মেলার আলো নিভে গ্যালো বইয়ের ব্যবসা ভোলো

মেলার আলো নিভে গ্যালো বইয়ের ব্যবসা ভোলো

বছর কয়েক আগে একটা কমন্ প্রবণতা বাংলাদেশে দেখা যাইত দৈনিক সংবাদপত্রের সাহিত্যসাময়িকীগুলোর মধ্যে। মেলান্তের বইরিভিয়্যু। প্রতি বছর বইমেলা সাঙ্গ হলে পরে এই নিউজপেপারওয়ালারা নানাভাবে তাদের পছন্দছকের লেখক-বিনোদকদের লেখা বই আলোচনা করানোর ব্যবস্থা করে এসেছে বেশ কয়েক বছর নিষ্ঠার সঙ্গে। আলোচনা বলতে চিলতে-কলামে ‘ভালো হয়েছে… ওইটা হলে আরো ভালো হতো…’ ইত্যাদি ইয়ার্কিমার্কা কথাবার্তা। সাধু উদ্যোগ, সন্দেহ নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এরা নির্বাচন করে এসেছে এমন-সমস্ত লেখক ও বই, যা দেখে হতাশায় হামেশাই নিভে যেতে হয়েছে। যেমন শীর্ষদৈনিক বলে বাজারে স্বঘোষিত একটি সংবাদপত্রিকা আয়োজন করত বইরিভিয়্যু দুই কিস্তিতে। এদের উপস্থাপন বেশ স্মার্ট। সৃজনশীল আর মননশীল, এহেন দুই ক্যাটাগোরিতে ভাগকৃত দশ-দশ বিশটি বই এরা ফি-বছর পাঠকসমাজে প্রেসক্রাইব করে এসেছে একটানা : নির্বাচিত ১০ সৃজনশীল বই, নির্বাচিত ১০ মননশীল বই — এই কিসিমে। খটকা লাগে একটুখানি, পাঠককে বলে দেয়া হচ্ছে যে এইটা হয় ‘সৃজনশীল’ আর ওইটা ‘মননশীল’! বলা হচ্ছে বুঝি-বা, পাঠকপাঁঠা! আপনার বাছবিচারের ওপর ভরসা করে আমরা ভাই ঘুমাইতে পারি না। তাই তো বলেই দিনু উহা হয় সত্যিকার ‘সৃজন’, আর ওই হোথা আসিতেছে কেশাগ্র-ও-মর্মছিঁড়া ‘মনন’! আপনে তো কাঁঠালপাতা আর কদলিপাতায় ভেদ রাখেন না মিঞা! যা-হোক, পাঠকসেবায় এহেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছেন এরা যে, হেন বইরিভিয়্যুমোচ্ছব সর্বত্র অনুসৃত হলে আর রক্ষে থাকত না। আনিস-ইদ্রিস-মদ্রিস, নমস্য ও নন্দগোপাল প্রমুখ, অমুক-তমুকের বেরোনো বালখিল্য বইগুলো বছরারম্ভেই নির্বাচিত দশাঙ্কের মধ্যে মেরিট লিস্টে একাধারে শ্রেয়তম ছয়টা জায়গা বাহুমূলদাবা করে নেয়াটা কি তিনটেখানি কথা! বাছাইপ্রক্রিয়া কী আর বাছাইকারক সেই সোনার-চান পিৎলাঘুঘু মহোদয়গণ কারা, জানবারও উদ্যম হয় না আর।

সার্কাসটা আয়োজিত হয় না আজকাল আর? মনে হয় স্তিমিত হয়েছে ব্যাপারটা যে-কোনো কারণেই হোক। অথবা আমিও বহুদিন লাইনে নাই বিধায় খেয়ালনজর করা হয় না ফ্রাইডেগুলো। জুম্মাবারেই লিটারেরি কাল্ট সাপ্লিমেন্টগুলো তরিতরকারির পাশে বাজারে ভোরবেলায় স্তূপাকার হয়ে খদ্দেরের পাঞ্জাবিখুঁট ধরে টানাটানি করে। লাইফের নানান পয়মালিতে পর্যুদস্ত হয়ে, বেহদ্দ শয়তানিতে ব্যস্তধস্ত হয়ে জীবন ও জীবিকাশাসনে, একদা সাহিত্যসন্ধিৎসু মনের মরণ ঘনিয়েছে একদশক গত হয়ে এসেছে প্রায়। লিটারেরি সাপ্লিমেন্টগুলোর ইভেন্ট ও অ্যাক্টিভিটিজ্ ঠিকই হয়তো পূর্ববৎ সংঘটিত হয়, কেবল আমিই দৃষ্টি দিতে পারি না। তারপরও মনে হয় হিড়িকটা আগের মতো অতটা বেগবান নাই। হিড়িকে এবং হুজুগে হিশেবে নামদার এই জাতির ক্ষেত্রে এইটা আদৌ অস্বাভাবিকও নয় নিশ্চয়। ইদানীং অন্য হুজুগ, অন্য হিড়িক, অন্য ওজারতি। আমরা যদিও ওজারতি নয়, এই নিবন্ধে অন্তত, তেজারতির খবরান্তর নিতে চেষ্টা করছি।

রিসেন্ট টেন্ডেন্সি নির্বাচিত অনলাইন মোচ্ছবের দিকেই দৃষ্ট। ঘটনাটা আদৌ মন্দ না। হাজারে-হাজার কাতারে-কাতার কবিসাহিত্যিকের নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে এই নির্বিচারী ইলেকশন্ প্রক্রিয়ায়। বেশুমার বাদশা, হাজার উজির, তামিশকির উধাও হয়েছে। ডেমোক্র্যাসির নজির হিশেবে এইটা আনন্দপ্রদ। তবে এইখানেও ওই শীর্ষ-ঘোষণাকারী নিউজপেপারের বদখাসলতের অনুসৃতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কোথাও-কোথাও। বই নিয়া নির্বাচন কমিশন বসানোর ঠুনকো সংঘতন্ত্র।

‘বইমেলা শ্যাষ’ — বন্ধুটির বিরস বদনে এই দীর্ঘশ্বাস শুনে কেঁপে ওঠে দেহতরী আমার। শুধু আমারই নয়, ফ্রেন্ডের ক্রাই শুনে ঈশ্বরের আরশ টলে ওঠার মতো পরিস্থিতি ক্রিয়েট হয়েছিল বিলিভ মি অর নট। বারবার হিক্কা উঠছিল তার, আর কান্নার ফোকর গলিয়ে কেবল প্রাণের মেলা … প্রাণের মেলা … ছাড়াছাড়াভাবে এইটুকু ধ্বনি ডিকোড করা যাচ্ছিল। বন্ধুকে প্রাণে বাঁচাইতে যেয়ে একটা বাজারী জ্যুস্ বুদ্ধি করে এনে একঢোঁক পিয়াইতেই সে ভোমিটিং দিয়া ভাসাইয়া দ্যায় দেশকাল। পরে এক-সময় একটু ধাতস্থ হলে পরে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে যা বুঝতে পারি তাতে আক্কেল বোমার ন্যায় ব্লাস্ট করে আমার। উল্লেখ্য, বন্ধুটি লিখিয়ে সংঘের সভ্য এবং অদ্যাবধি বিভিন্ন নামের গ্রন্থ প্রসব করেছে এগারো/বারোটা। তার কাছ থেকে আমি বইবিজনেসের যেসব তথ্য পাই তাতে অর্থশাস্ত্র না-পড়েও সম্যক বুঝতে পারি বিরাট একটা আর্থিক ক্ষতি একদল লোক মহাকালের রিটার্নের আশায় চেয়ে থেকে মেনে নিচ্ছে মুখ বুঁজে। ‘কেন, তোর বই বিক্রি হয় নাই?’ বিয়াল্লিশটা আইটেম সে নিজের হাতে বেচেছে, বন্ধুটি আমার প্রশ্নোত্তরে জানায়। এই ইতিহাসঘটিত পয়লাবারের মতো অধিকতর অধিবর্ষকালীন (তরুণ-বৃদ্ধ সর্বপ্রকার কবিদের ‘প্রিয় কবি’ হাবীবুল্লা সিরাজীর বইকৃপাবশত দুইদিনের এক্সট্রা টাইমের ক্যাল্কুলেশনে) ফেব্রুয়ারিতে এইটা ব্যবসা হিশেবে ভালো না খারাপ তা ঠাহর করতে পারি না যদিও। প্রকাশক বাকি এগারো মাসে অ্যাট-লিস্ট বিয়াল্লিশ ইন্টু এগারো তো বেচতে পারবেই। কিন্তু বন্ধু জানায়, শালার পাব্লিশাররা একটা বইও বাজারে নিয়ে যেতে পারে না। শালারা বাজারই চিনে না। শালারা খালি জন্মায় আর মরে আর লেখকদেরে ঠকায়। খালি মেলায় লেখকের টাকায় চিপা স্টলে পসরা সাজায় আর পিকচার খিঁচায় আর টিভিতে টকশো মারে আর এখানে-ওখানে নানাবাহারী ইন্টার্ভিয়্যু দৌড়ায়। আগামী মেলার আগে শালার শালাদের আর কোনো অ্যাক্টিভিটিই দেখা যাবে না।

আমি বিলকুল ধাঁধায় পড়ে যাই ব্যাপারটা ভেবে। একনাম্বার ধাঁধা, বন্ধুটি কাঁদছিল কেন? সারাবছর কেন মেলা থাকে না বহাল, এই দুঃখে? নাকি পাব্লিশারের পুংটামি দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে? সেকেন্ড ধাঁধা, আল্লার দুনিয়ায় চাহিদা আর যোগান হাত-ধরাধরি করে চলে বলেই জানি; আরও জানি যে, উৎপাদন মাত্রেই ভোক্তা খুঁজে নেয়; এবং ভোক্তা নিশ্চিত করে মুনাফা। খালি বইয়ের বিজনেসে এর ব্যত্যয় হবে কেন? বন্ধুকে ত্যক্ত না-করে নিজেই চিন্তা করতে বসি এবং বসে একটা আন্দাজ পাই। কিন্তু আন্দাজের বর্ণনা আজ নয়।

ফ্রেন্ডের ক্রাই ততক্ষণে থিতিয়ে এলেও ফোঁপানি তখনও চলছিল সবিরতি। ওরে শান্ত করতে শেষে একটা গান বাজাইতে শুরু করি মিডিয়াপ্লেয়ার ছেড়ে। “দিনের আলো নিভে গেল / রঙের দোকান তোলো / ও বেলা গেল / এইবার তোমার আপন দেশে চলো” — ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে এইটা মাকসুদ গেয়েছিলেন দুর্দান্ত। “ভবের হাটে দোকান দিয়ে করলি বেচাকেনা / লাভ হইল না হইল কেবল আসলেতে দেনা” — গানটা মাকসুদ তথা ফিডব্যাক   কর্তৃক নবকম্পোজিশন্ হয়েছিল, যদিও রসিক বাউলের গান এইটা। অ্যাক্নোলেজ্ করা আছে রিটেন্ টেক্সটের সঙ্গে। এবং গোটা গানের অন্তিম স্তবকে ভনিতাপদ তো রয়েছেই। “রসিক বলে হিসাব দিবার নেই তো কিছু আর / সার কেবল সেই গুরুর চরণ ধরো গিয়ে তার” — হরিনাকুণ্ডের বাউলদের কাছ থেকে এই গান ফিডব্যাক   তথা ম্যাক গলায় নিয়েছিল তুলে। এই গান শুনছিল বন্ধুটি তন্ময় হয়ে, আর তার নয়নস্রোতা পানিতে ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। আবার কান্না কেন বাছা? প্রাণের মেলা সাঙ্গ হবার শোকে, নাকি ফিডব্যাকের গানের ঠ্যালায়, ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you