বাঁশি || সুমনকুমার দাশ

বাঁশি || সুমনকুমার দাশ

[ছিলেন দুঁদে এক ডিপ্লোম্যাট, কুরুক্ষেত্র সংঘটনকালে এবং এর আগে-পরে, পোলিটিক্স বুঝতেন ভালো। কৌরব-পাণ্ডব উভয়কূলেই তিনি ফিলোসোফারের ভূমিকায় অ্যাক্ট করেছেন। রয়েছে এর বাইরে এন্তার বিচিত্র ভূমিকা তার। ড্রাইভ করতেন দারুণ। ড্রিঙ্ক করতেন কি না আপাতত অমূলক কোয়েশ্চন। কুরুক্ষেত্রের ব্যাটলফিল্ডে অর্জুনের রথচালকের কাজটা দায়িত্ব নিয়েই করেছেন তিনি। বিশেষ একটা স্টাইলে ড্যান্সম্যুভসমেত চলাফেরা করতেন। কস্টিউমসেন্স ছিল অসাধারণ। রমণীমোহন মুচকি স্মাইলের জন্য জগদ্বিখ্যাত। অত্যন্ত সপ্রতিভ। তবে টেলিভিশনের টকশোগুলো যথাসম্ভব এড়ায়ে চলতেন সবসময়। জেনানাদের সামনে যেন উৎসমুখবিস্ফারিত কথার ফোয়ারা। নারীদের একচেটিয়া আদর-সোহাগ লভেছেন জিন্দেগিভর। পুরুষদেরও। সম ছিলেন, নাকি উভ, সন্দেহ রইলেও ষোলশত মতান্তরে ষোলোসহস্রাধিক বান্ধবী ছিল তার শোনা যায়। ডন জিয়োভ্যানির চেয়েও ক্ষমতাধর ছিলেন সিডিউসিং স্কিলের দিক থেকে। এসবের পেছনে পাপারাৎসিদের কারসাজিও থাকতে পারে বলে তথ্যসূত্রসচেতন মহলের অনেকেই মনে করেন।

তবে যে-ব্যাপারে সন্দেহ নাই তা এ-ই যে তিনি বাঁশি বাজাইতেন। উদান নাই মাদান নাই দিবারাত্র টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স সুরের ঘোরে মত্ত রইতেন। গোচারণপ্রান্তরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াইতেন। দুইফরবেলায় গাঙপারে যেয়ে একটা-কোনো গাছের ডাল বেছে নিয়ে উঠে পড়তেন এবং গভীর মনোযোগে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। ফিগ্যারেটিভ স্টাডি নিয়াই দিনরাইত ব্যস্ত রইতেন। মোটামুটি কৃতি শিক্ষার্থীই ছিলেন বলা যায়। লাম্-সাম্ ক্যাল্কুলেশনেও গোপিনীর/কুঞ্জবালাদের কোয়ান্টিটি থেকে উনার অর্জন-অ্যাচিভমেন্ট সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যায়। কামেল আদমি ছিলেন। গোসলকালে ফিমেইল ড্রেসেস্ এবং এক্সেস্যরিস্ হাতাইতে যেয়ে বহুবার হাতেনাতে ধৃত হয়েছেন। বখে যেতে যেতে নারীদেরই নিত্য প্রযতনে ফের ভালো হয়ে উঠেছেন। লভেছেন লর্ডের খ্যাতি।

তিনি কৃষ্ণ। বসুদেব এবং দেবকীর অষ্টম সন্তান। নন্দ নামেই ছিলেন মশহুর ছেলেবেলায়। ডাকনাম আছে আরও কয়েকটা। মায়ের ন্যাওটা ডানপিটে ননীচোর। চুরির অভ্যাসটা যায় নাই জিন্দেগির ইয়া লাম্বা সফরেও। চুরি করেছেন বহু কুমারী ও ভার্যার মন। চুরি করে চলেছেন আজও। শৈশব-কৈশোর কেটেছে বৃন্দাবনে। এরপর গোকুলে, দ্বারকায়; এখন তো উনার শানশওকাত অনেক, ব্যাপক, দুনিয়ার বহু দেশে রয়েছে উনার বিলাসবহুল প্যালেস্। যুদ্ধজঙ্গের নৈতিকতা নিয়া আলাপচক্রে উনার পাঠক্রম স্কিপ্ করার উপায় নাই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি স্মৃত হন তিনি বিপন্ন প্রণয়িনী ও প্রণয়ার্থীদিগের কাছে, সম্ভবত, পেটরোগা প্রেমিকের বালামুসিবতে তিনি স্মৃত হয়ে চলেছেন যুগে যুগে বৈদ্যুতিক পাখার মতো পুনঃপুনঃ ঘূর্ণনে।

এই ভদ্রলোকের জন্মদিন আজকে। হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার কৃষ্ণ! হ্যাপি বার্থডে টু য়্যু! গোপবালাদের গুঞ্জরনে আজি বৃন্দাবন মধুমুখরিত। ননী, মাখন, ছানা, আমৃত্তি, জিলিপি, ফির্নি, বাতাসা, পায়েস ইত্যাদি জিভরোচক খাবারে উপচে-ওঠা ডাইনিং স্পেস্। চন্দনে আর আতর-গোলাপে মৌ-মৌ কুঞ্জও প্রস্তুত। জন্মাষ্টমী বলে কথা। বাকিটা ঠাকুরের মর্জি।

কৃষ্ণের জন্মদিনে একটা নাতিদীর্ঘ রচনা দিয়া আমরা গানপার থেকে সেলেব্রেইট করতে চেয়েছি। রচনাটা লিখেছেন সুমনকুমার দাশ। প্রথম প্রকাশ নয়, এইটা ছাপা হয়েছিল ‘লোকবাদ্যযন্ত্র মেলা ১৪১৬’ উৎসবস্মারকে খ্রিস্টাব্দ ২০১০ মার্চে সিলেট থেকে। সেই স্মারকপুস্তক সম্পাদনা করেছিলেন বিমান তালুকদার। পয়লা ছাপায় এর শীর্ষক ছিল ‘বাঁশি : নারীর চিরবিরহের প্রতীক’; নয়া ছাপার কালে এর নামটা কৃষ্ণপ্রতিভার একটি বিশেষ দিকের সম্মানে কেটেছেঁটে ছোট করে নেয়া হলো। রচয়িতা তাতে তেমন আপত্তিও করেন নাই। নিশ্চয় রচনাটা ভালো লাগবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের।

বলা হয়ে থাকে কৃষ্ণের পরিচায়ক প্রধান অস্ত্র ‘সুদর্শন চক্র’। তবে, এইটাও অগ্রাহ্য করবার মতো নয় যে, কেষ্টঠাকুর তথা লর্ড কৃষ্ণের মুখ্য উয়েপ্যন্ বাঁশি। কথিত যুদ্ধাস্ত্র ‘সুদর্শন চক্র’ গরহাজির আজ, যেমন ডাইনোসোরাস্, বাঁশি কিন্তু বিরাজিছে। এবং আশার, অথবা আশঙ্কার, কথা হচ্ছে এ-ই যে বাঁশি বাড়ছে। এই আশঙ্কাটা বাঁশিভীত কন্যাবৎসল পিতামাতাদের, প্রেমের সুরে লেলিহান উনাদিগের উন্মাদ পূর্বজন্ম স্মরণে; আশঙ্কা আমাদের নয়, আশঙ্কা আমাদের নেই, বাঁশিসুরে খেলা করে একটা আবিলতাহীন জগজ্জোড়া আশা।  — গানপার]

krishna

___________________________

বাঁশি

সুমনকুমার দাশ

___________________________

 

“কে যেন নিগূঢ় কাননে / বাঁশি বাজায় মোহন টানে”

এ বাঁশির ধ্বনি শোনার পর ঘরে-থাকা প্রেয়সীর মনের অনুভূতি কী হতে পারে সেটা আপনাআপনিই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে; পরের ঘটনা আর বলে দিতে হয় না, অনুমান করে যে-কেউ নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারেন — “মনপ্রাণ করিল সারা”।

কৃষ্ণবিহনে থাকা রাধার অসহায় অপেক্ষা যখন দীর্ঘতর, তখন বেজে ওঠে বাঁশির পাগল-করা সুর। “কালবাঁশির মোহন সুরে কান্দিতেছে হিয়া”। আর তাই তো এ সুরের আহ্বানে শত বাধানিষেধ উপেক্ষা করে ভরা-কলসির জল মাটিতে ফেলে নদীর ঘাটে ছুটে যান বিরহিনী রাধা।

আহা! বাঁশির কী যাদু! কী মহিমা! “যেন প্রাণ উড়ে যায় বাঁশির গানে”!

শুধু তা-ই নয়, বাঁশির সুর এতই আকর্ষণীয় যে “নিষ্ঠুর বাঁশির রব শুনিয়া / মনপ্রাণ গেল উড়িয়া”। আর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়েই প্রেয়সী “পাগলবেশে কাছে যাইয়া” “সোনার যৌবন” সঁপে দিচ্ছেন। এ-ই কী তাহলে বাঁশির যাদু?

আবার অন্যদিকে বাঁশির সুরজ্বালা তীব্র হওয়ার কারণে তা সহ্য করতে না-পেরে প্রেয়সী বলে ওঠে, “যাও সখিগণ করো জিজ্ঞাসন / নাম ধরিয়া বাঁশি বাজায় কেনে”। এরপরও “নিষেধ মানে না / কালিয়া সোনা / বাজায় বীণা / গহিন বনে”। গহিন বনে একটানা বাঁশি বাজাতেই থাকে। প্রিয়তমের বাজানো উদাস-করা এই বাঁশির সুরে ঘরের প্রেয়সীর মনপ্রাণ পাগল।

“মোহন বাঁশি হাতে করি / রাখালসঙ্গ ধরি / হেলেদুলে কানু চলে”। কিংবা “হাতে বাঁশি মাথে চূড়া / পীত বসন পরা / নয়নে প্রেমের রেখা”। আর এ-রূপের ছটা দেখেই “ব্রজনারী ফিরে চায়”। এরপর “প্রেমে হয় উন্মাদিনী”। এভাবেই শুরু।

প্রেমে মজে যায় ব্রজনারী। রাখালও পাগলপ্রায়। সে দিনরাত বাঁশির সুরে ‘রাধা’ নাম জপতে শুরু করে। আর যায় কোথা! ব্ব্যস, বাঁশির সুর শুনে নদীর ঘাটে দৌড়ে আসে ব্রজনারী। এরপর “কুলবধু কুলমান যায়”। কাঁদতে কাঁদতে ব্রজনারী বলে, “কুলমান ভাসাইয়া জলে / দিব মালা তোমার গলে”।

এ-ই হলো বাঁশি — নারীর চিরবিরহের প্রতীক। বাঁশি নিয়ে লোককবিরা নানা ধরনের কাহিনি সাজিয়েছেন। এদের মাধ্যমে লোকবাদ্যগুলোর মধ্যে গানে-কথায় ‘বাঁশি’ পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এসব লোককবিরা বাঁশির জন্ম-ইতিহাস থেকে শুরু করে প্রিয়তমাবন্দনা ইত্যাদি সবজায়গায় ‘বাঁশি’ শব্দটিকে গানের অনন্য উপকরণ হিশেবে ব্যবহার করেছেন। প্রায় সকল লোককবিই তাদের গানের পরতে পরতে বাঁশির মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। নারীর আবেগ-ভালোবাসা-প্রেম-বিরহে বাঁশি শব্দটি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।

গানঋণ : দুর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিম ও প্রবীর দেবনাথ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you