তকে সব্জি খাওয়ার এত উপকারিতার কথা পড়েছি। জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধ্বজাধারী সাহেবরা আমাদের শাকসব্জি খাওয়ার কথা বলে নিজেদের সুপারশপের তাকিয়াগুলো মিট আর দুধপণ্য দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। আমরা এক মিলে যে-পরিমাণ সব্জি কনজিউম করি, এক ইংরেজ পরিবার সারামাসে এত ভেজিটেবল খায় কি না সন্দেহ। এখন আছেন আমাদের জাহাঙ্গীরভাই। তিনি আমাদের গুড ফ্যাট খাওয়ার কথা বলেন। ডাক্তার জাহাঙ্গীর জিন্দাবাদ!
মেঠো পথ ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন-যে আমরা সব্জিবাগানে এসে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি। একটি তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাহারি রঙের শীতকালীন সব্জিখেতের মাঝখানে। কলিফ্লাওয়ার ও সমগোত্রীয় কাজিনফ্লাওয়ারদের সৌন্দর্য বিমোহিত করে ফ্যালে! ফোন দিয়ে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। তারপর শস্য আহরণের পালা।
গাড়ির পেছন ভরাট করে আমরা বাঁধাকপি, ফুলকপি, কলিফ্লাওয়ার, স্বাদের লাউ ও কয়েক ধরনের লত নিয়ে আসলাম। কদুর লত দিয়ে হুটকিশিরা খাওয়ার মজা শুধু যারা খেয়েছেন তারাই জানেন। যত ঝাল শুরুয়া, তত মজা! লন্ডনে এক লেস সুভারজাইরের সবচেয়ে হট ফুডের কথা জিজ্ঞেস করাতে আমাদের এক তরুণ সহকর্মী বলেছিল, ‘হুটকি শিরা’। তারপর, ঐ শ্বেতাঙ্গিনীকে হুটকিশিরার প্রনান্সিয়েশন শেখাতে গিয়ে আমাদের জান বেরোনোর দশা। ওর স্ত্রীকে নিয়ে আসলে আমাদের কাম তামা হয়ে গিয়েছিল উচ্চারণবিদ্যার কসরতে!
আসার সময় আমরা আঁকাবাঁকা বনের পথ দিয়ে ফিরছিলাম। ছায়ার মধ্যে আলোআঁধারির খেলা ভালোই লাগছিল। এ যেন অন্য ধরনের পরিবেশ। প্রায় এক কিলোমিটারের পথ। ফেরার তাড়া ছিল। যদি তাড়া না থাকত, তবে বেটারহাফের সাথে চলতে চলতে গাইতাম …
এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো?
কোভিডময় শীতের বিকালবেলায় || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী
- আপেলের মতো শরীরগড়ন ও সব্জিকড়চা || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 19, 2021
- কোভিডময় শীতের বিদায়বেলায় || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 13, 2021
- ট্রেন টু আজমপুর || ওলি মো. আব্দুল্লাহ চৌধুরী - February 7, 2021
COMMENTS