নিরাবেগ বুদ্ধিমত্তা || কাজল দাস

নিরাবেগ বুদ্ধিমত্তা || কাজল দাস

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে নিউজ পড়ার ব্যাপারটা দেখলাম বাংলাদেশেও চালু হয়েছে।

খুব ভাবলেশহীন আর ইমোশনলেস মনে হলো এদের সংবাদপাঠ। যদিও এই জায়গায় প্রোগ্রামাররা আরো বেশি করে হিউম্যান ভ্যালুর ডাটা ইনপুট দিয়ে উপস্থাপিকাকে আরো বেশি অ্যালাইভ করে ফেলবে শ্রীঘ্রই ।

তার কথায় শ্রুতিমধুরতা আসবে। বাক-চপলতাও আসবে। আরো রেসিপ্রোকাল হবে প্রেজেন্টাররা। কিন্ত আমি ভাবছি অন্য জায়গাটা নিয়ে।

এই যে মাঝেমাঝে আমরা দেখি কোনো কোনো টিভিচ্যানেলের অ্যাঙ্কর সংবাদপাঠ করতে গিয়ে যদি সহকর্মীর আকস্মিক মৃত্যুর খবর পড়েন তাহলে টিভিসেটের সামনে, লাইভ সংবাদে তিনি থেমে যান। চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। হাতের তালু একেবারে চোখের পাতায় চলে যায়…

এই যে ব্যাপারটা এগুলো একদম মানা সংবাদপাঠিকাদের ক্ষেত্রে, কোনো প্রকার ব্যক্তিগত ইমোশনকে এখানে শো করানো যাবে না। সবকিছু হতে হবে একদম ভ্যালু-নিউট্রাল। এগুলো আর এআই দিয়ে পাঠ করানো প্রেজেন্টারদের ক্ষেত্রে দেখাই যাবে না।

আমি কিছুদিন এক টিভিচ্যানেলে নিউজরুম-এডিটর হিসেবে কাজ করেছিলাম । সেখানে একবার আমার প্রিয় এক উপস্থাপিকাকে আমি চোখের জল টলমল করতে দেখেছিলাম নিউজ পড়তে পড়তে।

সেদিন ছিল মহাশ্বেতা দেবীর চলে যাবার দিন।

দেহ নয় আগুনের পাটাতনে মহাজীবন রাখলেন মহাশ্বেতা দেবী, — এটা বলতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে যাবার যে ব্যাপারটা দেখেছিলাম আর কোনোদিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে সেটা দেখা যাবে না।

এরা নির্ভুল আর এররলেস…

উপস্থাপিকা আমাকে বলেছিলেন — এই হলেন মহাশ্বেতা দেবী যিনি আজীবন অরণ্যের অধিকার নিয়ে লড়েছেন, হাজার চুরাশি নাম্বার লাশের কথা লিখেছেন, তিনি সেই মহাশ্বেতা দেবী যিনি নিজের জীবনকে চেনার জন্য শিশুপুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যকে রেখে বাহিরজীবনে পা রেখেছিলেন। তার চলে যাবার বিষয়টা কী এত সহজে বলে ফেলা যায়…!

এআইপাঠিকারা এক্ষেত্রে উতরে যাবেন। তাদেরকে অতীত থেকে স্মৃতিচিহ্ন তুলে এনে পুতি দিয়ে মালা সাজিয়ে ভাবতে হবে না। যিনি মারা গেলেন, তিনি কে ছিলেন? তিনি কোথায় তার প্রাণে লেগে আছেন?

এই যে কিছুই যায় আসে না ব্যাপারটা — এটা আমারে কষ্ট দিচ্ছে। কিছুটা আর্দ্র করে দিচ্ছে।

আমরা হলাম ’৯০-র দশকে জন্ম নেয়া মহীনের ঘোড়াগুলি। যারা এখনো কার্তিকের মাঠে চরে বেড়ায়। এই মিলেনিয়াল দশকে এসে আমাদের মন আশ্চর্য রকমের ভারাক্রান্ত হয়ে যায় এসব দেখলে।

হয়তো সময় লাগবে কিছুদিন অ্যাডাপ্টিভ হতে। হলে ভালো; না-হলেও ক্ষতি নেই খুব-একটা।

ফ্রেম আর ছকে বাঁধা উপস্থাপিকা যেভাবে মহাশ্বেতা দেবীর কথা ভাবতে ভাবতে বা বন্ধুর মৃত্যুর খবর পড়তে পড়তে বেরিয়ে পড়েছিলেন শৃঙ্খলিত টিভিসেট হতে; আমরাও সেভাবে এসব যান্ত্রিক আর নির্ভুল জীবনের ছক দেখে দেখে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ব হিম কুয়াশার প্রান্তরের দিকে…


কাজল দাস রচনারাশি

COMMENTS

error: