জনইতিহাসের নিভৃততম মানুষ || সরোজ মোস্তফা

জনইতিহাসের নিভৃততম মানুষ || সরোজ মোস্তফা

শেয়ার করুন:

প্রতিটি দিবসে রাস্তায় নামার আগে নিজেকে নিজেই বলি, স্বার্থপর যেন না-হই। ছোট-বড় সবার প্রতিই শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি যেন থাকে। মানুষকে চ্যালেঞ্জ করার কিছু নেই। আবার কারো অনুগত ছায়া হওয়ারও কিছু নেই। রঙ-জলসার উল্লাসে নিমজ্জিত থাকলে জীবনের নির্জনতা ছোঁয়া যায় না। তুলসী পাতার মতো সবুজ থাকার হিম্মতই আমার জীবন। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের চোখ নিয়ে উঁকি দিবেন এটাই তো স্বাভাবিক। জগৎ কখনোই কারো মনের মতো চলে না। প্রতিদিন তাই সহিষ্ণুতা শিখি। সহিষ্ণুতার পথেই থাকি, বাঁচি।

গত কয়েকদিন ধরে একটা বই পড়ছি। ড. হালিম দাদ খানের সম্পাদনায় ২০২৫ সালে দ্যু  প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ৪১৬ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির নাম ‘চেনা-অচেনা তাহেরুদ্দীন মল্লিক’। কিছু স্মৃতিচারণ বিষয়ক লেখা থাকলেও পুরো গ্রন্থটি মূলত লেখক তাহেরুদ্দীন মল্লিকের রচনাসম্ভার। তাই বলা যায় এই গ্রন্থটির দুটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডে স্মৃতিচারণ পর্বে লিখেছেন : এরশাদ উদ্দিন মল্লিক, স্বপন ধর, প্রিন্স রফিক খান, মু আ লতিফ, রওশন আলী রুশো, আশরাফ সারোয়ার, শায়মা খান, নাজমা মল্লিক, পারভেজ চৌধুরী, ড. হালিম দাদ খান। প্রত্যেক লেখকই তাহিরুদ্দীন মল্লিকের ব্যক্তিত্ব, জীবনদৃষ্টি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, লেখালেখির বৈচিত্র্য এবং কর্মজীবনের বিচিত্রিতা নিয়ে স্মৃতিচারণ এবং মূল্যায়ন করেছেন।

দ্বিতীয় পর্বেই উন্মোচিত হয়েছে লেখক তাহেরুদ্দীন মল্লিকের পরিচয়। রচনাসম্ভারে আছে ‘সমাবেশ’,’ জানবার মতো’ ‘গ্রামীণ উন্নয়ন পরিকল্পনার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা’, ‘চেনামানুষের জারি’, ‘শুক্রবাসরীয় সাহিত্য সংসদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ‘কোরআনের বিষয়বস্তু’, ‘মাসিক মোমেনশাহী’, ‘কিশোরগঞ্জের পথেঘাটে’ ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ’, ‘শিমুলবাঁকের আত্মকাহিনি’, ‘দুটি পত্র’। লেখাগুলো মূলত একটা সমাজ ও সংস্কৃতির স্মারক। বিগত শতকের ৪০-৫০ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের ইতিহাস।

‘কিশোরগঞ্জের পথে ঘাটে’ একটা জনজীবন কিংবা জনমানুষ কীভাবে তৈরি হয় তার বৃত্তান্ত। স্থানীয় ঘটনা, স্থাপনা, ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, ঐতিহ্য নিয়ে তিনি এ গ্রন্থগুলো লিখেছেন। ছোট-বড় মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়টি।

অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া খুব সাধারণ একটি ছেলে কর্মসংস্থান তৈরির আশায় একদিন রওনা দিয়েছিলেন কলকাতায়। এই যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী ছিলেন গ্রামের এক প্রতিবেশী। তিনি কলকাতায় কর্মরত ছিলেন । কলকাতায় যাওয়ার আগে তিনি কোনোদিন কিশোরগঞ্জেই যাননি, বিজলিবাতি কিংবা রেলগাড়িও দেখেননি। রেলস্টেশনের বিশ্রামখানা, সিমেন্টের বেঞ্চকেই তাঁর কাছে মনে হয়েছিল রেলগাড়ি। সেই বেঞ্চটিকেই তিনি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন কলকাতা পৌঁছার লক্ষ্যে। রেলগাড়ি যখন স্টেশনে পৌঁছল, সে তখন ভয়ে রীতিমতো কাঁপছিল। ভয় আর সীমাহীন আশা নিয়ে তিনি কলকাতায় পৌঁছে গেলেন।

১৫ বছর বয়সে ১৯৩৩ সালে জীবিকার সন্ধানে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন কলকাতায়। কলকাতায় তার মামাতো ভাইয়ের ব্যবসা ছিল। প্রথমে সেখানেই সে অবস্থান নিল। কিন্তু পরজীবী হয়ে থাকাটা তার গায়ে সইল না। বেরিয়ে পড়ল কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে। অবশেষে কর্ম জোগাড় হলো, শিয়ালদহ স্টেশনে ফেরি দিয়ে পাখা বিক্রয়। স্ব-উপার্জনে আত্মসম্মান নিয়ে চলার পথ পেয়ে ছেলেটি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করল। পরে পাশের গ্রামের সুরেন্দ্র সেন যিনি ‘ইউনিক অ্যাসিওরেন্স কোম্পানি’-র ক্যাশিয়ার ছিলেন, তাঁর সহায়তায় তিনি আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘বিজয়া প্রেস’-এ শিক্ষানবিশ হিসেবে মুদ্রাক্ষর সাজানোর [কম্পোজ] কাজ শিখতে শুরু করেন। কাজ শেখা উপলক্ষে প্রেসে রাতে থাকার ব্যবস্থা হলেও খাওয়ার টাকা জোগাড়ের জন্য তিনি সকালবেলা ভবানীপুরে পার্টটাইম পাখা বিক্রির কাজ করতেন। ছয় মাস পর প্রেসে তাঁর মাসিক ৫ টাকা বেতন ধার্য হয়। কিন্তু এইভাবে জীবন চলবে না ভেবে ১১ মাস পর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।

চলে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। এখানে জাওয়ার মাইনর ইংলিশ স্কুলের প্রধান পণ্ডিত সৈয়দ শামসুদ্দিনের সহায়তায় ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ময়মনসিংহ শহরের দুর্গাবাড়ি রোডে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘স্টার লাইবেরি’-তে [পরে শাজাহান লাইব্রেরি] চাকরি লাভ করেন। মতানৈক্য হওয়ায় চার বছর পর চাকরি চলে যায়। এরপর আনন্দ মোহন কলেজের আরবির অধ্যাপক কাজী আসাদুজ্জামানের ‘ফিরোজ লাইব্রেরি’-তে তিনি চাকরি নেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দেশের ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক-সামাজিক তথা সর্বত্রই সংকটজনক অবস্থা। এমতাবস্থায় ফিরোজ লাইব্রেরিতে দুই বছর কাজ করার পর ১৯৪২ সালে তিনি আবার গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন। গ্রামে এসে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি এবং সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময় তিনি বড়িবাড়ি ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গ্রামের রাজনীতির এবং সমাজসেবায় ইতি টেনে আবার তিনি ময়মনসিংহ শহরে চলে আসেন। ফিরোজ লাইব্রেরি তখন প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং প্রেস প্রতিষ্ঠা করে। তিনি ফিরোজ লাইব্রেরির প্রেসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত সোয়া এক বছর কাজ করেন। পরে কিশোরগঞ্জের তার ভাগ্নিজামাই এনামউদ্দিনের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘এনাম প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের ১৪ আগস্ট ২/এ, কলেজ রোড, ময়মনসিংহ ঠিকানায় এনাম প্রেসের উদ্বোধন করা হয়।

১৯৭৯ সালে তিনি ময়মনসিংহ থেকে পুরান ঢাকার হেমেন্দ্র দাস রোডে এনাম প্রেস স্থানান্তর করেন। কিন্তু নতুন জায়গায় ব্যবসা জমানোর মতো দুরূহ কাজটিতে তিনি আর সফল হতে পারেননি। বৃদ্ধ বয়সে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে শেষে ১৫ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারণ করে ২-৩ হাজার টাকা নগদ নিয়ে দিয়ে তিনি ময়মনসিংহে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে ঢাকায় অবস্থানকালে ইত্তেফাক সম্পাদক রাহাত খানের সহায়তায় কিছুদিন তিনি সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এ প্রুফরিডার হিসেবে কাজ করেন। সে-সময় রাহাত খান পরিচালিত বাংলাদেশ রেডিওতে ছোটদের আসর ধরনের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে তিনি কথিকা ও আবৃত্তিতে অংশ নেন।

তাহেরুদ্দীন মল্লিক একটা বিচিত্র জীবন যাপন করেছেন। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এই মানুষটি কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করেননি। পরার্থে, কল্যাণার্থে কাজ করে গেছেন।

‘চেনা-অচেনা তাহেরুদ্দীন মল্লিক’ নামের এই গ্রন্থটি আমাকে উপহার দিয়েছেন সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. রফিকুল ইসলাম মল্লিক। গ্রন্থটি আমার জন্য নিয়ে এসেছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় অগ্রজ নেত্রকোণা সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ড. আবুল বাসার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ স্যার। এ-দুজন মানুষের কাছে পরম কৃতজ্ঞতা রাখছি।

উল্লেখ্য, তাহেরুদ্দীন মল্লিকের জন্ম ১৯১৮ সালে, ২০০৪ সালে তাঁর দৈহিক জীবনাবসান ঘটে।

০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপার বইরিভিয়্যু

শেয়ার করুন:
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you