বইপড়া, কাক ও দুধদাঁত

বইপড়া, কাক ও দুধদাঁত

যে-বয়সে এসে পৌঁছেছি, জিভ ভারী হয়ে যেতেছে এবং স্থূল হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে স্বাদগ্রন্থিগুলো, কোনোকিছু চেখে দেখে ঠিকঠাক গুণমান বর্ণনা বা চাক্ষুষ কোনোকিছুর বস্তুনিষ্ঠ পরিস্থিতিবিবরণ সোজাসাধ্য নয় আর। অবশ্য দাবি করতে পারি যে তেঁতুলের স্বাদ কেমন কিংবা পানতোয়ার, তা আমার চেয়ে ব্যেটার বর্ণনা নাহি কেহ বর্ণিতে পারিবেক, তাতে এই বিশেষ বয়সের ভান প্রকাশ পায় হুদাহুদা, তাছাড়া কিছু নয়। দুধদাঁত হারিয়ে ফেলার পর, সত্যি কথা কি, মানুষমাত্রেই কিছুমাত্রায় ডিজ্যাবল হতে শুরু করে। সব-কয়টা আক্কেলদাঁত ওঠার পর পুরোপুরি বেআক্কেল হয়ে পড়ে মানুষ, যা তার আশপাশের সবাই বুঝতে পারলেও সে নিজে বুঝতে পারে না, মানুষের এ এক নিয়তি। আহা! কবে সেই কোনকালে আমরা আমাদের শেষ দুধদাঁত দূর্বাঘাসের ছোবায় কিংবা কেউ উন্দুরের গর্তে রেখে এসেছি কাকপক্ষীর অগোচরে! সেইসময় একটা কোনো সহৃদয়-হৃদয়সম্বাদী বায়স যদি জোর করে দেখে নিত লুকনো দুগ্ধদন্ত দুয়েকটা, আজ এই দশা হতো না। আকেলমান্দ হয়ে এই দিনদুনিয়ার বারো বাজিয়ে এখন অপয়া তেরোর গেরোতে এনে ঠেকিয়েছি মাতা-ধরিত্রীকে। এখন সদা-কৃপাতরু দয়াময় দুনিয়াখানা আরো পচে-গলে উঠবার আগেই যেন করেকম্মে খেয়েদেয়ে কোনোমতে পিছদুয়ার দিয়া বিদায় নিতে পারি।

খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন, কোনোকিছু পড়ার ক্ষেত্রে তেমনি টের পাই বয়সের ভালুকথাবা। সারাদিনই, একটা বয়স ছিল, কিছু-না-কিছু মুখে ফেলে চাবাতাম। তখন অচিনা ঘাসবিচিতেও মধু খুঁজে পেতাম, কোনোকিছু হাতের কাছে না-পেলে ঝুমকোজবার লাল পাপড়ি চিবাতাম, রাজ্যির গাছের গুটাগাটায় হাফপ্যান্টের ডান-বাঁ-পাছা পকেটগুলো ফুলে থাকত সারাক্ষণ। ফুলপেয়ারা, ফুল্টিবরই, মনগুটা বা বেতগুটা চাবাতে চাবাতে অনেক সফল অভিযান পরিচালন করেছি। কিন্তু আজ বুঝতে পারি, সবই ছিল দুধদাঁতের অবদান। এখন, এই আটকা-পড়া আজকের বয়সে, টেন্ডার-সাব্লাইম-সফিস্টিকেটেড বলে কথিত কত খানাখাদ্য খায়া মনে হয় তিত্তা জহর খাইলাম। দোষ কি খানাখাদ্যের? ফলে, এ-বয়সে এসে কোনোকিছু অভিজ্ঞতাধিকৃত করে তা নিয়া জোর গলায় কথা বলা আদতেই প্রিটেনশাস বলে মনে হয় আমার কাছে। কেননা বয়ানের অথেনটিসিটি না থাকলেও অরিজিন্যালিটি যদি না থাকে সেই বয়ান বা ইন্টারপ্রিটেশন বা বর্ণনা তখন কোনো কাজের থাকে না। যা-ই হোক, লেট’স্ প্রসিড।

বলছিলাম বইপড়া বা পাঠোত্তর অভিজ্ঞতা বর্ণনের ক্ষেত্রে পাঠকবয়সের ভূমিকা নিয়ে। একটা বয়সে এসে মানুষ জীবনযাপনের সমস্তকিছুতেই সিলেক্টিভ হয়ে ওঠে। এখন সিলেক্টিভ হওয়াটা আদৌ মন্দ নয়, বরং উচিত এবং কার্যকর, তবে সিলেক্টিভ হতে যেয়ে শামুক হয়ে গেলেই বিপত্তি। ঠিক তা-ই হয়ে উঠি আমরা, শামুকের মতো গুটিয়ে নেই নিজেকে, যাপনগত নানান মুসিবতের চাপ ও তাপে আমাদের জগৎ হয়ে যায় জেরবার ও অবভিয়াসলি ফিটেস্ট সার্ভাইব্যালিটির উপযোগ্য সংকুচিত। বয়স্ক করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কৃতিও অনুঘটকের কাজ করে দেখতে পাই। কিন্তু এরপরও, বয়সের হাজার বায়্নাক্কার পরেও, সহসা কোনো বই বা পাঠবস্তু উদ্বেল করে ফেলে এখনও। হয়তো রোজ রোজ অমন অভিজ্ঞতা হয় না, কালেভদ্রে হয়তো, কোনো কোনো বই পড়ে খুশিস্ফীত অথবা ব্যথাস্তিমিত হয়ে যাই। ঠিক তখনই মনে হয়, বইয়ের দোষ নাই, বয়সেরই দোষ। করার কিছু নাই, কারণ মানুষ হয়ে জন্মানোর একটা কাফফারা এ-ই যে একসময় আপনি আকেলমান্দ হয়ে উঠবেন এবং পকেটভর্তি তৃণবীজ-বনগুটা আর শিরিষবিচি সময়ের ফুটো গলে পড়ে যাবে পথের বাঁকে।

একটা ব্যাপার হলো, বইপড়ার ক্ষেত্রে, অভ্যাসের বনেদ যার যত জোরালো তার বায়নাক্কা তত কম। অন্তত খামোক্কাই ছিঁচকান্না নাই যে, ভালো বই লেখা হয় না বলেই আজকাল আর বই পড়ি না! আজব! ভালো বই আর খারাপ বই! জিনিশটা আপনার জজবা আর আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাচ্ছে কি না তা-ই বিবেচ্য। কথা আরেকটা আছে। সেটা হলো, সবকিছুরই সিলসিলা লাগে, একটা ধারাবাহিকতা থাকতে হয় সবকিছুতেই। জীবনে কোনোদিন মদ্যস্পর্শ করে নাই যে-জিভ, সে তো মদের গন্ধেই বমি করে ভাসাবে। যে-লোক কোনোদিন মুর্গিডিম খায় নাই, ডিমগন্ধে সে অসুস্থ হয়ে পড়বেই, তারে আপনি পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়া ঝাড়া বক্তিমা দিয়াও রাতারাতি ডিমপ্রেমিক বানাতে পারবেন না। তার মানে এও নয় যে ডিম খেলেই হৃষ্টপুষ্ট হওয়া যায়, ডিম না-খেলে অপুষ্ট দুবলাপাতলা। না, তা নয়। তেমনি বই না-পড়েও বহুভাবে বিবেচক হওয়া যায়। বরং বইপড়া কাউকে বিবেচক বানাতে পারে না, এইটা একটা বড় পর্যবেক্ষণ, বইপড়া কাজ করে অন্যত্র। বিবেচক বানানো, জ্ঞানী বানানো, বইয়ের দায়িত্ব নয় বা বইপড়ার কারণে কেউ মহান হয়ে যায় এমন কুত্রাপি নয়।

একটা ধারাবাহিকতা, একটা পারম্পর্য, একটা বুনিয়াদ, একটা সিলসিলা লাগে সবকিছুতেই। রস বা শাঁস পেতে গেলে তো কথাই নেই।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

জাহেদ আহমদ

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you