চব্বিশ বছর আগের কথা। পৌষের পয়লা রাত। আকাশে ধোঁয়ার মতো কুয়াশা, ঝিরঝির করে টুপটাপ শিশির পড়ছিল। ঠিক শিশির নয়, যেন বৃষ্টির ফোঁটা। বরফের মতো ঠাণ্ডা ছিল সেই শিশিরবৃষ্টি। সেদিনের বরফ-ঠাণ্ডা শীত উপেক্ষা করে আমাদের গ্রামের বাড়ির সুবিশাল শামিয়ানা টানানো উঠোনে পাতা খড়ের গাদায় বসে অন্য অনেকের মতো আমিও বাউল গান শুনছিলাম। মঞ্চে জনাপাঁচেক শিষ্য সহ গান গাইছিলেন প্রখ্যাত বাউল-গায়ক ও গীতিকার শাহ আবদুল করিম। লম্বা চুল, সাদা পাঞ্জাবি আর গলায় ডোরাকাটা মাফলার জড়ানো। এখনো সেই দৃশ্য চোখে ভাসে।
বয়সের কারণেই তখন অতশত বুঝি না। তাই গানের কথা নয়, সুরের টানেই গান শুনছিলাম। কী এক বিরহী উচ্চারণ — “আমার বুকে আগুন বন্ধু / তোমার বুকে পানি / দুই দেশে দুইজনার বাস / কে নিবায় আগুনি রে”। সেদিনের সেই সুর আর কথা এখনো কানে বাজে। হুট করেই আজ সেই স্মৃতি মনে ভর করল। এ যেন সেই ক্ষণ। চোখ বন্ধ করে বেসুরোভাবেই আস্ত গানটি আওড়ালাম :
বন্ধু দরদিয়া রে
আমি তোমায় চাই রে বন্ধু
আর আমার দরদি নাই রে॥
না জেনে করেছি কর্ম
দোষ দিব আর কারে
সর্পের গায়ে হাত দিয়াছি
বিষে তনু ঝরে রে
আর আমার দরদি নাই রে॥
আমার বুকে আগুন বন্ধু
তোমার বুকে পানি
দুই দেশে দুইজনার বাস
কে নিবায় আগুনি রে
আর আমার দরদি নাই রে॥
জন্মাবধি কর্মপোড়া
ভাগ্যে না লয় জোড়া
এ করিমরে করবায় নাকি
দেশের বাতাস ছাড়া রে
আর আমার দরদি নাই রে॥
এক এক করে আমার চোখে ভাসতে লাগল শাহ আবদুল করিমের শিষ্য প্রয়াত রোহী ঠাকুর ও আবদুর রহমানের গায়নভঙ্গি। অস্পষ্ট স্মৃতিতে ভাসছে বিশ বছর আগেরকার সেই দৃশ্য। সেদিন ওরা দুইজনও করিমের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন। আরও একজনের কথা খুব মনে পড়ে। তিনি ছিলেন সেই রাতের গানের আসরের মূল ঢোলবাদক। কী লম্বা চুল, সেই চুল দোলানোর ভঙ্গিটুকুও বেশ চমৎকার! একবার ডানে, অন্যবার বামে দুলিয়ে দুলিয়ে ঢোল বাজাচ্ছিলেন তিনি।
অনেক পরে যখন রোহী ঠাকুর আর আবদুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়, তখন জানতে পারি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সুখলাইন গ্রামের ওই আসরে তারা দুজন সারারাত গান গেয়েছিলেন। বয়সে ছোট থাকায় তাদের চেহারা স্পষ্ট মনে না পড়লেও আবছা আবছা সেই রাতের দৃশ্য মনে উঁকি দেয় ঠিকই। কিছু গানের ছড়ানো-ছিটানো পঙক্তি মনে পড়ে। সে-সময়ের বালকমনে প্রভাব ফেলেছিল যে-ঢোলবাদক, প্রথম দেখাতেই তার কথাও তাদের জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কেউই আমাকে সেই ঢোলবাদকের সন্ধান দিতে পারেননি।
সেই রাতের বাউলগানের আসরের স্মৃতির দীর্ঘদিন পর শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে কাজ করার সুবাদে এই বাউল-গীতিকারের রচিত প্রায় পাঁচ শতাধিক গানের সব-কটিই কমবেশি পড়া হয়েছে। তাঁর গানের পঠনপাঠন শেষে আমার ব্যক্তিগত যা অনুভূতি সেটা ভারতের বিশিষ্ট বাউলগবেষক অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর উদ্ধৃতিতেই মিলেছিল যথার্থ :
“মরমি গীতিকার তিনি — বৈরাগ্যপন্থী বাউল নন — জীবনসন্ধ্যায় পারগামী মুমুক্ষু মানুষ নন। তিনি জড়িয়ে রয়েছেন এই পরিবর্তমান দেশকালের ভাগ্য-ভবিতব্য নিয়ে, বর্তমানের শঙ্কা মেখে, আরও বড় চিন্তনের বোঝা নিয়ে। তাই তাকে দেখতে হয়, এমন ভরা দেশ কেমন করে রিক্ত হয়ে গেল মূল্যবোধের বিচারে।”
শুভেন্দু ইমাম সম্পাদিত ‘শাহ আবদুল করিম : পাঠ ও পাঠকৃতি’ বইয়ে অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ‘ভাটি অঞ্চলের গণগীতিকার : শাহ আবদুল করিম’ শিরোনামে মুদ্রিত প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখেছিলেন,
“[…] যাঁর সান্নিধ্যকামনায় এত আয়োজন আর আততি, তাঁকে বলা হচ্ছে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। আশি-উর্ধ্ব এই ভঙ্গুর শরীর নিয়েও এখনো আপোসহীন এক বাউল, এখনো গান লিখে যান সমান তালে, এমনকি এখনো সুর করে গানের কলি আওড়ালে সংলগ্ন পরিবেশ ঝিম ধরে যায় যেন।”
সেটা ছিল বেশ আগে লিখিত সুধীর চক্রবর্তীর অভিমত, তখন করিম ছিলেন আশি বছরের বয়স্ক। এরপর শাহ আবদুল করিম আরও ১৩ বছর বেঁচেছিলেন। সন-তারিখ উল্লেখ করে তাঁর মৃত্যুর তথ্য জানাতে হলে বলতে হবে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সকাল সাতটা ৫৮ মিনিট। তবে জীবনের শেষ কয়েকটি বছর ছাড়া শাহ আবদুল করিম সমানতালে গান লিখেছেন-গেয়েছেন, এমনকি তাঁর গান শুনে মুগ্ধতায় ‘ঝিম ধরেছে’ পুরো গানের আসরে।
আজ যে শাহ আবদুল করিমের দেশজোড়া পরিচিতি কিংবা তার গান নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতা পর্যন্ত। আরেকটু যোগ করলে বলা যেতে পারে বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষজনের কাছে তার গানের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কথা। অথচ ব্যক্তি শাহ আবদুল করিম কখনোই প্রচার-প্রচারণা চাননি। আর দশ-পাঁচজন বাউলের মতোই নীরবে-নিভৃতে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পুরো জীবন।
কিন্তু সেটা হলো কই? বরং দিনে দিনে শাহ আবদুল করিমের গানের সপ্রতিভ উপস্থিতি বাঙালি জাতিকে করেছে উজ্জীবিত ও প্রাণিত। জীবিতাবস্থায় পেয়েছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সম্মান। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বরং চলতি প্রবন্ধে শাহ আবদুল করিমের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেড়ে-ওঠার দিনগুলোর পাশাপাশি উত্থানপর্বের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর একটু খোলামেলা আলোচনা সেরে নিতে পারি।
শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভাটি এলাকার অসংখ্য দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শোষণ-পীড়ন প্রত্যক্ষ করে তাঁদেরই একজন প্রতিনিধি হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। আর কীভাবে গানের জগতে এলেন, সেটা বরং আহমদ মিনহাজের কথা ধার করেই বলে নিই :
সেই কবে, তাঁর নিজেরও স্মরণ আছে কি না কে জানে, গানে গানে তাঁর নিজেকে বেঁধেছিলেন করিম, ভাটির চারণকবি করিম। ভাটি, আক্ষরিক অর্থেই গানের দেশ, গান এখানে আপনিই খেলে — নদীর সর্পিল পরিবেষ্টনে, শস্যের সমাহারে হাওরের রাশি রাশি জলের ফেনায় অভিনব এই দেশটিতে প্রকৃতি তার আপন প্রয়োজনেই গান ফলায়, হাওরের ঢেউয়ের সঙ্গে ওঠে গানের ঢেউ — এই ঢেউয়ে নাও ভাসানো মানুষ হলেন করিম। ভাটির মানুষ গান ভালোবাসে, ভালোবাসে গানের ভাও রপ্ত করে নিতে এবং এভাবেই তারা রপ্ত করে নিয়েছে করিমকে, আর করিমও রপ্ত করে নিয়েছেন ভাটিকে।
লোকে বলে করিমের গান বাউল গান। করিম নিজেও তা বলেন। ভাটির বাইরে যারা তাঁর গানের সঙ্গে পরিচিত, তাঁর জীবনভাবনার অনুরাগী, তারাও বলেন। বলাটা মিথ্যে, তা নয়। কিন্তু এর মধ্যে একটা ছোট অসম্পূর্ণতা আছে। সন্দেহ নেই করিম শাহনুর-শিতালং-আরকুম-হাসন-লালনের উত্তরসূরি, তাঁদের ভাববৃত্তের অনুগামী — তারপরেও কেবল বাউল বললে করিমের পরিচয় যেন ঠিক ফুটে ওঠে না। এই পরিচয়ের ভেতর দিয়ে ভাটির সঙ্গে, ভাটির মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ ও বন্ধুতাকে ঠিক চেনা যায় না। অথচ যারা করিমের গানের সঙ্গে পরিচিত, বিশেষ করে গানের আসরে গান গাইবার আগে নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে করিম যে পটভূমি সৃষ্টি করেন প্রায়শই, এর সঙ্গে যারা পরিচিত তারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন : করিম প্রথমত ভাটির মানুষ, অতঃপর বাউল। তাঁর শরীরে তাঁর কণ্ঠে তাঁর বচনে ভাটির জল-হাওয়া-মাটির গন্ধ, এই গন্ধকে বাদ দিলে করিমের বাউলত্ব থাকে না। ভাটির জল-হাওয়া গায়ে মেখেই করিম বাউল।
এ তো গেল করিমের গানের জগতে প্রবেশ ও বেড়ে ওঠার সময়কার কথা। কিন্তু যে-পরিবারে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেটার চিত্র তো খুবই করুণ। তাঁর বাবা ইব্রাহিম আলী দরিদ্র কৃষক। নিজেদের কোনো জমি না থাকায় পরের জমি বর্গাচাষ করে সংসার চলে। যে-বছর বন্যা-খরা-শিলায় ফসলহানি হয়, সে-বছর দিনের পর দিন অভুক্ত অবস্থায় থাকতে হয়। ঘরে একবেলা খাবার থাকলে, অন্যবেলা নাই। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে শাহ আবদুল করিম ছিলেন সবার বড়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে শৈশবেই তাঁকে অভাব-অনটনে জর্জরিত সংসারের হাল ধরতে হয়। গ্রামের এক মহাজনের বাড়িতে গরু-মহিষ রাখালের চাকুরি নেন। শুরু হয় নতুন জীবন। মাঠে মাঠে মনের সুখে বাঁশি বাজিয়ে সুর তোলেন, রাতে আশপাশের গ্রামগুলোতে গিয়ে যাত্রাপালা, কীর্তন আর বাউল গান শোনেন মগ্ন হয়ে। সেই থেকে গানের নেশা পেয়ে যায়।
শাহ আবদুল করিমের দিন এভাবেই চলতে থাকে। গরুরাখালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের পাশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ধলবাজারের একটি ভুষিমালের দোকানে কর্মচারির চাকরি নেন। এরই ফাঁকে গ্রামে স্থাপিত নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু মাত্র আট দিন পর সেই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে পড়লে আর পড়াশোনা এগোয়নি।
করিম তখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে। যাত্রাগানের দলে যোগ দিয়ে গ্রামে গ্রামে গান গাওয়া শুরু করেন। এই সময় একটা-দুটা করে গানের পদও রচনা শুরু করে আসরে গাইতেন। তাঁর চমৎকার কণ্ঠ শুনে বিমোহিত হতেন দর্শকেরা। দর্শকদের সেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রাম থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তে। যুবক বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন সকলের প্রিয় ‘করিম ভাই’। কিন্তু তাতে কী, নিজগ্রামেই একদিন ঈদের নামাজের দিন ঘটে বিপত্তি। সেটা বরং করিমের আত্মস্মৃতি অংশ থেকেই তুলে দিচ্ছি :
ঈদ এসেছে ঈদের দিন বাড়িতে ছিলাম।
জামাতে যাইতে সবার সঙ্গ নিলাম॥
গ্রামের দুই-এক মুরব্বি মোল্লাগণ হতে।
ধর্মীয় আক্রমণ এল ঈদের জামাতে॥
জামাত আরম্ভের পূর্বে মুরব্বি একজন।
ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাস করলেন তখন॥
জানতে চাইলেন, গান গাওয়া পারে কি পারে না।
ইমাম বললেন, “গান গাওয়া আল্লা-নবির মানা॥”
মুরব্বি বললেন, “তবে জিজ্ঞাস করো তারে।
গান সে ছাড়বে কি না বলুক সত্য করে॥”
ইমাম বললেন, “কিতা জি বাঁচতে এখনো পারো।
তওবা করে বেশরা বেদাতি কাম ছাড়ো॥
সবার কাছে প্রথম বলো আমি এসব করব না।”
আমি বললাম, “সত্য বলি, গান আমি ছাড়ব না॥”
মুরব্বি বললেন, “দেখো কী করা যায় তারে।
সবার সামনে এই কথা বলতে কি সে পারে?
যা-ই করুক এখন বলা উচিত ছিল তার।
এই সমস্ত কর্ম আমি করব না আর॥”
আমি বললাম, “এসেছি আজ জামাত পড়িতে।
ইচ্ছা নয় মিথ্যা কোনো কথা বলিতে॥
ছাড়তে পারব না আমি নিজে যখন জানি।
উপদেশ দিলে বলেন কী করে তা মানি ॥
পরে করিব যাহা এখন বলি করব না।
সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না॥”
এই সময় অন্য এক মুরব্বি বললেন :
“আপনারা এখন কোন পথে চললেন॥
এই আলাপ ঘরে বসে পারি করিতে।
এখন এসেছি ঈদের নামাজ পড়িতে॥
এক গ্রামে বাস করি হিন্দু-মুসলমান।
কে না গেয়েছি বলেন জারি সারি গান॥
একতারা দিয়ে গায় একা গান তার।
ঈদের জামাতে কেন এই গানের বিচার?
এই আলোচনা এখন বন্ধ করেন।
নামাজ পড়তে এসেছি নামাজ পড়েন॥”
মুরব্বি হতে এই কথা যখন এল।
এই বিষয় এখানেই শেষ হয়ে গেল॥
জামাত শেষ হলে পরে আসিলাম বাড়িতে।
কী করিব গান যে আমি পারি না ছাড়িতে॥
মনে ভাবি দয়াল যাহা করেন আমারে।
আমার নৌকা ছেড়ে দিলাম অকূল পাথারে॥
এরপর শাহ আবদুল করিম ‘নৌকা ছেড়ে’ দিলেন ‘অকূল পাথারে’। গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান অজানার উদ্দেশে। একমাত্র সঙ্গী হাতের একতারা। সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো এ-গ্রাম থেকে সে-গ্রামে যান আর গান গেয়ে মুগ্ধ করেন অগণিত শ্রোতাকে। এভাবে দীর্ঘসময় হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে চষে বেড়িয়েছেন। একসময় নেত্রকোনার বাইশচাপরা গ্রামের বাউলসাধক রশিদ উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁকে উস্তাদ মান্য করে গানের তালিমও নেন। এ সময়টাতেই ময়মনসিংহ অঞ্চলের উকিল মুনশি, আবদুস সাত্তার, মিরাজ আলী, তৈয়ব আলী, মজিদ তালুকদার সহ অনেকের সঙ্গে বাউলগান পরিবেশন করেন।
শাহ আবদুল করিমের নাম-যশ ক্রমশই দ্রুত থেকে দ্রুততর ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো দেশময়। সর্বত্র গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ে তাঁর। মানুষের ভালোবাসাও উপেক্ষা করতে পারেন না। কিন্তু করিম যেন কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নিজেকে চেনার অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুর্শিদ মানেন নিজ জেলা সুনামগঞ্জের উকারগাঁও গ্রামের মৌলা বক্স মুনশিকে। আর তখনই তিনি দেহসাধনায় সিদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি অবিরাম লিখে গিয়েছিলেন একের পর এক বাউল অঙ্গের পদাবলি। এ বিষয়টি ভীষ্মদেব চৌধুরীর বয়ানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
দেহতত্ত্বের বিচিত্র অনুশাসন মান্য করেই সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করতে হয় একজন বাউলকে। দেহসাধনার নিগূঢ় করণ-কারণ, অন্ধি-সন্ধি আর তত্ত্ব-তালাশের আগুনে দগ্ধ হয়ে হয়ে নিকষিত হয়ে ওঠে এক-একটি বাউলহৃদয়। মরমি বাউলসাধকদের মতোই করিম বাউলও জীবাত্মা-পরমাত্মার অনন্ত লীলাখেলায় জড়িয়েছেন নিজেকে, সুফি এবং বৈষ্ণব সাধকদের মতোই জীবাত্মা হয়ে পরমাত্মারূপী ‘প্রাণবন্ধের’ সঙ্গে মিলনপিপাসায় ব্যাকুল হয়েছেন। সুফিরা যেমন মনুষ্যহৃদয়কেই ঈশ্বরের প্রকৃত আবাসস্থল হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং মানুষের সাধনাকেই পরমাত্মার সান্নিধ্য প্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে গণ্য করেছেন, শাহ আবদুল করিমও তেমনি নিগূঢ় সন্ধ্যাভাষায় বলে ওঠেন বাউলসাধনার সেই অমোঘ সত্য : ‘মক্কাতে কাবার ঘর আদি কাবা আদম শহর’। এই ‘আদম শহর’-ই বাউল করিমের দীর্ঘ সাধন-জীবনের উপাস্য। পির-মুর্শিদ এবং সংগীত-ঘরণী সরলার মধ্যেও ওই অপার রহস্যময় ‘শহর’-এর সন্ধান করেছেন করিম। একেই তিনি কখনো অভিহিত করেছেন ‘মানবগাড়ি’ নামে, কখনো সম্বোধন করেছেন ‘মানবগাছ’ বা ‘মানবতরী’ অভিধায়। মানুষকে জমিনের রূপকে প্রতিভাসিত করেছিলেন উপান্তু মধ্যযুগের শাক্তকবি রামপ্রসাদ সেন এই অবিস্মরণীয় আক্ষেপোক্তি করে, ‘মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।’ কিন্তু মানুষকে ‘শহর’, ‘গাড়ি’, ‘তরী’ আর ‘গাছ’-এর সঙ্গে অভেদ কল্পনার অপূর্বত্ব বাউলগানে পাগলা করিমের প্রাতিস্বিক অবদান। মানুষের প্রতিরূপক হিসেবে গাছ-এর ব্যবহারের দৃষ্টান্ত ভারতীয় দর্শনের ব্যাখ্যায়, এমনকী আধুনিক কথাসাহিত্য ও কবিতায় মধুসূদনে এবং বিভুতিভূষণে পাওয়া যাবে। কিন্তু শহর আর গাড়ির প্রতিসাম্যে মানুষকে দাঁড় করিয়ে তাতে অভেদ তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত দুর্লভ। করিমের সংগীতকৃতির এ-রকম অসামান্য দৃষ্টান্ত রয়েছে অনেক।
ভীষ্মদেব চৌধুরীর লেখা যেখানে শেষ, তারপর থেকেই আমি শুরু করতে চাইছি। তিনি করিমের সংগীতকৃতির অসংখ্য দৃষ্টান্তের দু-একটির কথা আলোকপাত করেছেন। বাউল আঙ্গিকের সে-রকম অসংখ্য পদাবলিও করিমের রয়েছে। সেসব গানের কয়েকটির প্রথম কলি তুলে দেওয়ার লোভটুকু সংবরণ করতে পারছি না। যেমন :
১. মুর্শিদের কাছে আমি কেন যাই
২. নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী
৩. কও গো দয়াল
৪. আসল কাজে ফাঁকি দিয়া রে
৫. মনমাঝি তোর মানবতরী
৬. এলিম শিখলে আলেম হয় না
৭. মানবতত্ত্বের কী মাহাত্ম্য
৮. আমি আছি আমার মাঝে
৯. মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে
১০. রাখো কি মারো এই দয়া করো
১১. মুর্শিদ ধন হে
১২. আজব রঙের ফুল ফুটেছে
১৩. ও মন খুঁজলে না রে
১৪. আমি তোমার কলের গাড়ি
১৫. হাওয়ার পাখি ভরা আমার
১৬. মানুষে মানুষ বিরাজ করে
১৭. মানুষ হয়ে তালাশ করলে
১৮. এমন এক রঙের দেশ আছে
উপরের প্রায় প্রত্যেকটি গানই শাহ আবদুল করিমের স্বকণ্ঠে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি যখন এসব গান গাইতেন তখন তাঁর চোখে-মুখে আশ্চর্যজনক এক জ্যোতি লক্ষ করা যেত। একটু তীক্ষ্মভাবে তাকালে সেটি যে-কারো নজরে পড়ার কথা। তবে সেই জ্যোতি কোনো অলৌকিক বা ঈশ্বরিক নয়। সেটা নিতান্তই অনুভবের বিষয়।
শাহ আবদুল করিম পলে পলে নিজের রচিত গানের সারমর্ম ও চেতনা বিশ্বাস করতেন বলেই তাঁর মধ্যে এমনটি হতো। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাত্ত্বিক তপোধীর ভট্টাচার্যের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
“শাহ আবদুল করিম শব্দের সিঁড়ি দিয়ে চেতনার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছতে চাইছেন এবং প্রতিপলে অনুপলে অনুভব করছেন, শব্দাতীতকে শব্দ দিয়ে বাঁধা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাবুক বাউলের কাছে উপকরণ তো বড় নয়; অভ্যস্ত শব্দসজ্জাকে বারবার ব্যবহার করেছেন এই বিশ্বাসে যে এর মধ্যে আশিকের ধন পরশরতন এর সাক্ষাৎ মিলবে। সন্ত-কবিতার কিছু কিছু পরিচিত শব্দবন্ধ বাউল করিমের প্রগাঢ় অনুভবের দ্যুতিতে নতুন সুরে-তালে-লয়ে বেজে উঠেছে।”
তপোধীর ভট্টাচার্য এও বলেছিলেন, “নানা উৎস থেকে উৎসারিত অজস্র নদী যেমন আপন বেগে পাগলপারা হয়ে স্বতন্ত্র উপস্থিতি ঘোষণা করে তবু সাগর-মোহনায় পৌঁছে অসামান্য ঐক্যবোধে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, শাহ আবদুল করিমের রচনাসম্ভারও তেমনি বহুমাত্রিক লোকায়ত চেতনার সংশ্লেষণে সমৃদ্ধ হয়েই অদ্বিতীয় অনুভবের আলো বিচ্ছুরণ করে।”
কথাপ্রসঙ্গে করিমের বহুল প্রচলিত ‘গাড়ি চলে না’ গানটির কথা বলা যেতে পারে। সেই গানে তিনি আধুনিক জীবনের সঙ্গে নিজের দেহকে অসামান্য দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন। বিস্তৃত আলোচনার পূর্বে নিচে সম্পূর্ণ গানটি চয়ন করা যেতে পারে :
গাড়ি চলে না, চলে না
চলে না রে
গাড়ি চলে না॥
চড়িয়া মানবগাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্যপথে ঠেকল গাড়ি
উপায়-বুদ্ধি মিলে না॥
মহাজনে যত্ন করে
পেট্রোল দিলো টেংকি ভরে
গাড়ি চালায় মনড্রাইভারে
ভালো-মন্দ বোঝে না॥
গাড়িতে পেসিঞ্জারে
অযথা গণ্ডগোল করে
হেন্ডিম্যান কন্ডাকটারে
কেউর কথা কেউ শোনে না॥
পার্টসগুলো সব ক্ষয় হয়েছে
ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে
ডায়নমা বিকল হয়েছে
লাইটগুলো ঠিক জ্বলে না॥
ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে
কন্ডিশন ভালো নয় রে
কখন জানি ব্রেকফেইল করে
ঘটায় কোন দুর্ঘটনা॥
আবদুল করিম ভাবছে এবার
কন্ডেম গাড়ি কী করব আর
সামনে বিষম অন্ধকার
করতেছি তাই ভাবনা॥
এ গানটি সর্ম্পকে গীতিকার নিজে কী বলেছেন শুরুতেই আমরা সেটি জেনে নিতে পারি। সাংবাদিক মাসুম অপুর নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শাহ আবদুল করিম ‘গাড়ি চলে না’ গানটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বন্ধুর বাড়ি এ আত্মায়। গাড়িতে চড়ে আত্মশুদ্ধির সন্ধানে ছুটি। কিন্তু পাই না। রিপু থামিয়ে দেয়। একদিন হয়তো এ গাড়ি পুরোদমে থেমে যাবে। প্রকৃত মালিকের কাছে ধরা দেবে। এ করিমকে তখন মানুষ খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে।”
এ তো গেল গীতিকারের নিজস্ব বয়ান। এই গান সম্পর্কে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ব্যক্তিগত অভিমত হলো :
‘গাড়ি চলে না’ গানটিতে একজন মানুষের শারীরিক সক্ষমতা ও দক্ষতার অভাবের সঙ্গে একটি বিকল-হতে-থাকা গাড়ির তুলনা করা হয়েছে। দেহতত্ত্বের সঙ্গে যন্ত্রতত্ত্বের এই সম্মিলন খুবই বিরল ঘটনা, কিন্তু শাহ আবদুল করিম খুব অনায়াসে কাজটি করেন। এছাড়া প্রেম ও বিরহ, মনোকষ্ট ও যন্ত্রণা — এসব চিরন্তন বিষয় তো রয়েছেই। আমার মনে হয়েছে, এই গুণী চারণকবি ও শিল্পী সময়ের দাবির প্রতিও সচেতন। সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের ভাব ও প্রকাশের জগতেও পরিবর্তন এসেছে। নতুন নতুন উৎপ্রেক্ষা, রূপক ও তুলনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি এসব বিষয়কে মনে রেখেই গান লেখেন। এজন্য এগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
এর মানে শাহ আবদুল করিমের লেখা দেহতত্ত্বের গানগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গীতিকারের সমকালীন চিন্তাভাবনার কারণেই — সেটাই কী বলতে চেয়েছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম? অন্তত উপরের উদ্ধৃতিটুকু পাঠ করলে সেটাই ধারণা হয়। সেটা হয়তো অনেকাংশে ঠিক, কিন্তু যে-গানগুলো একেবারেই নিরেট দেহতত্ত্বকেন্দ্রিক, সেগুলোর জনপ্রিয়তার মূখ্য কারণটুকু কী?
এই প্রশ্নের উত্তরও আমরা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথাতেই জেনে নিই : “তাঁর নানা ধরনের সৃষ্টিসত্ত্বেও শাহ আবদুল করিম বাউল ধারার একজন সাধক, ওই পথের পথিক; তাঁর মানসিকতায়, তাঁর সাধনায় একজন বাউলের উপস্থিতি। এবং এই বাউলটি শুধুই নিভৃতে বিচরণকারী একজন আধ্যাত্মিক মানুষ নন, তিনি গণমানুষের সেবায় নিয়োজিত। এজন্য তিনি সহজ, কিন্তু প্রবলও। তাঁর সুর নমিত হলেও যা বলতে চান, তাতে অস্পষ্টতা থাকে না। তাঁর চাওয়া প্রবল, চাওয়ার প্রকাশ উচ্চকিত নয়; ভাবনা প্রবল, ভাবনার প্রকাশ নমিত। সুরেলা।”
আমাদেরও ধারণা, শাহ আবদুল করিমের সহজ-সরল স্পষ্ট বয়ানই তাঁর গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তার মুখ্য কারণ। শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার ‘শাহ আবদুল করিম ও তাঁর গান’ শিরোনামে এক লেখায় এমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন, “তিনি এ অঞ্চলের মরমি গানকে তত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দি করে রাখেননি। তাঁর গানে সময়ের ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। সময়ের ছাপ বলতে এখানে চিত্রকল্পে আধুনিক জীবনের নানা ছবি উঠে আসার কথা বলা হচ্ছে না। এটা অনেকেই করেছেন। করিমের গানেও এ-ধরনের আধুনিক চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত একাধিক।”
শাহ আবদুল করিমের বয়স যতই বাড়ছিল, তিনি ততই গণমানুষের দিকেই ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছিলেন। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব নিয়ে যে শাহ আবদুল করিমের ছিল সাধনা, তিনি হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করলেন। সেই বদলে যাওয়াটা কেমন ছিল সেটাও আমরা করিমের নিজের কথাতেই জেনে নিতে পারি। তিনি ১৯৯৭ সালে টি এম আহমেদ কায়সারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “একদা তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ত্ব নয়, নিঃস্ব বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব আর সোনার বাংলা, সোনার মানুষ বললে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।” এ জন্যই হয়তো তিনি এক গানে লিখেছেন : “তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমি কবি / আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখদুর্দশার ছবি / বিপন্ন মানুষের দাবি করিম চায় শান্তিবিধান॥”
প্রসঙ্গক্রমে অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, “আবদুল করিম অধ্যাত্ম পথের গান দিয়ে শুরু করে, তাতে যশস্বী ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেও চলে আসেন দরিদ্র ও জর্জরিত মানুষের পক্ষে।” এই দরিদ্র মানুষের পক্ষে চলে আসার কারণটাই-বা কী? আশপাশের মানুষের দারিদ্র্য-বঞ্চনা আর শোষকদের অন্যায়-জুলুম দেখে দেখেই কী তিনি তাহলে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন? এ-জন্যই কী তিনি লিখলেন : “শোষক তুমি হও হুঁশিয়ার চলো এবার সাবধানে / তুমি যে রক্তশোষক বিশ্বাসঘাতক তোমারে অনেকে চেনে॥”
শুধু গান লিখেই থামলেন না। ভাষা আন্দোলন, কাগমারি সম্মেলন, ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সহ প্রত্যেকটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে গণসংগীত গেয়ে সংগ্রামী মানুষের চেতনায় নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছেন। কবি শুভেন্দু ইমামের ভাষায়, “অসম্ভব জনপ্রিয় ও তত্ত্ববহুল বাউলগানের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গণসংগীত, যা ‘সর্বহারার দুঃখজয়ের মন্ত্র’ বলে সারস্বত সমাজ কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।” এ সময়টাতেই তিনি পেয়েছেন মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রমেশ শীলের একান্ত সান্নিধ্য। এভাবেই করিম পরিণত হন ‘গণমানুষের বাউল’ হিসেবে। মানুষজন ভালোবেসে তাঁকে ‘বাউলসম্রাট’ অভিধায় অভিষিক্ত করেন। যদিও ‘বাউলসম্রাট’ শব্দটি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে, অনেকেই এই শব্দটিকে সামন্তবাদী শব্দ হিসেবে জানেন-মানেন। তবে সেটা অন্য বিতর্ক, আমরা বরং জনমানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা না করে আপাতত অভিধাটি ব্যবহার করে থাকি।
শাহ আবদুল করিম সাধারণ মানুষের দুঃখদুর্দশা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই অত্যন্ত হৃদয়ছোঁয়া ভাষায় সেসব কথা তাঁর গানে তুলে ধরতে পেরেছেন। অন্তত সেটা তাঁর বেলায় নির্দ্ধিধায় বলা যায়। টি এম আহমেদ কায়সার ঠিকই বলেছেন : “[…] নৌকা, জল, নদী, হাওর, ভাটির জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইত্যাকার প্রতিটি উপাদান করিম প্রয়োগ করেন স্রেফ মোড়ক বা মুখোশ হিসেবে। অন্তরালে ঢুকিয়ে দেন মানুষের অন্তর্নিহিত অন্তহীন দুঃখ, বেদনা আর পাঁজরভাঙা হাহাকার। তত্ত্বের রহস্যময়তা ছাপিয়ে মানববন্দনাই তাঁর গানের মূল সুর হয়ে ওঠে।” ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ — এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই তিনি লিখেছিলেন :
মানুষ যদি হইতে চাও করো মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা॥
নিজলীলা প্রকাশিতে আপে আল্লা পাকজাতে
প্রেম করল মানুষের সাথে তার আগে আর কেউ ছিল না॥
প্রেম ছিল আরশ-মহলে স্থান পাইল মানুষের দিলে
আসল মানুষ কারে বলে কী নাম তার কই ঠিকানা॥
সব দেশে সব জায়গায় মানুষ প্রেমখেলাতে নারী-পুরুষ
মানুষেতে আছে মানুষ রয় না মানুষ মানুষ বিনা॥
আবদুল করিম হুঁশে থাকো মানুষ ভালোবাসতে শিখো
অন্তরে অন্তরে মাখো রবে না ভবযন্ত্রণা॥
মানুষকে ভালোবেসে এবং মানুষের ভালোবাসা নিয়েই শাহ আবদুল করিম দেহত্যাগ করেছেন। তবে রয়ে গেছে তাঁর অগণিত সৃষ্টিসম্ভার। তিনি নেই, দেহও রেখেছেন সেই কবে। তবুও প্রতি বছর চৈত্র মাসে তাঁকে ঘিরে ‘শাহ আবদুল করিম লোকউৎসব’ হয়। সেই উৎসবে করিমবন্দনায় মেতে ওঠেন তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য-অনুরাগীরা। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো শুরু-হওয়া লোকউৎসবে তাঁর শিষ্য ষাটোর্ধ্ব কাইয়ূম শাহের গাওয়া করিমের সেই গানটি এখনও অবিরত কানে বাজে। সেই গানটি দিয়েই লেখার ইতি টানছি। ওইদিন কপালে ডান হাত ছুঁয়ে কাইয়ূম শাহ গেয়েছিলেন :
রাখো কি মারো এই দয়া করো
থাকি না যেন তোমারে ভুলিয়া॥
নিশিদিনে শয়নে স্বপনে
পরানে পরানে মিশিয়া
এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে
তুমি নিজে পথ দেখাইয়া॥
আমি তোমার পাগল, ভরসা কেবল
দীনবন্ধু তোমার নাম শুনিয়া
নেও যদি খবর হইব অমর
নামের সুধা পান করিয়া॥
দয়াল নাম তোমার জগতে প্রচার
জীবেরে দয়া করো বলিয়া
আবদুল করিম বলে রেখো চরণতলে
দিও না পায়ে ঠেলিয়া॥
করিমপোর্ট্রেট : শাহ্ আলম
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS