পরিণত নব্বইয়ের প্রবাহ ও পরিপক্কতা || আহমদ মিনহাজ

পরিণত নব্বইয়ের প্রবাহ ও পরিপক্কতা || আহমদ মিনহাজ

পূর্ব পরিচ্ছেদ / লোক দশকতামামি ৫ : বাংলাদেশের কবিতার নব্বই এবং ধারাবাহিকতা ও অভিনবতা

নতুন ভাষায় কথা বলা নব্বইয়ের জন্য অমোঘ ছিল যেহেতু আশির অন্তে পৌঁছে বিশ্ব বদলে যেতে শুরু করে। বার্লিনের প্রাচীর হঠাৎ ধসে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন চোখের সামনে উবে যায়। যে-ইন্টারনেট প্রযুক্তি এতদিন দুই পরাশক্তির পরস্পরের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির কামলা খাটছিল তার প্রাসঙ্গিকতা উন্মুক্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনায় চিরতরে পালটে যায়। চীন রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে নয়াবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এইসব হচ্ছে দূর দেশ জুড়ে বহমান কারণ যার জের ধরে বাংলাদেশের কবিকে সময়ে-চাগিয়ে-ওঠা নতুন ভাষার খাসলত রপ্ত করার মিশনে নামতে হয়েছিল। মাসুদ খান নব্বইয়ের মধ্য থেকে শূন্যের অন্ত মাতিয়ে রাখলেন তার নেপথ্য কারণ হয়তো এখানে নিহিত, অর্থাৎ আসন্ন সময়ের ভাষা তিনি ধরতে পারছিলেন। তাঁর সহযাত্রী কবিরাও মোটামুটি তা-ই ছিলেন। এরশাদশাহির পতনবহুল দিনগুলোয় দাঁড়িয়ে ষাট, সত্তর ও আশির সূচনাগ্রে পঠিত কাব্যভাষা থেকে বেরিয়ে তাঁরা নব্বইয়ে পা রেখেছিলেন। মাসুদ খান ও তাঁর বন্ধুবর্গ আশির কালপর্বে বিরাজ করলেও সমধিক নব্বইয়ের কবিও বটে। সুতরাং নব্বইয়ের স্বকীয়তা নিয়ে আলোচনায় আশির মধ্যভাগকে উপেক্ষার অবকাশ নেই। এইসব কবি ছিলেন যোগসূত্র, কেননা নব্বই ও পরবর্তী একদশকের ভাষায় নিজেকে তাঁরা সফলভাবে অভিযোজন করতে পেরেছিলেন।

মাসুদ খান সম্ভব ছিল না যদি সোভিয়েত গায়েব না-হতো। যদি সাদ্দামের টুঁটি চেপে না ধরত মার্কিন পরাশক্তি। এবং আশির মধ্যভাগ নতুন ভাষায় পরিণত হওয়ার দিকে গমন করতেই পারত না যদি জোড়া দালানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে হতবাক ’মেরিকা এটা অনুভব করত অন্যকে অরক্ষিত করার জঙ্গে নেমে সে নিজে আজ অরক্ষিত বটে! এইসব বৈশ্বিক গোলযোগের চাপে দেশ পাল্টায়, জনসমাজে নবতরঙ্গ বহে, আর সেই চাপে ভাষার পরিধি আমূল বদলে যেতে থাকে। দেশি ভাষা ভোল পাল্টায় বিশ্বভাষার চাপে। মাসুদ খানের কাব্যভাষায় এইসব প্রবণতা ছলকে উঠায় তাঁকে আর অগ্রজদের অনুরণন ভাবার উপায় ছিল না। কবিরা কোনো-এক দশকে জন্ম নিলেও তাদের বিকাশ, পরিণতি ঘটে পরবর্তী দশকের-পর-দশক জুড়ে। নব্বই যেমন এখন আর নব্বইয়ে দাঁড়িয়ে নেই। তার পরিণতি বুঝে আসে না যদি তাকে নব্বইয়ে আটকে রাখি। এবং এই নব্বই আবার আশির প্রতিবিম্ব নয়। প্রত্যেকে সেখানে নানা ঐক্য ধরে রাখলেও সময়ে তরঙ্গিত প্রবণতার বিচিত্র সমাহার থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভাষাভঙ্গি নিষ্কাশন করে নিয়েছিলেন। একজনকে অন্যজনের সঙ্গে একাকার ভাবা তাই যুক্তিসংগত নয়।

এই বুঝের কারণে কবিতার পাঠকের কাছে দশক জন্মতারিখের অধিক তাৎপর্য বহন করে না। এলিয়ট-পাউন্ডরা দুইয়ের দশকে কিতাব বের করে জগৎ মাতিয়ে দিলেন, কিন্তু ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কি ১৯২২-এ হুট করে বিশ্বে নাজিল হয়েছিল? প্রথম মহাসমর সাঙ্গ হওয়ার সাথে তাল দিয়ে মিল-কারখানা ও সমরাস্ত্রে ভরপুর নতুন যুগের বিকাশ ছাড়া এই ভাষাপৃথিবী সম্ভব ছিল না। বিজ্ঞানের ভাষায় পালাবদল এল বিংশ শতকের প্রথম দশকে আর সেই চাপ সইতে না-পেরে বেচারা এলিয়টের নিষ্ক্রমণ ঘটে গিয়েছিল গির্জার চৌকাঠে। বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার জয়রথ তাঁকে গীতার শ্লোকে গমন করতে বাধ্য করেছিল আর কালনাগিনীকে তিনি পড়তে বাধ্য হলেন ঋষি-উচ্চারিত মন্ত্রে :— Time the destroyer is time the preserver. ঠিক যেমন ম্যানহাটন প্রজেক্টর অধীনে অ্যাটমবোমার রূপকার ওপেনহাইমার হিরোশিমা ও নাগসাকি শহরে পারমাণবিক বিস্ফোরণের খবর শুনে স্থানুবৎ হয়ে পড়েছিলেন, অতঃপর সময় তাঁকে গীতার শ্লোক আওড়াতে বাধ্য করেছিল! হতবিহ্বল বিজ্ঞানী সেদিন উক্তি করেছিলেন, ‘এখন আমিই মৃত্যু,—পৃথ্বিসংহারী’;— Now I am become death, the destroyer of worlds. ওপেনহাইমারের উচ্চারণে নিহিত ছিল কী কারণে পঞ্চাশ থেকে পরবর্তী তিন দশকে দেশবিদেশ সর্বত্র কবিতার জগতে গ্লানি, অবসাদ, অবিশ্বাস, নৈরাশ্য আর আত্মকামী নির্বেদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক অনুধ্যানে নির্গমন নেওয়ার ক্ষুধা ক্রমশ দুর্বার হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশে বিরাজিত দেশকালচেতনার নিরিখে সেখানে হয়তো কিছু অতিরঞ্জন ঘটেছিল। স্যাড জেনারেশন  আন্দোলনের হুজুগে মেতে রফিক আজাদ, মান্নান সৈয়দরা হিপি-বিটনিকদের সমতুল ব্যক্তিকতায় হয়তো-বা খানিক ভুলভাল বকেছেন, কিন্তু মোটের ওপর তাঁরা সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেখানে গ্রামীণ জনপদ বৈশ্বিক পরিবর্তনের ছকে ক্রমশ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পানে ধাবিত হচ্ছিল। বিলাকীর্ণ জংলা ঢাকার ঝোপঝাড় ঠেলেঠুলে সেই ভাষা ঢুকে পড়ছিল ও হানা দিচ্ছিল মাহুতটুলি, আরামবাগ কিংবা বিউটি বোর্ডিংয়ের চত্বরে যাকে উপেক্ষা করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পক্ষে গাঁওগেরামের ভাষায় কবিতা লেখা দুরূহ ছিল! শহীদ কাদরীর গ্রামবাংলায় একপাক ঘুরান দিয়ে আসার কবিতা (দ্রষ্টব্য : খুব সাধ করে গিয়েছিলাম; কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই) সময়ের ভাষাপ্রবাহের কাছে কবির অসহায় আত্মসমর্পণের দলিল হয়ে এসেছিল। গ্রামবাংলাকে ‘আবহমান’ শব্দে নিহিত বোধির জায়গায় খুঁজে না-পাওয়ার অভিজ্ঞতাটি কবির জন্য মর্মান্তিক ছিল। একদিকে তিনি সেখানে ফেরত যেতে চাইছেন এবং অন্যদিকে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছে তীব্র হয়ে উঠতে পারছে না। শিকড়ে ফেরত যাওয়ার মনোবাসনা পূরণে কবির হাতে ভাষার সেই চাবি নিখোঁজ যার সাহায্যে আবহমান শব্দের আড়ালে ঢাকা গ্রামবাংলাকে রোমন্থন ও কবিতায় সেলাই করতে পারেন। সময়ের পটপরিবর্তন চাবিটি তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল, ফলে গ্রামে ঢুকলেও কবির গ্রাম দর্শন ট্যুরিস্টসুলভ রোমাঞ্চ আর বিরক্তির মাঝে নিঃশেষ হয়। কথাসাহিত্যে এর প্রভাব আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার বিবরণ লিখতে বাধ্য করায়, তাও আবার এমন এক ভাষায় গ্রামীণ ঢাকা শহরের সাপেক্ষে যেটি অচেনা ও বিদেশি ছিল :—

এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে…আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতদিন পাইনি, কতকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস।
(নিরুদ্দেশ যাত্রা; অন্য ঘরে অন্য স্বর)

দেশি অঙ্গে ভিনদেশি কন্ট্রাস্ট বহনের কারণে ইলিয়াসকে এখানে অচেনা ঠেকে! এ হলো বৈশ্বিক জলবায়ু এবং তাঁর নিঃশ্বাসে এটি সময়ের আগে ঢুকে পড়েছিল। বিল-জংলায় ভরপুর মফস্বলী ঢাকা বা মধ্যবিত্ত কালচার বায়ুকে স্বাগত জানানোর জন্য বিলকুল প্রস্তুত ছিল না, যদিও অচিরবর্তী আগামীতে এর প্রকোপ বৃদ্ধির ইশারা আক্কেলমন্দ ব্যক্তির কাছে গোপন ছিল না। অন্যদিকে আশি থেকে নব্বইয়ের মধ্যভাগে প্রবেশের ক্ষণে ইলিয়াসের পক্ষে নিরুদ্দেশ যাত্রার ভাষিক কন্ট্রাস্টে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি, যেহেতু প্রত্নবস্তুতে পরিণত আবহমান বাংলার গ্রামীণ ও নাগরিক অঙ্গ ততদিনে বৈপরীত্য থেকে পুনরায় সরলরৈখিক বা লিনিয়ার ছকে ফেরত যেতে চাইছিল। বৈশ্বিক পালাবদলের আসন্ন চাপে গ্রামীণ ধারায় বিবর্তিত জনপদ মুক্তবাজার নামের দৈত্যকে জায়গা দিতে বাধ্য হবে, নব্বইয়ের প্রবেশমুখে পা রাখার দিন থেকে সেটি না-বোঝার অবস্থায় ছিল না। বাংলার জনজীবনের কাহিনি ভানতে বসে অগত্যা প্রত্নতত্ত্বের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ইলিয়াসকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজতে হয়েছিল। এই প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে ইতিহাস যা তাঁকে পরাধীনতার শিকল থেকে স্বকীয় ও স্বাধীন হওয়ার অভিজ্ঞতা দান করেছিল। অথবা আরো পেছনে গেলে এটি সেই অতিকল্পনা বা মিথ যার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া রক্তমজ্জায় বামপন্থী লেখকের পক্ষে সংক্ষুব্ধ বাংলার অতীতকে খুঁজে ফেরা ও বর্তমানের সঙ্গে তার তফাৎ এবং সংঘাতের চরিত্র বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে। ইলিয়াস কাজটি সম্পন্ন করেন এই বিপন্নতা স্বীকার গিয়ে,—তাঁর এই ভ্রমণ শেষাবধি ‘স্বমেহন’ ও ‘খোয়াব’ যাতনায় নিঃশেষ হতে বাধ্য, কেননা লিনিয়ার ছকে ফেরত যেতে ইচ্ছুক নব্বইয়ের কবি যে-গ্রামবাংলা ও আবহমানকে পাঠ করতে চাইছে সেটি কার্যত নিখোঁজ, অথবা অবশেষ যেটুকু রয়েছে তার পতন ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই!

‘চিলেকোঠার সেপাই’ থেকে ‘খোয়াবনামা’-য় ভাষার স্বরূপ বদল অগত্যা ইলিয়াসের ইচ্ছায় ঘটে না। নিরুদ্দেশ যাত্রার মনোটোনাস রোমান্টিকতায় ছলকে-ওঠা কন্ট্রাস্ট থেকে বেরিয়ে ভীতিকর দৈত্যের সম্মুখীন হতে সাহস লাগে। সময় ইলিয়াসকে পাকড়াও করে সেই রচনা লিখতে বাধ্য করে যেখানে গ্রামীণ ও নাগরিক জনজীবনের সংঘাত বহমান থাকলেও দেশকাল কিংবা স্থানিকতার এক ইঞ্চিও আবহমান বৃত্তে দাঁড়িয়ে নেই! ইলিয়াসের বাংলাদেশ বরং সেই আবহমানের স্মারক ছিল যার নিরাশ বয়ান শহীদ কাদরীর গ্রামে ঘুরান দিয়ে আসার বিবরণ ক্লিয়ার করে যায়। সময় যদি পরিসর অবশিষ্ট না-রাখে তবে কবি বা কথাকার চাইলেই হবে না। আল মাহমুদের সোনালী কাবিনকে শহীদ কাদরী উদারচিত্তে মারহাবা জানাতে পারেননি, এর নেপথ্যে কাব্যঈর্ষা হয়তো ছিল, সেইসঙ্গে এই সংকট সেখানে কোনো অংশে কম তীব্র ছিল না। মাহমুদের কাবিন সেই জনপদে দাঁড়ানো ছিল না যেটি পঞ্চাশ পরবর্তী কালপ্রবাহে ক্রমশ অমোঘ হয়ে উঠছিল। ‘সোনালী কাবিন’-র বয়ানে অতীতচারী রোমন্থন ইউটোপিয়ান সম্মোহনে মনকে বশীভূত রাখে। আবহমান থেকে টেনে আনা শব্দ ধার করে একে অপরূপ ভাষা দেওয়া যায় কিন্তু এতে করে সে সত্য হয়ে ওঠে না। কাদরী ও মাহমুদে বিদ্যমান কাব্যভাষার দ্বন্দ্ব কবিরা কীভাবে সময়প্রবাহে সৃষ্ট ভাষার জিম্মি খাটেন এবং পরস্পরের বিপরীত প্রান্তে নিষ্ক্রমণ ঘটান ইত্যাদি উদাহরণকে অবারিত করে যায়।

জসীম উদদীন বা সৈয়দ আলী আহসানের ভাষাঅঙ্গে নিজেকে জুড়ে ‘আমার পূর্ব বাংলা’-য় ফেরত যাওয়ার খায়েশ পঞ্চাশ দশকের অন্তিমলগ্নে পা রাখার পর থেকে ক্রমশ অবাস্তব হতে শুরু করেছিল। শিকড় আগেই উপড়ে গিয়েছিল সেখানে। যে-কবি তখনো আধা-গ্রাম্য শহরে বসে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সংঘটিত ভাষাকে রক্তে বহন করতে বাধ্য হচ্ছিল এবং স্বদেশকে নয় মাসের যুদ্ধে গমন করতে দেখেছিল তার পক্ষে নজরুলের বিদ্রোহী টঙ্কার, জসীম উদদীনের পল্লী বাংলা কিংবা ফররুখের দীনী চেতনায় রঙিন কাব্য-অভিজ্ঞানে ফেরত যাওয়ার উত্তর-আধুনিকতা কি অলীক ছিল না? নব্বইয়ের ত্রিশ বছরের জার্নির কথা ভাবতে বসে প্রশ্নটি মনে উঁকি দিয়ে যায় বৈকি!


গানপার ম্যাগাজিনরিভিয়্যু
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির দশকের কবি, আশির দশকের কবিতা

COMMENTS

error: