ঠোঁটে নিয়ে কমলালেবুর ঘ্রাণ শীতপাখিগুলো শহরে নামছে। পূজার লাইটিঙে ঝকমক করছে নদীতীরের মগরা। শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ডাকপিয়নের একটা প্রাচীন সাইকেল খবর পৌঁছে দিতে চাইছে। কিন্তু কে নিচ্ছে খবর! হরিণস্বভাবে সবাই বেঁচে থাকতে চাইছে। পুঁইশাকের নরম ডাঁটায় লাফানো রোদের রহস্যময় সময়ে মুচকি হাসির চর্চায় সবাই নিজের জীবনকেই বাঁচাতে চাইছে। অথচ জীবন বাঁচানোর জন্য জীবনের ইতিহাস জানাটা খুব জরুরি। ভূমিসন্তানকে ভূমির ইতিহাস জানা ও জানানোটাও খুব জরুরি। আত্মপরিচয়ে সামনে তাকানোর শক্তি আসে। আত্মপরিচয়ে জীবনের অপচয় ও লোভের মাত্রা কমে আসে।
ছোট শহরেও অনেক জানালা। কিন্তু সব জানালায় শাপলা ফুলের হাসি দেখা যায় না। শাপলা ফুলের হাসিহীন জানালায় নিজেকে স্থাপন করলে ব্যক্তি আর বিকশিত হয় না। মগরা নামের প্রাচীন এই শহরে কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরী মূলত শাপলা ফুলের জানালা।
এই শহরে কয়টা বটগাছ? ঝড়ের বিপুল তাণ্ডবে কয়েকটা বটবৃক্ষ হারিয়ে যাবার পরেও এখনো কয়েকটা অবশিষ্ট আছে। যে-কয়েকটা আছে সে-কয়েকটাকেও হয়তো বড়ভাই নামের কোনো নির্ভার আশ্চর্য নাগরিক একদিন কর্তন করে ফেলবেন। জানি, শক্তিমান সেই বড়ভাই শহরের বটগাছ কর্তন করতে চাইলে নাগরিকেরা কেউ আটকাবেন না। জানি, শক্তিমান সেই বড়ভাইয়ের একটা অর্ডারে করাতিদের অপুষ্ট পেশী শত বছরের বটগাছগুলোকে ভূমিতে নামাবে। তবে সময়ের ধাবমান করাতিরা খালেকদাদ চৌধুরীদের কর্তন করতে পারবে না। যদি জিজ্ঞেস করেন কেন কর্তন করা যাবে না? তাহলে বলব, শরতের পূর্ণিমায় উনারাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গায়ক।
ঐতিহ্যের শক্তি ও আহ্বানকে-যে উপেক্ষা করে নিজের ভূমিকে কেউ চিনতে পারে না। ঐতিহ্য না জানলে দিনের শেষে কেউ হাসতে পারেন না। শান্তি নিয়ে ভোরের দিকে তাকাতে পারেন না। মহুয়া গাছের নিচে ইতিহাস ও ঐতিহ্য হচ্ছে ছোট্ট একটা জানালা। বকুলপ্রবাহে জীবনাশ্রম। জীবনে দৃষ্টি ও জানালা খুব দরকার। ধীমান কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরীর আত্মজীবনীতে বহমান জনপদের ইতহাসটাই আছে। ইতিহাসের সন-তারিখের চেয়ে আত্মজীবনীর বিবরণীতে গুপ্তস্রোতের মতো লেগে থাকে সত্য ইতিহাস। কারা সভ্যতার শত্রু-মিত্র; কাদের হাতে আগুন ও আফিম — ত্রিকালদর্শী লেখকের আত্মজীবনীতে তার একটা সত্য বিবরণই উঠে আসে। খালেকদাদ চৌধুরীর ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’ নামক গ্রন্থের বর্ণনা ও অক্ষরে ইতিহাস-সচেতন পাঠককে তাই ফিরতেই হবে।
কেন ফিরবে? মানুষ তো তার শেকড়েই ফেরে। এই যে হাওরাঞ্চল, ধীবর জনতা, রাজ্য ও জনবসতি, রাজা ও সম্পত্তি, বংশানুক্রমিক পরম্পরা, টিপুশাহ-র স্বাধীন রাজ্য, বাংলা ভাগ, দেশভাগ, ভাষার লড়াই কিংবা একাত্তর — জনপদের একটা প্রচ্ছন্ন পরিচয় আছে ‘শতাব্দীর দুই দিগন্তে’।
গ্রন্থটা লেখকের আত্মজীবনী। লেখকেরা ব্যক্তিগত সিন্দুক খুলেই আত্মীজীবনী লেখেন। নিজের জীবন লিখতে লিখতে ভাষা ও প্রণতিতে লেখক মূলত সময়যাপনের পরিক্রমা ও চারপাশকে লেখেন। আত্মজীবনীতে তাই দুধের সরের মতো ভাসতে থাকে ইতিহাস ও উপন্যাসের রঙ। শহরের বিভিন্ন স্রোতের মানুষকে তাই ‘শতাব্দীর দুই দিগন্ত’ নামকে গ্রন্থের ছায়াতনে কিছুক্ষণ বসে থাকা জরুরি।
এসেছে নতুন হাওয়া। সে-হাওয়ায় ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন বিষয়ে ঝুঁকছে। কেউ আর ভাষা শিখতে চাইছে না। কেন চাইছে না? কিন্তু ভাষা ছাড়া প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ও প্রকাশ কি সম্ভব? সে-সময়ে খালেকদাদ চৌধুরী আরবি, ফারসি, ইংরেজির চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষায় অনুবাদক খালেকদাদ চৌধুরীও এক শক্তিমান সত্তা। ‘মরু সাহারা’ এবং ‘বাহার-ই-স্থান-ই গায়েবী’-তে একজন ফার্সিজানা পণ্ডিতকেই খুঁজে পাই।
একজন সচেতন শিল্পী তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াইটাকেই লেখেন। লেখেন সময়যাপনের বিশ্বাস, মিথ ও সংস্কৃতির পরম্পরা। কাল্পনিক জগতের চেয়ে বাস্তবতার জগতটাকেই লিখেছেন খালেকদাদ চৌধুরী। বাংলা কবিতায় জসীম উদ্দীন যেমন আপন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি দরদি ছিলেন, বাংলা কথাসাহিত্যে খালেকদাদ চৌধুরীও প্রাকৃতজনের জীবন ও ঐতিহ্যকেই দরদি ভাষায় লিখেছেন। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতি পুনর্গঠনের যে সচেতন চেষ্টা ও অভিপ্রায় ছিলো — সেই অভিপ্রায়েই স্নাত ছিল খালেকদাদ চৌধুরীর শিল্পমানস। ১৯৮৫ সালের ১৬ অক্টোবর ৭৮ বছর বয়সে এই বরেণ্য সাহিত্যিকের মৃত্যুর পর প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দিন এক নিবন্ধে লেখেন, “সেকালের তরুণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ। তাঁকে ঘিরে অসংখ্য তারকা জ্বলছিল, যার যতটুকু ক্ষমতা সেইমতো আলো বিকিরণ করছিল। একে একে সবাই বিদায় নিচ্ছেন। খালেকদাদ চৌধুরীর পরলোক গমনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ তারকাটি খসে পড়ল।” কেউ যদি ভাটির সমাজটা সম্পর্কে জানতে চান তাহলে অবশ্যই তাঁর কথাশিল্পের জগতে প্রবেশ করতে পারবে। ভাটি অঞ্চল বলে যে-সমাজটিকে আমরা চিনি সে-সমাজের রূপ-রূপান্তর আছে, — ‘একটি আত্মার অপমৃত্যু’, ‘রক্তাক্ত অধ্যায়’, ‘চাঁদ বেগের গড়’, ‘শাপ মারির অভিশাপ’, ‘এ মাটি রক্তে রাঙ্গা’ নামক উপন্যাসগুলোতে।
কথাশিল্পী খালেকদাদ চৌধুরীর আরো একটি পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে যাবার প্রত্যুষকালীন সময়ে তাঁর ছেলে হায়দার জাহান চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের পিস্তল। তাঁর সুযোগ্য মুক্তিযোদ্ধাপুত্র এই ধীমান কথাশিল্পীর লেখা ও চিন্তাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। লেখকের প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত বইগুলোকে পুনঃপ্রকাশের চেষ্টা করছেন। হায়দার জাহান চৌধুরী নিজেও লিখছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী’ বইটি। একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ বিবরণ এবং আর্কাইভ খুঁজে সন-তারিখ লেখা একজন ইতিহাসবিদের বিবরণের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রত্যক্ষদর্শীর ইতিহাসে সত্যের সাথে যুক্ত হয় লেখকের দৃষ্টি ও দর্শন। ‘মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী’ তেমনি একটি গ্রন্থ।
হঠাৎ কেন এই লেখা লিখছি? কোনো কারণ নেই। কারণ ছাড়াই মগরায় কিছুক্ষণ সাঁতরালাম। আমি বলি, আপনারাও কিছুক্ষণ সাঁতরান। সাঁতরানো ভালো। নিজের নদীতে সাঁতরানো আরো ভালো। পেশী শক্ত হয়। সুগার কমে। নিজেকেই নিজে্র সুগার কমাতে হয়। নিজেকে নিজেই বাঁচিয়ে রাখতে হয়। খালেকদাদ চৌধুরীরা আমাদের আত্মপরিচয়ের আখ্যান লিখে গেছেন। সে-আখ্যানে সাঁতরালে সুস্থ থাকা যাবে।
ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী হিরণ মিত্র
… …
- ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা - October 30, 2024
- নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা - July 28, 2021
- মুক্তস্বরের মানুষ || সরোজ মোস্তফা - April 20, 2021
COMMENTS