শরতের দিনগুলো বরাবরই আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে । বিগতবর্ষা হাওর জামাইকাটায় রাখালের বাঁশির মতো যেন খুব একা হয়ে উঠি। দলে-দলে বিষণ্ন সুন্দরের ডালি নিয়ে হাজির হওয়া শুভ্র মেঘেদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব উঁকি দেয়। ধরতে গেলেই এক-পা এক-পা করে দূরে সরে যাই, আবার কাছাকাছিও আসি। আমি আজ চল্লিশ পা দূরে অথবা চল্লিশ পা সামনে। বিস্তীর্ণ স্মৃতি-অরণ্যঠাসা জোনাকের দল মূর্ত করে তোলে এই জীবনের অমৃতবৃক্ষ ও বিষবৃক্ষের সংগীত।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর—তার একটি গ্রাম শ্রীকরপুর—আমার জন্মস্থান। দালিলিক সব জায়গায় আমরা এই নাম ব্যবহার করলেও ইউনিয়নের অন্য জায়গায় আমাদের পরিচয় কিন্তু আধুয়ানিবাসী! আধুয়া, পাটুমোহা ও শ্রীকরপুর মিলেই বৃহত্তর আধুয়া গ্রাম। আধুয়া আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠার বুনিয়াদের ঠিকানা।
আমাদের বাড়ি থেকে পুব দিকে বের হলেই সামনে পড়ে কৃষ্ণতলা। একানব্বইয়ের ঝড়ের পূর্বে কৃষ্ণতলায় বহু প্রাচীন বৃক্ষটি মাটিতে উপড়িয়ে পড়ে গেলে আমার পিতা সহ পশ্চিমবাড়ির রামকৃষ্ণদা ওই গাছের ডাল রোপন করেন। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া শিশুবৃক্ষটি এখন বিশাল মহীরুহ। পৌষ সংক্রান্তিতে (তিলোসংক্রান্তি) নগরকীর্তন, কার্তিক মাসের নগরকীর্তন (ভোলার কীর্তন) এই বৃক্ষতলা থেকে শুরু হয়। বিয়ে ও শিশুজন্মতে নারীরা দলবেঁধে গান গেয়ে গেয়ে পুজো দিতে যায়। গ্রামের প্রবেশদ্বারে এর অবস্থান এক অসাম্প্রদায়িক তাৎপর্যপূর্ণ সংস্কৃতি বহন করে চলছে। প্রতিদিন সকালে (বর্ষাকাল ব্যতীত) গ্রামের সকল বাড়ি হতে গরু নিয়ে আসা হয় এখানে। জমায়েত হওয়া গরুগুলোকে এখান থেকে এক বা দুইজন রাখাল নিয়ে যায় হাওরের চারণভূমিতে। রাখালদের গরু চরানোকে সিলোটি ভাষায় বলে ‘গরুবারি’। গ্রামের প্রত্যেক বাড়িকে পালাক্রমে গরুবারি দিতে হয়।
আমাদের গ্রামের পূর্বের হাওরের নাম জামাইকাটা। এর একেকটি অংশের একেক নাম। যেমন লাঙ্গলজোড়া, বিন্দারটেক, ডুবি প্রভৃতি। বিন্দারটেক, বানাইয়া, হাপাতিতে প্রচুর ঘাস হয়। কৃষ্ণতলা থেকে গরু নিয়ে রাখাল দূর হাওরে যায় আবার গোধূলির সময় ফিরে আসে একই জায়গায়। গরুবারিতে যাওয়া রাখালবালকদের মধ্যে আশ্চর্য কিছু গুণ থাকে। বিশেষত বাঁশি বাজানো আর গান গাওয়ার ক্ষমতা। সিলেটের প্রখ্যাত দুইজন বাউলের নাম করতে পারি যারা এ-রকম হাওরের বুকেই নিয়েছিলেন বাউলিয়ানার প্রাকৃতিক পাঠ। তাদের একজন শাহ আব্দুল করিম, আরেকজন ক্বারী আমীর উদ্দীন।
জামাইকাটার জল ও ধানের গা ছুঁয়ে ঝরে পড়া পূর্ণিমার আলোয়, পালতোলা নৌকার উদ্ধত বুকে, শাপলাঘেরা ডিঙি ও ভেলার ওপর ভ্রমর আর আমি খেলা করেছি যেন কত জন্ম-জন্মান্তর! আজ সে বিগতযৌবনা—জলে ও জোছনায় নেই ভারসাম্য। নদী ও খাল হত্যা করে মানুষ তাকে করে ফেলেছে প্রায়-স্থবির। কচুরিপানার হাত এড়িয়ে বেঁচে যাওয়া শাপলারা বড়োই সংখ্যালঘু! জলের জৌলুশ নিয়ে চারপাশের জনপদের জীবনযাত্রার প্রাণকেন্দ্র এই হাওরের নামকরণের উপকথাও মানুষের লোভ আর আত্মঘাতিতার মধ্যকার ঘনিষ্টতার এক জ্যান্ত উপমা। বিবাহযাত্রীবাহী কোনও এক নৌকায় ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাতসর্দার নিজের মেয়ের বরকে হত্যা করে ফেলে। নির্বিঘ্নে লুট ও লাঞ্ছনা করতে গিয়ে যখন সে নববধুর ঘোমটা খুলে, তখন দেখতে পায় নতুন বউটি তার নিজেরই মেয়ে। সেই থেকেই এর নাম নাকি জামাইকাটা হাওর। বহুবছর আমি হাওর ও গ্রামের থেকে দূরে।

এই ঝলমলে ভাদ্রের বিকেলে আধুয়া থেকে শত শত মাইল দূরের কর্ণফুলিপাড়ে কী ভাবছি? জলজোছনার স্মৃতিকাতরতা আর নাগরিকবাস্তবতার নাগপাশ—এ-দুয়ের দ্বন্দ্বে কেমন আছি আমি?
শূন্যতারাশির বেলাভূমির উপর আমার জীবনসূর্যের আলো আজ পশ্চিমমুখী। উত্তরচল্লিশের আলোয় দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে সময় ও মাটি—মানুষের বহুমুখী জটিলতার বিভ্রমে ঢাকা এক মুরতি। রাষ্ট্র, দেশ, জাতি, জাতীয়তা, ধর্ম তথা নানাবিধ মোড়কের আড়ালে মানুষের আত্মিক সংকট প্রকট করে বেনিয়াদের ক্ষমতায়ন, মানুষের সামগ্রিক ক্ষেত্র সীমিত করে তুলেছে। ঠিক যেন সুধীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনের মতো প্রকট হয়ে উঠেছে—“জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ, নিরঙ্কুশ শুধু একনায়কেরা।” একদিকে মানুষ যেমন প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে, তেমন মানুষে মানুষে দূরত্বও বেড়েছে ঢের। প্রকৃতির ধর্ম থেকে স্খলিতপ্রায় মানবসমাজ নিয়ে তারপরও থেমে নেই মিথ্যে অহংবোধের হাস্যকর চর্চা।
আজকের দিন পর্যন্ত মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে অভূতপূর্ব উৎকর্ষ সাধন করেছে তা যদি মানুষের সামষ্টিক শক্তির ইতিবাচক বিকাশ ঘটাতে না পারে তবে তা সমগ্র মানবজাতির জন্য নিঃসন্দেহে কোনও শুভ ফল নিয়ে আসবে না। মানুষের সামষ্টিক ব্যর্থতায় আমার দায় থাক বা না থাক, আমি বা আমাদের তার ফল ভোগ করতে হয়—করতে হচ্ছে। আবার আশার বিষয় যে, মানুষের সামষ্টিক সাফল্যে, আমার অবদান থাক বা না থাক, আমি বা আমাদের তার সুফল কখনও বঞ্চনা করে না—করছেও না। আমি তাই ইতিবাচকতার পূজারী, সামষ্টিক সাফল্যের উপাসক।
৮/৯/২৫
লেখক জয়দেব করের প্রতিকৃতিদ্বয় ক্যামেরায় ধারণ করেছেন কৃষ্ণা
জয়দেব কর রচনারাশি
- বাইশে অক্টোবর || জয়দেব কর - October 22, 2025
- ধরিত্রীর নিকট প্রেমের চিঠি-৩ / ধরিত্রীমায়ের বুকে কোমলভাবে হাঁটা || তিক নাত হান || ভাষান্তর : জয়দেব কর - October 14, 2025
- ধরিত্রীর নিকট প্রেমের চিঠি-২ / তোমার বিস্ময়, সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতা || তিক নাত হান || ভাষান্তর : জয়দেব কর - October 9, 2025

COMMENTS