বাউলগীতিকার শেখ ওয়াহিদুর রহমান || সুমনকুমার দাশ  

বাউলগীতিকার শেখ ওয়াহিদুর রহমান || সুমনকুমার দাশ  

গানটা কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে শুনি — সেটির সঠিক দিনক্ষণ আর মনে নেই। একটা চাপা বেদনা/দুঃখবোধ গানটির প্রতিটি পঙক্তিতে উপলব্ধি করি। কী উচ্চারণ — ‘কত কষ্ট কইরা আমি / কামাই-রোজগার কইরা আনি / তবু বুইড়ার মন পাইলাম না / বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ … গানটির পরতে পরতে যেন এক নারীর বেদনার স্তর জমেছে, সেই নারীর হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত থাকা কষ্টের উচ্চারণই যেন এই গান। গানের মূল চরিত্র আবর্তিত হয়েছে চা-বাগানে খেটে খাওয়া এক নারীশ্রমিককে ঘিরে। সেই নারী দিনমান পরিশ্রম করে সর্বস্ব উপার্জন স্বামীর হাতে তুলে দিয়েও প্রিয়তম স্বামীর ভালোবাসা পাচ্ছেন না। এই হচ্ছে গানটির বিষয়বস্তু।

বাউল-গীতিকার শেখ ওয়াহিদুর রহমানের (১৯৩৯-২০১২) লেখা এ গানটি প্রথমে গেয়েছিলেন শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া। গায়িকার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। বার-তিনেক বিভিন্ন গানের আসরে তাঁর গান শুনেছি। লক্ষ করতাম — গান গাওয়ার সময় সুফিয়ার হালকা-পাতলা শরীর নাড়ানোর দৃশ্যটি বেশ উপভোগ্য। যে চা-কন্যার কষ্টের আর্তি গানটিতে পরিস্ফুট হয়েছে, সুফিয়ার পুষ্টিহীন হাড্ডিসার দৈহিক গড়ন যেন তারই পরিচয় বহন করে। গীতিকার শেখ ওয়াহিদুর রহমানের গানের মুখ্য চরিত্রটিই মনে হয় তাঁকে। তবে সুফিয়ার গাওয়ার ভঙ্গিতে মোটেই সে-রকম কষ্টবোধের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি ও খোলা চুলের দৃষ্টিনন্দন দোলানোটুকু গানটির প্রকৃত অর্থের বিচ্যুতি ঘটায়।

এটা ঠিক যে — সুফিয়ার সেই অভিনবত্ব শুধু দর্শক/শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কৃত্রিমভাবে উপস্থাপিত। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় সুফিয়ার ভেতরের কষ্টটুকু। সেটাও গানের সেই চা-কন্যার চেয়ে নেহাত কম নয়। অর্থসঙ্কট ও দারিদ্র্য তাঁর চোখে-মুখে পরিস্ফুট। অনেক পরে ২০০৯ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। তারিখটি আর মনে নেই। সেদিন বিকেলে সিলেট অডিটোরিয়ামে (বর্তমান নাম কবি নজরুল অডিটোরিয়াম) শেখ ওয়াহিদ গীতিসমগ্র-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান ছিল।

সে-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন সংগীতজ্ঞ মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, স্থপতি শাকুর মজিদ, শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়া সহ অনেকেই। প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজক মোস্তফা সেলিমের অনুরোধে দুপুরের দিকে ঢাকা থেকে আগত অতিথিরা যেখানে অস্থায়ী আবাসন গেড়েছেন সেখানে হাজির হই। অনুষ্ঠানের আগপর্যন্ত জম্পেশ আড্ডা হয়। সে-আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন বইটির লেখক গীতিকার শেখ ওয়াহিদুর রহমান।

সেদিন শেখ ওয়াহিদুর রহমানের রসজ্ঞান দেখে আমি মুগ্ধ না-হয়ে পারলাম না। নিজের গান সম্পর্কে তাঁর উচ্চধারণা দেখে আমি শুরুতেই একটু ভিরমি খেলাম। এ আবার কেমন কথা? লেখক নিজেই বলছেন কি-না — ‘আমার গান একদিন ইতিহাস অই থাকব’। পরে, আলাপ যখন আরও জমে ওঠে, তখন বুঝতে পারি — এসব কথা আসলে কোনও অহংবোধ থেকে নয়, এটি নিতান্তই তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা।

সেদিনই প্রথম সামনাসামনি আলাপ/পরিচয় হয় কাঙালিনী সুফিয়ার সঙ্গে। শুরুতেই তাঁকে বলি — ‘আপনার গান বিভিন্ন আসরে শুনেছি। এখন সরাসরি পরিচিত হয়ে ভালো লাগছে।’ তিনি আমার কথা শুনে মুচকি হেসে মাথা দুলালেন। আমি বলি, ‘বুড়ি হইলাম তোর কারণে’ গানটি যখন আপনি গেয়ে থাকেন, তখন খেয়াল করলাম আপনার চোখেমুখে এক-ধরনের প্রশান্তি ভর করে, কিন্তু কেন? এ গানটি তো দুঃখের গান, বেদনার গান!

আমার কথা শুনে কাঙালিনী সুফিয়া আবারও মুচকি হাসেন। আমি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। তিনি কোনও জবাব দেন না। কিছুক্ষণ পর লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তাঁর এই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই আমার উত্তর পেয়ে যাই। এ-সময় শেখ ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ‘এই গানটা বোধহয় আমি কাঙালিনীর জন্যই লিখেছিলাম। এ গানটি যখন সুফিয়া গায়, তখন সে শিল্পী হিসেবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। সেই সঙ্গে এ গানের গীতিকারও।’

কথার মোড় একটু ঘুরিয়ে দিই। জানতে চাই, ‘মাটির গাছে লাউ ধইরাছে’ গানটি প্রসঙ্গে। এবার যেন একটু খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন কাঙালিনী সুফিয়া। আমাকে অবাক করে দিয়ে জোর কণ্ঠে টান দেন গানটিতে। তিনি গাইতে থাকেন :

আমার মাটির গাছে লাউ ধইরাছে
লাউ যে বড়ো সোহাগী
আমার লাউয়ের পিছে লাগছে বৈরাগী।।

আঁচল দিয়ে ঢাইকা রাখি
চোরে নেওয়ার ডরে
কেমন কইরা পড়লো সে লাউ
বৈরাগীর নজরে
ও সে হরণ কইরা নিতে চায় লাউ
বানাইতে তার ডুগডুগি।।

বৈরাগীকে বললাম আমি
কূলের মুখে দিস না কালি
ও তার হাতে লোটা মাথায় জটা
কপালে তিলকের ফোটা
গাওগেরামে ঘুরে বেটা
সাজিয়ে ব্রম্মচারী ব্রম্মচারী।।

এই লাউয়ে হয় না একতারা
ও মন হয় না দোতারা
দুই তারে এক সুর ধরিলে
হয় রে একতারা
সাধক ওয়াহিদ বলে লাউয়ের জন্যে
কতজন হয় ঘরত্যাগী।।

হঠাৎ করেই যেন আসর জমে উঠেছে। আশপাশের কক্ষের সবাই একজায়গায় জড়ো হচ্ছেন। কাঙালিনী সুফিয়া এবার দাঁড়ালেন। ঠিক একই ভঙ্গি, যেমনটা প্রায়শই মঞ্চে দেখা যায়। ডান হাত উপরে তুলে নৃত্যরত ভঙ্গিতে টান দিলেন বহুল প্রচলিত সেই গানে :

কত কষ্ট কইরা আমি
কামাই-রোজগার কইরা আনি
তবু বুইড়ার মন পাইলাম না রে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।।

কোদালে কাটিয়া মাটি
হাতুড় দিয়া পাথর ভাঙি
তবু দুঃখ গেল না রে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।।

চা-বাগানে একলা জীবন
মর্মব্যথা দেয় যে কেবল
পিঠে রেখে বাঁশের ঝুড়ি
সবুজ চায়ের ভাঙি কুড়ি রে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।।

ভেবে সাধক ওয়াহিদ বলে
পাতার বাহার দেখে দেখে
ছড়ায় নালায় গোসল করে
কত নারীর জীবন গেল রে
বুড়ি হইলাম তোর কারণে।।

এ-রকম বেশ কতগুলো জনপ্রিয় আঞ্চলিক ও বিচ্ছেদী পর্যায়ের গান শেখ ওয়াহিদুর রহমান লিখেছেন। একজন শিল্পপতি হয়েও গানের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অপরিসীম। আমৃত্যু গানকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা বলে মনে করেছেন। আক্ষরিক অর্থে আমরা যাঁদের বাউল বলে থাকি, সেভাবে হয়তো ওয়াহিদুর রহমানকে পর্যায়ভুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে তাঁর বাউলাঙ্গিকের বেশ গান রয়েছে, যেগুলোতে বাউলতত্ত্বের নিগূঢ় বিষয়গুলোই পরিস্ফুট হয়েছে। সে-অর্থে তাঁকে একজন যথার্থ বাউলগীতিকার বলাটাই বোধহয় যুতসই হবে।

২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর যখন শেখ ওয়াহিদুর রহমানের মৃত্যুর খবর শুনি, বেশ খারাপ লাগে। তাঁর রচনাসংগ্রহটি বারংবার নেড়েচেড়ে দেখি। ধীরে ধীরে পাতা উল্টাই। বইটিতে তারিখবিহীন একটা অটোগ্রাফ চোখে পড়ে। এতে আমাকে উপহারস্বরূপ দেওয়া তাঁর স্বাক্ষরটিতে হাত বুলাই। গানগুলো পড়ার চেষ্টা করি। পড়তে পড়তে চমকে উঠি। অসাধারণ কিছু গান রয়েছে এই বইয়ে। কতশত অখ্যাত-অমেধাবীদের নিয়ে হাজারো লেখা পত্রপত্রিকায় চোখে পড়েছে, কিন্তু তাঁর গানের মূল্যায়ন করে কাউকে কোনওদিন লিখতে দেখিনি। সত্য বলতে দ্বিধা নেই, খোদ আমিই ভাবতাম — শেখ ওয়াহিদুর রহমান একজন শিল্পপতি মানুষ, অঢেল টাকাপয়সার মালিক। বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে শিল্পী পুষছেন, দৃষ্টিনন্দন বই প্রকাশ করছেন — তাঁকে নিয়ে লেখার কী আছে? কিন্তু এখন বুঝতে পারি — এ ধারণা মোটেই ঠিক ছিল না। শেখ ওয়াহিদুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর গানগুলো ভালোভাবে পড়তে গিয়ে আমার এতদিনকার চেনাজানা উপলব্ধি অনেকটাই পালটে যায়। তাঁর রচনা পাঠে গানপাগল এক আউলা মানুষের সন্ধান পাই।

অবাক হই ‘বাঁক চিনিয়া নাওখানি বাইও রে মাঝিভাই’ গানটি পাঠ করতে গিয়ে। বাউলসাধনাকেন্দ্রিক রীতিনীতির নিগূঢ় তত্ত্ব ধারণ করে রয়েছে পুরো গানটির পঙক্তিতে। শেখ ওয়াহিদুর রহমান ‘বস্তুনিয়ন্ত্রণ’-এর কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন :

বাঁক চিনিয়া নাওখানি বাইও রে মাঝিভাই
বাঁক চিনিয়া নাওখানি বাইও

এক দারিয়া নৌকাখানি
দুই দাঁড়ে দাঁড় বাইও
ওরে তিন দাঁড়াতে বাইলে নাও
তক্তা ছুটবে চাইও রে মাঝিভাই।।

থুরা থুরা খাইও মাঝি
একপ্রহর ঘুমাইও
ওরে দুইপ্রহর জাগিয়া তুমি
নৌকার দিকে চাইও রে মাঝিভাই।।

আদি হতে ডুবলো নৌকা
হিসাব না মিলিলো
ওরে ওয়াহিদ বলে ডুবলে নৌকা
আর না ভাসিব রে মাঝিভাই।।

এ-রকম বাউলতত্ত্বনির্ভর অসংখ্য গান তিনি রচনা করেছেন। তাঁর বেশকিছু দেহতত্ত্বকেন্দ্রিক গানও রয়েছে, সেসব গানে দেহের নানা গূঢ়তত্ত্বগুলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বিধৃত করেছেন। এছাড়া মানুষবন্দনা বাউল-দর্শনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তিনি অপরাপর বাউলদের মতোই বিশ্বাস করেন, মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা বিরাজ করছে, তাই মানুষের সেবা করতে পারলেই সৃষ্টিকর্তার সেবা হয়ে থাকে। এ-সম্পর্কিত তাঁর রচিত অসংখ্য গান রয়েছে। যেমন :

আদমকে বানাইয়া খোদা
লুকাইয়াছো তার ভিতর
কি নামে ডাকিব তোমায়
ভাবছি রে তাই জীবন ভর।।

বিশ্বরূপে ঢুকছো ওরে
রইয়াছো সবার ভিতরে
লক্ষ-কোটি আকার ধরে
নাম ধরেছো নিরাকার।।

পাপ করো না বলছে শুনি
মোল্লা-মুনশি-পাদ্রী-জ্ঞানী
আমি কি আর একা করি
তুমি কি নও সাথে মোর।।

শেষবিচারে হাকিম পাবে
হুকুম দিবে পাপীদেরে
মিটাইতে তোর কাম-কামনা
আমায় করবে ব্যবহার।।

ওয়াহিদ বলে চিন্তা করে
অরূপেতে স্বরূপ ধরে
আমার রূপে থেকে তুমি
নাম লাগাইছো নিরাকার।।

শেখ ওয়াহিদুর রহমান সরাসরি বলছেন, মানুষকে খোদা বানিয়ে তার মধ্যে ঈশ্বর বিরাজিত রয়েছেন। একইভাবে তিনি বলছেন — ‘আমার রূপে আলেক সাঁই গো / তোমার নামে দিন কাটাই / তুমি হইলা ফুলের মালি / তুমি গেলে আমি নাই’ … তিনি এও বলছেন, আগে নিজেকে চিনতে হবে, তা না-হলে স্রষ্টাকে চেনা সম্ভব হবে না। তাই তাঁর উক্তি :

আমিত্বকে চিনতে গেলে
চিনো পাক পাঞ্জাতন রে
তোমার মাঝে আছেন যিনি
তিনিই স্রষ্টা নিরঞ্জন রে।।

পাপ-পুণ্যের মালিক তিনি
আমার দেহের মালিক যিনি
তাহার অর্থ জানতে গেলে
গুরু ভজন করো ওরে।।

সাধক ওয়াহিদ তত্ত্ব লেখে
তিনশত তরিকা দেখে
মারফতেরই প্যাঁচে পড়লে
শরিয়ত কি টিকে রয় রে।।

কিংবা বাউলমত গ্রহণ করার জন্য একজন শিষ্যকে কী করা উচিত, তাও ওয়াহিদ জানাচ্ছেন — ‘গুরু ভজন করো আগে / মিশবে যদি বাউলদলে / বাউল হইতে কয়জন পারে / এই না সাধের সংসারে।। / পঞ্চরসে যে-জন মাখা / তারেই সবে বাউল বলে / রুহে কামাল, নূরে জামাল / যার অন্তরে বিরাজ করে।। / […] / ভেবে সাধক ওয়াহিদ বলে / নিজেকে নিজে চিনতে পারলে / তোমার মাঝে সাঁই নিরাঞ্জন / দেখো না চেয়ে অন্তরপুরে।।’ … দেখা যাচ্ছে, প্রতিবারই তিনি নিজের ভেতরের সত্তাকে চেনার আহ্বান করছেন। যেমন — ‘নিজের ঘরে মসজিদ রেখে / চিনলি না মন তাহারে / কাশি-মক্কা ধাক্কা খেয়ে / ফিরবে রে মন নিজ ঘরে।।’ … কিংবা — ‘নিজকে নিজে চিনলে পরে / পরমাত্মা চিনা যায় রে / তোরার মাণিক বুকে রেখে / খুঁজছো কারে অবিরল।।’ … আর ভেতরের এই মানুষের অনুসন্ধান করার সূত্র কেবল মুর্শিদই দিতে পারেন। তাই শেখ ওয়াহিদ বলছেন :

মুর্শিদ কইয়া দেও আমারে
মানুষের ভিতরে মানুষ
ঢুকল কেমন করে
মুর্শিদ কইয়া দেও আমারে।।

মুর্শিদ ও
খুঁজিয়া পাইলাম না
তাহার কোনও বিবরণ
জন্ম নিলে মরে কেন
কিসেরই কারণ
পোড়া দেহ কেমন করে
যোগাড় করবে তারে।।

মুর্শিদ ও
শয়তান যদি ভিতরে ঢোকে
আল্লা কোথায় রয়
ডিমের ভিতর বাচ্চা মরে
কেমনে পরান যায়
হাদিসেতে লেখা আছে
বলতে পারবে না রে।।

মুর্শিদ ও
পেরেশানিতে কেন মানুষ
মরণেরই ডরে
আমারই আমিত্ব মুর্শিদ
কার হাতের উপরে
বিশ্বাসে নিশ্বাসে ওয়াহিদ
মাতাল রইল রে।।

মুর্শিদ যেমন মানুষের ভেতরের সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দেন, তেমনি দেহতত্ত্বের নিগূঢ়াদি সম্পর্কেও ধারণা দেন। সেই সুস্পষ্ট ধারণার অভিজ্ঞতা থেকে ওয়াহিদের উচ্চারণ : ‘আউলা ওয়াহিদ বাউলা বলে / তারে তারে তাল মিলেছে / যাহা বলাও তাহাই বলে / ঝঙ্কার থাকে যতক্ষণ।। / নিচের তারে দিলে নাড়া / উপরের তারে দেয় রে সাড়া / তারে তারে সুর ধরিলে / বাদক হয় যে পেরেশান।। / প্রেমিক দেয় তার রস মিশাইয়া / নদীর তীরে যায় ভাসিয়া / অষ্টধাতুর মিশামিশি / তারে বলে প্রেমরতন।। / পঞ্চভূতে আছেন বিধি / আমি কেবল প্রতিনিধি / তোমায় কাঁধে লইয়া ওয়াহিদ / করছে কেবল বিচরণ।।’

দেহতত্ত্ব সম্পর্কে যেমন বাউলদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক, তেমনি নারীদেহসাধনার ক্ষেত্রেও বাউলসাধনার রীতিনীতি সম্পর্কে প্রাজ্ঞ হওয়া আবশ্যক। তা না-হলে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। যেসব বাউল-ফকিরেরা সাধনতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, তাঁরা প্রকৃত সাধক হয়ে উঠতে পারেন না। বাউলসাধনার বেশকিছু তত্ত্বমূলক গান রচনা করেছেন শেখ ওয়াহিদুর রহমান। এর একটি হচ্ছে :

ও ভাই জালুয়া রে
নদীতে জোয়ার আসে যখন
পানি লাল-কালা হয় সবুজ বরন
তখন তোমার জাল আর ফেলো না রে।।

নদীর দিকে নিরিখ রেখে
ভাটায় নদী টান মারিলে
হাঙ্গর-কুমির মিলবে জালে রে।।

সেই নদীরই এমনি ধারা
হিন্দুলাতে যায় ঘুরিয়া
সাবধানে জাল ফেলতে হবে রে।।

সেই নদীরই বাঁকে বাঁকে
ঝাঝরা কাটা কতই থাকে
সাত কাছিমে যুদ্ধ করে রে।।

ভেবে সাধক ওয়াহিদ বলে
উতাল নদী শান্ত হলে
বোয়াল কাতলা উঠবে জালে রে।।

উপর্যুক্ত গানে নারীর রজঃস্রাবের তিন দিনের কথা গীতিকার উল্লেখ করেছেন। তিনি সেই নদীরূপী নারীর শরীর অন্বেষণে ‘সাবধানে জাল ফেলা’-র আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ সামান্য অসাবধান হলেও ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’ সম্ভব হবে না। একই বিষয় নিয়ে তাঁর আরেকটি গান এ-রকম :

তিন মিলিয়া এক হইলে
চলে সাধুর কারখানা
লক্ষ-কোটি বিকটেরিয়া
করে গো আনাগোনা।।

প্রেমিকের মন খুশি করো
দেওনা তারে সান্ত্বনা
এক হইলে দুইজনের মন
থাকে না আর যন্ত্রণা।।

নদীতে জোয়ার আসলে পরে
ঢেউয়ে রেণু বাহির করে
সেই-না রেণু ঘুরতে ঘুরতে
পায় যে তার জীবনখানা।।

কামনদীর ওই লোনা পানি
পান করিল ঋষি-মুনি
ওয়াহিদ বলে সে-জল খেয়ে
মিটাও মন কামবাসনা।।

এসব সাধনতত্ত্বের গান যে-ব্যক্তি লিখেছেন, তিনি কখনওই জীবনাচরণে বাউলধারার ব্যক্তি ছিলেন না। তবে এটা ঠিক যে, শেখ ওয়াহিদুর রহমান নিজেকে সবসময় ‘আউলা-বাউলা’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। সংসার ছেড়ে শুধু বাউলধারায় সময় ব্যয় করেননি। শিল্পপতি হওয়ার সুবাদে জীবদ্দশায় তাঁকে বিভিন্ন সভা-সেমিনার-বোর্ডমিটিঙে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হতো। তবে সেটা যে তাঁকে মোটেই আকৃষ্ট করত না — সেটাও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা ভালোভাবেই জানতেন। তিনি বাউল না-হলেও বাউলগানে তাঁর প্রচণ্ড প্রভাবের কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় আমাদের নেই।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you