মুচিদের মরমি জীবন, বলিউড ভার্শন

মুচিদের মরমি জীবন, বলিউড ভার্শন

অরুণ সচদেব নামে এক মুচি, জুতাকারিগর, কিন্তু মুচি বলতে যতটা দারিদ্র‍্যদলিত শোনায় দেখতে একেবারেই তার উল্টো। মুচি কিন্তু স্বচ্ছল, সুখী ও সম্পন্ন। ভূভারতের মুচিদের আপডেট আমরার জানা নাই। সিনেমাবাহিত, বলিউডবাহিত, মুচিদের দেখনদারি কেমন বুঝতে চাইলে এই সিনেমাটা আপনারে দেখতে বলব। ২০১৭ ম্যুভি। ডিরেক্টেড বাই ওমনাগ কুমার; স্টারিং বাই সঞ্জয় দত্ত, অদিতি রাও হৈদরি, শরদ কেল্কর প্রমুখ।

পুরানা আমলের মারদাঙ্গা ছায়াছবির টেম্পলেটে এই সিনেমাটা আগাগোড়া বানানো। হরিবল অবস্থা। কাহিনির বাস্তবিক মাইবাপ খুঁজতে গেলে গলদঘর্ম হতে হবে; এর উৎস ও বাস্তবতা পাওয়া যাবে কেবল বলিউডি রিয়্যালিটির রিললাইফে। যেমন দেখা যেত এইটিজের সিনেমায়, পাপীর পতন পুণ্যাত্মার উত্থান, দুষ্টের দমন শিষ্টের শীলন, এই ফর্ম্যুলা মান্য করে এই জিনিশটা বানানো হয়েছে দুইহাজার-সতেরোয়। ভাবেন অবস্থা!

ভাল্লাগবে তাদের, যারা অ্যাকশন সিনেমা ভালোবাসেন। তাছাড়া মাইটি হিম্যান সঞ্জয় দত্তের ফ্যানবেইসের তো পোয়াবারো। বহুদিন ধরে লেগে থেকে জেলখানাফেরত মুন্নাভাই সিনেমাখানায় আশ মিটিয়েই ঢিশুমঢিশুম ফাইট করেছেন। সেই খলনায়ক ম্যুভিডিউরিং মর্দামো। শুধু তফাৎ এ-ই যে সেকালের ন্যায় হিরোর রোলটা তার কব্জায় নাই আর। উনি কন্যাবৎসল এক পিতার ভূমিকায় হিরোয়িজম পুরাটাই নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছেন।

ভূমি সচদেব ছবির নায়িকা। ক্যারেক্টারটা করেছেন অদিতি রাও হৈদরি। অরুণ সচদেব তথা বাবা সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে মেয়ে ভূমির আদর্শ ও সম্পূর্ণ স্বপ্নবৎ রঙিন আরামায়েশ-আদরভরা সংসার। মেয়ে আবার ফ্যাশন ডিজাইনার। বাপ জুতার ডিজাইনার। বড়সড় দোকান-কারখানা আছে মফস্বলবাজারে। বেজায় নামডাক তাদের বিজ্ঞাপনছাড়া ব্র্যান্ডের। মেয়ে ফ্যাশনহাউজে চাকরি করে। দেরিতে বাসায় ফেরে মেয়ে। হাত পুড়ায়া বাপের জন্য রন্ধন করে। এমন সংসার বলিউডে অ্যাভেইল করা যায়, বাস্তবে পেতে চাইলে বেঘোরে মরতে হয়।

মেয়ের বিয়া ধার্য হয় ইত্যবসরে, সিনেমার প্রারম্ভিকায়, মেয়েরই ফিয়াসের লগে। হ্যাপি স্টার্ট। হ্যাপি পিতা-কন্যার হাসিখুশি দিনরাইত। ও, বলতে ভুলে গেছি, বাপ বিপত্নীক। কন্যার অনাদর হবে ভেবে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন নাই বাবা। মানে সেই মুন্নাভাই ইমেইজের মহানুভবতা, ত্যাগতিতিক্ষা, গান্ধিগিরি। কিন্তু দর্শকদেরে হ্যাপিনেস দেখাইলেই তো হলো না, ক্লাইম্যাক্স তো পয়দা করতে হবে। থ্রিল, সাস্পেন্স, থরহরি ঢিশুমঢিশুম রক্তারক্তি। সিনে এলেন মহামহিম ভিলেইন। শোলে ব্র্যান্ডের সেই গব্বর সিং। অভিনয় করেছেন শরদ কেল্কর।

নায়িকার বিয়ার আগের দিনই নির্দয় বিয়োগান্ত ঘটনাটা ঘটানো হয়। এলাকার পয়সাপাতিওলা ঢাউলিবাবুর নজর ছিল ভূমির প্রতি। ভেবেছিল একদিন কব্জা করা যাবে রয়েসয়ে। কিন্তু ভূমির বিয়ার খবর পায়া খাঁটি বাংলায় ভিলেইনের মাথায় মাল উঠে যায় এবং উঠায়া আনে নায়িকারে নিজের ডেরায় স্বীয় মস্তিষ্কের মালমাত্তা নামাইবার সঙ্কল্প নিয়া। তারপর আর কী করার। রেইপ তো বলিউড যুগেযুগেই নির্মাণ করেছে। এইখানেও ওই জিনিশ। পরে হ্যানত্যান হাই-সুপ্রিম নানান কোর্ট। সংবেদনহীন সুশীল, প্যুলিস্, আদালত সবই তিতপুরানা স্টাইল।

বলিউড সমাজদরদি সিনেমা বানানোয় আগুয়ান জন্মলগ্ন থেকেই। সমাজের পকেট খসাইতে যেয়ে যেটুকু দরদ প্রোডিউস করা দরকার তা বলিউড করতে কার্পণ্য দেখায় না। এই সিনেমা বানানোর পূর্বাপর মুম্বই এবং ইন্ডিয়ার নানান প্রভিন্সে রেইপ বেড়ে যায়। পাব্লিক ট্র্যান্সপোর্টে স্পেশ্যালি। ইন্ডিয়ার দেখাদেখি বাংলাদেশেও গণপরিবহনে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা আমরা আদালত ও সরকারি লেজুড়দলের কৃপায় হজম করি। বিচার বাস্তবে না-হলেও বলিউডে বিচার হয়। সেখানকার বিচার আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া এবং তুলে নিয়ে তুমুল সহর্ষ আছাড় মারা।  পাব্লিকের পয়সা উশুলের জন্য প্রতিশোধ অত্যন্ত জরুরি জনগুরুত্ববহ বলিউডি টনিক।

২০১৭ সনের সিনেমা, টরেন্ট লিঙ্ক থেকে বেআইনি-বেনৈতিকভাবে নামায়া দেখা; আবার দেখবার রিভিশন দিবার শাস্তি নিশ্চয় কেউ দিবেন না আমারে। একটা ব্যাপার আবছা মনে পড়ছে এতদিন বাদে, ঠিকঠাক বলতে না-পারলেও মনে এটুকু পড়ে যে সিনেমার কোথাও কোনো-একটা জায়গায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। কটাক্ষে। নায়িকার বিয়ার পরে হানিম্যুনে কই যাবে এমন প্রশ্নে নায়ক আউট অফ ফান উল্লেখ করে বাংলাদেশ জায়গাটা, নায়িকার ইন্সট্যান্ট যেই রিয়্যাকশন তা বড় বেদনার মতো বেজেছে এই বাংলাদেশলাভারের প্রাণে। আওয়ামী লীগের সোনার বাংলায় মধুচন্দ্রিমা করতে এলে এমন কী খসে যেত হৈদরি প্রিয়তমা! নায়িকার বোধহয় আমাদের পিএমের সেই কবেকার বেডরুমে নিরাপত্তা দিতে অপারগতার ভাষণটুকু মনে পড়ে গিয়েছিল। অগত্যা।

আর কোনো কথা বাকি নাই। সিনেমার ষাটভাগই বাপ-মেয়ের সম্মিলিত প্রতিশোধ গ্রহণের পালায় পরিপূর্ণ। নৃশংস অগ্নিকুণ্ডে ফেলে ভিলেইনের জান কবচ করা। আরেকটা কথা। এইখানেও পরিচালক সমাজের সব বড়বড় মাথাদের মতো শুধু ধর্ষণ শব্দে আস্থা না রেখে গণধর্ষণ শব্দটা উচ্চারিয়া গেছেন। রেইপ বললে এমন কোনো ইম্প্যাক্ট ক্রিয়েট করে না যেন, বলতে হয় গ্যাঙরেইপ। বলদের দল। আর আরেকটা কথা। এই পরিচালক ধুমধাড়াক্কার লগে দরদফরদ মিশায়া সমাজচেতনার সাজুগুজু পরায়া বলিউডের ম্যাসালার পাশাপাশি নিজের একটা ম্যাসালা বানায়া নিতে চাইছেন, জিনিশটা তার ‘ম্যারিকম’ ও অন্যান্য কাজগুলা দেখলেই মিচকিমিচকি হেসে আপনিও অস্বীকার করতে পারবেন না।

আমার কী ভাল্লাগসে এই সিনেমায়? ভালো তো বলিউডের সবকিছুই। বিশেষ উল্লেখ করতে গেলে এই সিনেমায় সানি লিওনির ‘ট্রিপ্পি ট্রিপ্পি’ আইটেম স্যং, যেখানে এক ‘সাইক্যাডেলিক সাইয়া’ আর তার তোলপাড় শরীরাঘাতে ‘হিক্কি হিক্কি’ শীৎকার পর্দা ফেঁড়ে বেড় দিয়া ফালাইতে চাইবে আপনারে। আর ভাল্লাগসে এর ভিলেইন। বাকিটা টাডা থেকে ছাড়া পাওয়া ডাটবাবুর উরাধুরা ফাইটিং। অবশেষে সেই সুখেশান্তিতে বাস করার সমাপ্তি। মিস্টিক ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি ম্যাসালা দিয়া কারি বানাইলে খেতে এমন বিস্বাদ লাগার কথা না, স্বাদও।

তবে এই সিনেমাটা আদৌ অরিজিন্যাল কোনো স্কোর না। তা, বলিউডের সবই কী চুরিচামারি নয়? এই সিনেমার পোস্টার থেকে শুরু করে স্টোরিপ্লট, ক্যারেক্টারাইজেশন সবই বিদেশের সিনেমা অ্যাক্নোলেজ না করে মেরে দেয়া। আখবারে এইটা ফাঁসও হয় সেই সময় হাল্কা গলায়। আমাদের বলিউড এইগুলা ভালো পারে। হায়াশরম নিয়া ভাবলে ব্যবসা করা যাবে এই হাইজ্যাকার আর বাটপারের দুনিয়ায়?

লেখা / বিদিতা গোমেজ 


 বিদিতা গোমেজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you