প্রসঙ্গ : স্মৃতির শিশির… আর্ক, হাসান, আনঅর্থোডক্স স্বর, ঢেউটিন মার্কা অর্থোডক্স কার্নিভাল… || হাসান শাহরিয়ার

প্রসঙ্গ : স্মৃতির শিশির… আর্ক, হাসান, আনঅর্থোডক্স স্বর, ঢেউটিন মার্কা অর্থোডক্স কার্নিভাল… || হাসান শাহরিয়ার

 

গল্পটা ১৯৯৪-৯৫ থেইকা ২০০৪-০৫ সময়ের। ব্যান্ড ‘আর্ক’ তখন আকাশে আকাশে। সূর্যের মাতমে, চাঁদের আঘাতে। ধানের ঝরঝর সকালবেলায়, শান্ত মেঘনার ছোট ছোট ঢেউয়ে। বিকালে একলা টিলার মৌন ভাষায়। বৃষ্টিতে, সন্ধ্যাবেলায়। আর্ক… তাদের সেকেন্ড অ্যালবাম ‘তাজমহল’ (১৯৯৬) সমস্ত পৃথিবীর একটা বিস্ময়। ম্যাজিক, বেহেস্তের অপেরা। ‘একাকী আমি একাকী’ এই ব্যাকরণভাঙা অমাময়ী স্বর সমুদ্রের সকল ঝড় নিয়া, ঝড়ের বিলাপ নিয়া ঘাসরঙা এই শিশিরদ্বীপের গলিতে গলিতে, বেগুনিরঙা বালক-বালিকার বাস্তবের ভিতর স্বপ্ন হইয়া বাজতেছিল উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে, কাতরতায়, হুলুস্থুল। ভুলতে পারবো না। ওই অ্যালবামের ‘তাজমহল’ গানটা বাংলা গানের এমন এক ‘সময়’, এমন এক ‘সুন্দর’ যারে পার হইয়া আসা কঠিন, খুব কঠিন। বিপ্লব, ক্লাস-স্ট্রাগল, আকুলতা — মানুষ-সম্পর্কিত এত মধুর আকুতি এত সহজে এত মায়াবী সুর আর টানে কে শুনাইতে পারছে এর আগে? এখনো? ডিয়ার নৈতিকতার ব্যাপারিস, বুদ্ধিবৃত্তিক গান হইলো এক প্রকার আবর্জনা। ওইসব জিনিসের দোহাই শত্রুর কাছেও শুনতে চাই না আর। জগতের সকল শত্রুরা দূরে গিয়া মন দিয়া নিজের ক্ষেত নিজে চাষেন।

অ্যানিওয়ে,  ‘সুইটি’ …  এ এক গহিন ভ্রমণ, পৃথিবীর সকল অদেখার ভিতর। ঝড়, মরু, পাহাড়, সন্তাপ, ব্যাকুলতা, ভয় পার হইয়া অসীমে ছুটতেছে এক সরল প্রেমিক, সাথে তার প্রেমিকা। “তুমি আর কেঁদো না / অভিমান করো না / দূরে দূরে থেকো না / ঘুম আসে না… / সুইটি…” — এই গান এমন এক জাদু…  ইস্রাফিলের বাঁশির মতো, যেন কণার সাথে কণার নিখাদ গ্র‍্যাভিটি, যেন প্রেমিক আর প্রেমিকার স্বতঃস্ফূর্ত ছল হইলো নিয়তি, যেন প্রেমিক আর প্রেমিকার পানির রঙের মতো সহজ চোখের ভাষার বাইরে আর কোনো ভাষা নাই। তারপর ‘গুরু’… ব্যান্ডগানের হাই ফ্রিকুয়েন্সির শাবলে একরঙা বাউল গানের পাল যেন ঠাঁইহারা, কুলহারা। “সে-ই তো গুরু যে-জন বলে ভক্তিরও কথা / খুঁজে ফিরে জনে জনে অজানা ব্যথা…” — গুরুর এই স্কেচ গিটার, ড্রামস আর কিবোর্ডের হল্লায় কীভাবে এত মায়াবী হইয়া ওঠে… হাসান ও আর্ক না থাকলে কেমনে বুঝতাম? হাসান ও আর্ক? ইয়েস, মাই ম্যান। You heard me right. হাসান জয়েন করার পরই মূলত আর্ক ব্যান্ড বৈপ্লবিক ফিগার নিয়া হাজির হয়। তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কে শুনছে? আমি শুনি নাই। আবার স্বীকার কইরা নেওয়া দরকার, যদি টুলু আর পঞ্চমের ভালোবাসা আর ক্রিয়েটিভ মেকানিজম হাসানের উপর না থাকতো, তাইলে হাসানের মতো এত বেশি আনঅর্থোডক্স ভোকাল এইভাবে কোনোদিন মন্ত্রমুগ্ধ স্বর হইয়া এত মন দখল করতে পারতো না… অন্তত এই হালের ঢেউটিন মার্কা অর্থোডক্স কার্নিভালে।

২.
‘তাজমহল’-এর ঠিক দুই বছর পরে ‘জন্মভূমি’ (১৯৯৮)।  বাংলাদেশের গান এত তুখোড় আনঅর্থোডক্স ঝড় লইয়া এর আগে কোথাও হাজির হইতে পারে নাই। পারবে না। অ্যালবামের ফার্স্ট ট্র‍্যাক ‘প্রেম তুমি’ একটা সুরের কবিতা। বনের এক কাতর কোকিল প্রেম হইয়া বাজতেছে কোথাও মধুবীণার তালে। তারপর সন্ধ্যা, জোছনা, রূপালি চাঁদ। ধানের ক্ষেতে বৈশাখের প্রলয় আসার আগে, দূরে নতুন দিনের ছায়ার মতো সাজানো সবুজ স্বস্থ বনভূমি। হাসান অসাধারণ এক লিরিসিস্ট। তার লেখা গানের কথায় চারপাশ থেইকা তুফানের মতো প্রকৃতি, প্রেম, মায়া, তারপর বিচ্ছেদ ছুইটা আসে। তার প্রেম হইলো প্রকৃতির ভাষা। চারপাশে অবিরত ইশারায় থাকতেছে, কথা বলতেছে। ডাকতেছে। কে সাড়া দেয়? শুধু প্রেমিক সাড়া দেয়। শুধু প্রেমিকা সাড়া দেয়।

অ্যালবামের সেকেন্ড ট্র‍্যাক ‘যারে যা’। একের পর এক মহাবিশ্ব ধূলিসাৎ হবে। ধূলিসাৎ হবে অজস্র অসীম। তবুও এই গান এইসব ধ্বংসস্তূপের শেষে অন্য এক মহাবিশ্বে আর কোনো নতুন ভোরের দাবিদারের কানে সকাতরে সাক্ষ্য দিবে, মানুষের অস্তিত্বের কথা। মানুষের প্রেম, মায়া, ভালোবাসার কথা। ফুলের কথা। পাখির কথা। মেঘ, বৃষ্টির কথা। আকাশের কথা। স্বপ্নের মতো বিস্তৃত আশ্রয় মাটির কথা। এই গান সাক্ষ্য দিয়া যাবে, চোখে চোখ রাইখা। “যারে যা, উড়ে যা / পাখি তারে বলে যা / সে যেন আমারে কখনো ভুলে না রে… যারে যারে যারে যা।” যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও তোমারে হইলো না পাওয়া। আর আস্তে আস্তে তৈরি হইতে থাকে জাদুর ধূলিঝড় যেইখানে ধূসর লাগে আমার আর তোমার যাবতীয় প্রস্তাব। বাস্তব না পরাবাস্তব, বস্তু না ভাব, এইরকম এক দ্বিধার ভিতর আরো হুলুস্থুল কোনো লক্ষ্যের দিকে যেন ছুইটা যাইতেছে মানুষের অরূপ অনিমিখ আকুতি, যেন সমস্ত পৃথিবীর আগুনসম সোনালি রোদে পুইড়া যাইতেছে সে।

“অভিমানে নয়, কিছুটা অভিযোগ নিয়ে / অন্য কিছু নয়, শুধু তোমাকে শুধাই / কতটা এই আমায় আশাহত করে / তুমি সুখ খুঁজে পাও আনমনে, নীরবে…” গানটা এত বেশি কন্টেইজাস মনে হইবো বাংলাদেশের সুরে পশ্চিমের সব রঙ আর আভা আবছা হইয়া আছে, সুখের পরাজয়ে। ঠিক এই-রকম আরেকটা গান আছে এই অ্যালবামে। “এত চাই তবুও কেন পাই না / এতটা চাইনি যতটা পাওয়ার নয়…” ফের কথার ভেল্কিবাজি। ব্ল্যাকহোলের পশুবৃত্তিক টানের মতো দুর্ধর্ষ সুরে এই গান একদিকে আপনেরে বিদ্রোহের বস্তিতে নিয়া হোঁচট খাওয়াইবো, অন্যদিকে সমর্পণের বিনীত দুই হাতে দিবে আশ্রয়, সান্ত্বনা। অ্যানিওয়ে,  ‘তাজমহল’ অ্যালবামে টুলুর বিখ্যাত একটা গান ছিল “ওরে আমার পাগল মন / চিন্তাভাবনা কইরা তুমি দিও তোমার মন”। চাঁদের মুখের মতো সরল আর সংক্রামক এই গানের পর এই অ্যালবামে টুলু গায় প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গতার কথা, যেই নিঃসঙ্গতায় শুধু সবুজের অভাব। ‘জন্মভূমি’ অ্যালবামে পঞ্চমের গাওয়া ‘আকাশের নীলে’ গানটা এখন পর্যন্ত একটা একরোখা মেলাঙ্কলি হইয়া মনের ভিতর খবরদারি করে, বৃষ্টির আগে। বৃষ্টিতে। বৃষ্টির পরে।

‘জন্মভূমি’ অ্যালবামের শেষ ট্র‍্যাক ‘বাংলাদেশ’। হাসানের বাংলাদেশ মাটিতে বহুরঙা বীজের সুবাস, সবুজে মিইশা থাকা রাখালের সুর, মাটি যেন সাধু আর সন্ন্যাসীদের আখড়া। হাসানের বাংলাদেশে কৃষকের বউরে দেখা যায় বাতাসে দুলতেছে আর ওই ছবি চুরি কইরা মহৎ হইতেছে কোনো চিত্রচোরা। হাসানের বাংলাদেশ হইলো খাল, বিল, নদী। মা-র মুখে উধাও হইয়া থাকা পৃথিবীর ব্যথা। হাসানের বাংলাদেশ অসংখ্য বীর পুরুষ, বীর নারী হারানোর যন্ত্রণা, পথে পথে মোড়ানো নকশিকাঁথা।  হাসানের বাংলাদেশ পিরের, আউলিয়ার। বাউলের, কবির। গায়কের, চিত্রকরের। স্বপ্নের ভিতর হইলেও এই বাংলাদেশটারে হারাইয়া যাইতে দিয়েন না।

৩.
‘জন্মভূমি’-র সুনামিটাইপ সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ফের দুই বছর পর আর্ক  নিয়া আসে তাদের চতুর্থ অ্যালবাম ‘স্বাধীনতা’ (২০০০)। অন্য দুই অ্যালবামের মতো এইটাও সাউন্ডটেক-এর ব্যানারে। মনে হয়, কন্টেন্টের দিক দিয়া সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণ এই ‘স্বাধীনতা’ অ্যালবাম। ‘সেতার’, ‘আর কত মৃত্যু’, ‘বন্ধু’, ‘ভুলবো না তোমাকে’, ‘প্রতিবন্ধী’, ‘প্রেমা’, ‘তুমি তো হৃদয়ের গভীরে’, ‘স্বাধীনতা’ — এইসব গান নিয়া তুমুল এক আড্ডা হইতে পারে যখনতখন, ঘরের ভিতর, ঘরের বাইরে। রাস্তায়, ব্রিজে। বনের ভিতর, নদীতে। সন্ধ্যা নামার আগে কীভাবে প্রেমিকার মুখ, প্রেমিকার অভিমান সেতারের সুর হইয়া ওঠে এক সরল সুন্দর কবিতার মতো — আলাপ হইতে পারে। অথবা টুলুর গাওয়া ‘ভুলবো না তোমাকে’ ধইরা অনেক অনেক শূন্য বসন্তের অনেক অনেক হাহাকার পার হওয়া যাবে, অনায়াসে। পঞ্চমের গলা হইলো ফেরেস্তার মানুষ হইয়া উঠতে না পারার বেদনার মতো, ভোরের ঢেউয়ে ভাসা পতেঙ্গা সৈকতের তুমুল মেলাঙ্কলি। “তুমি তো হৃদয়ের গভীরে / কখনো শ্রাবণে দু-চোখেতে / নির্ঘুম রাতের আঁধারে / কষ্টের সীমাহীন মরুতে / মিশে রয়েছো”… আপনারে নিয়া যাবে লক্ষ বছর বিষণ্ণতায় ডুইবা থাকা ওই নক্ষত্রের কাছে, যেইখানে আছে বিপুল রঙহীন আশ্রয়। আবার এই অ্যালবাম শুনতে শুনতে এইরকমও মনে হইতে পারে, সোসাইটির সব ছোট বড় দুর্দশা, যন্ত্রণা, পেরেশানি কাঁধে লইয়া আর্ক  আর যেন সোজা হইয়া উঠতে পারতেছে না। ‘প্রতিবন্ধী’ গানটা আর্কের শৈল্পিক মনের, সৃজনশীলতার একটা কড়া সিগ্নেচার। সোসাইটির খুব ছোট কিন্তু দুর্বল এই জায়গাটারে এর আগে কেউ এত করুণ সুন্দর সুরে, কথায়, মিউজিকে এইভাবে হাজির করতে পারে নাই।

সবসময় নতুন নতুন ট্রেন্ড চালু হইতে দেখা যায় চারপাশে। কিন্তু সব ট্রেন্ড শিল্প হিসাবে গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠতে পারে না। বর্তমান সময়টারে খেয়াল করলে দেখবেন, দুই দিন পর পর একেকটা ট্রেন্ড আপনের মুখোমুখি হইতেছে। বেশিরভাগই চূড়ান্ত রকমের ফালতু। কিন্তু এই ফালতু জিনিসগুলা মনোযোগ দিয়া দেখার দরকার আছে। এইসব বাদ দিয়া আপনে আপনের কালচারাল প্রোগ্রেসটারে আইডেন্টিফাই করতে পারবেন না। ভার্চুয়াল আকাশ দখলের এই দুনিয়ায় এর থেইকা স্বাভাবিক জিনিস আর কী আছে? যখন একটা ট্রেন্ড শিল্প হিসাবে সোসাইটিতে প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায়, আপনেরে আজ নাইলে কাল এর কারণ খুঁইজা বাইর করতে হইবো। ব্যান্ড মিউজিক বাংলাদেশের আর্ট না। কোনোদিন ছিল না। কিন্তু ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’ বা ‘আলাল ও দুলাল’-এর হাত ধইরা ব্যান্ড বাংলাদেশে অসাধারণ এক শিল্প হইয়া ওঠে। এইসব সুর আর স্বরে, মিউজিক আর প্রেজেন্টেশনে, কথায় আর ডাকে — কী ছিল এমন, যা দেশের কমবয়সী ক্রিম জেনারেশনের হাত ধইরা, তাদের মুখে মুখে এত দূর হাঁইটা আসতে পারছে? সাবঅল্টার্নের ব্যথা অথবা আধুনিক গানের নামে মধ্যবিত্তের জাতে ওঠার একপেশে আহাম্মকি থেইকা মুক্তি? মাঝেমধ্যে সময়ের অতীতে একবার টোকা দিয়া দেখা দরকার।

পশ্চিমা ব্যান্ডের একটা ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস পশ্চিমের ইয়াং জেনারেশনের। তাদের যন্ত্রণার, তাদের আকুতির। একদিকে তাদের ইউরোপ এনলাইটেন্ড সিভিলাইজেশনের পুস্তক বিলি করতেছিল লাল আরবে অথবা নাকবোচা বেগুনি এশিয়ায়, আরেকদিকে উন্মাদের মতো যুদ্ধ করতেছে নিজের সাথে নিজে, গণহত্যা করতেছে আফ্রিকায়, নৃশংসভাবে। ইউরোপ তাদের কাছে হইয়া উঠছিল এক জ্যান্ত দ্বিধা, প্রতারণা। এইটা কি একটা ‘ট্রমা’ হইয়া তাদের আঘাত করতেছিল নিশিদিন? কে জানে। হাসানের ‘আর কত মৃত্যু’ গানটা ওইসব ইয়াংদের আইডেন্টিফাই করে, যারা দিনের পর দিন সন্ত্রাসে সন্ত্রাসে শিকার হইতেছে মতলববাজ দানবদের রক্তাক্ত হাতে।

তখন ক্যাসেটের যুগ। ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ। বড় বড় সাউন্ড বক্সের যুগ। বুকশেল্ফে যেইভাবে বই সাজাইয়া রাখি, তেমনি ক্যাসেটশেল্ফে সাজানো থাকতো ক্যাসেট। কার কয়টা ক্যাসেট ছিল, এই নিয়া ছিল মারমার কাটকাট প্রতিযোগিতা। সময় বইয়া যাইতেছিল। টেক্লোলোজি একদিকে আনন্দ নিয়া আসে, একদিকে বিষাদ। ক্যাসেটের যুগ সমাপ্ত হইতে না হইতে সিডি প্লেয়ারের যুগ হাজির হইলো। এইবার প্রতিযোগিতা শুরু হইলো কার জমানো সিডির সংখ্যা কত, কার কয়টা সিডি রাখার বক্স আছে; এইসবের। সিডির আস্ফালন বেশি দিন থাকে নাই। শুরু হইলো ভার্চুয়াল আকাশ দখলের খেলা। ইন্টারনেট আস্তে আস্তে সহজলভ্য হইয়া উঠলো। কম্পিউটারের মেমোরি দখলের পর, ল্যাপটপের মেমোরি দখল হইলো। নকিয়া এগারো শ মোবাইল-বিপ্লবের পরে এন্ড্রয়েড স্মার্ট ফোনের যুগ। গান, দৃশ্য, আমি আর তুমি — সব এখন ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ওয়েবে। আমরা সবাই যার যার মুখোমুখি ওই অদেখা কম্পাঙ্কে! এই জায়গা থেইকা পিছনে ফিইরা তাকাইলে ওইসব পুরান দিনের ভিজা চোখ দেখা যায় শুধু। সবকিছু ঝাপসা হইয়া ওঠে। অনেক অনেক ভাঙনের পরেও, বাংলাদেশে পুরান ব্যান্ডের সাথে অসাধারণ কিছু নতুন ব্যান্ডের আবির্ভাব দেখা গেছে এর মধ্যে। আর্টসেল, শিরোনামহীন, ব্ল্যাক — নাম নিতে হইলো এদের। যদিও খুব বেশি মনোযোগ দিতে পারি না এখন, কিন্তু মাঝেমাঝে এই ঘটনা সেই ঘটনা দেইখা মনে হয়, এখনো বাংলাদেশ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে খুব স্ট্রং এবং মর্যাদাপূর্ণ কোড অব কন্ডাক্ট বা প্রাইভেসি আইন চালু হয় নাই। অথচ সাউন্ডটেক  বা সংগীতার মতো বড় এবং অনেক পুরানো মিউজিক কোম্পানির কথা শুনতে পাই মাঝেমধ্যে।

“মনে পড়ে / সুদূরের সেই দিনগুলো / আজও / কত দেখা,  তবু যেন অচেনা, অজানা / মায়াবী সেই দু-চোখের কিশোরী / অপরূপা, দেখেছি সঙ্গোপনে / তোমাকে / দেখেছি বুকের অতল গভীরে”… ‘স্বাধীনতা’ অ্যালবামের চার নম্বর ট্র‍্যাক ‘বন্ধু’। যেন মায়ার সিম্ফনি। সমস্ত জাহান ঘুরতে ঘুরতে আচমকা দেখা হইলো ওর সাথে। মেঘের চলার মতো ওই চুল, সমুদ্রের শেষ প্রান্তে ভাইসা থাকা টলটলে বিষাদের মতো চোখ, ওই মুখ — বৃষ্টির মতো। তার লগে ফের হইলো দেখা, অবশেষে। হঠাৎ। যখন কোথাও আর উচ্ছ্বাস নাই, কোথাও রঙ নাই আর। যখন নিয়তির মতো অবধারিত অবসাদ চারপাশে, যখন মৃত্যু শ্যামের মতো লাগে। ওই শেষবেলায়। শেষবেলার হাহাকারে কেন ফের দেখা হইলো, শেষে… ওর সাথে? যখন উৎসবের মদে মিলনে নামবে না বসন্ত, তখন কেন? কী বাকি ছিল? ক্ষমা? ‘বন্ধু’ গান কি কোনোভাবে আশা? আশ্রয়? নট শিওর। তবু এই গান খুব ভিতরের। ভালোবাসার। পামির মালভূমি অথবা আরবের মরু, ল্যাটিন পাহাড় অথবা বারবোসার সমুদ্র — সব দেখার পরও বাকি থাকে…. তোমারে দেখার।

৪.
তারপর ‘আর্ক’ ব্যান্ডে ভাঙন শুরু হইলো। মূল তিন সদস্য টুলু, পঞ্চম, হাসান ছাড়া এমনিতে ব্যান্ডে কিছু চেইঞ্জ হইতেছিল নিয়মিত। কিন্তু ‘স্বাধীনতা’ অ্যালবামের পর একদিন আচমকা জানা গেল, হাসান আর্ক  ছাইড়া দিছে। লোকের মুখে অনেক কথা রটতেছিল। ওইসব দরকারি বিষয় না। কিন্তু ওই ভাঙনের পর মিউজিকে কেউ আর বেশিদিন ভালো কিছু নিয়া হাজির হইতে পারলো না। না হাসান, না আর্ক

আর্ক  ছাইড়া দেওয়ার পর হাসান ‘স্বাধীনতা’ নামে একটা ব্যান্ড তৈরি করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে। বোঝা যাইতেছিল, সঙ্গীদের সাথে অভিমানের মাত্রা কত ধারালো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘স্বাধীনতা’ ব্যান্ড একটা অ্যালবামও রিলিজ করে। অ্যালবামের নাম ‘কারবালা’ (২০০২)। মিউজিক কোম্পানি সংগীতার ব্যানারে। ‘প্রথম যখন দেখেছি’, ‘এত গান আজ’, ‘অপর্ণা’, ‘একলা চলো রে’, ‘কারবালা’ — এই পাঁচটা গান ব্যান্ড হিসাবে হাসানের শেষ মাইটি স্ট্রোক।

‘প্রথম যখন দেখেছি’… গানটা রোমান্টিকতার এক-সাগর হুইস্কি। শান্ত মিউজিক, সরল লিরিক, হাসানের জাদুমাখা গলা — সব মিলাইয়া এই গান এক মোহন প্রকৃতি হইয়া ছড়াইয়া থাকে মনের ভিতর, মনের বাইরে। ‘এত গান আজ’ — অভিমানে ভরা এই গান। সাথে এক বিদায়ী তৃপ্তি। যেইখানে ক্লান্ত, বিষণ্ণ এক অভিমানী শিল্পীর লগে দেখা হইয়া যায়, সময়ের অনেক আগে। ‘একলা চলো রে’ গানটাও তা-ই। তবে এইখানে আর বিষণ্ণতা নাই, অবসাদ নাই। আর্টিস্ট যেন এইখানে ওসমানের ঘোড়া কারায়েলের মতো। কেউ সাথে নাই, দরকারি কিছু না এইটা। আমারে ছুইটা যাইতে হইবো অনেক দূর। একলা…। ভাঙনের পর যা হয়, সৃষ্টি কিছুটা ব্যক্তিগত বিলাপ হইয়া ওঠে। এইখানেও তা-ই হইলো। তবে এই বিলাপ শৈল্পিক, এই বিলাপ সুন্দর, এই বিলাপ মধুর। এই বিলাপ শুনতে ভালো লাগে।

আমার মনে হয়, হাসানের সবচাইতে বেস্ট সৃষ্টি হইলো ‘কারবালা’ গানটা। মাঝে মাঝে ভাবি, সীমাহীন সুন্দর এইরকম একটা গান লইয়া কেমনে কোথাও তেমন একটা আলাপ হইতে শুনি না? মনে হয়, পাবলিক তখনই খুব সুন্দর যখন সে লাইন ধইরা খাড়াইয়া থাকে কোনো জংশনে, মুদি দোকানে, ব্যাংকের দরজায়, গরুর হাটে, কোটামার্কা এবং কোটাবিহীনমার্কা ফর্ম হাতে!

তিন দিন আর তিন রাত্রি কারবালা মরুপথে
ছয় হাজার অন্ধ যাত্রী সঙ্গে বীর হোসেন
ফোরাত নদীর বুকে জেগেছিল কত ঢেউ,
তবু একফোঁটা পিপাসার জল মুখে তুলে দেয়নি কেউ…

হায় হোসেন! হায় হোসেন! কেঁদেছিলে পিপাসায়
হায় হোসেন! হায় হোসেন! হায় হোসেন…
হায় হোসেন! হায় হোসেন! কেন এসেছিলে এই কারবালায়?
হায় হোসেন! হায় হোসেন!…

বেঈমান আর কাপুরুষ এজিদের লক্ষ সেনা
পারেনি তো রুখতে তোমার নির্ভীক সাথিদের
আল্লাহ্‌র বান্দার বুকে ছিল না তো মৃত্যুর ভয়
শুধু বুকফাটা তৃষ্ণার কষ্ট এনে দিলো পরাজয়।

হায় হোসেন! হায় হোসেন! কেঁদেছিলে পিপাসায়…
হায় হোসেন! হায় হোসেন! হায় হোসেন!
হায় হোসেন! হায় হোসেন! কেন এসেছিলে এই কারবালায়?
হায় হোসেন! হায় হোসেন!…হোসেন!…হোসেন!…হোসেন!

‘কারবালা’ একটা হেভি মেটাল। প্লট কারবালার পরাজয়, ফোরাত নদীর পার। গানের নিয়ন্ত্রিত সহজ কথা, সুরের ভিতর ইতিহাসের আর্তনাদ, মিউজিকে সারাক্ষণ চলতে থাকা বিষাদের এক দীর্ঘ বহর — বিষাদকাব্য বা ম্যুভির রঙসর্বস্ব দৃশ্যের চেয়েও আরো গভীর ভাবে, আরো গহিন টানে আপনারে কাতর কইরা তুলবে। বাংলাদেশে যে-কোনো ব্যান্ডের জন্য ‘কারবালা’ একটা চ্যালেঞ্জ। ‘কারবালা’ একটা সময়, মাইলস্টোন। ‘কারবালা’ একটা অহঙ্কার। আরেকটা ‘কারবালা’ সৃষ্টি করা সম্ভব না আর।

৫.
হাসানের লিডারশিপে ‘স্বাধীনতা’ ব্যান্ড বেশি দূর হাঁটতে পারলো না। এর মধ্যে পঞ্চমও একদিন আর্ক  ছাইড়া দিলো। নতুন লাইনআপে আর্ক  তাদের পঞ্চম অ্যালবাম বের করলো। কিন্তু ওই অ্যালবামে মনে রাখার মতো কিছুই ছিল না। ২০০২/’০৩-এর পর আর্ক  আস্তে আস্তে স্মৃতি হইয়া যাইতেছিল। আর্ক  একটা মায়াবী স্মৃতি হইয়া এখনো মনের ভিতর ঠিকঠাক আছে।

ক্যাসেটের যুগ চলতেছিল। ব্যান্ডের নিজস্ব অ্যালবামের পাশাপাশি মিউজিক-ইন্ডাস্ট্রিতে আরেকটা ট্রেন্ড খুব চালু ছিল তখন। তা হইলো মিক্সড অ্যালবাম।  মানে একই অ্যালবামে ১০টা/১২টা ব্যান্ড একটা কইরা গান দিত, একজন বা দুইজন সুরকারের সমন্বয়ে। মিক্সড অ্যালবামের এই কালচার কি আশিকুজ্জামান টুলুর সৃষ্টি? নট শিওর। মিক্সড অ্যালবামের পাশাপাশি ডুয়েট অথবা তিনজনের মিক্সড বা চারজনের মিক্সড, ছয়জনের মিক্সড — এই-রকম ছিল। এইসব মিক্সড অ্যালবামের তখন হুলুস্থুল  গ্রহণযোগ্যতা। প্রিন্স মাহমুদ, শফিক-তুহিন, কিশোর শাহিন, শওকাত, জুয়েল বাবু, দূরে — দুঃখিত, সবার নাম এখন মনে করতে পারতেছি না, তবে এইসব অসাধারণ সুরকারদের জাদুতে সাউন্ডটেক, সংগীতা, সিডিসাউন্ড  ইত্যাদি মিউজিক কোম্পানির ব্যানারে তখন বলতে গেলে মাসে মাসে একটা দুইটা মিক্সড অ্যালবাম বের হইতেছিল। মিক্সড অ্যালবামের এইসব রূপালি দিনে সবচেয়ে সফল ছিল প্রিন্স মাহমুদ। বলতে দ্বিধা নাই, প্রিন্স মাহমুদ বাংলাদেশের একটা ঘটনা। তার সুর আমাদের কৈশোরকালের স্মৃতির স্মারক, যা বাদ দিলে ওই সময়টারে শূন্য লাগে। প্রিন্স মাহমুদের শক্তি, ক্ষমা, শেষ দেখা, এখনো দু চোখে বন্যা, দাগ থেকে যায়, স্রোত, হারজিৎ  হইলো কোনোদিন ভুইলা না যাওয়ার মতো কিছু অ্যালবাম।

ব্যান্ডের মেইন ভোকালরা এইসব মিক্সড অ্যালবামে প্রচুর কাজ করতেছিল৷ প্রিন্স মাহমুদের ‘শেষ দেখা’ অ্যালবামে ব্যান্ড আর্কের হইয়া হাসানের গাওয়া “চারিদিকে উৎসব, পরিপূর্ণ নিয়ন আলোয় / আমার এ পৃথিবী,  ঘিরে আসছে আঁধার কালোয় / শানাইয়ের সুর, নিয়ে যাবে দূর / একটু একটু করে তোমায় / আজকে রাতে তুমি অন্যের হবে / ভাবতেই জলে চোখ ভিজে যায় / এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়…” গানটা এখনো তার পুরা আবেদন নিয়া টিইকা আছে মিউজিক-পাগলদের মনে। এহসান এলাহী ফান্টির মাস্টারিংয়ে মিক্সড অ্যালবাম ধুন-এ গাওয়া ‘দূরে বহুদূরে গাংচিল’, টিঅ্যান্ডটি  অ্যালবামের ‘পাহাড়ের চূড়ায়’, জিল প্রোডাক্টস-এর ব্যানারে আনন্দধারা  অ্যালবামের গান ‘সেই সে বালুকাবেলায়’, প্রিন্স মাহমুদের অন্য আরেকটি অ্যালবাম ঘৃণাতে গাওয়া ‘ভালোবাসতে হবে আমাকে’, জুয়েল বাবুর সুরে মেয়ে  অ্যালবামে গাওয়া ‘একাকী এ প্রহর’, আশিকুজ্জামান টুলুর স্টারস টু  অ্যালবামে ওয়েস্টার্ন ব্যান্ড স্টারশিপ-এর ‘Nothings gonna stop us’ গানের ইন্সপাইরেশনে গাওয়া ‘ভুলে গেছি কবে’ সহ অজস্র সিঙ্গেলে আমাদের শৈশবের সবখানে কণায় কণায় হাসান অ্যান্ড ব্যান্ড আর্কের নির্বিচার দখল, অমাময়ী দখল।

গল্পের শেষ দিকে এখন। এইভাবে ঝুড়ি ঝুড়ি গান হইতেছিল তখন। ২০০৪/’০৫-এর শেষের দিকে সম্ভবত, একটা আচমকা পরিবর্তন দেখা যাইতে থাকে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। ব্যান্ডের মূল তিন জনপ্রিয় ভোকাল ‘বাজাইরা’ গানের দিকে ঝুঁইকা পড়লো। এইসব ‘বাজাইরা’ গানের শ্রোতারা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠতে শুরু করলো তাদের কাছে, এমনকি বাংলা সিনেমাতেও দেখা গেল ভুড়িওয়ালা নর্তনকুর্দন মার্কা সিনসিনারিতে রূপালি গিটারের মাতলামি! কেন আচমকা ব্যান্ডের পপুলার ভোকালরা এইসব সস্তা গান গাইতে শুরু করলো, কেন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় কোম্পানিগুলা এইসব গান প্রমোট করতে লাগলো — আমরা কিছুতেই বুঝতেই পারি নাই। শুধু বুঝলাম, আমরা বড় হইয়া যাইতেছি। মা-র ওম মাখা তুলতুলে ইনোসেন্ট মন ও শরীর থেইকা খুব করুণভাবে খইসা পড়তেছিল আমাদের শৈশব, কৈশোর। খইসা পড়তেছিল ওইসব মিউজিকমাস্টাররাও, তাদের ‘বাজারি’ পথ ধইরা।

যদি ভুল না হয়, ২০০১ সালে দূরের পরিকল্পনায় মিউজিক প্রোডাকশন জি-সিরিজ  থেইকা ‘ছাড়পত্র’ নামে একটা মিক্সড অ্যালবাম বের হয়। এই অ্যালবামে আর্টসেল  গায় ‘অদেখা স্বর্গ’ নামে একটা গান। ব্যান্ড আর্টসেল  এর আগে অন্য কোথাও গান রিলিজ করছিল কি? তবে ‘অদেখা স্বর্গ’ গানের ভিতর দিয়া ফের আমরা গানের উৎসবে হারাইয়া যাবার পথ পাইলাম। এতদিন যারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের কী এক রহস্যময় মিউজিকসিনে নিজেদের হাতুড়িপিটা করতেছিল, এই গানের ভিতর দিয়া তারা মেইনস্ট্রিমে আসার এবং মেইনস্ট্রিম দখল করার ঘোষণা দিলো যেন। তারপর জি-সিরিজ  নিয়া আসে ‘অনুশীলন’ নামের আরেকটা মিক্সড অ্যালবাম। এইখানে আর্টসেল  গাইলো ‘অপ্সরী’ আর ‘দুঃখবিলাস’ নামে দুইটা কালজয়ী গান। তারপর একই কোম্পানি থেইকা ‘আগুন্তক-২’ বের হয়, আরেকটা মিক্সড অ্যালবাম।  আর্টসেল  গাইলো ‘চিলেকোঠার সেপাই’। পৃথিবীর এক অপার বিস্ময় এই গান। এইভাবে একটা জেনারেশনের নুইয়া-পড়ার ভিতর কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব লইয়া হাজির হইতে লাগলো আরেকটা মাস্টার জেনারেশন। তবে এইটা আরেকটা গল্প।

মে ২০২১


হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you