“কুরুঞ্জীর নাও লড়েচড়ে, পুয়া-পুরুত্তা পানিত পড়ে” — একসময় গ্রামের শিশুরা সমস্বরে অবাক বিস্ময়ে নৌকার দিকে তাকিয়ে এমনি বলত। যখন তাদের নজরে পড়ত কুরুঞ্জী বা গাইন বেদে সম্প্রদায়ের নৌকা বা তাদের নৌকার কোনো বহর। আর সে-রকম বলাটাই তো স্বাভাবিক, যেখানে বর্ষার পানিতে চারদিক টুইটুম্বুর। পানি এসে দাঁড়ায় একেবারে বাড়িঘরের দোরগোড়ায়। ঘর থেকে একপা এগোলেই পানি। সেই সময়টিতে গ্রামের শিশুদের প্রতি থাকে তার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের তীক্ষ্ণ নজর। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তার অবুঝ শিশুটি যেন পানিতে পড়ে না যায়। আর এমনি যখন অবস্থা তখন কিনা তাদেরই বয়সী শিশুরা, ছোট নৌকায় করে দিনের পর দিন পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামে। কী আশ্চর্য তাদের জীবনযাত্রা!
যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের একটি গোত্র গাইন বেদে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে যাদের আমরা গাইনী বা কুরুঞ্জী হিসেবে জানি। বেদেদের অন্য সব গোত্রের মতো নৌকাই তাদের আবাসস্থল। নৌকা নিয়েই জীবিকার তাগিদে তারা ঘুরে বেড়ায় দেশের সর্বত্র। নৌকাই তাদের একমাত্র সম্পদ। তাদের জন্ম যেমন নৌকায়, তেমিন বেড়ে-ওঠা আবার জীবনের সমাপ্তিটাও ঘটে নৌকায়।
গাইনদের একটি নৌকাই তাদের একটি পরিবার। বড়জোর ৪/৫ হাত প্রস্থ আর ১০/১২ হাত দৈর্ঘ্যের কাঠের তৈরি একটি ছৈয়া নৌকা। যেগুলো ভেসে আছে নদীতে কিংবা হাওরের পানিতে। আর এ-রকম একটি নৌকার মধ্যেই একটি পরিবারের বসবাস, যে-পরিবারে আছে বাবা-মা আর তাদের চার-পাঁচটি সন্তান। এত অল্প পরিসরে একটি পরিবারের বসবাস। ভাবতেই অবাক লাগে। পাশাপাশি আছে নিত্যদিনের সঙ্গী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়তুফান, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা … এমনি কতকিছু। এতসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুকাবিলা করেই যাদের জীবন চলা। তাদের যাপিত জীবনসংগ্রামের চিত্রটা এ-রকমই।
এক-সময় গাইনদের একেকটি বহরে দেখা যেত ৩০ থেকে ৪০টি নৌকা। প্রতিটি বহরে থাকে একজন সর্দার, যার হুকুম বা নির্দেশ মেনে চলা প্রত্যেক সদস্যের জন্য বাধ্যতামূলক। তবে সর্দার শুধু তার নিজের মতামতকেই প্রাধান্য দেন না। বিভিন্ন বিষয়ে বহরের অন্যান্য মুরব্বিগণের সাথেও পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের মধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তারা নিজেরাই বসে মিমাংসা করে নেয়। এসব বিষয়ে অবশ্য সর্দারের মতামতই বেশি গুরুত্ব পায়। তাদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা নেই বললেই চলে। সহজ-সরল, স্বাভাবিক জীবনযাপনেই তারা অভ্যস্ত।
গাইনদের স্থায়ী সম্পদ বলতে কিচ্ছু নেই। নৌকাই তাদের একমাত্র সম্পদ। যা হয়তো-বা কয়েক বছর পর পচে, গলে নষ্ট হয়ে যাবে। যেহেতু স্থায়ী কোনো সম্পদের মালিকানা তাদের নেই সেহেতু তাদের মননে চাওয়-পাওয়ার লোভও তেমন একটা নেই। এটা কে না জানে — লোভই জন্ম দেয় হিংসা আর বিদ্বেষের যা এক-সময় রূপ নেয় মানুষে-মানুষে হানাহানি, মারামারিতে। আর বর্তমান বিশ্ব তথা মানবজাতি সেই লোভ থেকে জন্ম নেয়া হিংসা-বিদ্বেষেই আক্রান্ত। আজ দেশে-দেশে, মানুষে-মানুষে সেই লোভের লড়াইটাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
যাযাবর গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন এক স্থানে অবস্থান করে না। মাঝেমধ্যে তারা স্থান পরিবর্তন করে। যে বহরটি আজ দিরাই বাজারে অবস্থান করছে, সেই বহরটিকে কয়েক মাস পর দেখা যাবে পাথারিয়া বাজারে। কয়েক মাস পর তারাই হয়তো-বা অবস্থান নেবে জাউয়া বাজারে। দেখা যাবে ঘুরেফিরে তারা একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা একটি জেলার মধ্যেই অবস্থান করেছ। এক-সময় নদী কিংবা হাওরে দেখা যেত গাইনদের নৌকার বহর। পুরাতন স্থান ত্যাগ করে, নতুন কোনো গন্তব্যে তাদের ছুটে চলা। যুগের পর যুগ তারা এমনি ছুটে চলেছে। তাদের এই ছুটে চলার যেন শেষ নেই।
গাইনরা মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসার সাথে জড়িত আর সে-ব্যবসা গড়ে ওঠে পরিবারের মহিলাদের কেন্দ্র করে। তাই জীবিকা উপার্জনের দায়িত্ব বিশেষ করে মহিলাদের। তারা গ্রামে-গঞ্জে ফেরি করে মহিলাদের হাতের চুড়ি, নাকের ফুল, কানের দুল, সুই-সুতা ইত্যাদি বিক্রয় করে থাকে। বর্ষায় নৌকা নিয়ে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে জিনিসপত্র বিক্রয় করে আর হেমন্তে কোনো-একটি নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা নিয়ে অবস্থান করে। সেখান থেকে প্রতিদিন ভোরে বাঁশের বানানো ঝাঁকায় জিনিসপত্র মাথায় নিয়ে মহিলারা বেরিয়ে পড়ে; আশপাশের গ্রামগুলোই তাদের লক্ষ্য।
গাইনদের এসব জিনিসপত্রের বেচা-বিক্রয় সবসময় এক-রকম হয় না। সেটাও নির্ভর করে অনেকটা প্রকৃতি আর গ্রামবাসী কৃষকের ভাগ্যের ওপর। বৈশাখী বোরো ফসল ভালো হলে আর সুন্দরভাবে গোলায় উঠলেই তবে গৃহস্থ ঘরের বউ-ঝিয়েরা কিছু টাকা তাদের আউস-আহ্লাদের পিছনে খরচ করে। আর সে-রকম সময়ই কুরুঞ্জী বেটি দেখলে গৃহস্থ বউ-ঝিয়েরা ডাক দেয় — ‘ও কুরুঞ্জী বেটি আমরার দাইরও একটু আইও চাইন।’ কুরুঞ্জী বেটির ব্যবসাটা মোটামুটি ভালো চলে জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত। বছরের বাদবাকি সময় ব্যবসাটা তেমন একটা ভালো চলে না। যুগের পর যুগ তারা এমনিভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
এদিকে নৌকায় থেকে সন্তানাদির দেখাশোনা করে পরিবারের পুরুষেরা। শুধু সন্তানাদির দেখাশোনা বললে ভুল হবে। বর্ষাকালের দুই/তিন মাস পুরুষেরা কিছু উর্পাজনও করে। এই সময়ে তাদের দেখা যায় হাটবাজারে কিংবা গ্রামে ছাতা মেরামতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে। অন্য সময় পুরুষেরা সংসার দেখাশোনার পাশাপাশি মাছ ধরা, পাখি শিকারে মেতে ওঠে। এভাবেই নারী-পুরুষের যৌথ শ্রমে কোনোরকম ভাবে কেটে যাচ্ছিল তাদের জীবন।
যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার নাই বলেই চলে। তবে বর্তমান সময়ের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তাদের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাটা পাচ্ছে। তবে সেটার হার খুবই কম। শিক্ষা না থাকার কারণে তারা অনেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার অধিক। কেউ বিপদ-আপদে কিংবা অসুখ-বিসুখে পড়লে পিরের নামে সেবা দেয়। অনুষ্ঠান করে বহরের সবাইকে শিন্নি খাওয়ায়। পুরুষেরা রাতভর মজে থাকে পির-মুর্শিদি গানে। তারা সবাই কোনো না কোনো পির-ফকির কিংবা মাজারভক্ত। প্রতি বছর ওরস উপলক্ষ্যে পিরের বাড়ি কিংবা মাজারে যাবে। এটাই যেন তাদের নিয়ম। ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি তারা যতটুকু জানে মেনে চলে। সেটা অন্যসব মুসলমানদের মতোই।
যুগের পর যুগ গাইনদের জীবনটা এভাবেই চলে আসছিল, যে-রকম জীবনযাপনে তারা অভ্যস্থ। কিন্তু সময় পরির্বতনের সাথে তাদের মধ্যেও দেখা দেয় পরির্বতন। হয়তো-বা একসময় পরিবর্তনটা আসে বাধ্য হয়েই। যেমন — তাদের আবাসস্থল নৌকাগুলো পানিতে ভাসিয়ে রাখতে প্রয়োজন ছিল প্রতিবছর মেরামতের। আবার একেবারে ব্যবহার-অনুপযোগী নৌকার জায়গায় নতুন নৌকা ক্রয়। ইতোমধ্যে কিছু নৌকার কাঠ পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আরেকদিকে বর্ধিত নতুন জনসংখ্যা। তাদের জন্য চাই নতুন আবাসস্থল নৌকা। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তারা কোনোটিই করতে পারছিল না। এক-সময় বাধ্য হয়েই পুরাতন অকেজো নৌকাগুলো ত্যাগ করে তারা উঠে আসতে থাকে ডাঙায়। শুরু হয় তাদের নতুনধারার জীবনযাত্রা। বেঁচে থাকার আরেক নতুন সংগ্রাম।
দুই
গাইনদের এমনি প্রায় ৩৫টি নৌকার একটি বহর। যাদের সর্দার ইদ্রিছ আলী। এক সময় জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘুরে বেড়াত সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে। এমনকি সিলেটের কিছু এলাকায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই বহরটি শেষ নোঙর করে দিরাই উপজেলার টুকদিরাই গ্রামে। প্রায় ১০বছর পূর্বে তাদের কয়েকটি পরিবার অবস্থান নেয় পাগলা বাজারে। সেখান থেকে কয়েকটি পরিবার চলে যায় পাথারিয়া বাজারে। বর্তমানে পাগলা বাজারে ৮টি, পাথারিয়া বাজারে ৬টি, জয়কলসে ৪টি এবং শান্তিগঞ্জে তাদের ৪টি পরিবার বসবাস করছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্র শান্তিগঞ্জ বাজার। শান্তিগঞ্জ-রজনীগঞ্জ রাস্তার পূর্বপার্শ্বে স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিসসংলগ্ন একটি রেইনট্রি গাছ। গাছের নিচে বসে ছাতা মেরামত, লাইটে গ্যাস ভর্তি সহ টুকটাক ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র মেরামতের কাজ করছে আঙ্গুর মিয়া নামের একজন। পাগলা বাজার কেন্দ্রিক গাইনদের যে-কয়টি পরিবার ছড়িয়েছিটিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে সে তাদেরই একজন। এবার তার নিজের মূখেই শুনি ডাঙায় তাদের নতুনধারার জীবনযাত্রার কিছু সুখ-দুঃখের বয়ান —
“হ, ভাই, আমার নাম আঙ্গুর মিয়া। বাবার নাম সোনাউল্লা। আমরা প্রায় ১৫ বছর পূর্বে পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকা ছেড়ে ডাঙায় উঠি। নৌকাগুলোও যে আর চলছিল না। নৌকা থেকে সাথে নিয়ে আসি একমাত্র শেষ সম্বল নৌকার ছৈয়া। নদীতীরের এই ছৈয়া দিয়ে কোনোরকমে একটি ঝুপড়ি-মতো তৈরি করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা নেই। ভাই, ডাঙায় তো আর আমরার জাগা-জমি নাই। কোনোকালে ছিলও না। দেশের সব জাগা-জমি বিভিন্ন জনের মালিকানাধীন। কিছু জাগা-জমি আবার সরকারের। ভাই, সরকারের জায়গা-জমিরও বিভিন্ন দখলদার মালিক আছে। সেসব জমিতে আমাদের থাকার কোনো অধিকার নাই। ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতে গেলেও স্থানীয় দখলদারদের নিয়মিত মাসিক ভাড়া প্রদান করতে হয়। আজও মাসিক ১০০০ থেকে ১৫০০টাকা ভাড়া প্রদান করে দিন কাটাচ্ছি।
ভাই, এদিকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাজারের চাহিদা বদলেছে। টাকার অভাবে চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র ক্রয় করা সম্ভব হয় না। তাই আমাদের মহিলাদের চুড়ি-ভাংরির ক্ষুদ্র ব্যবসাটিও আর আগের মতো চলে না। চাউল সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম দিনদিন বেড়েই চলছে। সামান্য রুজি-রোজগারে আর চলে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না-খেয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করে আসছি।
ভাই, সকলে তো আর এক-রকম না। বর্তমানে আমাদের পরিবারের সন্তানেরা প্রাথমিক শিক্ষাটা গ্রহণ করছে। সেটাও সম্ভব হচ্ছে সরকারের বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তি প্রদানের কারণে। আর্থিক সমস্যার কারণে এর বেশি লেখাপড়া শেখানোর আশা করা যায় না। আমরা মাঝেমাঝে এও শুনি, কোনো কোনো এলাকায় আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবারের সন্তানদের স্কুলে যেতে বাধা প্রদান করা হয়। সেটা খুবই দুঃখজনক। আমরা তো এদেশেরই মানুষ।
ভাই, আমাদের নিজেদের কোনো কবরস্থান নেই। কোন কবরস্থানে আমাদের কোন পূর্বপুরুষ ঘুমিয়ে আছে আজ সেটা আমরাও ঠিকভাবে বলতে পারব না। আমাদের কেউ মারা গেলে যেখানে অবস্থান করি সেখানকার কবরস্থানে গোর-দাফন করি। সেটা সেখানকার স্থানীয়দের অনুমতি নিয়েই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও ঘটে। স্থানীয় কবরস্থানে গোর-দাফনে নিষেধ করা হয়। মাঝেমধ্যে এ-রকম অমানবিক সমস্যারও মোকাবিলা করতে হয়। তবে সব মানুষ এক-রকম না। কিছু মানুষ আছে যারা বিভিন্নভাবে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।”
যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের গাইন গোত্রের আঙ্গুর মিয়াদের জীবনযাত্রার বয়ান আর তাদের অন্যসব গোত্রের জীবনযাত্রার বয়ানটা প্রায় একই রকম। তার কথা থেকে বোঝা যায় তারা তেমন ভালো নেই। কোনোরকমে বেঁচে আছে মাত্র। আজও তাদের নিজেদের কোনো স্থায়ী বাসস্থান নেই। নৌকার জীবনের মতোই আজ এখানে তো কাল ওখানে। আরেকদিকে রুজি-রোজগারের সমস্যা। এতসব সমস্যার কারণে ছেলেমেয়েদেরও নিয়মিত স্কুলে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনিতেই তারা অনগ্রসর পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠী। দিন দিন তারা আরো পিছিয়ে পড়ছে।
যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় — আর্য-পরবর্তী সময়ে এদেশের স্থানীয় প্রাচীন কৌম বা জাতি-গোষ্ঠীগুলি ধর্মের কারণে নিম্নবর্ণের অচ্ছুৎ অপবিত্র বলে গণ্য হতো। নিজেদের ধর্ম, নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে তাদের অনেকেই তখন অরণ্যচারী হয়ে যায়; আবার কেউ কেউ আশ্রয় নেয় নৌকায়। পরবর্তীকালে বাংলায় সেনবংশীয় রাজাদের আমলেও দেখা গেছে জাতপাতের কারণে বিদ্রোহ করে অনেকে নৌকাবাসী হয়েছে। সে-হিসাবে বেদেদের নৌকায় বসবাসের বয়স অনধিক ৭০০ বছর।
গবেষকদের মতে, আমাদের দেশের বেদেরা আরাকান অঞ্চলের কোনো-এক আদিবাসী গোষ্ঠীর অংশ। কোনো-এক সময় বলাল সেনের (এই ব্যক্তি আর সেনবংশের রাজা বল্লাল সেন বা বলাল সেন এক নয়) সাথে তাদের আগমন এই বাংলায়। সময়টা ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি। সে-হিসেবে বাংলায় এদের বিচরণ ৪০০ বছরের বেশি নয়। (সূত্র : বাংলার বেদে সম্প্রদায় — মাহমুদ’স পেজ)
বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপমতে বাংলাদেশে প্রায় ৭৬,০০০ যাযাবর বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের শতকরা ৯৯ ভাগই মুসলমান; আর শতকরা ৯০ ভাগই নিরক্ষর। এই বেদে সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত — মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইনবেদে ইত্যাদি। এদের প্রধান পেশা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ-কবচ বিক্রি, সর্পদংশনের চিকিৎসা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যসেবা, শিঙা লাগানো, ভেষজ ঔষধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, যাদু দেখানো প্রভৃতি।
পরিশিষ্ট : দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, যে-দলের কাছে এ দেশের মানুষের চাওয়া ও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বিশাল। ইতিমধ্যে দেশের সাধারণ জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার অনেক পদেক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ধীরে ধীরে প্রান্তিক জনগণ সেই সুফলও পেতে শুরু করেছে। সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্যমতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে দেশের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসতে সরকার আলাদাভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় আজ অবধি এ-রকম কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। আশা করি, উপজেলায় অবস্থানকারী গাইন বেদেদের ২২/২৩টি পরিবারও সরকারপ্রদত্ত সে-সুবিধাটুকু পাবে। একদিন হয়তো-বা তারা পাবে স্থায়ী ঠিকানাও। তেমনিভাবে ধীরে ধীরে পিছিয়ে-পড়া যাযাবর বেদে জনগোষ্ঠী এক-সময় মিশে যাবে দেশের মূল স্রোতে।
রচনাকাল / মে ২০১৮
… …
- বেদেমঙ্গল || মুহাম্মদ শাহজাহান - August 2, 2019
- মকদ্দস আলম উদাসী ও তাঁর গান || মুহাম্মদ শাহজাহান - September 21, 2018
- শাহ আবদুল করিম ও তাঁর মদনমাঝির সুলুক সন্ধান || মুহাম্মদ শাহজাহান - July 24, 2018
COMMENTS