‘রহমান, দ্য ফাদার অফ বেঙ্গল’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ১৯৭৩ সালে নির্মিত রঙিন ডকুমেন্টারি। এর নির্মাতা নাগিসা ওশিমা (Nagisa Oshima)। এই সিনেমাটি সম্ভবত শেখ মুজিবুর রহমানের উপর নির্মিত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টারি। ওশিমা বাংলা এবং ইংরেজি কোনোটাই জানতেন না, তাই তিনি দোভাষী নিয়ে কাজটি করেছিলেন। ছবিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত ভঙ্গিতে ইংরেজি ভাষায় তার রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনা, ইতিহাস, ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা, দর্শন সবকিছু নিয়ে অকপটে কথা বলছেন। এমনকি তিনি কি বই পড়েন, কেন পড়েন সেইসব কথাও বলেছেন এই ছবিতে। এমন প্রশ্ন খুব বিরল। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে সবাই কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নই করে এবং তার মধ্যেই সবাই ঘুরপাক খায়। ওশিমা প্রচলিত রাস্তায় হাঁটেননি।
লক্ষণীয়, তিনি সিনেমার শুরুতে দীর্ঘ সময় ধরে কেবল বুড়িগঙ্গার দৃশ্য দেখিয়েছেন। পেছনে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল মিউজিকের আবহ। তার সেই মন্তাজ এবং পেছনের ধারাবর্ণনা যেন নৃতাত্ত্বিকের মতোই সূক্ষ্ম এবং ইতিহাস-সচেতন। সেই মন্তাজের ভেতর দিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। অদ্ভুত ব্যাপার, তার কাছে বাংলা মানেই নদী, বঙ্গবন্ধু মানেই নদীর বহমানতা। রাজনৈতিক ঘটনার চেয়ে বাংলার পথঘাট মানুষ তাদের জীবনযাপনআচারের মধ্যেই তিনি তার আরাধ্য শেখ মুজিবুর রহমানকে বুঝতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কেন তার সফরসঙ্গী হিসেবে তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলকে সঙ্গে রাখতেন এই প্রশ্নটি বেশ অভিনব। কারণ অন্য এক বঙ্গবন্ধুর সন্ধান করেছেন তিনি। এই প্রশ্নের উত্তরটিও ছিল ভীষণ আবেগঘন। ছোট্ট রাসেল বঙ্গবন্ধুকে চোখে চোখে রাখতে চেয়েছিল। কারণ রাজনৈতিক কারণেই বঙ্গবন্ধুকে প্রায়শই জেলে থাকতে হতো। রাসেলের তাই ধারণা চোখের আড়াল হলেই আবারও তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। এর সাথে ৭৫ এর বিভৎসতাকে মিলিয়ে দেখলেই এই ঘটনার করুণ ট্রাজিক জায়গাটি ধরা পড়বে।
নাগিশার ছবিতে বঙ্গবন্ধু কোনো পোশাকি নেতা নন বরং হয়ে উঠেছেন গণমানুষের নেতা। ছবির শেষদিকে খুব সম্ভবত গণভবনের একটা চা-চক্রে অন্যান্য নেতাকর্মীদের সাথে বঙ্গবন্ধু মতবিনিময় করছেন এমন একটা দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। কতটা সাধারণ কতটা আন্তরিক ভঙ্গিতে বঙ্গবন্ধু মানুষের সাথে মিশতেন তার একটা ছোট্ট ডকুমেন্টেশন এই দৃশ্য।
নাগিশা অবাঙালি হয়েও এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য অনুভব করেছিল, হয়তো তাই তার ছবি অন্য নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎরাতে পেরেছে। নাগিশা জাপানের মেইনস্ট্রিম নির্মাতা। তার মতো একজন প্রথম সারির নির্মাতা সুদূর জাপানে বসে বহু যুগ আগেই এই মহান নেতার তাৎপর্য অনুভব করেছিলেন, অপরদিকে এই বঙ্গে একটা গোষ্ঠী তখন তাদের ছুরিতে ধার দিচ্ছিল আর তাদের বন্দুকের নিশানা ঠিক করছিল; কারণ, তার ঠিক দু-বছর পর মাত্র ১৮টি বুলেট খরচ করে তারা নির্মমভাবে শেষ করে দেবে বাংলার আত্মপরিচয়ের নায়ককে, যিনি নাগিশা ওশিমার ‘রহমান, দ্য ফাদার অফ বেঙ্গল’।
Film Title: Rahman, The Father of Bengal, Genre: Documentary, Directed by Nagisa Oshima, Released in 1973
দেখতে চাইলে নিচের ভিডিয়ো ক্লিক করুন :
… …
- টুকটাক সদালাপ ১০ - February 1, 2025
- টুকটাক সদালাপ ৯ - February 1, 2025
- টুকটাক সদালাপ ৮ - January 23, 2025
COMMENTS