বুয়েনেস এইরেস। আর্জেন্টিনার রাজধানী। এস্তাদিও মাস মনুমেন্তাল। রাজধানীর এক ঐতিহাসিক মাঠ। ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় মাঠ। আর এই মাঠেই নীলাকাশের দেবতারা ড্যানিয়েল প্যাসারেলার নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। সেইটা ১৯৭৮ সালের কথা।
২৬ মার্চ, ২০২৫। এস্তাদিও মাস মনুমেন্তাল ইতিহাসের নাক্ষত্রিক আলোয় ফের রাঙা হইলো আজ। গৌরবে। মডার্ন ফুটবলের তিলোত্তমা সুন্দরে। যেন বেহেস্তের ললিত অপ্সরা নাচতেছিল নীলাভ ঘাসের প্রগলভ বুকে, উন্মাতাল।
আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল। ফুটবলপ্রেমিকাদের এক লাস্যময় সাইফাই। এমন এক ম্যাট্রিক্স যেখান থেইকা মুক্তি চায় না কেউ। এক থান্ডারবোল্টস, তারপর তুমুল ঝড়। আর আজকের এই ঝড়ে, আমরা দেখলাম দুই ঐতিহ্যের, দুই সংস্কৃতির, দুই ভাষার মুখোমুখি বড় একপেশে লড়াই৷ আলবিসিলেস্তেদের ট্যাক্টিক্স আর ছন্দে ধরাশায়ী সেলেসাঁওদের অতিরঞ্জিত ফুলকি।
লিওনেল স্কালোনির আজকের ফর্মেশনটা যেন নিজের দিকে নিজেরই ছুঁইড়া দেওয়া এক চ্যালেঞ্জ। 4-1-3-2 ফর্মেশন যেইখানে মিডফিল্ডার এন্সোরে ফলস নাইনে খেলানো, সাথে হুলিয়ানের লাগাতার প্রেসিং, ডিফেন্সিভ মিড থেইকা পেরেদেসের দুই পাশে থাকা দুই মিড-উইং ডিপল আর আলামাদা, মাঝখানে ম্যাক এলিস্টাররে বল সাপ্লাই করা যেন মিড থেইকা একের পর এক বল উপরে তোলা যায়।
বল পজেশনে রাইখা খেলা আর্জেন্টাইন ঐতিহ্য। বল লুজ করা যাবে না কিছুতেই প্রয়োজনে বারবার নিচ থেইকা শুরু করা যেইখানে গৌলি প্রচন্ডভাবে ইনভলবড। এবং বারবার ডিফেন্স থেইকা মিডফিল্ড, ফের একটানে ডিফেন্সে, আবার ধীরে ধীরে মিডফিল্ড থেইকা জায়গা বানানো এবং আচমকা এটাকিং-উইঙে থাকা শ্যুটারদের কাছে বল তুইলা দেওয়া। নান্দনিক এই ফুটবলে আর্জেন্টিনা সম্ভবত সবরকম ক্রাফট আর কারসাজি আবিষ্কার কইরা ফেলছে। সাথে আলভারেজ, এন্সো, আলমাদা, লাউতারোদের ক্ষিপ্র গতি।
স্কালোনির হাতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারটি ছিল না আজ। শুধু সর্বশ্রেষ্ঠ, এতটুকুন দিয়া আলবিসিলেস্তে শিবিরে লায়োনেল মেসির গুরুত্ব বোঝানো যাবে না মোটেও। মেসি এই দলের হার্ট। এনার্জি। মেসি এই দলের এক ডেমোক্রেটিক একনায়ক। ছিল না ইনফর্ম লাউতারো। ছিল না স্কালোনির নতুন ট্যাক্টিক্সে ব্রাত্য-হইয়া-পড়তে-থাকা লো সেলসো। ডিফেন্সে নাই ইঞ্জুরি আক্রান্ত লিসান্দ্রো মার্তিনেজ, দ্য বুচার।

আপনে ক্লাবফুটবলের অসম্ভব সফল কোচ পেপ গার্দিওলার সাথে স্কালোনির একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখতে পাইবেন যদি খেয়াল করেন ক্লাবফুটবলের চেয়ে ন্যাশনাল টিমে হুলিয়ান আলভারেজের রিভ্যুলেশনারি চেইঞ্জ। এইটার ক্রেডিট আপনারে দিতে হবে স্কালোনিরে। পেপ এইটা পারে নাই। আমার ধারণা, পেপের ট্যাক্টিক্সে গতি ব্যপারটা অনেকটা ব্রাত্য। পেপ গতি বোঝে না। হালান্ড যদি লাগাতার স্কোর না করতো, আলভারেজের মতো তারেও গার্দিওলা বাদ দিয়া দিতো। এইটা আমার ধারণা, আবারও বলি। অর্থাৎ ফলস নাইনের গতি বা স্ট্রাইকারের গতির ব্যবহার ক্লাসিক্যাল পেপ সেইভাবে করতে পারে না। যেইটা স্কালোনি পারছে। যদিও স্কালোনি ল্যাটিন ফুটবলের অংশ। ইউরোপের না। পেরেদেস বা রোমেরো বা তালিয়াফিকো বা ওতামেন্দি, লিসান্দ্রো এদের সবার ক্ষেত্রে স্কালোনির কোচিং ম্যানেজমেন্ট অসাধারণ কাজ করছে। এদের সবাইরে যেন নাক্ষত্রিক অমরতা দিছে স্কালোনির নেতৃত্বে থাকা আর্জেন্টাইন প্রেজেন্ট ট্যাক্নিক্যাল টিম।
যা-ই হোক, আজকের খেলাটা সহজে ভুইলা যাওয়ার মতো না। বিশেষ কইরা ব্রাজিলিয়ানদের দুঃস্বপ্নেও হয়ত ২৬ মার্চ তারিখের রাত আগে কোনোদিন আসে নাই। ওহ! জার্মানির সাথে বিগত এক বিশ্বকাপে কিছু-একটা হইছিল বোধ হয়। অ্যানিওয়ে, ওইটারে মাথায় রাইখাও উল্লেখিত বক্তব্যের পক্ষে থাকা যায়, নির্ভয়ে। ব্রাজিলের এই দল দুই মিনিটের জন্যও মাঠে খাড়া হইতে পারে নাই আজ। চ্যালেঞ্জ করতে পারে নাই অদম্য স্কালোনিব্যাটেলিয়ানদের।
গতকাল ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের ফুটবল ম্যাচ যারা দেখছেন, তারা কি বলতে পারবেন বল পজেশনে বঙ্গরা কেন একটুও মুন্সিয়ানা দেখাইতে পারলো না? ল্যাটিন ফুটবলের সাথে তুলনা করতেছি না। এতটুক আকল আমার আছে৷ কিন্তু ফুটবল মানেই ত পাস, পাস এন্ড পাস। মনিটরে ইন্টার মায়ামি সতীর্থদের সাথে খেলা দেখতে বইসা লায়োনেল মেসি নাকি উত্তেজনায় একটা শব্দই উচ্চারণ করে, পাস! পাস! পাস দ্য বল! বাংলাদেশের ফুটবলারদের বল পজেশনে রাখাটা দ্রুত শিখতে হবে। বল পজেশনে রাখার আগে সঠিক সময়ে সঠিক পজিশনে থাকাটা শিখতে হবে। কীভাবে বল পজেশনে রাখতে হয়, এইরকম একটা ক্লাসিক্যাল উদাহরণ ডেফিনিটলি আজকের এই ল্যাটিন দ্বৈরথ। আর্জেন্টিনা (4) – ব্রাজিল (1)।
হাসান শাহরিয়ার মার্চ ২০২৬
- ছফা, হুমায়ূন ও সাহিত্যের ভাষা || হাসান শাহরিয়ার - October 14, 2025
- হুমায়ূন, মধ্যবিত্তের ফ্যান্টাসি ও ডেড ফিলোসোফি || হাসান শাহরিয়ার - October 9, 2025
- বৃষ্টিতে ব্রহ্মনাদের খোঁজে প্রাগভবিষ্যের পদাবলিতে… || হাসান শাহরিয়ার - September 17, 2025

COMMENTS