মায়ের চরণে মেমোয়ার

মায়ের চরণে মেমোয়ার

শেয়ার করুন:

অরুন্ধতীর রচনায় আত্মজৈবনিকতা আজকের জিনিশ নয়। আমরা তাকে পেয়েছি যে-প্রাইজউইনিং উপন্যাসের অথার হিশেবে, দ্য গড অফ স্মল থিংস, ডেব্যুটান্ট সেই উপন্যাসে লেখকের মেমোয়ার অ্যাকাউন্টগুলা আমরা আগাগোড়া আন্ডার্লাইন করে এসেছি। কিংবা তার দ্বিতীয় উপন্যাসটিও, দি মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস, অটোবায়োগ্র্যাফিক উপাদানের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগে পূর্ণ। তবে সেসবই ফিকশনের অনিবার্য অবধারিত প্রয়োজনে এসেছে, ব্যবহৃত হয়েছে, পরিপ্রেক্ষিতের উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে সেসব লাগসই হয়েছে যে বলা বাহুল্য। এইবার আর ফিকশনের এলিমেন্ট শুধু নয়, মেমোরির মধু ও তেতো তুলে এনেছেন লেখক সরাসরি মেমোয়ারে।

তেতো অভিজ্ঞতার এমন অতলান্তিকতায় আঠারো বছর অব্দি অরুন্ধতী ছিলেন মায়ের সঙ্গে, কেরালায়, এরপরে সেই তিত্তা মাতৃসংশ্রব থেকে বেরিয়ে আসার ইতিহাসই অরুন্ধতী রায় নামের ফেনোমেনাল স্ববশ সবাক স্বাধীন সত্তাটির ক্রমশ হয়ে ওঠার ইতিহাস। বইয়ের পাতায় পাতায় এই ইতিহাস এক অন্তর্লীন ছন্দে গেঁথে যাওয়া হয়েছে। মেমোয়ারের যদি প্রোট্যাগনিস্ট ফিগারাউট করা যায় তাহলে এই বইয়ের প্রোট্যাগনিস্ট আর কেউ নয়, লেখকের মা, অরুন্ধতী রায়ের মা, মেরি রায়। বাস্তবেরই মাটিপানিমিশা মানুষ। একটু বেশিই বাস্তব। চাঁছাছোলা। আকাট বাস্তব। নিরেট বাস্তব। বইয়ের নামেও রয়েছেন তিনি : মাদার মেরি কামস্ টু মি। ইংরেজি শিরোনামে যে-বাগালঙ্কারটির দোলা, পান বা শ্লেষালঙ্কার, তার সনে ক্ষণে ক্ষণে দেখা হয় অধ্যায়ান্তরে। এই বইটার কথাই বলছিলাম। মাদার মেরি কামস্ টু মি

রিসেন্ট বই বলতে পেঙ্গুইন থেকে বেরিয়েছে অরুন্ধতী রায়ের এই আত্মজৈবনিক গদ্যের বই। কিন্তু অরুন্ধতীর এই গদ্যের সঙ্গে আমাদের দুই যুগেরও অধিক কাল ধরে চেনাজানা আছে। মেরি রায়ের সঙ্গেও পরিচয় সেই প্রথম উপন্যাসে, এর বহু বছর পরে বেরোনো দ্বিতীয় উপন্যাসেও মেরি রায়কে পেয়েছি আমরা, কেরালার যে-সেটিংস্ পেয়েছিলাম গড অফ স্মল থিংসের আখ্যানভাগে, এইখানে সেই সেটিংস্ দেখে একটা আত্মীয়তাবোধ জাগে, যে-কারণে টেক্সটের রিড্যাবিলিটি অনেক বেড়ে যায়, পাঠে প্লেজার হয় বেশি। কিন্তু অস্বস্তি ঠিকই অন্তরাত্মায় খচখচ করে। লেখক আঁকছেন তার মায়ের মুখ, অথচ কী নিষ্ঠুর সেই অঙ্কন! মাতৃভক্তির দেশে এ কেমন জননীচেহারা! আদ্যোপান্ত অকারণ প্রায় বাতিকগ্রস্ত এক নিপীড়ক মা!

মাদার মেরি কামস টু মি  পড়তে পড়তে যে-কোনো বাংলা ভাষাভাষী পাঠক স্মরণ করবেন প্রায় আড়াই দশক আগে একটা আত্মজৈবনিক বই দিয়ে এ-অঞ্চলে তোলপাড় তুলেছিলেন তসলিমা নাসরিন। ‘আমার মেয়েবেলা’ সেই বইয়ের নাম। সেখানে যেভাবে কদর্য অবয়বে নিজের বাবা, ভাই, মা আর বোনের আর সমস্ত পয়পরিচিত লোকের দৈনন্দিন আচরণের ছবি এঁকেছিলেন, তাতে করে পাঠকের যে-বিবমিষা হয়, বিস্বাদ লাগে লেখাটাকেই, বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় লেখকের ইন্টার্প্রিটেশন, অরুন্ধতীর রচনায় সেই বিপদ ঘটেনি। নিষ্ঠুর দজ্জাল পাশবিক পীড়ক এক নারীমূর্তি নির্মাণ করেছেন তিনি, যে-নারীটি লেখকের মা, কিন্তু মনে হয় না বানোয়াট কিছু। মনে হয় এমন মা সমাজে আছে, দেখেছি আমরা, দেখেছি বিশেষত ফিমেইল-হেডেড হাউসহোল্ডগুলায়, একগুঁয়ে, একরোখা, পাশবিক, দজ্জাল স্বভাবের এমন নারী আমাদের মা নন বলে প্রসাদ লভেছি, শিল্পসাহিত্যে যত মা ক্যারেক্টার পাওয়া যায় তারা সবাই প্রায় দেবলোকাগত, অপাপবিদ্ধ, সর্বংসহা, মমতার নিঃশর্ত প্রতিমূর্তি। কিন্তু বাস্তবে তো অনেক রকম মা আছেন।

খল যে-চেহারায় আমরা মেরি রায়কে দেখি, এরই ভিতরে টের পাই তার চরিত্রের দৃঢ়তা, অটল অনড় অবিচল লক্ষ্যাভিমুখিনতা। আর অকুতোভয় স্পৃহা। পাথরের ন্যায় নির্লিপ্তি। ঠিক এই গুণগুলাই অরুন্ধতীরও চরিত্রের ফিচার, তবে মেরি রায়ের অস্বাভাবিকতাটুকু ছাড়া। মাকে ছেড়ে থেকেছেন অরুন্ধতী জীবনভর, মাও খোঁজ রাখেননি বিখ্যাত মেয়ের, অনেক পরে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কিন্তু কেউ কাউকে না ঘাঁটিয়ে সেই দেখা কালেভদ্রের দেখা, মাকে আজীবনের দূর থেকে দেখার এই নিয়তি অরুন্ধতীকে লেখক হিশেবে অনেক বেশি বিবেচক, অনেক বেশি মানবিক, অনেক বেশি সহিষ্ণু করে তুলেছে। হয়তো। প্রভাবিত হয়েছেন কি না তিনি মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা, হয়ে থাকলে কোথায় এবং কতটুকু, বইয়ের পাতা ধরে এগোতে এগোতে এই খোঁজাখুঁজিটা বাড়তে থাকে। টেক্সটের এই যাদু অরুন্ধতীর প্রবন্ধগদ্যেও সবসময় থাকে।

সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিস্টাব্দে মেরি রায় মৃত্যু গ্রহণ করেন। অরুন্ধতী হৃদয়বিদীর্ণ হবার চেয়ে বেশি হন লজ্জিত। লজ্জা কাটাতেই, মায়ের সঙ্গে এই প্রথম বোঝাপড়ায় বসতেই, লিখতে শুরু করেন অরুন্ধতী। নির্মিত হয় মেমোটি। এর পাতায় পাতায় রয়েছে আশ্চর্য সব রিয়্যালাইজেশন। রয়েছে কেরালার পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গড়ন বুঝে নেবার প্রয়াস। অরুন্ধতীর ফিকশনের যারা পাঠক, তাদের কাছে এই বই গৃহীত হবে সাদরে। আর যারা আগের দুই উপন্যাস পড়েন নাই, তাদের কাছে এই ননফিকশন উপন্যাসোপম মনে না হবার কারণ অল্পই।

নিজের চেষ্টায় পিতৃস্পর্শমুক্ত পরিবারটাকে যেভাবে টেনে নিয়ে গেছেন একটি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে, মেরি রায়ের এই সাক্সেস ফুটিয়ে তুলতে অরুন্ধতী কসুর করেন নাই। নিজের প্রতিশোধ তুলেছেন মেরি নিষ্ঠুরভাবে। থেমে যান নাই। অকারণ প্রতিশোধস্পৃহা তার অচিকিৎস্য অসুখেই পর্যবসিত হয়। বেপরোয়া। ব্যাখ্যা যুক্তি কিচ্ছুরই ধার না ধেরে চলা ব্যক্তি মেরি। কিন্তু কত সব বৈপরীত্য রয়েছে তার চরিত্রে, দেখতে হয় তাকিয়ে তাকিয়ে। দেখতে হয় কেরালার সেই প্রত্যন্ত গ্রামে একটি ইশকুল প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল এক মেরি রায়, যিনি অরুন্ধতী রায়ের কাছে একইসঙ্গে স্বয়ং ঝড় ও ঝড়ের রাতের শেল্টার। মায়ের মৃত্যুর পরে মেয়ের এই স্মৃতিআলেখ্য পড়ে আমরা জীবন সম্পর্কে একটি বিশিষ্ট বিবেচনাবোধে দীপ্ত হই।

সুবিনয় ইসলাম

সুবিনয় ইসলাম রচনারাশি

গানপার
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you